ফ্যাসিস্ট শাসকের পলায়ন গণতন্ত্রের প্রাথমিক বিজয়: আলী রীয়াজ
Published: 12th, May 2025 GMT
চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শাসকের পলায়নের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাথমিক বিজয় নিশ্চিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এখন বিজয়ের লক্ষ্য পূরণে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অগ্রসর হতে হবে বলেও জানান তিনি।
সোমবার (১২ মে) সংসদ ভবনের এল. ডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের আলোচনার শুরুতে এসব কথা বলেন তিনি।
এ সময় কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো.
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “গত ৫৩ বছর ধরে এ দেশের মানুষ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে সংগ্রাম করেছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি বলে জনগণ এ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত থেকেছেন।”
কমিশনের লক্ষ্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশের রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোসহ নাগরিক সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখা। এই ঐক্যকে সুদৃঢ় করে একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা।”
সুযোগ বার বার আসেনা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা একটা ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে আছি। স্বাধীনতার পর এমন সুযোগ আর কখনো আসেনি৷ তাই অপূর্ণ স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।”
গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের সমন্বয়ক এবং সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে আলোচনায় বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল এম. এল এর সভাপতি কমরেড হারুন চৌধুরী, সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টির সভাপতি কমরেড আলি হোসেন, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল- পিডিপি'র মহাসচিব হারুন আল রশীদ খান এবং সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ডাক্তার সামছুল আলম-সহ ২০ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেন৷
ঢাকা/এএএম/ইভা
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণত ন ত র ক
এছাড়াও পড়ুন:
স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের
প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগররাষ্ট্র ছিল। সেখানে নগরের অধিবাসীকেই বলা হতো নাগরিক, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সেই সব ব্যক্তিকে নাগরিক বলব, যাদের আইন প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে।’ তাঁর মতে, যে ব্যক্তি নগররাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে অক্ষম, তিনি প্রকৃত নাগরিক নন।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিককে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—যেকোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়ের সঙ্গে পালন করেন, তাঁকেই নাগরিক বলা যায়। একই সঙ্গে নাগরিককে অবশ্যই অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।
প্রতিটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সৎ, যোগ্য ও নীতিবান নাগরিক। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নাগরিকের চরিত্র ও আচরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক—যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত। এ জ্ঞান ও সচেতনতাই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন, তবে কি গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে? বাস্তবতা হলো নাগরিকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাই স্বৈরতন্ত্রকে জন্ম দেয়।
প্রথমত, যেখানে মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, সেখানে শাসকগোষ্ঠী সহজেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন—এসব বিষয়ে নাগরিক উদাসীন থাকলে শাসকের জবাবদিহি বিলীন হয়ে যায়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকলেও এর প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, নাগরিকেরা ভয়, অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যখন অন্যায় ও অনিয়ম মেনে নেন, তখনই স্বৈরতন্ত্র শিকড় গাড়ে। শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিলে সরকার জবাবদিহি এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—শক্তিশালী শাসকের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় কেবল তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি থেকে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অতীত—সবখানেই দেখা যায়, নাগরিক–সচেতনতার অভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল।
তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ দুর্বল হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন কিংবা নাগরিক সংগঠনগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন শাসকেরা সহজেই বিকল্প কণ্ঠরোধ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অর্থাৎ, নাগরিকের নীরবতাই শাসকের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়।
অতএব, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নাগরিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষকে জানতে হবে তাদের অধিকার, কর্তব্য ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার উপায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে হবে সত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, তোষণ বা প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়। মনে রাখতে হবে—অধিকার চর্চা না করলে অধিকার হারিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা ও তা প্রয়োগ করা।
সবশেষে বলা যায়, নাগরিকের অধিকার বিষয়ে অসচেতনতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; বরং তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর। সচেতন নাগরিক সমাজই পারে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে আর অসচেতন নাগরিক সমাজই সৃষ্টি করে স্বৈরতন্ত্রের জন্মভূমি।
ইসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়