‘গছিয়ে দেওয়া’ যন্ত্র নিয়ে বিপাকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
Published: 3rd, May 2025 GMT
কচুরিপানা ও ভাসমান বর্জ্য পরিষ্কারের জন্য প্রায় ছয় কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়েছিল আড়াই বছর আগে। কিন্তু কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এর ফলে যন্ত্রটি নিতে আগ্রহ দেখায়নি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু চাহিদা না থাকলেও সম্প্রতি দামি এই যন্ত্র চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে একপ্রকার ‘গছিয়ে’ দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এখন এই যন্ত্র নিয়ে কী করবে, ভেবে পাচ্ছে না সংস্থাটি।
ভাসমান বর্জ্য পরিষ্কার করার দামি এই যন্ত্রের নাম উইড হারভেস্টার। গত মার্চের মাঝামাঝি পবিত্র রমজান মাসে এই যন্ত্র চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাগরিকা ওয়ার্কশপে রেখে যায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে যন্ত্রটি ওভাবেই পড়ে আছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি উইড হারভেস্টার কিনেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ‘সিটি করপোরেশনের জন্য উন্নয়ন সহায়তা’ খাতের বরাদ্দ দিয়ে ২০২২ সালে এ ধরনের আটটি যন্ত্র কেনা হয়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক নথিতে দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের জন্য রক্ষিত উন্নয়ন সহায়তা খাতের বরাদ্দে আটটি উইড হারভেস্টার কেনা হয়। ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনকে একটি করে উইড হারভেস্টার দেওয়া হয়েছে।
শুধু উইড হারভেস্টার নয়, এর আগে সিটি করপোরেশনগুলোকে দেওয়া রোড সুইপার ট্রাকও কোনো কাজে আসেনি। আওয়ামী লীগের আমলে ২০২০ সালে সড়কের ধুলাবালু পরিষ্কারের জন্য ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইতালি থেকে ২০টি রোড সুইপার ট্রাক কিনেছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বাজেটে মন্ত্রীর অভিপ্রায় খাত থেকে রোড সুইপার কেনার ব্যয় বহন করা হয়েছিল।
দেশের ১০টি সিটি করপোরেশনকে এসব রোড সুইপার দেওয়া হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছিল তিনটি। কিন্তু এগুলো ধুলা পরিষ্কারের পরিবর্তে উল্টো সড়কে আরও ধুলা ওড়ায়। কোনো কাজে না আসায় এগুলোর ব্যবহার বন্ধ রেখেছে সিটি করপোরেশনগুলো। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গাড়িগুলো সাগরিকা ওয়ার্কশপে পড়ে আছে।
বর্তমানে কাজে না আসা এসব দামি যন্ত্রপাতি কেনার সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মো.
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) এসব যন্ত্রপাতি কেনাকাটা করে। মন্ত্রীসহ প্রভাবশালীদের পছন্দের ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের মাধ্যমে বাড়তি দামে এসব যন্ত্রপাতি কেনা হয় বিনা দরপত্রে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানতে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিটি করপোরেশন শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আর সিটি করপোরেশনকে দেওয়া চিঠিতে স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব মাহবুবা আইরিনকে মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। কার্যকর যন্ত্রপাতির অভাবে নালা-নর্দমা ও খাল পরিষ্কারের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় থেকে একটি উইড হারভেস্টার দেওয়া হয়।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলেন, যন্ত্রটি জলাশয়ের কচুরিপানাসহ ভাসমান বর্জ্য পরিষ্কারের জন্য। তবে এটি কার্যকর করতে গেলে জলাশয়ের গভীরতা অন্তত সাত ফুট হতে হবে। আর প্রশস্ততায় যথেষ্ট বড় হতে হবে। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের খালগুলোর গভীরতা অত নয়। এটি চট্টগ্রাম নগরের খালগুলোতে নামানোর মতো অবস্থাও নেই।
জার্মানি থেকে কেনা এসব যন্ত্র নিয়ে ২০২২ সালের আগস্টে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় ৭ আগস্ট আগাছা পরিষ্কার করার যন্ত্রটি পুকুরে নামানো হয়। সেখানে উপস্থিত এক কর্মকর্তা ওই সময় প্রথম আলোকে বলেন, এই যন্ত্র পরীক্ষা করার মতো জলাশয় চট্টগ্রাম সিটি এলাকায় নেই। খোঁজখবর নিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুরে যন্ত্রটি নামানো হয়। কিন্তু যন্ত্রটি আর ওঠানো যাচ্ছিল না। অথচ জলে-স্থলে এটি চলে বলে জানানো হয়েছিল।
সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের যন্ত্র রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ কিংবা মিরসরাইয়ের মহামায়া হ্রদের কচুরিপানা পরিষ্কারে ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনোভাবেই এটি চট্টগ্রাম নগরের খালগুলোর জন্য ব্যবহার উপযোগী নয়।
সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভাসমান ময়লা পরিষ্কারের জন্য এ ধরনের যন্ত্রের কোনো চাহিদা সিটি করপোরেশনের ছিল না। এটি এখানকার জন্য ব্যবহার উপযোগীও নয়। এখন এটি নিয়ে কী করবেন, তা-ই বুঝতে পারছেন না।
এ ধরনের যন্ত্রপাতি কেনা এবং করপোরেশনগুলোকে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এসব যন্ত্রপাতি কেনায় সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। এসব কেনাকাটার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। তাই দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দিয়ে এগুলোর তদন্ত করানো উচিত এবং কেনাকাটার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ষ ক র র জন য প রথম আল ক কর মকর ত এ ধরন র ব যবহ র হয় ছ ল নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
ইরান প্রশ্নে ইসরায়েলের চাপে যেভাবে অবস্থান বদলালেন ট্রাম্প
আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইসরায়েলের সামরিক কর্মকাণ্ড ও দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের আলোচনার ওপর নজরদারি চালিয়ে গত মাসের শেষ নাগাদ একটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। আর সেটি হলো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে শিগগির একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করছেন; যুক্তরাষ্ট্র তাতে অংশ নিক বা না-নিক।
নেতানিয়াহু এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বলে আসছিলেন যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই তাদের বিরুদ্ধে একটি জোরালো সামরিক হামলা জরুরি। তবে অতীতে একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যারা মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, তাকে সব সময় নিরস্ত করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র হামলায় অংশ নেবে না বলে জানিয়েছেন।
কিন্তু এবার মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মূল্যায়ন ছিল নেতানিয়াহু শুধু ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সীমিত হামলার পরিকল্পনা করছেন না, বরং এমন একটি বৃহৎ আকারের হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যা ইরানি শাসনব্যবস্থাকেই হুমকির মুখে ফেলতে পারে এবং তিনি এককভাবেই এগোতে প্রস্তুত।
আরো পড়ুন:
প্রশ্ন হলো, ইসরায়েলের পক্ষে ট্রাম্প সমর্থন কতটা জোরালো করতে চান
আলজাজিরার বিশ্লেষণ: ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের বৈশ্বিক প্রভাব
ট্রাম্পের সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত
এই গোয়েন্দা তথ্যের মুখে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হন। তিনি ইরানকে কূটনৈতিকভাবে পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগে রাজি করাতে আগ্রহী ছিলেন এবং এর আগেই এপ্রিলে নেতানিয়াহু যখন হামলার পক্ষে সওয়াল করেন, তখন সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ট্রাম্প। মে মাসের শেষ দিকে এক উত্তেজনাপূর্ণ ফোনালাপে ট্রাম্প আবার নেতানিয়াহুকে একতরফা হামলার বিরুদ্ধে সতর্ক করেন।
তবে গত কয়েক সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এবার নেতানিয়াহুকে থামানো হয়তো আর সম্ভব নয়। একই সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে নিয়েও বিরক্ত হয়ে পড়ে।
ইসরায়েলের দাবির বিপরীতে মার্কিন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনো নতুন গোয়েন্দা তথ্য জানতেন না, যা প্রমাণ করত যে ইরান দ্রুত পারমাণবিক বোমা তৈরির দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাদের হাতে আর পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে নেই, তখন ট্রাম্পের উপদেষ্টারা বিভিন্ন বিকল্প বিবেচনা করতে শুরু করেন।
এক দিকে ছিল কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা এবং পরে দেখা ইরান কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারপর করণীয় ঠিক করা। আরেক দিকে ছিল ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরাসরি হামলায় অংশ নেওয়া, এমনকি শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের পথে যাওয়া।
ট্রাম্প শেষমেশ মাঝামাঝি একটি পথ বেছে নেন; তিনি ইসরায়েলকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে গোপন সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দেন, যাতে তারা হামলা চালাতে পারে। এরপর তেহরানের ওপর চাপ বাড়িয়ে দেন যেন তারা দ্রুত আলোচনায় বসে এবং ছাড় না দিলে সামরিক আঘাত অব্যাহত থাকবে- এমন হুমকি দেন।
ইসরায়েল হামলা শুরু করার পাঁচ দিন পরও ট্রাম্পের অবস্থান দোদুল্যমান রয়ে গেছে।
ট্রাম্পের বিবেচনায় মার্কিন যুদ্ধবিমান পাঠানোর বিষয়
এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গম্ভীরভাবে বিবেচনা করছেন, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলোকে জ্বালানি ভরার সহায়তা দিতে এবং ইরানের গভীর ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা ফোরদোতে ৩০ হাজার পাউন্ডের বোমা নিক্ষেপে সহায়তার জন্য মার্কিন বিমান পাঠানোর ব্যাপারে।
এই ইসরায়েলি হামলার পেছনের ঘটনা হলো: দুই নেতা- ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু, যারা উভয়েই ইরানকে পারমাণবিক বোমা অর্জন থেকে বিরত রাখতে একমত, কিন্তু একে অপরের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দুই ডজন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার থেকে উঠে এসেছে, ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় ফেরার পর পররাষ্ট্রনীতিতে প্রথম সংকট তৈরি হয় নেতানিয়াহুকে থামানো উচিত কি না এবং কীভাবে তা করা যায়, সেটি নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থা। ট্রাম্প নিজের অনুগতদের নিয়ে একটি অনভিজ্ঞ উপদেষ্টা দল গঠন করে পরিস্থিতির মোকাবিলার চেষ্টায় নামে।
মঙ্গলবার (১৭ জুন) ভোরে কানাডার জি-৭ সম্মেলন থেকে দ্রুত ওয়াশিংটনে ফিরে আসার সময় ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, গোয়েন্দা তথ্যসংক্রান্ত জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ডের এক বক্তব্যে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। গ্যাবার্ড তাকে বলেছিলেন, ইরান সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে যাচ্ছে এমন প্রমাণ এখনো গোয়েন্দা সংস্থার কাছে নেই। ট্রাম্প উত্তরে বলেন, “আমি ওসব শুনতে চাই না। আমার মনে হয়, ওরা খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।”
এই বিষয়ে মন্তব্য চাইলে হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র বলেন, প্রেসিডেন্ট এর আগেও বলেছেন, ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া যাবে না।
জুন ৮: ক্যাম্প ডেভিডে সংকট মূল্যায়ন
জুনের ৮ তারিখ, ক্যাম্প ডেভিডে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ট্রাম্প তার উপদেষ্টাদের নিয়ে ইরান-ইসরায়েল পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। ওই বৈঠকে সিআইএ পরিচালক জন র্যাটক্লিফ সোজাসাপ্টা বলেন, ইসরায়েল শিগগিরই ইরানে হামলা চালাতে চলেছে, যুক্তরাষ্ট্র এতে থাকুক বা না-থাকুক।
আসলে, মে মাসের শেষ দিকে গোয়েন্দা তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে, ইসরায়েল একটি বড় ধরনের আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং পররাষ্ট্র ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার যুগপৎ দায়িত্বে থাকা মার্কো রুবিও প্রেসিডেন্টকে বিকল্প সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তুতির কথা বলেন, যাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
জুন ৯: নেতানিয়াহুর ফোন
এর পরদিন ৯ জুন, ট্রাম্প ফোনে নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেন। তিনজন সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, নেতানিয়াহু পরিষ্কার জানান, মিশন এখন যাত্রার জন্য প্রস্তুত। তিনি বলেন, ইরানের মাটিতে ইতোমধ্যে ইসরায়েলের বাহিনী কাজ করছে।
ইসরায়েলি সামরিক কৌশলের সৃজনশীলতা দেখে ট্রাম্প মুগ্ধ হন। যদিও কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি, তবে ফোন রাখার পর তিনি উপদেষ্টাদের বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, আমাদের তাকে সহায়তা করতে হতে পারে।”
সিদ্ধান্তের দ্বিধা
তবু ট্রাম্প দ্বিধায় ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ইরানকে নিজের কৌশলে সামলাতে, নেতানিয়াহুর ছায়ায় নয়। নিজেকে একজন দক্ষ সমঝোতাকারী মনে করেন ট্রাম্প। কিন্তু শেষমেষ তার মনে হচ্ছিল, ইরান তাকে শুধু সময়ক্ষেপণ করাচ্ছে।
গোটা বিষয়টিতে ট্রাম্প তার দলের কিছু ‘অ-হস্তক্ষেপবাদী’ অংশের মতো নন, যারা মনে করেন পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেও ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বরং নেতানিয়াহুর মতো তিনিও বিশ্বাস করে বসেন, ইরান ইসরায়েলের জন্য একটি অস্তিত্বগত হুমকি।
ইসরায়েলের প্রস্তুতি আগে থেকেই
ইসরায়েল মূলত ডিসেম্বর থেকেই ইরান আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল, যখন হিজবুল্লাহ (ইরানের ছায়া শক্তি) ধ্বংস হয়ে যায় এবং সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ঘটে, যার ফলে ইরানের ওপর বোমাবর্ষণের জন্য আকাশপথ খুলে যায়।
এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক ক্রমবর্ধমান জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আটকে পড়েছেন, যেখানে সিদ্ধান্তের প্রতিটি পথই এক দিকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়, আবার অন্য দিকে তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পতনের আশঙ্কাও তৈরি করে।
ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিয়াহুর সাক্ষাৎ
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার হোয়াইট হাউসে যান। ওভাল অফিসে ট্রাম্পকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ছবি দেখান নেতানিয়াহু।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ইরান এখন আরো দ্রুত ও কম পরিশীলিত পদ্ধতিতে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে। তাদের যুক্তি ছিল, ইরান যত দুর্বল হয়ে পড়ছে, ততই তারা বোমার কাছাকাছি যাচ্ছে।
নেতানিয়াহুর সফরসঙ্গীরা ট্রাম্পকে আরো একটি যুক্তি দেন: যদি আপনি চান কূটনীতি সফল হোক, তবে আগে একটি শক্তিশালী সামরিক প্রস্তুতি থাকতে হবে, যাতে দরকষাকষিতে বাস্তব চাপ সৃষ্টি হয়।
ব্যক্তিগতভাবে তারা চিন্তিত ছিলেন যে, ট্রাম্প হয়তো ইরানের সঙ্গে এমন একটি দুর্বল চুক্তি করে বসবেন, যা পর্যাপ্ত নয় এবং তারপর সেই চুক্তিকেই ‘মিশন অ্যাকমপ্লিশড’ ঘোষণা করবেন।
নভেম্বরে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্টিভ উইটকফকে মধ্যপ্রাচ্য দূত হিসেবে নিয়োগ দেন এবং ইরানের সঙ্গে সমঝোতা গঠনের দায়িত্ব দেন।
রাজনৈতিক জটিলতা এবং প্রশাসনিক পার্থক্য
ট্রাম্প জানতেন, ইসরায়েল-ইরান ইস্যু তার নিজস্ব রাজনৈতিক জোটকে বিভক্ত করতে পারে। এক দিকে ছিলেন টাকার কার্লসনের মতো অ-হস্তক্ষেপবাদী কণ্ঠস্বর; অন্যদিকে ছিলেন মার্ক লেভিনের মতো কট্টর ইরানবিরোধী রক্ষণশীলরা।
তবে প্রশাসনের ভেতরে এই মেয়াদে আদর্শগত বিভাজন আগের মতো তীব্র ছিল না। আগের দফায় যেমন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ট্রাম্পকে লাগাম পরাতে চাইতেন, এবার তেমন কেউ ছিলেন না।
ওমানে শুরু হয় কূটনৈতিক আলাপ
এপ্রিলে উইটকফ ও পররাষ্ট্র দপ্তরের নীতিনির্ধারণ পরিচালক মাইকেল অ্যানটন ওমানের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে গোপন আলোচনা শুরু করেন। মে মাসের শেষ নাগাদ ইরানকে একটি লিখিত প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
প্রস্তাবে বলা হয়, ইরানকে ধাপে ধাপে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে হবে এবং একটি আঞ্চলিক কনসোর্টিয়াম গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়; যেখানে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলো অংশ নেবে।
কূটনীতি চালিয়েও ট্রাম্প সামরিক বিকল্পে আস্থা রাখেন
যদিও ট্রাম্প কূটনৈতিক পথেই সমাধান চাচ্ছিলেন, তবু ইসরায়েলিদের একটি বক্তব্য তার মনে দাগ কাটে: একটি বিশ্বাসযোগ্য সামরিক হুমকি থাকলে দরকষাকষির ক্ষেত্রে তা কার্যকর হবে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ইসরায়েলের সঙ্গে সমন্বয় করে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড প্রধান জেনারেল মাইকেল এরিক কুরিলা তিনটি সামরিক বিকল্প প্রস্তুত করেন:
১. কেবল ইসরায়েলি মিশনের জন্য মার্কিন পুনঃজ্বালানি ও গোয়েন্দা সহায়তা;
২. ইসরায়েলি-মার্কিন যৌথ হামলা;
৩. যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ হামলা, যেখানে ইসরায়েল সহায়ক শক্তি হিসেবে থাকবে।
এই শেষ বিকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের বি-১ ও বি-২ বোমারু বিমান, বিমানবাহী রণতরীর জেট এবং সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্রুজ মিসাইল ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল।
নেতানিয়াহুর ধৈর্যচ্যুতি ও ট্রাম্পের প্রতিরোধ
তবে ট্রাম্পের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলাকালেই নেতানিয়াহু অধৈর্য হয়ে পড়েন। এপ্রিল মাসে তিনি হোয়াইট হাউসে হঠাৎ এক সফরে এসে ফোরদোর ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাটি ধ্বংসের জন্য ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমা চেয়ে বসেন।
ট্রাম্প এতে রাজি হননি। এরপর তার প্রশাসন জোর প্রচেষ্টা চালায় ইসরায়েল যেন একতরফাভাবে আগ্রাসনে না যায়।
ট্রাম্প চিন্তিত ছিলেন নেতানিয়াহু তার চুক্তির ফলাফল পছন্দ না করলে নিজেই হামলা শুরু করে দেবে। একইসঙ্গে আশঙ্কা ছিল, ইসরায়েল যদি হামলা চালিয়েও ইরানের সব পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসে ব্যর্থ হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
ইরান চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে
মে থেকে জুনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে উইটকফ তার সহকর্মীদের জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান একটি চুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। কিন্তু ৪ জুন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তখন ট্রাম্পের উপদেষ্টারা বুঝতে পারেন, ইরান সম্ভবত আলোচনায় আন্তরিক নয়।
ট্রাম্প তখনো প্রকাশ্যে কূটনীতির গুরুত্বের কথা বলছিলেন। তবে এটি ইরানকে আশ্বস্ত করতে নয়, বরং যেন তারা ‘হাই অ্যালার্টে’ না যায়, সেই কৌশল হিসেবেই তা করা হচ্ছিল।
হামলার আগের দিন
কিন্তু ১২ জুন আলোচনায় আর কোনো অগ্রগতির ইঙ্গিত ছিল না। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা তখন জানতেন, পরদিনই হামলা শুরু হবে।
হামলা চলাকালে হোয়াইট হাউস ‘সিচুয়েশন রুমে’ ট্রাম্প
শুক্রবার (১৩ জুন) ইসরায়েল যখন ইরানের ওপর প্রথম দফার হামলা শুরু করে, তখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে জাতীয় নিরাপত্তা দলের সঙ্গে ছিলেন। সেই মুহূর্তেও তিনি তার সব বিকল্প খোলা রেখেছিলেন। একই দিন তিনি উপদেষ্টাদের ও ঘনিষ্ঠজনদের বলছিলেন, তিনি এখনো ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চান।
হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসে ট্রাম্পের কাছ থেকে নয়, বরং রুবিওর পক্ষ থেকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলি অভিযান থেকে দূরে রাখার ইঙ্গিত দেন এবং একজন মিত্র রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ানোর কোনো উল্লেখ করেননি, যদিও তখন থেকেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ইসরায়েলকে সহায়তা দিচ্ছিল।
ট্রাম্পের অবস্থান বদলাতে থাকে
তবে রাত গড়াতেই যখন ইসরায়েল একের পর এক নিখুঁত হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতাদের ও কৌশলগত স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানে, তখন ট্রাম্প তার প্রকাশ্য অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করেন।
শুক্রবার (মধ্যপ্রাচ্যে শনিবার) সকালে ঘুম থেকে উঠে ট্রাম্প দেখেন, ফক্স নিউজ পুরো সম্প্রচারে ইসরায়েলের সামরিক সাফল্য প্রচার করছে, যাকে তারা ‘সামরিক প্রতিভার’ নিদর্শন হিসেবে জাহির করছিলেন। ট্রাম্প তখন নিজেও কিছু কৃতিত্ব দাবি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেননি।
গোপনীয় কথোপকথন ও সম্ভাব্য আরো বড় পদক্ষেপ
সংবাদকর্মীদের সঙ্গে ফোনালাপে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিতে শুরু করেন, এই যুদ্ধে তার ভূমিকা সাধারণ মানুষের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বেসরকারিভাবে তিনি কিছু ঘনিষ্ঠজনকে বলেন, তিনি এখন ইসরায়েলের আগের অনুরোধ অর্থাৎ ফোরদোর ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাটি ধ্বংসের জন্য মার্কিন ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমা সরবরাহ করার দিকে আরো গভীরভাবে ঝুঁকছেন। এটি একটি বড় ধাপ, যার অর্থ হতে পারে সরাসরি মার্কিন সামরিক সম্পৃক্ততা।
ঢাকা/রাসেল