রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- নামটি শুধু একটি ব্যক্তির পরিচয় নয়; এটি এক যুগান্তকারী চেতনার নাম। তিনি শুধুমাত্র কবি, নাট্যকার, সংগীতস্রষ্টা বা দার্শনিক নন। এক বিস্ময়ের নাম। আজকের এই অস্থির, অসহিষ্ণু এবং বিভেদের সময়ে বারবার ফিরে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটক কিংবা ছোটগল্প—সবখানে যে মনন, যুক্তি, মমতা, প্রতিবাদ তা আজও সমান জরুরি। 
আধুনিকতার ছোঁয়ায় রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতা বলতে যা বোঝাতে চেয়েছেন, তা নিছক প্রযুক্তিগত নয়; বরং এক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মননের প্রকাশ। আমরা যতই আধুনিক দাবি করি না কেন, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির মতো মুক্তচিন্তা আজও আমাদের অনেকের মধ্যে অনুপস্থিত। তাঁর লেখা নাটক, গল্প, উপন্যাস, কবিতাগুলো যদি আমরা মনোযোগ দিয়ে পড়ি, বুঝি এবং বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমরা অনুভব করব, এগুলো যেন এই সময়ের জন্যই রচিত। তাঁর নাট্যকর্মে যে বোধ, প্রতিবাদ এবং যে মানবিকতা- তা সময়কে অতিক্রম করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আধুনিক, এমনকি উত্তর-আধুনিক বললেও অত্যুক্তি হয় না। তিনি সেই সময়েই শিক্ষা, নারীর স্বাধীনতা, শিল্পের মর্যাদা, মানবাধিকার, বর্ণবৈষম্য, উপনিবেশবাদ, ধর্মান্ধতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে যে ধরনের কথা বলেছিলেন, তা আজও আমাদের জন্য বিস্ময়কর। আমরা যাকে আজ ‘মডার্নিটি’ বলি-তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চর্চার একটি গভীর যোগ রয়েছে। 
নাট্যভাবনার ভিন্ন দিগন্ত
রবীন্দ্রনাথের নাটকে বারবার উঠে এসেছে মানবমুক্তি, চিন্তার স্বাধীনতা এবং অচলায়তন ভাঙার আহ্বান। কুসংস্কার, দুঃশাসন, ধর্মান্ধতা এবং অন্ধ আনুগত্যের বিরুদ্ধে তিনি বারবার সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর ‘রক্তকরবী’, ‘অচলায়তন’, ‘রাজা’, ‘রথের রশি’ কিংবা ‘বিসর্জন’-সব নাটকেই রয়েছে একটি গভীর প্রতীকী বক্তব্য। নারীকে তিনি কখনও করুণা বা আশ্রয়ের প্রতীক হিসেবে দেখাননি, বরং তাঁর নাটকে নারী হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এক মৃত্যুঞ্জয়ী নারী, যিনি অন্ধকারের বিপরীতে আলোর প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের নাট্যজগৎ তাঁর অন্য সৃষ্টির চেয়ে ভিন্নতর এবং অনেক বেশি প্রগতিশীল। তাঁর নাটকে কেবল বিনোদন বা মনোরঞ্জনের বিষয় নেই- বরং রয়েছে চিন্তার খোরাক, সামাজিক প্রতিবাদ এবং একটি পরিবর্তনের আহ্বান। নাটককে তিনি ব্যবহার করেছেন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক প্রজ্ঞাবান অস্ত্র হিসেবে।
নাট্যকর্মী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শ
ব্যক্তিগতভাবে আমি রবীন্দ্রনাথের নাট্যকর্ম নিয়ে বিশেষ গবেষণা করেছি, এমন নয়। তবে মঞ্চে কাজ করেছি তাঁর দুটি নাটকে- ‘রাজা’ ও ‘অচলায়তন’। এই দুটিই প্রতীকী নাটক এবং এই নাট্যরূপায়ণে আমরা সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি রবীন্দ্রনাথকে। 


এই নাটকগুলো মঞ্চস্থ করার অভিজ্ঞতা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে—কারণ, এগুলো নিছক নাটকের গল্প নয়, বরং এক একটি দর্শন। 
রাজা: রূপকথা থেকে সমসাময়িক রাজনীতি
‘রাজা’ নাটকটি যখন প্রথম পড়ি, এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। যেন এক রূপকথার অদৃশ্য রাজা, যার শাসনপদ্ধতি রহস্যে মোড়া, সৌন্দর্য ও বেদনায় আচ্ছাদিত। তবে এই অনুভূতির সঙ্গে জুড়ে যেতে থাকে আমাদের সময়, বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। ৯/১১ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করেই মনে হলো, ‘রাজা’ নাটকের কাঞ্চিরাজ যেন হয়ে উঠছে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অজুহাতে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দোসর রাষ্ট্রগুলো এক ধরনের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসন চালিয়েছে, সেটি যেন ‘রাজা’ নাটকের প্রতিধ্বনি। আমরা ‘রাজা এবং অন্যান্য…’ নামক প্রযোজনায় কাঞ্চিরাজকে উপস্থাপন করেছি আধিপত্যবাদী শক্তির প্রতীক হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান, রাশিয়ার সংঘাত, ফ্রান্সের নিস্পৃহতা কিংবা হিটলার-লাদেনের চরিত্রকেও নাটকে প্রতীকীভাবে মঞ্চে এনেছি। উদ্দেশ্য ছিল, নাটকের প্রতিটি চরিত্র যেন হয়ে ওঠে বাস্তব রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। এভাবে ‘রাজা’ নাটক হয়ে উঠেছে একটি মুক্তির প্রতীক। এটি কোনো কাল্পনিক রাজার গল্প নয়, বরং শোষিত মানুষের মনের গভীরে লুকানো এক আশার প্রতিমূর্তি—যে মুক্তি চায়, আলো চায়, সত্য চায়। ‘রাজা’ নাটকের মধ্যে আমি দেখতে পেয়েছি আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আগ্রাসী রাজনীতি, একচ্ছত্র আধিপত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ওপর দখল—এসব যেন রবীন্দ্রনাথ আগেই দেখতে পেয়েছিলেন।  এই নাট্য প্রযোজনায় আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার করেছি সময়ের প্রয়োজনে। চরিত্রদের চলাফেরা সবই আজকের বাজারকেন্দ্রিক দুনিয়ার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এ সবই রবীন্দ্রনাথকে ছেঁটে ফেলার জন্য নয়, বরং তাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার প্রয়াস। কারণ, আমাদের সবার ভেতরেই এক সুদর্শনা আছে—যে সত্য জানতে চায়, বুঝতে চায় এবং সত্যের পাশে দাঁড়াতে চায়। নাটকের শেষ দৃশ্যে কাঞ্চিরাজের চিৎকার—“সব বন্ধ করো। আলো দাও! আলো! আলো! আলো!”—সে যেন আজকের পৃথিবীর আর্তনাদ।
অচলায়তন: অচলতা ভাঙার কথা
রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ মূলত ছেলেদের বিদ্যালয় নিয়ে লেখা হলেও আমরা নাট্যরূপ দিয়েছি এক রক্ষণশীল নারী বিদ্যালয়। কারণ, নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতা আজও যতটা প্রাতিষ্ঠানিক, ততটাই অনভ্যস্ত। সামাজিক বিধিনিষেধ, রীতি, সম্মান, ভয় ও ভ্রান্ত ধারণায় আজও নারী নিজেকে খুঁজে ফেরে। আমাদের ভাবনায় ‘অচলায়তন’ একটি সময়বিহীন জগৎ, যেখানে নিয়ম মানে নিয়ম নয়—একটি অন্ধ অনুশাসন। সেই সমাজে প্রশ্ন নেই, যুক্তি নেই, প্রাণ নেই—শুধু আনুগত্য আর নিষ্ক্রিয়তা। সমাজে পশ্চাৎপদতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় নারীর ক্ষেত্রেই। নারীকে একাধিক বিধিনিষেধে বেঁধে রাখার পেছনে রয়েছে এক গভীর সামাজিক ষড়যন্ত্র, যেখানে নারী নিজেও অনেক সময় অংশ নেয়। আমরা দেখেছি, অচলায়তনের নিয়ম এতটাই যান্ত্রিক ও মন্থর যে সেখানকার শিক্ষার্থীরা যেন হয়ে উঠেছে দম দেওয়া পুতুল। অন্যদিকে অচলায়তনের বাইরের জগতে মানুষ কর্মমুখর, প্রাণবন্ত ও স্বাধীন। এই দ্বৈত বাস্তবতাই আমাদের প্রযোজনার মূল উপজীব্য। এখানে চরিত্ররা হতে পারে গতকালের, আজকের বা ভবিষ্যতের। পঞ্চক নামের চরিত্রটি একসময় ছিল বিদ্রোহী, পরে হয়ে উঠেছে ভাঙনের প্রবর্তক। দাদাঠাকুর, যিনি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুক্তির আহ্বান জানাচ্ছেন, আমাদের বলে যান—শিক্ষা যেন হয় আনন্দের, মুক্তির এবং বোধের উৎস। এই নাটকে আমরা পঞ্চককে দেখিয়েছি বিদ্রোহী হিসেবে, যিনি পরবর্তীতে সেই ব্যবস্থারই ধারক হয়ে ওঠেন। দাদাঠাকুর চরিত্রটি হয়ে ওঠে এক মানবিক বিদ্রোহের প্রতীক—যিনি আসলে আমাদের বলে যান, “শিক্ষা মানেই বই মুখস্থ নয়, বরং নিজেকে আবিষ্কারের চাবিকাঠি।”
নারী ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের নারীচরিত্রগুলো—চিরায়ত বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। তিনি নারীকে কেবল প্রেমিকা, জননী বা ভোগ্য বস্তু হিসেবে দেখেননি। বরং নারীকে দিয়েছেন নিজস্ব চিন্তা, অধিকার, প্রতিবাদ ও অভিমান। ‘নন্দিনী’ যেন এক নারী নয়, এক চলমান বিদ্রোহ। ‘অচলায়তন’-এর শিক্ষার্থীরা কেবল পাঠরত নয়, তারাও বিপ্লবের সম্ভাবনা। এই চেতনাই আমাদের প্রযোজনায় স্থান পেয়েছে। কারণ আমরা মনে করি, যদি সমাজ বদলাতে হয়, তবে নারীকেই সেই বদলের মুখ হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বহু আগে এই সত্য বুঝেছিলেন, যা আজও অনেকের বোধগম্য হয়নি।
প্রযুক্তি ও নাট্যরূপ
আমরা মঞ্চে প্রযুক্তির ব্যবহার করেছি সময়ের দাবি মেটাতে, চরিত্রগুলোকে সমকালীন করে তুলতে। এইসব বৈচিত্র্য রবীন্দ্রনাথের মূল ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় না, বরং তাঁর ভাবনার বিস্তারকেই আরও প্রাঞ্জল করে। কেননা রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন রূপান্তরের কবি। তিনি নিজেই বারবার নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, পাল্টেছেন। তাঁর গানে যেমন ‘আমি চাহি না রাজা হতে’, আবার কখনও ‘মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম’—এই দ্বৈততা তাঁর ভাবনার বহুমাত্রিকতা।
রবীন্দ্রনাথ: নাম নয়, এক ভাবনা
আমরা রবীন্দ্রনাথের গান শুনি, কবিতা পড়ি, বক্তৃতায় তাঁর কথা বলি—কিন্তু কতটুকু আত্মস্থ করি? কতটুকু তাঁকে বাস্তব জীবনে অনুসরণ করি? রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্যিক নন, তিনি এক প্রগতিশীল মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ধারক। তিনি যুক্তির পক্ষে ছিলেন, মানবতার পক্ষে ছিলেন, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ছিলেন। মেহনতি মানুষের কথা তাঁর রচনায় এসেছে স্পষ্টভাবে। সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির প্রতি তাঁর সহমর্মিতা, তাঁদের মুক্তির স্বপ্ন, সবই যেন আজকের সমাজের প্রতিচ্ছবি। এ কারণেই তাঁর নাটক ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’, কিংবা ‘রথের রশি’ আজও মঞ্চে অনুরণিত হয়। নতুন নতুন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে—তবু মূল চেতনায় অটুট থেকে যায় রবীন্দ্রনাথ। তিনি রবীন্দ্রনাথ কোনো একটি সময়ের শিল্পী নন। তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে, ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করা এক শাশ্বত দার্শনিক। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই যেন নতুন সময়ের নতুন প্রশ্নের উত্তর। আমরা যতই আধুনিক হই না কেন, যতই প্রযুক্তির উৎকর্ষে পৌঁছাই, তবুও রবীন্দ্রনাথের রচনায় বারবার ফিরে আসতে হয়। এই যুগেও যখন পৃথিবীজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদ, নারী নিপীড়ন, দুঃশাসন বিরাজ করছে—তখন রবীন্দ্রনাথই আমাদের কাছে হয়ে ওঠেন পথপ্রদর্শক। তাঁর ভাবনার আলোয় আমরা খুঁজে পাই নিজেকে, সমাজকে এবং মুক্তির সম্ভাবনাকে। এইজন্যই রবীন্দ্রনাথ আজও প্রাসঙ্গিক এবং অবিচ্ছেদ্য। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ব ধ নত র চর ত চর ত র আম দ র র ভ বন য ন হয় র ন টক ব রব র র জন ত ন টক র এই ন ট ভ বন র আজক র সময় র

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ