রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আবার তৎপর হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা নিজেদের মধ্যেও বিবাদে জড়াচ্ছে। অনেক এলাকায় রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে বিরোধে জড়াচ্ছে তারা। এতে ঘটছে খুনোখুনিসহ হামলার ঘটনা।

গত দুই মাসে রাজধানীতে তিনটি খুনের ঘটনার নেপথ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম এসেছে। অন্তত আটটি স্থানে হামলা, জখম, দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের জড়িত থাকার কথা জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। মগবাজার, মতিঝিল, বাড্ডা, গুলশানসহ কিছু এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও অন্যের হয়ে ভাড়ায় খাটছে শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ তাদের সহযোগীরা।

সর্বশেষ গত রোববার রাতে বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপির নেতা কামরুল আহসানকে (সাধন) গুলি করে হত্যা করা হয়। কেব্‌ল টিভি ও ইন্টারনেটের সংযোগসহ চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের জেরে ঘটা এ হত্যাকাণ্ডে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সহযোগীদের নাম এসেছে। এর আগে ১৯ এপ্রিল হাতিরঝিলে ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ শিকদারকে গুলি ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানতে পারে, এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যেও আছেন সুব্রত বাইন। হত্যার কারণ, হাতিরঝিল, মগবাজারসহ আশপাশের এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জের।

গতকাল মঙ্গলবার কুষ্টিয়া শহরের একটি বাসা থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী।

আরিফ হত্যার ঘটনায় আগেই মো.

মিরাজ ও মো. অনিক নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলার আরেক আসামি শুটার মাহফুজুর রহমানকে (বিপু) র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। বিপু শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলে র‍্যাব জানিয়েছে।

# বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিবাদে সুব্রত বাইন।
# মগবাজারে একের পর এক গুলি ও হামলা চলছে।

এ হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে ১৩ মার্চ কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মো. রাজনকে। মগবাজারের ওয়্যারলেস রেলগেটের পাশে একটি ক্লাব ঘরের ভেতরে তাঁকে কোপানো হয় এবং মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়। মৃত ভেবে তাঁকে ফেলে রাখা হয়। পরে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে ফেরেন রাজন। এর নেপথ্যেও শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের সম্পৃক্ততার কথা জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় করা মামলার আসামি মোল্লা মাসুদ ও শুটার বিপু।

১১ মে রাজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ময়লার টাকা নিয়ে একটি দলের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল। এরপর ক্লাবে ঢুকে তারা গুলি করে। গুলি শরীরে লাগেনি। এরপর একটি সুইচ গিয়ার চাকু দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। কাচের অনেকগুলো গ্লাস দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়। এই সন্ত্রাসীরা টাকার বিনিময়ে ভাড়া খাটে।’ তিনি তাদের চেনেন বলে জানান।

# বাড্ডা–গুলশানে অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণে চার গ্রুপ।
# আলোচিত দুই খুনে ব্যবহার হয় পেশাদার ‘কিলার’।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এর সুযোগ নেয় সন্ত্রাসীরা। আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্তত ছয়জন জামিনে মুক্তি পান। তাঁদের মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল ও হাজারীবাগ এলাকার সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন। এ ছাড়া ঢাকার অপরাধজগতের আরও দুই নাম খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসুও কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই এক থেকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে ছিলেন।

এর বাইরে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর গোপন স্থান থেকে ফিরে প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন অনেকে। তাঁদের কেউ কেউ এরই মধ্যে বিদেশে চলে গেছেন, এমন তথ্যও রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এ ছাড়া আগে থেকেই যাঁরা বিদেশে অবস্থান করছেন, তাঁদের অনেকে দেশে ফিরে বিভিন্ন এলাকায় নতুনভাবে তৎপরতা শুরু করেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ দখলের ঘটনায় নাম আসতে থাকে তাঁদের। এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জেরে বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসীদের তৎপরতা রোধে এলাকাভিত্তিক নজরদারি এবং সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের চিহ্নিত করে নজরদারি করছে ডিবি। এতে সন্ত্রাসী তৎপরতা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। এখনকার যেসব অপরাধে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম আসছে, সেগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এ জন্য এলাকাভিত্তিক সাঁড়াশি অভিযানও পরিচালনা করা হয়েছে।

খুনোখুনিতে অপরাধীরা

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করে আধিপত্য বিস্তার করছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। জমি ও সম্পদ দখল, কোরবানির পশুর হাটের নিয়ন্ত্রণ, কেব্‌ল টিভির সংযোগ, ব্রডব্যান্ট ইন্টারনেট ব্যবসা ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে খুন–জখমসহ বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করছে তারা। সম্প্রতি মগবাজার–হাতিরঝিল এলাকায় কয়েক দফায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ এলাকার একটি সন্ত্রাসী দল সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে অস্ত্র আনার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে একটি গোয়েন্দা সূত্র। আধিপত্য বিস্তারের এ প্রতিযোগিতায় নিজেদের মধ্যেও খুনোখুনিতে জড়াচ্ছে অনেকে।

এলাকাভিত্তিক নজরদারি এবং সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের চিহ্নিত করে নজরদারি করছে ডিবি। ...যেসব অপরাধে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম আসছে, সেগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম, ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার

যুবদলের সদস্য আরিফ সিকদার হত্যার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, মগবাজার–রামপুরা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সঙ্গে দুবাইয়ে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। হাতিরঝিল, মগবাজার ও রামপুরা এলাকার বিএনপির যে অংশের সঙ্গে জিসানের যোগাযোগ আছে, তাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন আরিফ সিকদার। এ জন্য সুব্রত বাইনের অনুসারীরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।

১৪ মে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে মুঠোফোনে কল করে শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ পরিচয় দিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। ঘটনার বিষয়ে ভুক্তভোগী কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নিজেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের লোক পরিচয় দিয়ে চাঁদা দাবি করা হয়েছে।

এর আগে মহাখালী ও নিকেতনের ময়লা–বাণিজ্যের (বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ) নিয়ন্ত্রণের ঘটনায় আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাসের নাম আসে। বিদেশি একটি নম্বর থেকে আসা ফোনকল এবং কয়েক দফা হামলার ঘটনায় ২১ থেকে ২৪ অক্টোবর ওই এলাকার বর্জ্য সংগ্রহ, রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া এবং নালা পরিষ্কারের কাজ টানা চার দিন বন্ধ ছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাড্ডা ও গুলশান এলাকায় বর্তমানে জিসানের সহযোগীদের বাইরে চার সন্ত্রাসী গ্রুপ ও তাদের সহযোগীদের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসছে।

পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডিএনসিসির আওতাধীন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের এ এলাকার ময়লা–বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাছিরের হাতে। ৫ আগস্টের পর স্থানীয় বিএনপির নেতারা এর নিয়ন্ত্রণ নেন। এর মধ্যেই সন্ত্রাসী বিকাশের পরিচয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মুঠোফোনে কল দিয়ে ময়লা সংগ্রহের কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়। কথা অনুযায়ী কাজ বন্ধ না রাখায় কয়েক দফায় হামলা চালানো হয়।

শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ আগারগাঁওয়ে জোড়া খুন, ছাত্রলীগের নেতা জরিপ হত্যাসহ বেশ কয়েকটি হত্যা ও চাঁদাবাজির মামলার আসামি ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ ১২ বছর কারাভোগের পর ২০০৯ সালে জামিনে মুক্ত হন তিনি। এরপর পালিয়ে যান বিদেশে। বর্তমানে বিদেশে বসেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অপরাধজগতে প্রভাব বিস্তার করছেন বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র।

গুলশান–বাড্ডায় নতুন সন্ত্রাসী দল

মতিঝিল এলাকার অপরাধজগতের অন্যতম দুই আলোচিত নাম বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ও দুবাইয়ে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ। মতিঝিলের বাইরে বাড্ডাসহ রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের খুন, দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধকর্মে বিভিন্ন সময়ে জিসানের নাম আসে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাড্ডা ও গুলশান এলাকায় বর্তমানে জিসানের সহযোগীদের বাইরে চার সন্ত্রাসী গ্রুপ ও তাদের সহযোগীদের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসছে। এই গ্রুপগুলোর নেতৃত্বে আছেন সুব্রত বাইন, মেহেদী, রবিন ও বাড্ডার হেলাল উদ্দিন। এর মধ্যে মেহেদী যুক্তরাষ্ট্রে ও রবিন মালয়েশিয়ায় আছেন বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্র। রবিনের ভাই হিসেবে এলাকায় পরিচিত মাহবুব এখন এ এলাকায় চাঁদাবাজির ঘটনায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। আর হেলালের বাড়ি উত্তর বাড্ডায়। তবে গ্রেপ্তার আতঙ্কে তিনি এলাকা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নাওড়া এলাকায় বেশির ভাগ সময়ে থাকছেন। কখনো কখনো তাঁকে গুলশানেও দেখা যায়।

জানতে চাইলে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাউকে দেখা যায় না। এ জন্য সন্ত্রাসীদের সহযোগী হয়ে যারা কাজ করছে, আমরা তাদের গ্রেপ্তার করছি। এতে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।’

যে ঘটনাগুলোতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম আসছে, সেই মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করতে হবে। ...শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দেশে তাদের হয়ে যারা কাজ করছে, তাদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।নাইম আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার

গত ২০ মার্চ রাতে গুলশানের পুলিশ প্লাজার সামনের সড়কে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় সুমন মিয়া ওরফে টেলি সুমনকে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রগুলো জানায়, কেব্‌ল টিভি সংযোগ ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসার আড়ালে সন্ত্রাসী দলের হয়ে কাজ করতেন সুমন। বাড্ডা–গুলশান এলাকার রবিন গ্রুপের সদস্য ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুনপ্রকাশ্যে এসেই তৎপর সুব্রত বাইন, ‘পিচ্চি হেলাল’, ‘কিলার আব্বাস’সহ শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ১১ অক্টোবর ২০২৪

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বাড্ডা এলাকায় বিদেশি পিস্তল, গুলি, ম্যাগাজিনসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সুমন। গত ১৭ জানুয়ারি চাঁদা না পেয়ে বাড্ডায় এক ব্যক্তিকে গুলি করে আবার গ্রেপ্তার হন তিনি। এরপর জামিনে বের হওয়ার পর তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যার ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

র‌্যাব জানিয়েছে, গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্ত্রাসী মেহেদী ও রবিন গ্রুপের বিরোধের জেরে খুন হন সুমন। মেহেদীর নির্দেশে তাঁকে খুন করতে পাঁচজনের একটি ‘কিলার গ্রুপ’ কাজ করে।

সুমন হত্যার নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে র‌্যাব জানায়, ওয়াসির মাহমুদের মাধ্যমে গুলশান ও বাড্ডা এলাকার চাঁদা সংগ্রহ করতেন সন্ত্রাসী মেহেদী। সন্ত্রাসী রবিন গ্রুপের হয়ে একই এলাকায় চাঁদাবাজি শুরু করেন সুমন। গুলশান এলাকার বিভিন্ন বিপণিবিতানে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মেহেদী গ্রুপের সঙ্গে রবিন গ্রুপের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। এ বিরোধের জেরে মেহেদীর নির্দেশে সুমনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ওয়াসির মাহমুদ।

২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকারের ঘোষণা করা ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন। তাঁকে ধরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, বর্তমানে ফার্মগেট ও আশপাশের এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলামের কিছু তৎপরতা রয়েছে। মহাখালীতে কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তরা নিজেদের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমাম হোসেনের সহযোগী বলে পরিচয় দিয়েছে।

অপরাধীরা অধরা, আত্মগোপনে

অপরাধীরা জামিনে বের হয়ে কিংবা গোপন স্থান থেকে প্রকাশ্যে এসে এলাকায় নানাভাবে নিজের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনও ছিলেন এই দলে। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎ মগবাজারের বিশাল সেন্টারে আসেন সুব্রত বাইন। এতে বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। এলাকায় তাঁর উপস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে এ এলাকার চাঁদাবাজি ও খুন–জখমের একের পর এক ঘটনায় তাঁর নাম আসতে থাকে।

১৬ মে মগবাজার ও হাতিরঝিল এলাকায় আরিফ শিকদার হত্যার বিচার দাবিতে অলিগলি দেয়ালে পোস্টার দেখা যায়। পোস্টারে লেখা রয়েছে, ‘৩৬ নং ওয়ার্ড হাতিরঝিল থানা যুবদলের সক্রিয় কর্মী আরিফ শিকদার হত্যার বিচার চাই।’ নিচে লেখা, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল, হাতিরঝিল থানা, ঢাকা মহানগর উত্তর।

২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকারের ঘোষণা করা ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন। তাঁকে ধরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এখনো তাঁর নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। নোটিশ অনুযায়ী সুব্রত বাইনের বয়স ৫৬ বছর।

আরও পড়ুনকে এই সুব্রত বাইন, কীভাবে জড়ালেন অপরাধজগতে১১ ঘণ্টা আগে

গতকাল কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় সোনার বাংলা মসজিদের পাশে একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সুব্রত বাইনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সুব্রত বাইনের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদসহ চারজনকে। সুব্রত বাইন গ্রেপ্তার হলেও মগবাজার, মতিঝিল, বাড্ডা ও গুলশান এলাকায় সক্রিয় অন্য সন্ত্রাসীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সুযোগ কাজে লাগিয়েছে সন্ত্রাসীরা

অপরাধবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরু থেকেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন ছিল। কাজটি ঠিকভাবে হয়নি। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তাদের অপরাধের জাল আরও বিস্তৃত হবে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বন্ধে দেশে তাদের হয়ে যারা কাজ করছে, তাদের ওপর বিশেষ নজরদারি রাখতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার নাইম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যে ঘটনাগুলোতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম আসছে, সেই মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করতে হবে। আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হলে এই সন্ত্রাসীদের কেউ বিদেশে পালিয়ে গেলেও ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরানো সহজ হবে। শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দেশে তাদের হয়ে যারা কাজ করছে, তাদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।

আরও পড়ুনকুষ্টিয়া থেকে যেভাবে আটক হলেন আলোচিত সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ১১ ঘণ্টা আগে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ও ত দ র সহয গ দ র ব ভ ন ন এল ক য় রব ন গ র প র এ হত য ক ণ ড গ র প ত র কর প রথম আল ক ন র সহয গ এল ক য় ব র ন পথ য রক ষ ক র স ত রগ ল অপর ধ র ক জ করছ সরক র র ল ইসল ম ল র ঘটন র অপর ধ র ঘটন য় র সদস য মগব জ র ব এনপ র নজরদ র হত য র ক জ কর এল ক র এ এল ক ন স মন স গ রহ আল চ ত পর এক র একট আসল ম ম ওরফ য বদল ব যবস আহম দ আতঙ ক

এছাড়াও পড়ুন:

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে

সম্প্রতি চট্টগ্রামের হালিশহরে এক কলেজছাত্রকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্য দিয়ে শহরটিতে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের বিষয়টি আবারও সামনে এল। কিন্তু হতাশাজনক ব্যাপার হচ্ছে, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য রোধে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা কোনোভাবেই সুফল দিচ্ছে না।

স্থানীয়ভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত যে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠে এসব কিশোর গ্যাং। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে দলটি ও এর অঙ্গসংগঠনের এলাকাভিত্তিক নেতাদের প্রশ্রয়ে গড়ে উঠেছিল অনেক কিশোর গ্যাং। এখন দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা থেমে নেই। বরং নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্য রাজনৈতিক বলয়ে যুক্ত হচ্ছে তারা এখন।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, শহরে ২০০টির বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। তাদের পেছনে থাকে একজন বা একাধিক ‘বড় ভাই’। গত ছয় বছরে অন্তত ৫৪৮টি অপরাধের সঙ্গে তারা সরাসরি যুক্ত। এই সংকটের মূলত তিনটি স্তর রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার অব্যবস্থা। পুলিশ জরিপে দেখা গেছে, স্কুলে অনুপস্থিত ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এসব কিশোর অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত এবং মূল্যবোধহীন পরিবেশে বেড়ে উঠছে। শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার পর তাদের জন্য কোনো বিকল্প গঠনমূলক কাঠামো নেই। তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ও অনলাইনের বিরূপ প্রভাব। সাইবার অপরাধ, জুয়া ও সহিংস গেম তাদের বাস্তব জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এসব গ্যাংয়ের সদস্যদের বড় অংশই অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল ও দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। কেউ দোকানে বা কারখানায় কাজ করে। মা–বাবা বেঁচে থাকলেও পরিবারের অভিভাবকত্ব থেকে বিচ্যুত এসব কিশোর বা অল্প বয়সী তরুণ। ফলে এলাকার কথিত ‘বড় ভাই’ তাদের অভিভাবক হয়ে ওঠেন। সেসব বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তারা অপরাধজগতে প্রবেশ করে।

পৃথিবীর অনেক দেশে কিশোর গ্যাং রোধে সামাজিক সেবা, কাউন্সেলিং, স্কুলভিত্তিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের জন্য সুসংগঠিত ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদেরও এমন পদক্ষেপের দিকে এগোতে হবে। কিশোর গ্যাংকে যারা আশ্রয়–প্রশ্রয় দেয়, তাদেরকে কোনোভাবে ছাড় দেওয়া যাবে না। চট্টগ্রাম পুলিশ প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। শুধু আইনি ব্যবস্থাই নয়, সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান—সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে এখানে সামাজিক সুরক্ষাবলয় তৈরি করতে হবে। আমরা চাই না, আর কোনো কিশোর হত্যাকাণ্ডের শিকার হোক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জামিন পেয়ে বেপরোয়া সন্ত্রাসীরা, জড়াচ্ছে চাঁদাবাজি, খুনোখুনিতে
  • সারা দেশে জোরদার অভিযান চলুক
  • আলোচনায় সুব্রত বাইনের স্যাটেলাইট ফোন
  • চীনের নজরদারি নিয়ে ভারতের উদ্বেগ
  • ভারতীয় নাগরিকের মরদেহ হস্তান্তর
  • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে
  • যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে
  • সিদ্ধিরগঞ্জে শিশু ধর্ষণ চেষ্টার মামলার আসামি গ্রেপ্তার
  • এবার চামড়ার দাম নিশ্চিতে বিশেষ তৎপরতা থাকবে: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা