গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের ১৯ মাস পেরিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের সামরিক অভিযান তার মূল কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল এই অভিযানের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন, বিশেষ করে হামাসকে নির্মূল করে দেওয়া। শুরু থেকেই পশ্চিমা শক্তিগুলো ইসরায়েলের এই আক্রমণকে প্রায় নিঃশর্তভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে। তারা বলেছে, এটা ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার জন্য’ বৈধ পদক্ষেপ।
কিন্তু পশ্চিমাদের এই সমর্থন এবং স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করার পরও ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভাঙতে পারেনি ইসরায়েল। গাজা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো তাদের কর্মকাণ্ড সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। তারা অব্যাহতভাবে রকেট ছুড়ছে। সামরিক বিবেচনায় জটিল অভিযানও তারা পরিচালনা করছে।
যেমন গত মাসে গাজার বেইত হানুনের কাছে তারা হামলা চালিয়েছে। হামাস যোদ্ধারা একটি সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে ইসরায়েলি সামরিক যান লক্ষ্য করে আক্রমণ করে। এতে তিনজন ইসরায়েলি সেনা আহত হয়। উদ্ধারকারী বাহিনী সেখানে পৌঁছালে হামাস যোদ্ধারা বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে একজন ওয়ারেন্ট অফিসার নিহত হন।
আরও পড়ুনইসরায়েল এখনো বুঝতে পারছে না, তারা যুদ্ধে হেরে গেছে১৯ মে ২০২৫ইসরায়েল বারবার দাবি করে আসছে, বেইত হানুনের মতো এলাকাগুলো ‘নিরপেক্ষ’ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক আক্রমণ একটা কৌশলগত বার্তা দিল। সেটা হলো, বিরামহীন বোমা হামলা ও সীমাহীন দখলদারির মধ্যেও হামাস গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করতে ও লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে হামলা করতে সক্ষম। এভাবেই তারা বিশ্বের সবচেয়ে প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা একটা সেনাবাহিনীকে কৌশলে ঘায়েল করে চলেছে।
এখানেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের সঙ্গে গাজা যুদ্ধের তুলনাটা প্রাসঙ্গিক। সেই যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ছিল—উন্নত অস্ত্রশক্তি ও বাইরের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও মতাদর্শিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত প্রতিরোধী শক্তিকে পরাজিত করা যায় না। গাজা যুদ্ধ ক্রমাগত ইসরায়েলের ভিয়েতনাম যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান সংকটের মুখে পড়ছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ এবং একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানো চলছে। গাজায় বিপর্যয়ের কারণে সমালোচনার যে ঝড় উঠছে, সেটা সামাল দিতে নেতানিয়াহু এখন দোষ চাপাচ্ছেন অন্যদের ঘাড়ে। যেমন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের ওপর তিনি দোষ চাপিয়েছেন। সবচেয়ে নাটকীয় বিরোধটা দেখা গেছে গোয়েন্দা খাতে।গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ব্যর্থতা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই। দেশটির রাজনীতি ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার গভীরে সেটা বিস্তৃত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান সংকটের মুখে পড়ছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ এবং একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানো চলছে। গাজায় বিপর্যয়ের কারণে সমালোচনার যে ঝড় উঠছে, সেটা সামাল দিতে নেতানিয়াহু এখন দোষ চাপাচ্ছেন অন্যদের ঘাড়ে। যেমন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের ওপর তিনি দোষ চাপিয়েছেন। সবচেয়ে নাটকীয় বিরোধটা দেখা গেছে গোয়েন্দা খাতে।
ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট হারেৎসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সতর্ক করে বলেছেন, ‘ইসরায়েল এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি।’ এই প্রেক্ষাপটে হামাসের সাম্প্রতিক আক্রমণ সামরিক ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও বেশি কিছু। এটা ভেতর থেকে ইসরায়েলে যে ফাটল ধরেছে, সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন। এই ভাঙন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরেও পৌঁছে গেছে। দ্য নিউ আরব–এর খবর জানাচ্ছে, সেনাবাহিনীর ভেতরে অসন্তোষ বেড়ে চলেছে।
ইসরায়েলের জন্য আরেকটি নাজুক জায়গা হলো গাজা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপ। যুদ্ধ পরিচালনার খরচ, অবরোধ বজায় রাখা ও আঞ্চলিক হুমকির জবাব দিতে গিয়ে ইসরায়েলি অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে।
যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। ইসরায়েলের মূল খাতগুলোর ওপর এই অর্থনৈতিক চাপ পড়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। এই খাত ইসরায়েলের রাজস্ব আয়ের বড় উৎস। সীমান্তের ওপার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঝুঁকির কারণে ইসরায়েল এখন ব্যবসা বা ভ্রমণের জন্য নিরাপদ গন্তব্য নয়।
এটা পরিষ্কার যে ইসরায়েলের সঙ্গে দেশটির প্রধান মিত্রদের বিভাজনটা ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলি আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর আহ্বানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বছরে চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করে। ইসরায়েলের যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে ট্রাম্প হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি এই সংঘাতের অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন।
সবকিছুর বিচারে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এই যুদ্ধের সঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাদৃশ্য দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। বিশ্ব এটা মেনে নিক বা না নিক, গাজা এখন ইসরায়েলের ভিয়েতনাম হয়ে উঠেছে।
● মেহমেত রাকিপওগ্লু তুরস্কের মারদিন আরতুকলু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
মিডলইস্ট আই ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র লক ষ য মন ত র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক কমেছে, বাংলাদেশে স্বস্তি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর দেশটির আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এ কথা বলা হয়। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহার কমে প্রতিযোগীদের কাছাকাছি অবস্থানে আসার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।
২৯ জুলাই থেকে তিন দিনের আলোচনা ও দর-কষাকষির শেষ দিন ৩১ জুলাই এ ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে।
পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনতে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও বেশ কিছু সুবিধা দিতে হয়েছে। একদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান গত ২১ জানুয়ারি। এর দুই মাস পর গত ২ এপ্রিল হঠাৎ বিশ্বের ৭০ দেশের জন্য বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। অনেকেই ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে একধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে সমালোচনা করেছেন।
প্রথমে গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয় ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। মাঝখানে তিন মাস স্থগিত রাখার পর ৮ জুলাই তা কমিয়ে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ করেন। বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ করায় মোট শুল্কহার দাঁড়াবে এখন ৩৫ শতাংশে।
দর-কষাকষির মাধ্যমে ঘোষিত শুল্কহার কমিয়ে আনাকে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের আলোচকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আলোচকদের মধ্যে আরও ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে বলেছে, অনেক বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু শুল্ক কমানোর সঙ্গেই যুক্ত ছিল না; বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্যঘাটতি ও নিরাপত্তা–সংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগও ছিল এর সঙ্গে। সমাধানের বিষয়টি নির্ভর করছিল একটি দেশের সদিচ্ছার ওপরও।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’
প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্কহারযুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা এবং ১৯ শতাংশ হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯ শতাংশ। তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ; জাপান, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৪১ শতাংশ শুল্কহার সিরিয়ার ওপর। বেশি হার আরোপ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ; সুইজারল্যান্ডের ওপর ৩৯ শতাংশ; ইরাক ও সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ এবং লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিচ্ছে বাংলাদেশসরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেশন পুরোপুরি মেনে চলারও অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে পাঁচ বছর ধরে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।
দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হচ্ছে। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯ থেকে ১১ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সফল না হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সেসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ১৭ থেকে ২৩ জুলাই সপ্তাহব্যাপী অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বৈঠকগুলো করেন।
গত ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করার কারণে সরকারি প্রতিনিধিদলে অন্য কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভেতরে-ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
সরকারের আহ্বানে সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেন তাঁরা। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩ কোটি ডলারে ৩ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রায় ১০ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
এ ছাড়া ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ১৯ হাজার টন তুলা আমদানির সমঝোতার চুক্তি করেছে বস্ত্র খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্গিল ইনকরপোরেটের কাছ থেকে এশিয়া কম্পোজিট ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে ৬ হাজার টন আমদানির এমওইউ করেছে। একই দরে একই পরিমাণ তুলা আমদানির এমওইউ করেছে সালমা গ্রুপও। এ ছাড়া মোশাররফ গ্রুপ মার্কিন লুইস ড্রেফাস গ্রুপ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন তুলা আমদানির এমওইউ করেছে।
কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ২০ শতাংশ শুল্কহার ঠিক করতে পেরেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।’
ট্রেড ইউনিয়ন, মজুরি, শ্রমিক নিপীড়ন, মামলা—এসব বিষয় আলোচনায় উঠেছিল কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখতে জোর দিয়েছে তারা। আমরা আইএলও কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ জন্য শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে।’
‘অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা’ওয়াশিংটনে দর-কষাকষিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্ক কমার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, তাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে রেহাই পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘সময়সীমার মধ্যেই জটিল আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। নইলে ৩৫ শতাংশের গুরুভার বহন করে যেতে হতো।’
খলিলুর রহমান আরও বলেন, প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান অথবা যত্সামান্য বেশি এবং ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য এখন প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। তৈরি পোশাকশিল্প ও এর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টার উদ্দেশে ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (শেখ বশিরউদ্দীন) সমালোচকদের হতাশ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেন, হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিশ্বশক্তির চাপের মুখে এই সাফল্য অর্জনের জন্য সরকার ও আলোচক দলের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন। এটি সম্ভবত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোর একটি ছিল, যা পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাঁরা।