গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের ১৯ মাস পেরিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের সামরিক অভিযান তার মূল কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল এই অভিযানের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন, বিশেষ করে হামাসকে নির্মূল করে দেওয়া। শুরু থেকেই পশ্চিমা শক্তিগুলো ইসরায়েলের এই আক্রমণকে প্রায় নিঃশর্তভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে। তারা বলেছে, এটা ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার জন্য’ বৈধ পদক্ষেপ। 

কিন্তু পশ্চিমাদের এই সমর্থন এবং স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করার পরও ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভাঙতে পারেনি ইসরায়েল। গাজা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো তাদের কর্মকাণ্ড সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। তারা অব্যাহতভাবে রকেট ছুড়ছে। সামরিক বিবেচনায় জটিল অভিযানও তারা পরিচালনা করছে।

যেমন গত মাসে গাজার বেইত হানুনের কাছে তারা হামলা চালিয়েছে। হামাস যোদ্ধারা একটি সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে ইসরায়েলি সামরিক যান লক্ষ্য করে আক্রমণ করে। এতে তিনজন ইসরায়েলি সেনা আহত হয়। উদ্ধারকারী বাহিনী সেখানে পৌঁছালে হামাস যোদ্ধারা বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে একজন ওয়ারেন্ট অফিসার নিহত হন। 

আরও পড়ুনইসরায়েল এখনো বুঝতে পারছে না, তারা যুদ্ধে হেরে গেছে১৯ মে ২০২৫

ইসরায়েল বারবার দাবি করে আসছে, বেইত হানুনের মতো এলাকাগুলো ‘নিরপেক্ষ’ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক আক্রমণ একটা কৌশলগত বার্তা দিল। সেটা হলো, বিরামহীন বোমা হামলা ও সীমাহীন দখলদারির মধ্যেও হামাস গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করতে ও লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে হামলা করতে সক্ষম। এভাবেই তারা বিশ্বের সবচেয়ে প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা একটা সেনাবাহিনীকে কৌশলে ঘায়েল করে চলেছে। 

এখানেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের সঙ্গে গাজা যুদ্ধের তুলনাটা প্রাসঙ্গিক। সেই যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ছিল—উন্নত অস্ত্রশক্তি ও বাইরের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও মতাদর্শিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত প্রতিরোধী শক্তিকে পরাজিত করা যায় না। গাজা যুদ্ধ ক্রমাগত ইসরায়েলের ভিয়েতনাম যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। 

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান সংকটের মুখে পড়ছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ এবং একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানো চলছে। গাজায় বিপর্যয়ের কারণে সমালোচনার যে ঝড় উঠছে, সেটা সামাল দিতে নেতানিয়াহু এখন দোষ চাপাচ্ছেন অন্যদের ঘাড়ে। যেমন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের ওপর তিনি দোষ চাপিয়েছেন। সবচেয়ে নাটকীয় বিরোধটা দেখা গেছে গোয়েন্দা খাতে। 

গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ব্যর্থতা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই। দেশটির রাজনীতি ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার গভীরে সেটা বিস্তৃত হয়েছে। 

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান সংকটের মুখে পড়ছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ এবং একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানো চলছে। গাজায় বিপর্যয়ের কারণে সমালোচনার যে ঝড় উঠছে, সেটা সামাল দিতে নেতানিয়াহু এখন দোষ চাপাচ্ছেন অন্যদের ঘাড়ে। যেমন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের ওপর তিনি দোষ চাপিয়েছেন। সবচেয়ে নাটকীয় বিরোধটা দেখা গেছে গোয়েন্দা খাতে। 

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট হারেৎসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সতর্ক করে বলেছেন, ‘ইসরায়েল এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি।’ এই প্রেক্ষাপটে হামাসের সাম্প্রতিক আক্রমণ সামরিক ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও বেশি কিছু। এটা ভেতর থেকে ইসরায়েলে যে ফাটল ধরেছে, সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন। এই ভাঙন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরেও পৌঁছে গেছে। দ্য নিউ আরব–এর খবর জানাচ্ছে, সেনাবাহিনীর ভেতরে অসন্তোষ বেড়ে চলেছে। 

ইসরায়েলের জন্য আরেকটি নাজুক জায়গা হলো গাজা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপ। যুদ্ধ পরিচালনার খরচ, অবরোধ বজায় রাখা ও আঞ্চলিক হুমকির জবাব দিতে গিয়ে ইসরায়েলি অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে।

যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। ইসরায়েলের মূল খাতগুলোর ওপর এই অর্থনৈতিক চাপ পড়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। এই খাত ইসরায়েলের রাজস্ব আয়ের বড় উৎস। সীমান্তের ওপার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঝুঁকির কারণে ইসরায়েল এখন ব্যবসা বা ভ্রমণের জন্য নিরাপদ গন্তব্য নয়। 

এটা পরিষ্কার যে ইসরায়েলের সঙ্গে দেশটির প্রধান মিত্রদের বিভাজনটা ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলি আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর আহ্বানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বছরে চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করে। ইসরায়েলের যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে ট্রাম্প হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি এই সংঘাতের অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন। 

সবকিছুর বিচারে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এই যুদ্ধের সঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাদৃশ্য দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। বিশ্ব এটা মেনে নিক বা না নিক, গাজা এখন ইসরায়েলের ভিয়েতনাম হয়ে উঠেছে। 

মেহমেত রাকিপওগ্লু তুরস্কের মারদিন আরতুকলু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক

মিডলইস্ট আই ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র লক ষ য মন ত র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

কাঁচা চামড়া নিতে চীনকে অনুরোধ করবে বাংলাদেশ

কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে চায় সরকার। এ জন্য কাঁচা চামড়া রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে কাঁচা চামড়া আমদানির অনুরোধ জানিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতকে চিঠি পাঠানো হবে। একইসঙ্গে চামড়া আমদানি ও রপ্তানিবিষয়ক সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে (ইপিবি) চিঠি দিবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

আজ বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বাণিজ্য সচিব মহাবুবুর রাহমানের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, আসন্ন কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তবে বাণিজ্য উপদেষ্টা বৈঠক উপস্থিত না হতে পারায় দাম চূড়ান্ত হয়নি। আগামী রোববার দাম ঘোষণা করা হবে।

 বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কোরবানির ঈদের পর অন্তত ১৫ দিন স্থানীয় পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়ে আধা-সরকারি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংসহ দেশব্যাপী ৭০ হাজার টন লবণ সরবরাহ করবে শিল্প মন্ত্রণালয়। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ হাজার টন লবণ বিনামূল্যে দেওয়া হবে। গত বুধবার এ সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে বিষয়টি জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয় ১৬ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলার। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে। তবে গত অর্থবছরে আয় কমে দাঁড়ায় ১ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৯৩২ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ