আইএমএফের শর্তে ‘বাজারভিত্তিক’ করার পর আজ ডলারের দাম কত
Published: 15th, May 2025 GMT
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুসারে, ডলারের দাম ‘বাজারভিত্তিক’ করার সিদ্ধান্তের পর আজ বৃহস্পতিবার ডলারের বাজারে তেমন প্রভাব নেই। আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত দেশের ডলারের বাজারে তেমন কোনো প্রভাব এখন পর্যন্ত পড়েনি। ব্যাংকগুলো আগের দামে প্রবাসী আয় কিনছে এবং ডলার বিক্রি করছে, যা ১২৩ টাকার মধ্যে রয়েছে।
অন্যদিকে খোলাবাজারে দাম কিছুটা বেড়েছে। খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা ১২৪ টাকা ৭০ পয়সা দামে ডলার কিনছেন এবং ১২৫ টাকা দামে বিক্রি করছেন। তবে ব্যাংকগুলোতে ডলার আগের মতো বিক্রি হচ্ছে ১২৩ টাকা দামেই। তবে ডলারের দাম নিয়ে ব্যবসায়ী ও বিদেশ ভ্রমণে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের মধ্যে আগ্রহ দেখা গেছে।
আজ সকাল থেকে দেশের শীর্ষ পাঁচটি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা জানা যায়, ব্যবসায়ীসহ গ্রাহকেরা ডলারের খবর জানতে অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে বেশি খোঁজখবর করছেন। অনেকে ডলার কেনার জন্য ব্যাংকে গেছেন। আবার খোলাবাজারেও একটু চাপ দেখা গেছে। অনেকে বাড়তি মুনাফার আশায় ডলার মজুত করার পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোতে পাঁচ কোটি ডলারের নগদ মুদ্রা মজুত আছে। তাই যে কেউ গেলেই ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে। তাই গ্রাহকেরা যাতে বাজার থেকে বেশি দামে ডলার না কেনেন, এমন পরামর্শ দেন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো আজ বাড়তি দাম ‘অফার’ করেনি। বেশি দাম চাওয়া কয়েকটি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার না কেনার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম বলে জানান তাঁরা।
অন্যদিকে ঈদকে সামনে রেখে বেশি প্রবাসী আয় আসছে। পাশাপাশি নগদ ডলার দেশে ঢুকছে। এতে ঈদের আগে কোনোভাবেই ডলারের বাজার অস্থির হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন।
গতকাল বুধবার দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ সম্মেলনে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা ঘোষণা দেন। মূলত আইএমএফের ঋণের কিস্তি ছাড়ের শর্ত হিসেবে এই উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে দাম কী হবে, তা ব্যাংক ও গ্রাহকের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ডলারের দাম আরও বাজারভিত্তিক হবে, সঙ্গে থাকবে জোরদার তদারকি।
গতকালে সংবাদ সম্মেলনে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাজারভিত্তিক মানে এই নয় যে ডলার যেকোনো দামে কেনাবেচা হবে। আমাদের সরবরাহ পরিস্থিতি এবং পূর্বাভাস অনুযায়ী, যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে হবে। বড় ধরনের প্রয়োজন দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা করবে। ডলারের বাজারে কোনো সিন্ডিকেট বরদাশত করা হবে না। ডলারের দাম দুবাইয়ে নয়, দেশেই নির্ধারিত হবে।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতের আপত্তির পরও কেন আইএমএফের ঋণের কিস্তি পেল পাকিস্তান
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি পাকিস্তানকে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তা অনুমোদন দিয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন সামরিক উত্তেজনা চরমে, তখন এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দিল্লি। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে অপ্রত্যাশিত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে।
ভারতের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদ ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেয়। সংস্থাটির মতে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে এবং দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় পাকিস্তানের সক্ষমতা বাড়াতে ভবিষ্যতে আরও ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি ডলারের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে আইএমএফ।
তবে আইএমএফের এই কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত। এক বিবৃতিতে দিল্লি দুটি প্রধান উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে। প্রথমত, পাকিস্তানের সংস্কার বাস্তবায়নে অতীতের দুর্বল ইতিহাসের কথা তুলে ধরে তারা প্রশ্ন তোলে, এ ধরনের আর্থিক সহায়তা কতটা কার্যকর?
দ্বিতীয়ত, ভারতের আশঙ্কা, এই অর্থ ‘রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট আন্তদেশীয় সন্ত্রাসবাদে’ ব্যবহৃত হতে পারে—যে অভিযোগ ইসলামাবাদ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। ভারতের মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আইএমএফসহ অন্য দাতাদের ‘সুনামের ঝুঁকি’ তৈরি করছে এবং একই সঙ্গে তা ‘আন্তর্জাতিক মূল্যবোধকে হাস্যকর করে তুলছে’।
বিবিসির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলেও আইএমএফ প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এদিকে পাকিস্তানের অনেক বিশেষজ্ঞও ভারতের প্রথম উদ্বেগকে পুরোপুরি অযৌক্তিক মনে করছেন না। তাদের মতে, ১৯৫৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৪ বার আইএমএফের সহায়তা নেওয়ার পরও পাকিস্তানে কাঠামোগত বড় পরিবর্তন আসেনি।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি বলেন, আইএমএফের কাছে যাওয়ার অর্থ হলো, হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হওয়া। কেউ যদি ২৪-২৫ বার আইসিইউতে যায়, তাহলে বোঝা যায়, শরীরে বড় সমস্যা আছে, যা বারবার ফিরে আসছে।
ভারতের আপত্তি কেন ধোপে টিকল না
দিল্লির আরও যে অভিযোগ ছিল, অর্থাৎ আইএমএফ আন্তদেশীয় সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়া একটি দেশকে পুরস্কৃত করছে এবং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে বিপজ্জনক বার্তা দিচ্ছে—বিষয়টি আরও জটিল ও সংবেদনশীল। সম্ভবত এই জটিলতার কারণে ভারত চাইলেও এই ঋণের কিস্তি থামাতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত যে এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা থেকে বাস্তব ফল পাবে, তা হয়তো ভাবেনি, বরং এর লক্ষ্য ছিল কৌশলগত বার্তা দেওয়া। ভারতের পর্যবেক্ষণ, আইএমএফের কাঠামোগত ও প্রক্রিয়াগত সীমাবদ্ধতার কারণে তেমন কিছু করার অবস্থানে তারা ছিল না।
আইএমএফ পর্ষদের ২৫ সদস্যের একজন হলেও সেখানে ভারতের প্রভাব সীমিত। ভারত চার দেশের গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে এই পর্ষদে—তারা ছাড়া বাকি তিনটি দেশ হলো শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও ভুটান। অন্যদিকে পাকিস্তান মধ্য এশিয়া গোষ্ঠীর অংশ, যে গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে ইরান।
জাতিসংঘের ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতির বিপরীতে আইএমএফের পর্ষদে ভোটাধিকার নির্ধারিত হয় সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতির আকার ও অর্থনৈতিক অবদানের ভিত্তিতে। এ ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনার মুখে পড়ছে।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ভোটের হিস্যা ১৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যেখানে ভারতের মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রস্তাবের বিপক্ষে সরাসরি ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। সদস্যরা কেবল পক্ষে ভোট দিতে পারেন বা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। সিদ্ধান্তগুলো পর্ষদের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই গৃহীত হয়।
এ বিষয়ে এক অর্থনীতিবিদের বক্তব্য, এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২৩ সালে ভারতের জি-২০ সভাপতিত্বকালীন এই বৈষম্য দূর করা ছিল আইএমএফ ও অন্যান্য বহুপক্ষীয় ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সংস্কারের অন্যতম মূল প্রস্তাব।
সেই প্রতিবেদনে ভারতের সাবেক আমলা এন কে সিংহ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অর্থমন্ত্রী লরেন্স সামার্সের প্রস্তাব ছিল এ রকম: আইএমএফে ভোটাধিকার যেন আর শুধু আর্থিক অবদানের ওপর নির্ভর না করে, সেখানে যেন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। যদিও এই সুপারিশ বাস্তবায়নে এখনো অগ্রগতি হয়নি।
এ ছাড়া যুদ্ধরত দেশগুলোকে অর্থসহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের সাম্প্রতিক নীতিগত পরিবর্তনের কারণে বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে। ২০২৩ সালে ইউক্রেনকে দেওয়া ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের ঋণ ছিল যুদ্ধরত কোনো দেশকে দেওয়া আইএমএফের প্রথম সহায়তা।
দিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের মিহির শর্মা বলেন, ‘আইএমএফ ইউক্রেনকে ঋণ দেওয়ার জন্য নিজের নিয়মই শিথিল করেছে। একই যুক্তিতে পাকিস্তানের পূর্বনির্ধারিত ঋণ আটকে দেওয়া এখন আর সম্ভব নয়।
ধূসর তালিকা থেকে বেরিয়ে গেছে পাকিস্তান
হোসেইন হাক্কানি বলেন, ভারত যদি প্রকৃত অর্থেই পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে তুলে ধরতে চায়, তাহলে তা করার সঠিক মঞ্চ আইএমএফ নয়, বরং জাতিসংঘের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)। এটি মূলত সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও অর্থ পাচার রোধে কাজ করে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে ‘ধূসর’ বা ‘কালো’ তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তালিকাভুক্ত হলে সেই দেশ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেমন আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক থেকে অর্থসহায়তা পেতে বড় ধরনের বাধার মুখে পড়ে।
আইএমএফকে কূটনৈতিক চাপ দিয়ে কিছু আদায় করা সম্ভব নয়, অতীতে তা হয়নি, এখনো হবে না,’ মন্তব্য করেন হাক্কানি। এফএটিএফ যদি কোনো দেশকে তালিকাভুক্ত করে, তবেই আইএমএফ ঋণ পেতে সমস্যার মুখে পড়ে, যেমনটা এক সময় পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছিল।’ কিন্তু মনে রাখা দরকার, পাকিস্তান ২০২২ সালেই এফএটিএফের ধূসর তালিকা থেকে বেরিয়ে গেছে।
অন্যদিকে আইএমএফের অর্থায়নপ্রক্রিয়া ও ভোটাধিকার সংস্কারের যে দাবি ভারত তুলছে, তা নিয়েও সতর্কবার্তা দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, এমন পরিবর্তন হলে লাভবান হতে পারে চীন, ভারত নয়। মিহির শর্মা বলেন, এ ধরনের সংস্কার বাস্তবায়িত হলে দিল্লির চেয়ে বরং বেইজিংয়ের প্রভাব আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে হাক্কানিরও অভিমত, বহুপক্ষীয় ফোরামে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ টেনে আনা ভারতের জন্য সব সময় সুফল বয়ে আনেনি। অতীতে এ ধরনের উদ্যোগে ভারতই উল্টো চীনের ভেটোর মুখে পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ভারতের অরুণাচল প্রদেশে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়ন চীন কীভাবে সীমান্ত বিরোধ দেখিয়ে আটকে দিয়েছিল।