স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংক্রামক ব্যাধি
Published: 26th, April 2025 GMT
দীর্ঘদিন ধরিয়া অচল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) যন্ত্রটি বারংবার তাগাদার পরেও মেরামত না করিবার নেপথ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যেই মনস্তত্ত্ব কাজ করিতেছে, উহাকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংক্রামক ব্যাধি বলিলে ভুল হইবে না। উহার কারণ হইতে পারে এমআরআই সেবাপ্রত্যাশীদের বেসরকারি রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে পাঠাইয়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কিঞ্চিৎ বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করা। অবশ্য অপেক্ষাকৃত ভদ্র ভাষায় স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলাও বলা যায়। যেই নামেই ডাকা হউক, ইহাকে ব্যাধি বলিবার কারণ হইল, শনিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যদ্রূপ বলা হইয়াছে, যন্ত্রটির রোগ সারাইতে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে গত চার বৎসরে ৪২ দফায় পত্র লিখিবার পরও সদুত্তর মিলে নাই। চিকিৎসকদের মতে, মস্তিষ্কসহ শরীরের বিভিন্ন অংশের সূক্ষ্ম রোগ নির্ণয়ের জন্য এমআরআই পরীক্ষা জরুরি। এই পরীক্ষার প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে মুমূর্ষু রোগীকে দ্রুত চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হয়। অতএব স্বাস্থ্যসেবায় যন্ত্রটির গুরুত্ব বাড়াইয়া বলিবার প্রয়োজন নাই। উপরন্তু, চট্টগ্রাম অঞ্চলের কয়েক লক্ষ রোগীর একমাত্র ভরসার নাম ২২ শত শয্যার চমেক হাসপাতাল, যথায় প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকেন প্রায় চার সহস্র। প্রতিদিন শুধু বহির্বিভাগে চিকিৎসা গ্রহণ করিয়া থাকেন আরও তিন সহস্র রোগী। এই সকল রোগীর মধ্যে প্রতিদিন দুই শতাধিক রোগীকে এমআরআই পরীক্ষার জন্য পাঠাইয়া থাকেন বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকগণ। প্রসঙ্গত, প্রতিবেদনমতে চমেকে মাত্র ৩ সহস্র টাকায় এমআরআই পরীক্ষা সম্ভব হইলেও বেসরকারি হাসপাতালে উহার জন্য গুনিতে হয় ৮ হইতে ১৫ সহস্র টাকা। রোগীদের এই পকেট কাটিবার ব্যবস্থা কি অকারণেই? সন্দেহ করিবার অবকাশ যথেষ্ট যে, রোগীদের যতই কষ্ট হউক, এই বাবদ প্রাপ্ত কমিশন চমেকের কেউ যদ্রূপ পাইয়া থাকেন তদ্রুপ মন্ত্রণালয়েও উহার ভাগ যাইবার কথা। অন্যথায় এইরূপ গুরুতর চিকিৎসাযন্ত্র লইয়া দীর্ঘসূত্রতার হেতু কী?
সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিবার দাবি এই দেশে দীর্ঘদিনের। জটিল যেই কোনো রোগ তো বটেই, সামান্য অসুখেও অনেককে রাজধানীমুখী হইতে হয়। কিন্তু এই দাবি যে বরাবরই উপেক্ষিত রহিয়াছে, তাহার প্রমাণ হইল, চমেক হাসপাতালের ন্যায় বিভাগীয় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেও মাত্র একটা এমআরআই যন্ত্র বসানো হইয়াছে। যন্ত্রটি নষ্ট হইবার চার বৎসর পরও মেরামত না করিবার পশ্চাতেও অভিন্ন মানসিকতা কাজ করিয়াছে। অনস্বীকার্য, এই সময়ে সমগ্র দেশে বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়াছে। ইহাও সত্য, প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির অভাবে একদিকে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান লইয়া বহু প্রশ্ন জন্ম লইয়াছে, অন্যদিকে ইহা অনেকাংশে নিরীহ রোগীদের পকেট কাটিবার একপ্রকার যন্ত্রে পরিণত হইয়াছে। এই ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, এমনকি নীতিনির্ধারকেরাও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছেন। সামগ্রিকভাবে জনগণের স্বাস্থ্য অধিকারের প্রতি তাহাদের অবহেলা ও উপেক্ষাই ইহার জন্য প্রথমত দায়ী। আলোচ্য এমআরআই যন্ত্র যথাসময়ে সারাই না হইবার মধ্যে যাহা পুনরায় পরিস্ফুট হইয়াছে। স্মরণে রাখিতে হইবে, চমেক কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, যন্ত্রটি মেরামতে মাত্র সাত কোটি টাকা প্রয়োজন। অতএব অর্থের অভাব নহে, অন্য কিছু এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
আশার বিষয় হইল, চমেক হাসপাতালের পরিচালক বলিয়াছেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংযোজন শেষে এক সপ্তাহের মধ্যে যন্ত্রটি পুনরায় সচল হইবে। আমরাও ইহাই প্রত্যাশা করি। কিন্তু এই ঘটনা হইতে প্রাপ্ত শিক্ষা কাজে না লাগাইলে সমস্যা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকিয়া যাইবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব সরক র ব যবস থ পর ক ষ র জন য হইয় ছ সহস র
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।