সাংবিধানিক সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে তার সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনকারী মিত্র দলগুলো। ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন এবং এর মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সুপারিশে বিএনপি রাজি না হলেও তার মিত্ররা রাজি।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা ঘোষণা করেছিল। আগামী নির্বাচনে এই জোট জয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা।
বিএনপির মিত্র দলগুলো হলো– গণঅধিকার পরিষদ, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট ও ১২টি দলের জাতীয়তাবাদী জোট।
এর মধ্যে দুই জোট বিএনপির পথে হাঁটলেও বাকিদের ভিন্নমত আছে।
মিত্র হয়েও সংস্কারে বিএনপির বিপরীতে অবস্থান বিষয়ে দলগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তারা মতামত দিয়েছেন। আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষ না হলে ছোট দলগুলো সংসদীয় রাজনীতিতে টিকতে পারবে না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনে ঐকমত্য পোষণ করেছে। দলটি সংসদ নির্বাচনের ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন এবং এনসিসি গঠনের পক্ষে। দলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক জানিয়েছেন, এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে তারা না রাখার পক্ষপাতী। এ দু’জন থাকলে অন্য সদস্যরা বিব্রত হতে পারেন।
পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংস্কারের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন চেয়েছে বিএনপি। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে প্রথম দফার সংলাপে নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ গণভোটের মাধ্যমে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন চেয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের পক্ষে।
গণঅধিকার পরিষদ এনসিসি গঠন, প্রধানমন্ত্রী পদ দুবারে সীমাবদ্ধ রাখা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশে একমত। দলটির প্রস্তাব, কোনো দল সংসদ নির্বাচনে ১ শতাংশ ভোট পেলেই উচ্চকক্ষে আসন পাবে।
বিএনপি এনসিসি, ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ দু’বারে সীমাবদ্ধ করার সুপারিশে একমত নয়। কমিশন এ তিন সুপারিশকে মৌলিক পরিবর্তন বলছে এবং জামায়াত ও এনসিপি এ বিষয়ে একমত। একই অবস্থান বিএনপির ঘনিষ্ঠ গণঅধিকারের। একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না– কমিশনের এ সুপারিশেও সম্মত দলটি। তবে এসব সুপারিশে একমত নয় বিএনপি।
গণসংহতি আন্দোলন সংস্কার বাস্তবায়ন চায় গণপরিষদের মাধ্যমে। দলটি অবশ্য প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে। এনসিপিও গণপরিষদে সাংবিধানিক সংস্কার চায়। বিএনপি গণপরিষদ ধারণার ঘোর বিরোধী। গণসংহতিও আনুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ চায়।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেছেন, তাদের দল সংখ্যানুপাতিক নয়, শ্রেণি ও পেশাভিত্তিক উচ্চকক্ষ চায়। এতে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা থাকবে না। জেএসডি এনসিসি গঠনে একমত। তবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এনসিসির মাধ্যমে মনোনীত হোক–এটি তারা চায় না। অন্যান্য সাংবিধানিক নিয়োগ এনসিসির মাধ্যমে হতে পারে।
নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার জানান, আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষের পক্ষে তাঁর দল। এনসিসি গঠনেও একমত। তবে এনসিসিকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষপাতী নয় নাগরিক ঐক্য।
বিএনপির আরেক মিত্র এনডিএম উচ্চকক্ষ ও এনসিসি চায়। দলটির চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ সমকালকে বলেন, উচ্চকক্ষের গঠন কী হবে, তা আগামী সংসদে ঠিক হবে। আগামী নির্বাচন সংসদ নির্বাচনই হবে। পরের নির্বাচন থেকে উচ্চকক্ষ থাকতে পারে।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ গণঅধ ক র ব এনপ র অবস থ ন এনস স দলগ ল
এছাড়াও পড়ুন:
সংসদীয় গণতন্ত্রই চায় ইসলামপন্থি ছয় দল
ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রই চায়। সংস্কার কার্যক্রমে অংশ নেওয়া এমন ছয়টি দলের কেউই শরিয়াহভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা, খেলাফত রাষ্ট্র চায়নি। ঐচ্ছিক শরিয়াহ আদালত স্থাপনের প্রস্তাব করেছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন। বাকি দলগুলো বিদ্যমান ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের প্রস্তাব করেছে।
এর বাইরে ঐচ্ছিক শরিয়াহ আদালত চেয়েছে আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।
সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ যুক্তের সুপারিশে একমত হয়নি ইসলামপন্থি দলগুলো। ধর্মভিত্তিক সব দল সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা’ পুনর্বহালের প্রস্তাব করেছে। কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন প্রণয়ন না করার প্রস্তাব করেছে দলগুলো। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছে।
সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনে লিখিত মতামত জানায় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিস। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এই তিন দল ছাড়াও মতামত জানিয়ে সংলাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি।
ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সমকালকে বলেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছে সব ধর্মভিত্তিক দল।
হেফাজতে ইসলাম-সংশ্লিষ্ট এবং কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর নেতারা সমকালকে বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থান হিসেবে দেখাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্টের পর পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা বারবার জানতে চেয়েছেন, ইসলামী দলগুলোর শরিয়াহভিত্তিক শাসন, খেলাফতভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনে জামায়াত প্রস্তাব করেছিল, জরুরি অবস্থা জারি হলেও মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার স্থগিত করা যাবে না। ঐকমত্য কমিশনের মতামতে এবং সংলাপে তারাও উন্নত গণতন্ত্রের দেশগুলোর আদলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, জবাবদিহির প্রস্তাব করেছে।
দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেছেন, জামায়াত কখনও জোরজবরদস্তির মাধ্যমে ইসলাম কায়েম করার কথা বলেনি। জামায়াত সম্পর্কে যেসব নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ছড়ানো। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জামায়াতের লক্ষ্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া; সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ১২ পৃষ্ঠার প্রস্তাবে ধর্মবিষয়ক একটি লাইন লিখেছে। এতে বলা হয়েছে, শরিয়াহবিরোধী আইন করা যাবে না। ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬ সুপারিশেও দলটি ধর্ম-সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব দেয়নি। দলের মহাসচিব ইউনূস আহমদ বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো গণতান্ত্রিক দলই শরিয়াহবিরোধী আইনের পক্ষে নয়।
৭ মে দ্বিতীয় দিনের সংলাপে শরিয়াহ আদালত স্থাপনের প্রস্তাব করে ইসলামী আন্দোলন। এর ব্যাখ্যায় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে শরিয়াহ আইনে বিচার হয়। ইসলামী আন্দোলন প্রস্তাব করেছে, নিম্ন থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত পৃথক শরিয়াহ বেঞ্চ থাকবে। বাদী ও বিবাদী একমত হলে বিচারের জন্য শরিয়াহ আদালতে যেতে পারবেন। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেমন সাধারণ ও শরিয়াহ পদ্ধতি রয়েছে। গ্রাহক যে পদ্ধতি পছন্দ করেন, তা গ্রহণ করেন। শরিয়াহ আদালতও তেমন ঐচ্ছিক হবে।
নেজামে ইসলাম পার্টি সংলাপে গুরুত্ব দিয়েছে স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসনে। খেলাফত মজলিস সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদ সংস্কারে প্রস্তাব দেয় কমিশনে। জমিয়ত ১৬৬ সুপারিশের ১০৯টিতে একমত পোষণ করেছে। দলটি দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। দেশের নাম ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব করেছে।
মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস ১৬৬ সুপারিশের ১৪৭টিতে একমত। এই দলটিও আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষ, সাংবিধানিক কাউন্সিলসহ সরকার, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে।
দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিনী সমকালকে বলেছেন, ইসলামপন্থি দল হিসেবে খেলাফত মজলিসের চূড়ান্ত লক্ষ্য খেলাফতের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তবে তা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অর্জন করা হবে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারলে জনগণের মতামত এবং সমর্থনে খেলাফত কায়েম করবে খেলাফত মজলিস।