রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- নামটি শুধু একটি ব্যক্তির পরিচয় নয়; এটি এক যুগান্তকারী চেতনার নাম। তিনি শুধুমাত্র কবি, নাট্যকার, সংগীতস্রষ্টা বা দার্শনিক নন। এক বিস্ময়ের নাম। আজকের এই অস্থির, অসহিষ্ণু এবং বিভেদের সময়ে বারবার ফিরে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটক কিংবা ছোটগল্প—সবখানে যে মনন, যুক্তি, মমতা, প্রতিবাদ তা আজও সমান জরুরি। 
আধুনিকতার ছোঁয়ায় রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতা বলতে যা বোঝাতে চেয়েছেন, তা নিছক প্রযুক্তিগত নয়; বরং এক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মননের প্রকাশ। আমরা যতই আধুনিক দাবি করি না কেন, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির মতো মুক্তচিন্তা আজও আমাদের অনেকের মধ্যে অনুপস্থিত। তাঁর লেখা নাটক, গল্প, উপন্যাস, কবিতাগুলো যদি আমরা মনোযোগ দিয়ে পড়ি, বুঝি এবং বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমরা অনুভব করব, এগুলো যেন এই সময়ের জন্যই রচিত। তাঁর নাট্যকর্মে যে বোধ, প্রতিবাদ এবং যে মানবিকতা- তা সময়কে অতিক্রম করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আধুনিক, এমনকি উত্তর-আধুনিক বললেও অত্যুক্তি হয় না। তিনি সেই সময়েই শিক্ষা, নারীর স্বাধীনতা, শিল্পের মর্যাদা, মানবাধিকার, বর্ণবৈষম্য, উপনিবেশবাদ, ধর্মান্ধতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে যে ধরনের কথা বলেছিলেন, তা আজও আমাদের জন্য বিস্ময়কর। আমরা যাকে আজ ‘মডার্নিটি’ বলি-তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চর্চার একটি গভীর যোগ রয়েছে। 
নাট্যভাবনার ভিন্ন দিগন্ত
রবীন্দ্রনাথের নাটকে বারবার উঠে এসেছে মানবমুক্তি, চিন্তার স্বাধীনতা এবং অচলায়তন ভাঙার আহ্বান। কুসংস্কার, দুঃশাসন, ধর্মান্ধতা এবং অন্ধ আনুগত্যের বিরুদ্ধে তিনি বারবার সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর ‘রক্তকরবী’, ‘অচলায়তন’, ‘রাজা’, ‘রথের রশি’ কিংবা ‘বিসর্জন’-সব নাটকেই রয়েছে একটি গভীর প্রতীকী বক্তব্য। নারীকে তিনি কখনও করুণা বা আশ্রয়ের প্রতীক হিসেবে দেখাননি, বরং তাঁর নাটকে নারী হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এক মৃত্যুঞ্জয়ী নারী, যিনি অন্ধকারের বিপরীতে আলোর প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের নাট্যজগৎ তাঁর অন্য সৃষ্টির চেয়ে ভিন্নতর এবং অনেক বেশি প্রগতিশীল। তাঁর নাটকে কেবল বিনোদন বা মনোরঞ্জনের বিষয় নেই- বরং রয়েছে চিন্তার খোরাক, সামাজিক প্রতিবাদ এবং একটি পরিবর্তনের আহ্বান। নাটককে তিনি ব্যবহার করেছেন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক প্রজ্ঞাবান অস্ত্র হিসেবে।
নাট্যকর্মী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শ
ব্যক্তিগতভাবে আমি রবীন্দ্রনাথের নাট্যকর্ম নিয়ে বিশেষ গবেষণা করেছি, এমন নয়। তবে মঞ্চে কাজ করেছি তাঁর দুটি নাটকে- ‘রাজা’ ও ‘অচলায়তন’। এই দুটিই প্রতীকী নাটক এবং এই নাট্যরূপায়ণে আমরা সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি রবীন্দ্রনাথকে। 


এই নাটকগুলো মঞ্চস্থ করার অভিজ্ঞতা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে—কারণ, এগুলো নিছক নাটকের গল্প নয়, বরং এক একটি দর্শন। 
রাজা: রূপকথা থেকে সমসাময়িক রাজনীতি
‘রাজা’ নাটকটি যখন প্রথম পড়ি, এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। যেন এক রূপকথার অদৃশ্য রাজা, যার শাসনপদ্ধতি রহস্যে মোড়া, সৌন্দর্য ও বেদনায় আচ্ছাদিত। তবে এই অনুভূতির সঙ্গে জুড়ে যেতে থাকে আমাদের সময়, বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। ৯/১১ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করেই মনে হলো, ‘রাজা’ নাটকের কাঞ্চিরাজ যেন হয়ে উঠছে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অজুহাতে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দোসর রাষ্ট্রগুলো এক ধরনের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসন চালিয়েছে, সেটি যেন ‘রাজা’ নাটকের প্রতিধ্বনি। আমরা ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নামক প্রযোজনায় কাঞ্চিরাজকে উপস্থাপন করেছি আধিপত্যবাদী শক্তির প্রতীক হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান, রাশিয়ার সংঘাত, ফ্রান্সের নিস্পৃহতা কিংবা হিটলার-লাদেনের চরিত্রকেও নাটকে প্রতীকীভাবে মঞ্চে এনেছি। উদ্দেশ্য ছিল, নাটকের প্রতিটি চরিত্র যেন হয়ে ওঠে বাস্তব রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। এভাবে ‘রাজা’ নাটক হয়ে উঠেছে একটি মুক্তির প্রতীক। এটি কোনো কাল্পনিক রাজার গল্প নয়, বরং শোষিত মানুষের মনের গভীরে লুকানো এক আশার প্রতিমূর্তি—যে মুক্তি চায়, আলো চায়, সত্য চায়। ‘রাজা’ নাটকের মধ্যে আমি দেখতে পেয়েছি আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আগ্রাসী রাজনীতি, একচ্ছত্র আধিপত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ওপর দখল—এসব যেন রবীন্দ্রনাথ আগেই দেখতে পেয়েছিলেন।  এই নাট্য প্রযোজনায় আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার করেছি সময়ের প্রয়োজনে। চরিত্রদের চলাফেরা সবই আজকের বাজারকেন্দ্রিক দুনিয়ার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এ সবই রবীন্দ্রনাথকে ছেঁটে ফেলার জন্য নয়, বরং তাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার প্রয়াস। কারণ, আমাদের সবার ভেতরেই এক সুদর্শনা আছে—যে সত্য জানতে চায়, বুঝতে চায় এবং সত্যের পাশে দাঁড়াতে চায়। নাটকের শেষ দৃশ্যে কাঞ্চিরাজের চিৎকার—“সব বন্ধ করো। আলো দাও! আলো! আলো! আলো!”—সে যেন আজকের পৃথিবীর আর্তনাদ।
অচলায়তন: অচলতা ভাঙার কথা
রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ মূলত ছেলেদের বিদ্যালয় নিয়ে লেখা হলেও আমরা নাট্যরূপ দিয়েছি এক রক্ষণশীল নারী বিদ্যালয়। কারণ, নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতা আজও যতটা প্রাতিষ্ঠানিক, ততটাই অনভ্যস্ত। সামাজিক বিধিনিষেধ, রীতি, সম্মান, ভয় ও ভ্রান্ত ধারণায় আজও নারী নিজেকে খুঁজে ফেরে। আমাদের ভাবনায় ‘অচলায়তন’ একটি সময়বিহীন জগৎ, যেখানে নিয়ম মানে নিয়ম নয়—একটি অন্ধ অনুশাসন। সেই সমাজে প্রশ্ন নেই, যুক্তি নেই, প্রাণ নেই—শুধু আনুগত্য আর নিষ্ক্রিয়তা। সমাজে পশ্চাৎপদতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় নারীর ক্ষেত্রেই। নারীকে একাধিক বিধিনিষেধে বেঁধে রাখার পেছনে রয়েছে এক গভীর সামাজিক ষড়যন্ত্র, যেখানে নারী নিজেও অনেক সময় অংশ নেয়। আমরা দেখেছি, অচলায়তনের নিয়ম এতটাই যান্ত্রিক ও মন্থর যে সেখানকার শিক্ষার্থীরা যেন হয়ে উঠেছে দম দেওয়া পুতুল। অন্যদিকে অচলায়তনের বাইরের জগতে মানুষ কর্মমুখর, প্রাণবন্ত ও স্বাধীন। এই দ্বৈত বাস্তবতাই আমাদের প্রযোজনার মূল উপজীব্য। এখানে চরিত্ররা হতে পারে গতকালের, আজকের বা ভবিষ্যতের। পঞ্চক নামের চরিত্রটি একসময় ছিল বিদ্রোহী, পরে হয়ে উঠেছে ভাঙনের প্রবর্তক। দাদাঠাকুর, যিনি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুক্তির আহ্বান জানাচ্ছেন, আমাদের বলে যান—শিক্ষা যেন হয় আনন্দের, মুক্তির এবং বোধের উৎস। এই নাটকে আমরা পঞ্চককে দেখিয়েছি বিদ্রোহী হিসেবে, যিনি পরবর্তীতে সেই ব্যবস্থারই ধারক হয়ে ওঠেন। দাদাঠাকুর চরিত্রটি হয়ে ওঠে এক মানবিক বিদ্রোহের প্রতীক—যিনি আসলে আমাদের বলে যান, “শিক্ষা মানেই বই মুখস্থ নয়, বরং নিজেকে আবিষ্কারের চাবিকাঠি।”
নারী ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের নারীচরিত্রগুলো—চিরায়ত বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। তিনি নারীকে কেবল প্রেমিকা, জননী বা ভোগ্য বস্তু হিসেবে দেখেননি। বরং নারীকে দিয়েছেন নিজস্ব চিন্তা, অধিকার, প্রতিবাদ ও অভিমান। ‘নন্দিনী’ যেন এক নারী নয়, এক চলমান বিদ্রোহ। ‘অচলায়তন’-এর শিক্ষার্থীরা কেবল পাঠরত নয়, তারাও বিপ্লবের সম্ভাবনা। এই চেতনাই আমাদের প্রযোজনায় স্থান পেয়েছে। কারণ আমরা মনে করি, যদি সমাজ বদলাতে হয়, তবে নারীকেই সেই বদলের মুখ হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বহু আগে এই সত্য বুঝেছিলেন, যা আজও অনেকের বোধগম্য হয়নি।
প্রযুক্তি ও নাট্যরূপ
আমরা মঞ্চে প্রযুক্তির ব্যবহার করেছি সময়ের দাবি মেটাতে, চরিত্রগুলোকে সমকালীন করে তুলতে। এইসব বৈচিত্র্য রবীন্দ্রনাথের মূল ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় না, বরং তাঁর ভাবনার বিস্তারকেই আরও প্রাঞ্জল করে। কেননা রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন রূপান্তরের কবি। তিনি নিজেই বারবার নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, পাল্টেছেন। তাঁর গানে যেমন ‘আমি চাহি না রাজা হতে’, আবার কখনও ‘মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম’—এই দ্বৈততা তাঁর ভাবনার বহুমাত্রিকতা।
রবীন্দ্রনাথ: নাম নয়, এক ভাবনা
আমরা রবীন্দ্রনাথের গান শুনি, কবিতা পড়ি, বক্তৃতায় তাঁর কথা বলি—কিন্তু কতটুকু আত্মস্থ করি? কতটুকু তাঁকে বাস্তব জীবনে অনুসরণ করি? রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্যিক নন, তিনি এক প্রগতিশীল মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ধারক। তিনি যুক্তির পক্ষে ছিলেন, মানবতার পক্ষে ছিলেন, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ছিলেন। মেহনতি মানুষের কথা তাঁর রচনায় এসেছে স্পষ্টভাবে। সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির প্রতি তাঁর সহমর্মিতা, তাঁদের মুক্তির স্বপ্ন, সবই যেন আজকের সমাজের প্রতিচ্ছবি। এ কারণেই তাঁর নাটক ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’, কিংবা ‘রথের রশি’ আজও মঞ্চে অনুরণিত হয়। নতুন নতুন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে—তবু মূল চেতনায় অটুট থেকে যায় রবীন্দ্রনাথ। তিনি রবীন্দ্রনাথ কোনো একটি সময়ের শিল্পী নন। তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে, ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করা এক শাশ্বত দার্শনিক। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই যেন নতুন সময়ের নতুন প্রশ্নের উত্তর। আমরা যতই আধুনিক হই না কেন, যতই প্রযুক্তির উৎকর্ষে পৌঁছাই, তবুও রবীন্দ্রনাথের রচনায় বারবার ফিরে আসতে হয়। এই যুগেও যখন পৃথিবীজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদ, নারী নিপীড়ন, দুঃশাসন বিরাজ করছে—তখন রবীন্দ্রনাথই আমাদের কাছে হয়ে ওঠেন পথপ্রদর্শক। তাঁর ভাবনার আলোয় আমরা খুঁজে পাই নিজেকে, সমাজকে এবং মুক্তির সম্ভাবনাকে। এইজন্যই রবীন্দ্রনাথ আজও প্রাসঙ্গিক এবং অবিচ্ছেদ্য। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ব ধ নত র চর ত চর ত র আম দ র র ভ বন য ন হয় র ন টক ব রব র র জন ত ন টক র এই ন ট ভ বন র আজক র সময় র

এছাড়াও পড়ুন:

বান্দার তওবা যেভাবে কবুল হলো

তওবা মানে অনুতাপ বা প্রত্যাবর্তন। সুরা তওবা পবিত্র কোরআনের নবম সুরা। এই সুরা মদিনায় অবতীর্ণ হয়। এতে রয়েছে ১৬ রুকু, ১২৯ আয়াত। এই সুরাকে ‘তওবা’র পাশাপাশি ‘বারাআত’ (দায়মুক্তি) নামেও ডাকা হয়। এ সুরায় বিশ্বাসীদের তওবা কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য এটিকে সুরা তওবা বলা হয়। বারাআত বলার কারণ হলো, বারাআত অর্থ সম্পর্ক ছিন্ন করা। এতে অবিশ্বাসীদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তির কথা উল্লেখ রয়েছে।

পবিত্র কোরআনে শুধু এই সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লিপিবদ্ধ হয়নি। অনেকের মতে, এটি স্বতন্ত্র সুরা নয়, সুরা আনফালের শেষাংশ মাত্র। হজরত আলী (রা.)–এর মতে, এটি স্বতন্ত্র সুরা। কাফিরদের সঙ্গে তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য চুক্তি বাতিল করার ঘোষণা রয়েছে। অনেকের মতে, এ রকম ব্যাপারে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ব্যবহৃত হয় না।

 ইসলাম যে জয়যুক্ত হবে, এ বিষয়ে বিশ্বাসীদের তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত করা হয়েছে। সুরা তওবার ২৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যাদের ওপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা আল্লাহ বিশ্বাস করে না ও পরকালেও না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা যারা নিষিদ্ধ করে না ও সত্যধর্ম অনুসরণ করে না, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে যে পর্যন্ত না তারা বশ্যতা স্বীকার করে আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ স্বেচ্ছায় জিজিয়া দেয়।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ২৯)

আরও পড়ুনযে কারণে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়া হয়০৮ এপ্রিল ২০২৫

জাকাত প্রদানের আট খাত

আল্লাহ তাআলা এই সুরায় জাকাত প্রদানের খাত বর্ণনা করেছেন। যেমন ১. গরিব, যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। ২. মিসকিন, যার মালিকানায় কোনো সম্পদ নেই। ৩. ইসলামি সরকারের পক্ষ থেকে জাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তি। ৪. ইসলামের দিকে চিত্ত আকর্ষণের জন্য জাকাত দেওয়া। ৫. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। ৬. নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ দাস–দাসী। ৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী। ৮. মুসাফির, সফর অবস্থায় অভাবগ্রস্ত মানুষ। (সুরা তওবা, আয়াত: ৬০)

তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ

এই সুরার মাধ্যমে আল্লাহ মুসলমানদের তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ দেন। (সুরা তওবা, আয়াত: ৩৯)

 ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের নবম হিজরিতে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাবুক মদিনা ও দামেস্কের (সিরিয়া) মধ্যবর্তী একটি স্থান, যা মদিনা থেকে ৬৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের অবিশ্বাসী ও মুনাফিক দলের শেষ চেষ্টা ছিল এই যুদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর দূত হারেস বিন উমায়ের (রা.)–কে হত্যার মধ্য দিয়ে তাবুক যুদ্ধের সূচনা হয়। রাসুল (সা.) দূতের মাধ্যমে জানতে পারলেন, মুতা যুদ্ধের (মুসলিম ও রোমানদের যুদ্ধ) প্রতিশোধ নিতে একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে রোম। নবীজি আদেশ করেন, হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের আগে তিনি আক্রমণ করবেন। সবাইকে তৈরি হতে বলেন। এর আগে এমন রাজকীয় বাহিনীর মুখোমুখি তাঁরা কোনো দিন হননি।

 এদিকে মদিনায় তখন প্রচণ্ড গরম, খেজুর পাকার মৌসুম। সময়মতো খেজুর ঘরে তুলতে না পারলে মদিনায় খাদ্যের অভাবও দেখা দেবে। কিন্তু সবকিছু পেছনে ফেলে রাসুল (সা.) ৩০ হাজার সাহাবির কাফেলা নিয়ে চললেন তাবুক প্রান্তের দিকে। অনেকে যুদ্ধে যেতে চাইলেন না, কপটতার (মুনাফিক) পরিচয় দেন। হিরাক্লিয়াস মুসলমানদের অভিযানের সংবাদ পেয়ে রণেভঙ্গ দেন।

 তাবুক থেকে ফেরার পথে জু–আওয়ান নামক স্থানে ‘মসজিদে জিরার’ বলে অভিহিত ষড়যন্ত্রকারীদের একটি স্থাপনা ধ্বংস করে দেন তিনি। মূলত মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য খ্রিষ্টান পাদরি আবু আমিরের উসকানিতে কিছু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণের ভান করে ওই মসজিদ বানিয়েছিল। তাবুক থেকে ফেরার পথে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ আয়াত নাজিল করেন, ‘আর যারা মসজিদ তৈরি করেছে ক্ষতিসাধন, কুফুরি আর মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, আর যে ব্যক্তি আগে থেকেই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের নিমিত্তে, তারা অবশ্যই শপথ করবে যে, আমাদের উদ্দেশ্য সৎ ব্যতীত নয়। আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তারা নিশ্চিত মিথ্যাবাদী।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ১০৭)

আরও পড়ুনযাঁর নামে কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে০৮ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্বাসী ও কপটদের বৈশিষ্ট্য

সুরা তওবায় তাবুক যুদ্ধে অংশ না নেওয়া মুনাফিকদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ১. মিথ্যা অজুহাত পেশ করে। ২. টালবাহানা করে। ৩. হাস্যকর কথা বলে জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি আদায় করে। ৪. মুসলিম সমাজে অনিষ্ট ছড়ায়। ৫. মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা–বিদ্বেষ ছড়ায় ও মুসলমানদের বিপদে আনন্দ প্রকাশ করে। ৬. মিথ্যা শপথ করে। ৭. সম্পদ পেলে আনন্দ পায়, না পেলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। ৮. আল্লাহর মহব্বত, আল্লাহর জিকির ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধশূন্য অন্তর। ৯. নবীজি (সা.)–কে গালমন্দ করে। ১০. একে অপরকে মন্দ কাজের আদেশ দেয়, ভালো কাজ থেকে নিষেধ করে। ১১. কৃপণ। (সুরা তওবা, আয়াত: ৪২ থেকে ৫৯)

আল্লাহ বিশ্বাসীদের কিছু গুণের কথাও বলে দিয়েছেন। যেমন ১. যারা তওবা করে। ২. উপাসনা করে। ৩. আল্লাহর প্রশংসা করে। ৪. রোজা রাখে। ৫. রুকু করে। ৬. সিজদা করে। ৭. ভালো কাজের নির্দেশ দেয়। ৮. অসৎকর্মে নিষেধ করে। ৯. আল্লাহর সীমারেখা মেনে চলে। (সুরা তওবা, আয়াত: ১১২)

তবে তিনজন সাহাবি, যাঁরা মুনাফিক নন, কিন্তু অলসতাবশত তাবুকে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁদের সঙ্গে বর্জনের নির্দেশ দিয়েছিলেন রাসুল (সা.)। তাঁরা হলেন, কা’আব ইবনে মালিক, হিলাল ইবনে উমাইয়া ও মুরারা ইবনে রুবাই। আল্লাহ তাআলা তাঁদের ক্ষমার ঘোষণা দেন এই সুরায়, ‘আর তিনি অপর তিনজনকেও ক্ষমা করলেন, যাদের পেছনে ফেলে আসা হয়েছিল। পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য তা ছোট হয়ে আসছিল এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে আল্লাহ ছাড়া কোনো আশ্রয় নেই। পরে আল্লাহ তাদেরকে অনুগ্রহ করলেন, যাতে তারা অনুতপ্ত হয়। আল্লাহ তো ক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ১১৮)

আরও পড়ুনযে কারণে দোয়া ইউনুস পড়া হয় ০৯ মার্চ ২০২৫

আবু লুবাবার (রা.) তওবা

মসজিদে নববির ভেতরে কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে, সেগুলোকে রহমতের স্তম্ভ বা খুঁটি বলা হয়। উস্তুওয়ানা আবু লুবাবা (তওবা স্তম্ভ) উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর অবস্থিত। একটি ভুল করার পর তিনি নিজেকে এই স্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত হুজুরে পাক (সা.) নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সঙ্গে বাঁধা থাকব।’ রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে আল্লাহ আদেশ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত খুলব না।’ এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর এই সুরার আয়াত নাজিল হয় এবং তাঁর ক্ষমার ঘোষণা আসে, ‘আর কিছু লোক নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছে, ওরা এক ভালো কাজের সঙ্গে আরেক খারাপ কাজ মিশিয়ে ফেলেছে। আশা করা যায়, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ ( সুরা তওবা, আয়াত: ১০২–৩)

অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে তাঁর বাঁধন খুলে দেন।

আরও পড়ুনসুরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের বিশেষ ফজিলত০৭ মার্চ ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ