ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল ঐশান্যা দ্বিবেদীর চোখের সামনেই তাঁর স্বামীকে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনার কথা মনে করে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। কথা বলতে গিয়ে বারবার গলা ধরে আসছিল তাঁর।

বাড়িভর্তি মানুষের মধ্যে এক কোণে চুপচাপ বসে ছিলেন ঐশান্যা। তাঁর মতোই অবস্থা পরিবারের অন্য সদস্যদের। একমাত্র ছেলে শুভম দ্বিবেদীকে হারিয়েছে এই পরিবার। তাঁরা উত্তর প্রদেশের কানপুরের বাসিন্দা।

শুভমের স্ত্রী ২৯ বছর বয়সী ঐশান্যা বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের দেশ, আমাদের সরকার আমাদের ওখানে (পেহেলগামে) অনাথের মতো ছেড়ে দিয়েছিল। যাদের ওপর ভরসা করে আমরা ওখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম, তারা সেই সময় ওখানে উপস্থিত ছিল না।’

হামলার সময়কার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ঐশান্যা বলেন, ‘কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছিল না, কোনো জওয়ান ছিল না। ঘরের ভেতরে বাবা-মা আমাদের রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু ঘরের বাইরে আমাদের রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের।’

ধীরে ধীরে লোকে শুভমকে ভুলে যাবে

সেলফের ওপর রাখা প্রয়াত স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে ঐশান্যার গলা ধরে আসে। তিনি বলছিলেন, ‘আমার নিজের চোখের সামনে আমার ভালোবাসা, আমার স্বামী, আমার পৃথিবীকে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি। কাউকে যেন এমন দিন না দেখতে হয়।’

তারপর সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে ঐশান্যা দ্বিবেদী বলেন, ‘এই দেশের ভুলের কারণে, সরকারের ব্যর্থতার জন্য আমার স্বামী শহীদ হয়েছেন। তাই শুভমকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হোক।’

ঐশান্যা বলতে থাকেন, ‘আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রথম গুলিটা শুভমের লেগেছিল। তাই সেই সময় উপস্থিত অনেকে ওখান থেকে পালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। যাঁরা সেখান থেকে নিরাপদে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছেন, যাঁরা বলতে পারছেন আমরা বেঁচে গেছি, সেটা একমাত্র শুভমের জন্যই সম্ভব হয়েছে।’

ঐশান্যা দ্বিবেদীসহ গোটা পরিবার দাবি করেছে, ঘটনার দিন শুভম দ্বিবেদীকেই প্রথমে গুলি করা হয়েছিল।

কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছিল না, কোনো জওয়ান ছিল না। ঘরের ভেতরে বাবা-মা আমাদের রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু ঘরের বাইরে আমাদের রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারেরঐশান্যা দ্বিবেদী, হামলায় নিহত শুভম দ্বিবেদীর স্ত্রী

দেশের সব নাগরিকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন ঐশান্যা, যাতে তাঁর প্রয়াত স্বামীকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। তাঁর কথায়, ‘শুভমের জন্য অনেক জীবন রক্ষা পেয়েছে। তাই তাঁকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার এই দাবিতে সবাই যাতে আমাদের পাশে দাঁড়ান, সেই অনুরোধ জানাচ্ছি। শুভম শহীদের মর্যাদা না পেলে ওকে কিছুদিনের মধ্যেই সবাই ভুলে যাবে।’

‘আমার ছেলের বেড়াতে যাওয়ার শখ ছিল’

শুভমের বাবা সঞ্জয় কুমার দ্বিবেদী বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের ছেলে ঘুরতে খুব ভালোবাসত। বিশ্বের বহু দেশ ঘুরেছে। সব জায়গা থেকেই নিরাপদে ঘরে ফিরে এসেছে। এটা তো আমাদের দেশ ছিল। নিজের দেশেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো।’

দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে নিরাপত্তার বিষয়ে আবেদন জানিয়েছেন সঞ্জয় কুমার।

শুভম দ্বিবেদীর মা অন্য একটা ঘরে একা বসেছিলেন। কারও সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না তিনি।

ছেলের মৃত্যুর পর থেকে সঞ্জয় কুমার দ্বিবেদীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। কারও সঙ্গেই খুব একটা কথা বলেন না তিনি।

তিন–চার বছর আগে বাবার সিমেন্টের ব্যবসার পুরো দায়িত্ব নিয়েছিলেন শুভম। তিনি এমবিএ করেছেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিয়েও করেছিলেন ঐশান্যাকে। মধ্যপ্রদেশের ওরছায় ‘ডেসটিনেশন ওয়েডিং’ করেন তাঁরা।

ঐশান্যা দ্বিবেদীসহ গোটা পরিবার দাবি করেছে, ঘটনার দিন শুভম দ্বিবেদীকেই প্রথমে গুলি করা হয়েছিল।

এই নববিবাহিত যুগলের বিয়ের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা হয়েছে। পরিবারের সবাই যে কতটা খুশি ছিলেন, তা ওই সব ছবি ও ভিডিওতে স্পষ্ট।

একটা ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে শুভমের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ঐশান্যার। প্রথম দেখা হয়েছিল ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর।

সেই দিনের কথা স্মরণ করে ঐশান্যা দ্বিবেদী বলেন, ‘গত ছয়-সাত মাসে শুভম আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছে। সেই সব স্মৃতি আঁকড়ে আমি আমার বাকি জীবনটা এই বাড়িতেই কাটিয়ে দেব।’

‘রাগ ছিল সরকারের ওপর, মারা হয়েছে নিরীহ মানুষকে’

ঐশান্যা জানান, শুভম দ্বিবেদীর পছন্দের খাবারের তালিকায় ছিল ‘ইনস্ট্যান্ট নুডলস’।

গত ১৭ এপ্রিল প্রথম পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি ফেরার কথা ছিল ২৩ এপ্রিল।

ফিরে আসার আগের দিন, ২২ এপ্রিল পেহেলগামে ঘুরতে যান তাঁরা। যেদিন শুভম দ্বিবেদীকে হত্যা করা হয়, সেদিনই ছিল কাশ্মীরে দ্বিবেদী পরিবারের শেষ দিন।

ভ্রমণের প্রস্তুতির কথা মনে করে তাঁর স্ত্রী বলেছেন, ‘বিয়ের পর শুভম এক বছরে দুটি ফ্যামিলি ট্রিপ (পারিবারিক ভ্রমণের) পরিকল্পনা করেছিল। এটাই ছিল আমাদের প্রথম পারিবারিক ভ্রমণ।’

ঐশান্যা বলেন, ‘কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে, সেটা ঠিক করতে সবার ভোট নেওয়া হয়েছিল। সবাই মিলে কাশ্মীরকে বেছে নিয়েছিলাম। আমরা জানতাম না, কাশ্মীর আমাদের জন্য এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে।’

নিহত শুভমের স্ত্রী বলেন, ‘সরকার তো বলে কাশ্মীর এখন নিরাপদ। সেখানে ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হয়েছে। কোনোরকম দুশ্চিন্তা ছাড়াই আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। জানতাম না যে আমাদের পৃথিবী সেখানে শেষ হয়ে যাবে।’

কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলায় নিহত শুভমের বাড়িতে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র হয় ছ ল র জন য পর ব র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

শুল্ক কমেছে, বাংলাদেশে স্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর দেশটির আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এ কথা বলা হয়। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহার কমে প্রতিযোগীদের কাছাকাছি অবস্থানে আসার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।

২৯ জুলাই থেকে তিন দিনের আলোচনা ও দর-কষাকষির শেষ দিন ৩১ জুলাই এ ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে।

পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনতে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও বেশ কিছু সুবিধা দিতে হয়েছে। একদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান গত ২১ জানুয়ারি। এর দুই মাস পর গত ২ এপ্রিল হঠাৎ বিশ্বের ৭০ দেশের জন্য বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। অনেকেই ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে একধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে সমালোচনা করেছেন।

প্রথমে গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয় ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। মাঝখানে তিন মাস স্থগিত রাখার পর ৮ জুলাই তা কমিয়ে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ করেন। বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ করায় মোট শুল্কহার দাঁড়াবে এখন ৩৫ শতাংশে।

দর-কষাকষির মাধ্যমে ঘোষিত শুল্কহার কমিয়ে আনাকে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের আলোচকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য।’

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আলোচকদের মধ্যে আরও ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে বলেছে, অনেক বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু শুল্ক কমানোর সঙ্গেই যুক্ত ছিল না; বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্যঘাটতি ও নিরাপত্তা–সংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগও ছিল এর সঙ্গে। সমাধানের বিষয়টি নির্ভর করছিল একটি দেশের সদিচ্ছার ওপরও।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’

প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্কহার

যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।

বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা এবং ১৯ শতাংশ হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯ শতাংশ। তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ; জাপান, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৪১ শতাংশ শুল্কহার সিরিয়ার ওপর। বেশি হার আরোপ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ; সুইজারল্যান্ডের ওপর ৩৯ শতাংশ; ইরাক ও সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ এবং লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিচ্ছে বাংলাদেশ

সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেশন পুরোপুরি মেনে চলারও অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে পাঁচ বছর ধরে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।

দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হচ্ছে। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯ থেকে ১১ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সফল না হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সেসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ১৭ থেকে ২৩ জুলাই সপ্তাহব্যাপী অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বৈঠকগুলো করেন।

গত ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করার কারণে সরকারি প্রতিনিধিদলে অন্য কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভেতরে-ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।

সরকারের আহ্বানে সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেন তাঁরা। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩ কোটি ডলারে ৩ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।

ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রায় ১০ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।

এ ছাড়া ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ১৯ হাজার টন তুলা আমদানির সমঝোতার চুক্তি করেছে বস্ত্র খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্গিল ইনকরপোরেটের কাছ থেকে এশিয়া কম্পোজিট ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে ৬ হাজার টন আমদানির এমওইউ করেছে। একই দরে একই পরিমাণ তুলা আমদানির এমওইউ করেছে সালমা গ্রুপও। এ ছাড়া মোশাররফ গ্রুপ মার্কিন লুইস ড্রেফাস গ্রুপ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন তুলা আমদানির এমওইউ করেছে।

কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ২০ শতাংশ শুল্কহার ঠিক করতে পেরেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।’

ট্রেড ইউনিয়ন, মজুরি, শ্রমিক নিপীড়ন, মামলা—এসব বিষয় আলোচনায় উঠেছিল কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখতে জোর দিয়েছে তারা। আমরা আইএলও কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ জন্য শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে।’

‘অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা’

ওয়াশিংটনে দর-কষাকষিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্ক কমার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, তাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে রেহাই পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘সময়সীমার মধ্যেই জটিল আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। নইলে ৩৫ শতাংশের গুরুভার বহন করে যেতে হতো।’

খলিলুর রহমান আরও বলেন, প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান অথবা যত্সামান্য বেশি এবং ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য এখন প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। তৈরি পোশাকশিল্প ও এর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টার উদ্দেশে ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (শেখ বশিরউদ্দীন) সমালোচকদের হতাশ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেন, হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।

অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিশ্বশক্তির চাপের মুখে এই সাফল্য অর্জনের জন্য সরকার ও আলোচক দলের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন। এটি সম্ভবত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোর একটি ছিল, যা পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাঁরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ