অন্তর্মুখীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে সবার সঙ্গে আরও ভালোভাবে মেশার তিনটি পরামর্শ
Published: 26th, May 2025 GMT
আমি অন্তর্মুখী। তাই সব সময় মনে হতো, গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলাকালে আমি কথা বলি না। কিন্তু তারপর উপলব্ধি করলাম, আমার নিজের ভালো গুণগুলোর প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া এবং যোগাযোগে ভালো করার দিকে নজর দেওয়া উচিত। আরও বুঝতে পারলাম, সব সময় আমার কথা বলার আদতে প্রয়োজনও নেই।
আমি কাজ করতাম এক স্বাস্থ্যসেবাদাতা কোম্পানিতে। একদিন অন্য এক কোম্পানি আমাদের কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করল। আমাদের নতুন কোম্পানির প্রধান কার্যালয় ছিল সান দিয়াগোতে। আমাকে ঘিরে একটা টেবিলের চারপাশে কোম্পানির নেতৃত্বস্থানীয় অনেকে বসে ছিলেন। এদিকে আমি ভাবছিলাম, তাঁরা কি কোম্পানি একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? আমার খুবই অবাক লাগছিল, তাই চুপ করে রইলাম। সেদিনের মিটিংয়ে বলতে গেলে অংশই নিইনি। শুধু মনে হচ্ছিল, তাঁরা ভাবছেন, আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে? কেন আমি খামাখা একটা চেয়ার দখল করে রেখেছি?
মিটিংয়ের পর হোটেলে নিজের রুমে গিয়ে ভাবতে থাকলাম, আমার কী কী বলা উচিত ছিল, কী কী প্রশ্ন করতে পারতাম, এ রকম আরও অনেক কিছু। আর অন্তর্মুখী হওয়ার জন্য নিজেকে দোষ দিতে থাকলাম। মনে হলো, ইশ্, যদি গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম! নিজের চিন্তাভাবনা আর আইডিয়াগুলো দ্রুত গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারতাম!
আরও পড়ুনইতি, তোমার অন্তর্মুখী বন্ধু২০ জুন ২০১৮আমি অন্তর্মুখী—কথাটি যখন বলি, তখন মানুষ প্রায়ই অবাক হয়। কারণ, আমি আমার ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় কাজ করেছি প্রশিক্ষক ও বক্তা হিসেবে।
নিজেকে চেনার জন্য কিছু পরীক্ষা করার এবং মার্কিন লেখক সুজান কেইনের ‘কোয়ায়েট: দ্য পাওয়ার অব ইন্ট্রোভার্টস ইন আ ওয়ার্ল্ড দ্যাট ক্যান নট স্টপ টকিং’ বইটি পড়ার পর আবিষ্কার করলাম, আমি আদতেই অন্তর্মুখী। বইটি আমাকে নিজের কিছু ইতিবাচক দিক আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে, যেসব অন্তর্মুখিতার সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন মনোযোগ দিয়ে শোনা; যা কিছু শুনি, তা নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা করা এবং ভালো প্রশ্ন করতে পারা।
এর অর্থ হলো আমি অনেক বহির্মুখীর মতো মুখে কোনো কথা বলি না। আমার এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অফিসের পরিবেশে খাপ খাওয়ানো আমার জন্য কঠিন হতে পারে। অনেক অফিস চলেই শুধু মিটিং আর মুক্ত আলোচনার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক অন্যভাবে কাজ করে। তাই আমাকে আমার পথ খুঁজে নিতে হয়েছে। নিচের ৩টি পরামর্শ অন্তর্মুখী হয়েও কর্মক্ষেত্রে আমাকে উন্নতি করতে সহায়তা করেছে।
১.নিজের ইতিবাচক দিকগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে শিখেছি
সেদিন মিটিং শেষে হোটেল রুমে ফিরে আসার পর লিখতে বসলাম, কী কারণে কোম্পানির সিইও আমাকে মিটিংয়ে রেখেছেন এবং কোম্পানি একীভূতকরণের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে নির্বাচিত করেছেন। কয়েকটি কারণ ভেবে বের করতে পারলাম। যেমন আমি পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম; প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমার দক্ষতা আছে।
বুঝতে পারলাম, অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে আমার যেসব গুণ আছে, যেমন মনোযোগ দিয়ে শোনা, ভালো ভালো প্রশ্ন করা, এসব গুণ আমার ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই আমি একজন দলনেতা হিসেবে ভালো করতে পারব।
আরও বুঝতে পারলাম, আমার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর না–ও থাকতে পারে। তবু নিজের শিখতে ও প্রশ্ন করতে পারার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মিটিংয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে পারি কিংবা গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যা কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন, সেসব নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে পারি।
আরও পড়ুনকীভাবে বুঝবেন আপনি একই সঙ্গে বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী০৬ অক্টোবর ২০২২২. শব্দ বাছাইয়ের পরিবর্তে সংযোগ তৈরির ওপর মনোযোগ দিয়েছিলামপ্রেজেন্টেশনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় বিভ্রান্ত হয়ে পড়তাম। আমার কী বলা উচিত, সঠিক পদ্ধতি কী, যদি দর্শক-শ্রোতা আমাকে বোকা ভাবে? এসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম।
এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেকে প্রশ্ন করতে শিখেছি, কোন পদ্ধতিতে প্রেজেন্টেশন দেওয়া আমার মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? প্রেজেন্টেশনটির মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতার মধ্যে কী ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করতে চাই?
যখন এভাবে চিন্তা করতে শুরু করলাম, তখন আমার ভয়গুলো নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না। বরং দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে আমার সংযোগ গড়ে তোলার প্রতি বেশি করে নজর দিলাম।
৩. আমার শুধু তখনই কথা বলা উচিত, যখন আমাকে বলতেই হবেবেশ কয়েক বছর আগে আমার ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ) ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলাম। আর্টিকেলটি যখন ছাপা হলো, তখন অনেকেই না জেনে–বুঝে অনেক মন্তব্য করতে শুরু করলেন, যা ছিল ভীষণ কষ্টদায়ক।
কমেন্টগুলো পড়ে কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু আর্টিকেলটি লেখার জন্য আমার কোনো অনুশোচনা হয়নি। কারণ, বন্ধ্যাত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং কর্মস্থল–সংক্রান্ত নীতিমালার উন্নয়নের পক্ষে কথা বলা আমার মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখলাম, আমার কথাগুলো তখনই সবচেয়ে শক্তিশালী হবে, যখন কথাগুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। আগে মনে করতাম, বহির্মুখী এবং সফল হতে হলে আমাকে সবকিছু নিয়েই কথা বলতে হবে। বিষয়টি আদতে এমন নয়। আমাকে খুঁজে নিতে হবে আমার কাছে কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো সেই বিষয়েই আমাকে কথা বলতে হবে। বুঝতে পেরেছি, জীবনে সফল হতে হলে আমি যেমন, সেভাবেই নিজেকে গ্রহণ করতে হবে। আমি কী বলব এবং কখন বলব, সে ব্যাপারে নিজেকেই নির্দেশনা দিতে হবে।
সূত্র: এমএসএন
আরও পড়ুনঅন্তর্মুখী নাকি বহির্মুখী, কোন ধরনের মানুষেরা বেশি সুখী১৪ মার্চ ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য মন য গ আম র ক
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।