অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করছেন না, এটা আপাতত পরিষ্কার। কেউ তাঁর পদত্যাগ চাননি, তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন হতাশা ও বিরক্তি থেকে। তাঁর হতাশার কারণ সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মহলের অসহযোগিতা। সংবাদমাধ্যমে এমনই খবর হয়েছে। 

গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব শক্তি একমত হয়ে অধ্যাপক ইউনসূকে দায়িত্ব দিয়েছিল। এখন তিনি যদি নিজের মতো কাজ করতে না পারেন, অসহযোগিতার মুখে পড়েন, তাহলে পদত্যাগের ভাবনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেই ভাবনা থেকে তিনি সরে আসায় একটা স্বস্তি এসেছে; কারণ, তাঁর পদত্যাগ নিশ্চিতভাবেই অনিশ্চয়তা বাড়াত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সংকট কতটা কাটল?

পরিস্থিতি হঠাৎ যে সংকটময় হয়ে উঠল, এর কিছু কারণ পুরোনো। যেমন বিভিন্ন ইস্যুতে মব তৈরি, ভাঙচুর ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং প্রায় প্রতিদিনই রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কোনো না কোনো দাবিতে রাস্তা অবরোধ। সরকার এগুলো সামাল দিতে পারেনি। এই অব্যাহত মব সংস্কৃতি নিয়ে মানুষের বিরক্তি চরমে পৌঁছেছে। এর সঙ্গে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে বিএনপির অব্যাহত চাপ এবং এ নিয়ে সরকারের নির্বিকার অবস্থান দুই পক্ষের মধ্যে ক্রমাগত দূরত্ব বাড়িয়েছে।

এখন নতুন পরিস্থিতি হচ্ছে, ইশরাকের মেয়র পদ ইস্যুতে বিএনপির রাজনৈতিক শক্তি প্রমাণের চেষ্টা। এ নিয়ে মুখোমুখি হয়ে পড়ে বিএনপি ও এনসিপি। দুই পক্ষ থেকেই কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগের পাল্টাপাল্টি দাবি ওঠে।

পাশাপাশি মিয়ানমারকে মানবিক করিডর দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতিবাচক অবস্থান দেশের রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। এ পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় ঢাকা সেনানিবাসে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’-এ দেওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য। সেখানে নির্বাচন, করিডর, বন্দর নিয়ে সেনাপ্রধান তাঁর অবস্থানের কথা জানান। এর মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে সেনাপ্রধানের অবস্থানের পার্থক্য স্পষ্ট হয়।

এসব নানা ঘটনার পটভূমিতেই গত বৃহস্পতিবার রাতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সম্ভাব্য ‘পদত্যাগ’ ভাবনার খবর আলোচনায় আসে। এ বিষয়ে জল্পনা-কল্পনার অনেকটাই অবসান ঘটে শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা পরিষদের দেওয়া বিবৃতির মাধ্যমে। উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত এক বৈঠক শেষে এই বিবৃতি দেওয়া হয়। আমরা বুঝতে পারলাম অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন না।

আরও পড়ুনপ্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের প্রশ্ন এল কেন২৩ মে ২০২৫

বিবৃতি অনুযায়ী উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সংস্কার, বিচার, নির্বাচন-অন্তর্বর্তী সরকারের এই তিন প্রধান দায়িত্বের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই সূত্রে, ‘এসব দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অযৌক্তিক দাবিদাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্য এবং কর্মসূচি দিয়ে যেভাবে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে তোলা হচ্ছে এবং জনমনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা হচ্ছে,’ তা নিয়ে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’

উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ নিচ্ছেন। সরকারি খরচ কমানোর চেষ্টাও আছে অনেকের মধ্যে। তা ছাড়া সরকারের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তেমন অভিযোগ নেই। এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের ভালো দিক। কিন্তু একই সঙ্গে কোনো কোনো উপদেষ্টার যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারা বা কারও কারও বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়গুলোও আলোচিত; যা সরকারের সামগ্রিক দক্ষতা ও ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব ফেলছে। উপদেষ্টাদের কাজ ও ভূমিকা মূল্যায়ন করে ড.

ইউনূস কি উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেবেন?

বিবৃতিটি বিবেচনায় নিলে আমরা বুঝতে পারি যে অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতিতে দৃঢ় অবস্থান এবং কঠোরভাবেই তা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু শুধু দৃঢ় থাকা বা কঠোর হওয়াই কি সব? নাকি গণ-অভ্যুত্থানের বিভিন্ন অংশীপক্ষের মধ্যে যে বিরোধ ও বিভক্তি তৈরি হয়েছে, তা দূর করার উদ্যোগও নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। অথবা নিজেদের সঙ্গেও যেন কোনো পক্ষের বিরোধ না হয়, সে ব্যাপারেও সচেষ্ট থাকবে অন্তর্বর্তী সরকার।

গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্ররা। আবার গত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে যে দলটি সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে, সেই দলটি হচ্ছে বিএনপি। তারা চরম প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে গেছে। এই দুটি পক্ষের কারও অবদানকে ছোট-বড় করে দেখার সুযোগ নেই। তাদের সঙ্গে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণ যুক্ত হওয়াতেই স্বৈরাচারের পতন ঘটানো সম্ভব হয়েছিল।

আরও পড়ুনদলগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকে কী পাওয়া গেল১৬ ঘণ্টা আগে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও ৫ আগস্ট হাসিনার পতনে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাকেও কি অস্বীকার করা যাবে? অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে ৮ আগস্ট, মাঝের তিন দিন কাদের হাতে ছিল দেশ? ছাত্র-জনতার সঙ্গে কি সেনারা মাঠে থাকেননি? এখনো দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বড় দায়িত্ব পালন করছে সশস্ত্র বাহিনী। তাদের দেওয়া আছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা। এরপরও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্বের কথা আলোচনায় আছে, তা দুর্ভাগ্যজনক।

আগেই বলেছি, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস থাকছেন, এটা স্বস্তিদায়ক। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের এই পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ বা বিভক্তি অথবা এই পক্ষগুলোর কারও সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব বা ভুল-বোঝাবুঝি দেশ ও দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

গত দুই দিনে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের আস্থা ও একই সঙ্গে বিভিন্ন পরামর্শ ও চাওয়া-পাওয়ার কথা বলে এসেছে। কিন্তু সংকট পুরোপুরি কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে কি? না, তেমন মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিক দলগুলো বা সরকার কেউ তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে—এমন ইঙ্গিত নেই। ড. ইউনূস মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তাদের বক্তব্য শুনেছেন।

তবে তাঁর প্রেস সচিব বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দেশ বড় যুদ্ধাবস্থার মধ্যে রয়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার সব ধরনের চেষ্টা করছে। বিভাজন থেকে উদ্ধার পেতে ঐকমত্য থাকতে হবে।’

অধ্যাপক ইউনূস যে সংকটকে ‘বড় যুদ্ধাবস্থা’ বলে মনে করেন এবং এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে ‘ঐকমত্য’ দরকার বলে মনে করেন, তা অর্জনে মূল ভূমিকাটি কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারকেই পালন করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তিগুলোর মধ্যে বিরোধ কমিয়ে আনা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ। শুধু তা-ই নয়, নিজেদের সঙ্গেও সব পক্ষের দূরত্ব কমিয়ে আনার বাড়তি চেষ্টা ও উদ্যোগ থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কঠোর বা দৃঢ় অবস্থানের নীতি খুব কাজে দেয় না।

প্রেস সচিবের সূত্রে আমরা জেনেছি, অধ্যাপক ইউনূস জানিয়েছেন, তিনি জুনের (২০২৬) ৩০ তারিখের পর এক দিনও থাকবেন না। তাই যদি হয় তবে এই সময়সীমা বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের একটি পথনকশা দিয়ে দেওয়া।

অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিয়েছে। যার কিছু হয়তো দৃশ্যমান, অনেক কিছু সুফল হয়তো ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ নিচ্ছেন। সরকারি খরচ কমানোর চেষ্টাও আছে অনেকের মধ্যে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা সফল হচ্ছেন। তা ছাড়া সরকারের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তেমন অভিযোগ নেই। এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের ভালো দিক।

কিন্তু একই সঙ্গে কোনো কোনো উপদেষ্টার যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারা বা কারও কারও বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়গুলোও আলোচিত; যা সরকারের সামগ্রিক দক্ষতা ও ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব ফেলছে। উপদেষ্টাদের কাজ ও ভূমিকা মূল্যায়ন করে ড. ইউনূস কি উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেবেন? এমন উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হবে না, বরং সরকার যে চেষ্টা করছে, তারই প্রতিফলন ঘটাবে। উপদেষ্টা পরিষদে কার্যকর রদবদল রাজনৈতিক সংকট কাটাতেও ভূমিকা পালন করতে পারে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করেছে। ঘুষ-দুর্নীতির জাল থেকেও মানুষ মুক্তি পায়নি। এদিকে সচিবালয়ে বিক্ষোভ, এনবিআর অচল, নগর ভবনে তালা—এই হচ্ছে দেশের সাম্প্রতিক চিত্র। গণ-অভ্যুত্থানের সব শক্তিকে পুরোপুরি আস্থায় নিতে না পারলে এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যে কঠিন হবে, অন্তর্বর্তী সরকারের তা না বোঝার কথা নয়।

এ কে এম জাকারিয়া উপসম্পাদক, প্রথম আলো

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট দ র ক সরক র র স র অবস থ ন উপদ ষ ট র র পদত য গ পর স থ ত দলগ ল র ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ