তাহিরপুরে ‘পছন্দের লোক দিয়ে’ বাজার ও নৌকাঘাটের খাস আদায় করাচ্ছেন ইউএনও
Published: 23rd, May 2025 GMT
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় ইজারা না হওয়া চারটি বাজার ও নৌকাঘাটের খাস আদায়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌখিকভাবে দর নির্ধারণ করে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই এসব বাজার ও নৌকাঘাটের খাস আদায়ে কিছু লোককে দায়িত্ব দিয়েছেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ডাম্পের বাজার নৌকাঘাট, শ্রীপুর বাজার নৌকাঘাট, পাতারগাঁও বাজার নৌকাঘাট ও বাদাঘাট বাজার মামলা–সংক্রান্ত জটিলতায় এবার ইজারা হয়নি। চলতি বাংলা সন শুরুর পর এসব বাজার ও ঘাটে খাস আদায় করছিলেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। এ জন্য ইউএনও গত ১৪ এপ্রিল লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি এসব বাজার ও নৌকাঘাট থেকে খাস আদায়ের জন্য ইউএনও স্থানীয় লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি লিখিতভাবে এক ব্যক্তিকে, অন্য তিনটি মৌখিকভাবে তিনি অন্যদের অনুমতি দেন। এ জন্য ইউএনও মো.
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার বাজার ও নৌকাঘাটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় শ্রীপুর বাজার নৌকাঘাট থেকে। এটি ১১ মাসের জন্য উপজেলার ভাটি তাহিরপুর গ্রামের বাসিন্দা গোলাম মওলাসহ পাঁচ ব্যক্তিকে মৌখিকভাবে খাস আদায়ের অনুমতি দিয়েছেন ইউএনও। এবার বাংলা সন শুরু হওয়ার পর কিছুদিন এখানে উপজেলার ডিহিবাটি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা খাস আদায় করেন। এরপর হঠাৎ ওই ব্যক্তিরা গিয়ে জানান, ইউএনও তাঁদের খাস আদায়ের অনুমতি দিয়েছেন। এর পর থেকে তাঁরাই ঘাটের দখল নিয়ে অর্থ তুলছেন।
জানতে চাইলে গোলাম মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আলাদাভাবে নয়, তহশিলদারের সঙ্গে আছি। তাঁরাই টাকা তুলছেন। ইউএনও সাহেব বলেছেন সঙ্গে থাকার জন্য।’ কত টাকায় তাঁরা ঘাটে খাস আদায়ের অনুমতি পেয়েছেন জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
একইভাবে উপজেলার ডাম্পের বাজারে খাস আদায়ের জন্য কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দুটি বাজার ও ঘাট উপজেলার ডিহিবাটি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অধীন। ডিহিবাটি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী খাস আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কারা আদায় করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানে। আমি এর বেশি বলতে পারব না।’
উপজেলার তাহিরপুর–বাদাঘাট সড়কের পাতারগাঁও এলাকায় একটি নৌকাঘাট আছে। এটি উপজেলার কালীপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সামাদকে ১৪ মে লিখিতভাবে দিয়েছেন ইউএনও। এটি ছোট্ট একটি অস্থায়ী ঘাট বলে জানিয়েছেন ইউএনও আবুল হাসেম। আবদুস সামাদ বলেছেন, যত দিন নৌ চলাচল থাকবে, তত দিন তিনি টোল আদায় করবেন। তিনিও কত টাকায় ঘাটটি নিয়েছেন, সেটি জানাতে চাননি।
বাদাঘাট বাজার ও নৌকাঘাটে তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের খাস আদায়ের কথা থাকলেও আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এলাকার কিছু লোক খাস আদায় শুরু করেছেন। ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা প্রায় এক মাস ধরে বাজারে উপস্থিত হয়ে খাস আদায় করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাদাঘাট এলাকার পাঁচজন লোককে ইউএনও এই বাজার ও ঘাটে খাস আদায়ের জন্য গতকাল বুধবার রাতে মৌখিকভাবে অনুমতি দিয়েছেন। এই পাঁচজনের সঙ্গে আরও ২০ জন যুক্ত আছেন। বাজারটি সর্বশেষ ১৪২৯ বাংলা সনের জন্য ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা হয়েছিল।
আজ থেকে খাস আদায়ে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বাদাঘাট বাজার বণিক সমিতির সভাপতি নজরুল শিকদার ও সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ রয়েছেন। নজরুল শিকদারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। হারুন অর রশিদ বলেন, বাজারের নেতারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করেই খাস আদায়ে যুক্ত হয়েছেন। তবে তহশিলদারই সব দেখাশোনা করবেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইউএনওর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
বাদাঘাট বাজারের বিষয়ে ইউএনও আবুল হাসেম বলেন, গতকাল তাঁর কাছে বাজারের ৩০ থেকে ৩৫ ব্যবসায়ী এসেছিলেন। সবাই বাজারটি খাস আদায়ের জন্য নিতে চাইলে তিনি প্রতি মাসে চার লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার শর্তে তাঁদের অনুমতি দিয়েছেন। একইভাবে অন্য বাজার ও ঘাটগুলো দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
অইজারাকৃত বাজার ও নৌকাঘাট খাস আদায়ের নীতিমালার মধ্যে একটি হচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশাসনের কর্মকর্তা–কর্মচারী দিয়ে আদায় করবেন। অন্যটি হচ্ছে তিনি (ইউএনও) প্রকাশ্যে সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে সর্বোচ্চ দরদাতাকে খাস আদায়ের জন্য অনুমতি দেবেন।
তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা ও কনজ্যুমার রাইটস বাংলাদেশের উপজেলা শাখার সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, উপজেলায় খাস আদায়যোগ্য সব বাজার ও ঘাট নিয়েই একটা অস্বচ্ছতা দেখা যাচ্ছে। যাঁরা দেন ও যাঁরা নেন, দুই পক্ষের মধ্যে একটা রহস্য ও গোপনীয়তা দেখা যায়। সব হয় গোপনে। সরকার যে কী পায়, সেটি কেউ জানে না।
ইউএনও আবুল হাসেম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থেই এভাবে বাজার ও নৌকাঘাট তিনি খাস আদায়ের জন্য দিয়েছেন। তবে অন্য লোকজন আদায় করলেও এটি তদারকি করবেন তহশিলদাররা। কোনো বিজ্ঞপ্তি বা প্রকাশ্য উদ্যোগ ছাড়া তিনি একা এসব বাজার ও ঘাট খাস আদায়ের জন্য অন্যদের দিতে পারেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি শতভাগ সৎ। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থে কিছু লোক নিয়োগ করেছি। আমার তো এত লোকবল নেই।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এসব ব জ র ও কর মকর ত র ছ ন ইউএনও সব ব জ র ও উপজ ল র ড প রক শ সরক র করব ন
এছাড়াও পড়ুন:
ফেস্টুন অপসারণ করায় ইউএনওকে শাসালেন বিএনপি নেতা
ফেস্টুন অপসারণ করায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়সাল আহমেদকে শাসিয়েছেন এক বিএনপি নেতা। তিনি ইউএনওকে আগের স্থানেই ফেস্টুন লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “তা না হলে যেটা করা দরকার, সেটাই করব।”
এই বিএনপি নেতার নাম কে এম জুয়েল। তিনি রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুলে তার বাড়ি।
গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সড়ক বিভাজকে থাকা বিভিন্ন দলের ফেস্টুন অপসারণ করেন ইউএনও ফয়সাল আহমেদ। বিষয়টি জানতে পেরে ইউএনওকে ফোন করে ধমকান জুয়েল।
কে এম জুয়েলের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। এতে শোনা গেছে, কে এম জুয়েল বলেছেন- “আজকে একটা ঘটনা ঘটেছে, আমি শুনেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার কে এম জুয়েল বলছি, সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট। আপনার গোদাগাড়ী থানার প্রোপারে যে পোস্টার সরিয়েছেন, এই বিষয়ে কিছুক্ষণ আগে আমাকে ইনফর্ম করা হয়েছে। সেখানে আমার পোস্টার ছিল। জামায়াত-বিএনপির পোস্টার ছিল। আপনি যে হটাইছেন, এর কারণ কী? কোনো পরিপত্র আছে, না ইচ্ছে করেই?”
ইউএনও তখন বলেন, “জনগণ অভিযোগ দিয়েছে।” জুয়েল বলেন, “জনগণ তো অনেক অভিযোগ দিয়েছে। সমগ্র গোদাগাড়ী থানাতে ভর্তি হয়ে আছে পোস্টার। তোলেন, সব তোলেন।”
এ সময় ইউএনও কিছু বলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে জুয়েল বলেন, “শোনেন, আমি যেটা বলছি লিগ্যাল রাইট নিয়ে বলছি, সেটার সঠিক অ্যানসার করবেন। আপনি কেন ওই জায়গার পোস্টার তুলেছেন, আর অন্য জায়গার তুলছেন না কেন? আমি ঢাকাতে আছি, আমি আসতেছি।”
ইউএনও বলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।” জুয়েল বলেন, “না, আপনি যেখান থেকে পোস্টার তুলেছেন, সেখানে আপনি সাবমিট করবেন পোস্টার।” কথা না বাড়িয়ে ইউএনও বলেন, “ঠিক আছে।”
এ সময় আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি নেতা জুয়েল বলেন, “কালকে যেন আমরা ওখানে দেখতে পাই, পোস্টার যেখানে ছিল। ঠিক আছে মানে কী? অবশ্যই করবেন। না হলে যেটা করা দরকার সেটাই করব। আপনার এগেইনেস্টে যেরকম স্টেপ নেওয়া দরকার, সেটাই আমি করব। বিশেষ করে আমরা করব। আমার নেতার ছবি তুলেছেন আপনি ওখান থেকে। জাস্ট রিমেম্বার ইট।”
জুয়েল বলতে থাকেন, “নরসিংদী বাড়ি দেখান আপনি, না? কোন দল থেকে আসছেন আপনি? কোন দল থেকে এসেছেন? কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেছেন আপনি? কালকে পোস্টার ভদ্রলোকের মতো লাগাবেন। ফাইজলামি! এহ, বিশাল ব্যাপার। উনি টিএনও হয়ে গোদাগাড়ীতে আসছেন।”
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইউএনও ফয়সাল আহমেদ বলেন, “ডাইংপাড়া মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুন এরকম পর্যায়ে ছিল যে, যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। পাশাপাশি পৌরসভার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল বলে অভিযোগ ছিল। স্থানীয় জনগণ এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভা থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে সরানোর জন্য। দুই-তিনবার মৌখিকভাবে ও লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল। না সরানোর কারণে ব্যানার-ফেস্টুন সরিয়ে পৌরসভায় রাখা হয়েছে।”
তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভাতেও আলোচনা হয়েছিল। সেখান থেকে সকল রাজনৈতিক দলের পোস্টারই পৌরসভার পক্ষ থেকে সরানো হয়েছে। তবে, বিএনপি নেতা কে এম জুয়েলের ফোনে শাসানোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা কে এম জুয়েল বলেন, “ইউএনওর কাছে জনগণ অভিযোগ করেছে, আর আমরা কি মানুষ না? আমরা জানোয়ার? আমার ছবি তুলে ফেলুক আপত্তি নাই। আমার নেতার ছবিতে হাত দিয়েছে কেন? তার কাছে কি নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পোস্টার তুলে ফেলতে? তিন মাসের মধ্যে কি নির্বাচন? উনি জাস্টিস করতেন, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গরু-ছাগলের মতো আচরণ করবেন, তা তো হয় না।”
বিষয়টি নিয়ে কোথাও আলোচনা হয়নি, ইউএনও কোনো চিঠিও দেননি, দাবি করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “গতকাল আমার এক লোককে ডেকে ইউএনও বলেছেন, যেখানে পোস্টার ছিল, দয়া করে আপনারা লাগিয়ে নেন। কিন্তু, আমরা তো লাগাব না। ইউএনওকেই লাগাতে হবে।”
উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রায় দুই মাস আগে উপজেলা সদরের এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উত্থাপন করেন এক ব্যক্তি। এক মাসেও সেগুলো অপসারণ না হওয়ায় পরবর্তী মাসের সভাতেও বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। ওই সভায় ট্রাফিক পুলিশ আপত্তি করেছিল যে, ফেস্টুনের কারণে রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা যায় না। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ দুটি সভার মধ্যে প্রথম সভায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল ছিলেন না। দুই সভার মাঝে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠন করা হলে তিনি পরবর্তী সভায় উপস্থিত ছিলেন।
তবে, কোনো আলোচনা হয়নি দাবি করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল বলেন, “আমি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য। পোস্টার নিয়ে কোনো আলোচনা সভায় হয়নি। ইউএনও আমাদের না জানিয়ে এভাবে ফেস্টুন অপসারণ করে ঠিক করেননি। সেখানে আমাদের নেতার ছবি ছিল।”
ঢাকা/কেয়া/রফিক