পতিত সরকারের অনেক মন্ত্রী, এমপি শ্রমিকের বেতন না দিয়ে বিদেশে পালিয়েছে বা আত্মগোপনে আছে। তাদের বাড়ি, গাড়ি, জমি বিক্রি করে শ্রমিকের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যারা শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ না করে বিদেশে পালিয়েছে তাদের ধরে আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেডএলার্ট জারির কথা বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.

) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। 

শনিবার শ্রমিক অধিকার সুরক্ষায় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।

উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমার শ্রমিককে আমি দেখবো, মালিকদের এমন মানসিকতা গড়ে উঠেনি। আমরা সর্বদা শ্রমিকের পক্ষে, আবার মালিককেও দেখার দায়িত্ব আছে। আমরা চাই না শ্রমিক একদিকে, মালিক অন্যদিকে। শিল্পখাতে আমাদের ব্যর্থতার কারণ অতীতের দুবৃর্ত্তায়ন। যিনি কারখানার মালিক তিনি রাজনৈতিক দলের নেতা, তিনি সংসদে এমপি, এ ভাবেই অতীতে শাসন এবং শোষণ চলেছে। জুলাই বিপ্লবে ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও প্রাণহানি ঘটেছে। এর পেছনে কারণ ছিল তাদের দীর্ঘদিনের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ। সরকারের অবহেলায়ই রানাপ্লাজা দুর্ঘটনা ঘটেছে। রানাপ্লাজার ধ্বংসস্তুূপ থেকে ১৭ দিন পরে রেশমা নামক নারী কর্মীকে উদ্ধার করা ছিল সাজানো নাটক।’

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।

সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ‘মে দিবস আসে যায়। দিবসটি নানা র‍্যালি, মিছিল-শ্লোগান, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে পালিত হয়। কিন্তু শ্রমিকের ভাগ্য বদলায় না। যাদের শ্রমে-ঘামে দেশের চাকা ঘোরে, তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। শ্রমিক অধিকার আদায়ের যে দিবস, সে দিবস তাদের স্পর্শ করে না। দেশের ৮ কোটি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ৮৫ শতাংশ শ্রমিকেরই আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। শ্রমিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই, নেই কর্মস্থলে পরিচয়পত্র। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ১১২ জন শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ শহীদ হয়েছেন। কয়েক হাজার শ্রমজীবী মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। এর মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তাই শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য দাবি পূরণ না হলে, জুলাই বিপ্লবের অর্জিত সুফল ম্লান হয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা ব্যতিত শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শুধু মে দিবসে শ্রমিকদের সুরক্ষার কথা না বলে, শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি আগামী জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনী ইশতেহারে ভালোভাবে উল্লেখ করলে তাদের ভোট বাড়বে বৈ কমবে না। আমরা শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের পক্ষে। তবে অযৌক্তিক দাবির মাধ্যমে বহিরাগতদের নিয়ে কারখানায় শ্রমিকদের বিক্ষোভ, ভাঙচুর, কারখানা বন্ধ করে দেওয়া, জ্বালাও-পোড়াও কোনোভাবেই আমরা সমর্থন করি না। আওয়ামী সরকারের পতনের পর কিছু দেশি-বিদেশি অপশক্তি পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন মিল-ফ্যাক্টরি অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এমনও দেখা গেছে, শ্রমিক আন্দোলনের নামে উস্কানিদাতা কেউই শ্রমিক বা শ্রমিক নেতা নয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অযৌক্তিক শ্রমিক আন্দোলনের নামে তথাকথিত বিশৃঙ্খলা দমন করতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি এক বড় কালো অধ্যায়। অথচ রানা প্লাজায় নিহত ও আহত পরিবারের সাহায্যে দেশি—বিদেশিদের যে অর্থ পাওয়া গিয়েছিল তার বেশির ভাগ অংশই তৎকালীন সরকার ও তার সুবিধাভোগীরা লুটপাট করেছে।’

মহান মে দিবস—২০২৫ উদযাপনের অংশ হিসেবে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘শ্রমিক অধিকার সুরক্ষায় মালিক অপেক্ষা শ্রমিক সংগঠনের দায়িত্ব বেশি’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকদের পরাজিত করে তেজগাঁও কলেজের বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, সাংবাদিক মো. আলমগীর হোসেন, সাংবাদিক মো. তৌহিদুল ইসলাম, সাংবাদিক মো. আতিকুর রহমান ও জনাব নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল। প্রতিযোগিতা শেষে চ্যাম্পিয়ন দলকে ৫০ হাজার ও রানারআপ দলকে ৩০ হাজার টাকাসহ  ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ড ব ট ফর ড ম ক র স ম দ বস ড ব ট ফর ড ম ক র স উপদ ষ ট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

'লাল বেনারসি পরে আসার কথা, সাদা কাফন পরতে হলো’

‘ভালো থেকো প্রিয়তমা। নিয়তি হয়তো আমাদের আলাদা করে দিল, কিন্তু ভালোবাসা কখনো আলাদা হবে না।’ যুবক সানি বড়ুয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে যাঁর উদ্দেশে এই লেখা লিখেছেন, তিনি তখন না–ফেরার দেশে। কক্সবাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত রিমঝিম বড়ুয়ার উদ্দেশে গতকাল মঙ্গলবার ফেসবুকে এসব কথা লেখেন সানি। আগামী ৬ জুলাই দুজনের বিয়ের দিন নির্ধারিত ছিল। চলছিল সেই ক্ষণগণনা। তবে এর আগেই যেন বিধাতা পাষাণ হলেন, নিয়ে গেলেন রিমঝিমকে।

ফেসবুকে রিমঝিমের উদ্দেশে সানি লেখেন, ‘লাল বেনারসি পরে আমার বাড়িতে আসার কথা থাকলেও সাদা কাফন নামক কাপড়টাই শেষ সময়ে পরতে হলো। কত আশা, আকাঙ্ক্ষা; সব একটি দুর্ঘটনা তছনছ করে দিল।’ গত সোমবার কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে সানির কাছে আসার সময় রামুর রশিদনগর এলাকায় পূরবী পরিবহনের বাসের সঙ্গে কাভার্ড ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হন রিমঝিমসহ তিনজন। চট্টগ্রামে এসে সানির সঙ্গে বিয়ের কেনাকাটা করার কথা ছিল রিমঝিমের। রিমঝিম কক্সবাজারের উখিয়ায় ব্র্যাকের উন্নয়নকর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সানি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পে কাজ করেন।

সে বলেছিল খায়নি। তখন আমি লিখেছিলাম, বিয়ের পর কিন্তু খাওয়া নিয়ে এই উদাসীনতা চলবে না। শেষ মেসেজটি আর সিন হয়নি। হয়তো ততক্ষণে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।সানি বড়ুয়া

চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা সানির সঙ্গে কক্সবাজারের রামুর রিমঝিম বড়ুয়ার পরিচয় ফেসবুকে। এরপর দুজনের প্রেম। সেটি সাড়ে তিন বছর আগের কথা। সানি লেখেন, ‘এমন একটা দিন যায়নি, তোমার সঙ্গে কথা বলিনি। সাড়ে তিন বছরের সম্পর্কে একটি দিনও কথা না বলে থাকনি। আজ কীভাবে কথা না বলে থাকবে পরপারে?’

প্রেম থেকে পরিণয়ের দিন নির্ধারিত হয়েছিল দুজনের। ১৬ মে ফেসবুকে একটি যুগল ছবি পোস্ট করেন সানি বড়ুয়া। লেখেন দুটি শব্দ—‘পূর্ণতার কাছাকাছি’। সেখানে কতশত শুভকামনা ও অভিনন্দন শুভানুধ্যায়ীদের। সেই ছবিতে সানির কাঁধে হাত রেখে বসেছিলেন রিমঝিম। সারা জীবন এভাবে কাঁধে হাত রেখে চলতে চাওয়া রিমঝিম আজ দূর আকাশের তারা।

রিমঝিমের স্মৃতি যেন কুরে কুরে খাচ্ছে সানিকে। সারাক্ষণ দুজন কাছাকাছি থাকতেন ফোনে বা মেসেঞ্জারে। সোমবার রামু থেকে রিমঝিম রওনা দেওয়ার সময় দুজনের শেষ কথা হয়। বাসের টিকিট কেটে সানিকে জানিয়েছিলেন রিমঝিম। এরপর বাসে বসে দুজনের মধ্যে মেসেঞ্জারে কথা হচ্ছিল নানা বিষয়ে।

রামুতে শ্মশানে রিমঝিমকে সমাহিত করা হয়। শেষযাত্রায় রিমঝিমকে কিন্তু ঠিকই লাল বেনারসিতে বিয়ের সাজে রাঙিয়ে দিয়েছেন সানি। তাৎক্ষণিকভাবে একটা বেনারসি কিনে রিমঝিমের গায়ের ওপর পরিয়ে দেন। রিমঝিমের সিঁথিতে নিজ হাতে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ের অপূর্ণতা ঘোচানোর চেষ্টা করেন সানি।

‘আমি তখন অফিসে ঢুকেছি মাত্র। ফোন রাখার পর মেসেঞ্জারে আমি জানতে চেয়েছিলাম কিছু খেয়েছে কি না। সে বলেছিল খায়নি। তখন আমি লিখেছিলাম, বিয়ের পর কিন্তু খাওয়া নিয়ে এই উদাসীনতা চলবে না। শেষ মেসেজটি আর সিন হয়নি। হয়তো ততক্ষণে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।’ ফোনের ওপারে সানির গলা ধরে আসে।

প্রিয়তমার দুর্ঘটনার খবর শুনে উদ্‌ভ্রান্তের মতো কক্সবাজার ছুটেছেন সানি। রিমঝিমের নিথর দেহের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আর্তনাদ করতে থাকেন। সেই ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাসছে, যেখানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‌‘আমাকে একা করে কেন চলে গেলে? আমি কীভাবে থাকব?’

রামুতে শ্মশানে রিমঝিমকে সমাহিত করা হয়। শেষযাত্রায় রিমঝিমকে কিন্তু ঠিকই লাল বেনারসিতে বিয়ের সাজে রাঙিয়ে দিয়েছেন সানি। তাৎক্ষণিকভাবে একটা বেনারসি কিনে রিমঝিমকে পরিয়ে দেন। রিমঝিমের সিঁথিতে নিজ হাতে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ের অপূর্ণতা ঘোচানোর চেষ্টা করেন সানি। সানি বললেন, ‘তার অনেক আশা ছিল বেনারসি পরবে। ওই বেনারসি আমার সঙ্গে কেনার কথা ছিল। সব শেষ।’

কদিন আগে রিমঝিমের পাঠানো শাড়ি পরিহিত শেষ ভিডিওটিও পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। রিমঝিমের আত্মার শান্তি কামনায় সানি পটিয়ার ভান্ডারগাঁওয়ের নিজ বাড়ির মন্দিরে সমবেত প্রার্থনার আয়োজন করেন গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। সেখান থেকে রাতে ঘরে ফিরে ফেসবুকে সানি লেখেন, ‘প্রভু, আমাকে সইবার শক্তি দাও। আমার প্রতিক্ষণ যাচ্ছে যেন বিষাদে। এখনো মনে হচ্ছে না তুমি নেই। বিয়ের সাজে একসাথে হাসিমুখে আমাদের বাড়িতে আসার কথা ছিল। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। চলে গেলে অন্তিমে। তুমি যে নেই তা আমি মানতে পারছি না। মনে হচ্ছে একটু পরই ফোন দেবে...।’

রিমঝিমের মামাতো ভাই রিটন বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৬ মে দুই পরিবারের লোকজন বসে বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করেছিলাম। আমিও বৈঠকে ছিলাম। বিয়ের জন্য ৬ জুলাই লোহাগাড়ার আমিরাবাদে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করা হয়। তার আগে চলে গেল বোন। সানি তাঁকে লাল বেনারসি ও শাঁখা-সিঁদুর পরিয়ে বিদায় দিয়েছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ