মুন্সীগঞ্জ সদরের মোল্লাকান্দিতে সানা মাঝি (৪২) নামে শ্রমিক লীগের এক কর্মীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের মধ্য মাকহাটি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ওই দিন রাত ৩টার দিকে গ্রামের তালগাছতলা সংলগ্ন রাস্তার পাশ থেকে পুলিশ সানা মাঝির লাশ উদ্ধার করে। এ সময় লাশের বুকে একটি পাইপগান ও দুই রাউন্ড কার্তুজ রাখা ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

সানা মাঝি মাকহাটি গ্রামের প্রয়াত মোহাম্মদ মাঝির ছেলে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে গ্রাম ছেড়ে একই উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের ডেকরাপাড়া গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন সানা। তিনি মোল্লাকান্দি ইউনিয়ন শ্রমিক লীগ কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন।

এদিকে হত্যার কথা স্বীকার করে শুক্রবার বিএনপিকর্মী শিপন মাঝির ভাই মোল্লাকান্দি ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি প্রার্থী বাবু মাঝি ফেসবুক লাইভে আসেন। সেখানে বাবু মাঝিকে বলতে শোনা যায়, ‘ঠিক আছে শিপন মাঝির মার্ডার। শিপন মাঝিরে মারছিল সানা। আজ অয় ডাকাতি করতে আইছিল। আমরা গ্রামবাসীরা ধইরা মারছি।’

পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে মাকহাটি গ্রামের মসজিদের মাইকে ডাকাতির কথা ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করে সানা মাঝিকে আটকে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। উদ্ধারের সময় সানা মাঝির বুকের ওপর পাইপগান ও কার্তুজ পাওয়া গেছে। 

নিহতের ভাই আসাদ মাঝি জানান, তার ভাই একজন শ্রমিক। বৃহস্পতিবার বিকেলে শ্বশুরবাড়ি থেকে কাজ দেওয়ার কথা বলে তার ভাইকে ডেকে নিয়ে আসে স্বাধীন নামে এক ব্যক্তি। পরে রাতে লোকমুখে জানতে পারেন, তার ভাইকে মাকহাটি গ্রামে আটকে রেখে বাবু মাঝি ও তার সহযোগীরা পিটিয়ে ও কুপিয়ে মেরে ফেলে রেখেছে।

জানা গেছে, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাকহাটি গ্রামের মোহাম্মদ মাঝি ও শামসুল মাঝির পরিবারের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এর জেরে ১৯৯৭ সালে খুন হন মোহাম্মদ মাঝি। ওই খুনের জেরে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুন হন শামসুল মাঝির ছেলে বিএনপিকর্মী শিপন মাঝি। এ হত্যা মামলায় ২০০৪ সালে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ প্রয়াত মোহাম্মদ মাঝির ছেলে সানা মাঝির বড় ভাই খলিল মাঝিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

হত্যার কথা স্বীকারের ব্যাপারে জানতে বাবু মাঝির ফোনে একাধিকবার কল করে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মাসুদ রানা বলেন, বাবু মাঝি যুবদলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না। সে ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি প্রার্থী কিনা, জানি না। 

সদর থানার ওসি সাইফুল আলম বলেন, পূর্ব বিরোধের জেরে যুবদল নেতা বাবু মাঝি এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে। তবে জড়িতরা গা-ঢাকা দিয়েছে। শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। হত্যার ঘটনায় মামলার প্রক্রিয়া চলছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: হত য ম হ ম মদ ম ঝ য বদল র

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ