কার্বনের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে
Published: 5th, June 2025 GMT
ইঁদুর ধরার ফাঁদ আছে, অন্যান্য পশু-পক্ষী ধরার ফাঁদও আছে- সবাই জানি। ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে’— রবীন্দ্রসংগীত আছে। তাহলে প্রেমের ফাঁদও আছে। কিন্তু আমাদের বিষয় ‘কার্বন ফাঁদ’, মানে কার্বন ধরার ফাঁদ, সেও আছে।
জীবন্ত কোষ (প্রাণী বা উদ্ভিদ কোষ) অসংখ্য অণু দিয়ে গঠিত, যেগুলি ‘জৈব অণু’ নামে পরিচিত। এই ‘জৈব অণু’ সাধারণত ২৫টিরও বেশি উপাদান দিয়ে গঠিত, যার মধ্যে ৬ (ছয়)টি উপাদানকে জৈব অণুর কমন উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়; এগুলো হল কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস ও সালফার। জীবজগতের গঠনের দিক থেকে এই ছয়টি পরমাণুর মধ্যে কার্বন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু। এই কারণেই বলা হয় যে কার্বন হল পৃথিবীতে জীবনের ভিত্তি। কার্বন শুধুমাত্র কয়লা, পেট্রল বা জ্বালানির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; বাস্তবে কার্বন জীবনের মৌলিক উপাদান এবং এটি প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ডিএনএ এবং অন্যান্য জৈব অণুর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বাংলা অভিধানে কার্বন শব্দের অর্থ অঙ্গার অর্থাৎ কয়লা জাতীয় পদার্থ। বস্তুত ইংরেজি কার্বন শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘কার্বো’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘কয়লা’। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এটি কাঠকয়লা এবং কাঁচের আকারে পরিচিত ছিল। কয়লা যে কালো, কারণ কার্বনের মৌলিক রং কালো। কালোকে যেমন জগতের আলো বলা হয়, তেমনি কয়লার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দ্যুতিময় পদার্থ- হিরা। শুনলে অবাক হতে হয় যে হিরা আসলে কার্বন।
১৭৭২ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যান্টোয়ান ল্যাভোয়াসিয়ে প্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান যে হিরা পোড়ালে (অক্সিজেনের উপস্থিতিতে) কেবলমাত্র কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়, অন্য কোনো পদার্থ নয়। তিনি অনুমান করেছিলেন যে হিরা মূলত কার্বনেরই একটি রূপ। ১৭৯৭ সালে ইংরেজ রসায়নবিদ স্মিথসন টেন্যান্ট আরও নির্ভুলভাবে প্রমাণ করেন যে হিরা ও সাধারণ কয়লা মূলত একই মৌলিক পদার্থ— কার্বন। অর্থাৎ, রাসায়নিকভাবে দুটোই বিশুদ্ধ কার্বন। হিরা কার্বনের একটি রূপভেদ । হিরার অনেক পৃষ্ঠ থাকায় যখন আলো হিরার ভেতর প্রবেশ করে, তখন এটি এক পৃষ্ঠ থেকে অন্য পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয় এবং প্রতিসৃত হয়। এই প্রক্রিয়ায় আলো ভেঙে যায় এবং বিভিন্ন দিকে বিচ্ছুরিত হয়, যা হিরাকে ঝকমক করে তোলে। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ও নরম পদার্থ দুটোই মূলত কার্বন, প্রথমটি হিরা, দ্বিতীয়টি গ্রাফাইট (পেনসিলের লিড এবং লুব্রিকেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত)।
হিরা ঝকমক করে- এটা কোনো খবর নয়। খবর, যা মহাউদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, তা হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বনের গ্যাসীয় রূপ কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা গত ৮০০,০০০ বছরের মধ্যে যে কোনো সময়ের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি রেকর্ড করা হয়েছে। এনওএএ/স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশন অব ওশেনোগ্রাফি জানাচ্ছে, এই সময়ের বেশির ভাগ সময় কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব প্রায় ১৫০-৩০০ পিপিএম-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। তবে, ১৯৫০ সাল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, ৪০০ পিপিএম ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০২৪ সালে ৪২৪ পিপিএমেরও বেশিতে পৌঁছেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২৪ সাল ছিল রেকর্ডের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ বছর। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস’ জানিয়েছে, ২০২৪ সাল ছিল প্রথম ক্যালেন্ডার বছর যখন গ্রহের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০ সালের শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় ১.
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বা কীভাবে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমাদের গ্রহটিকে একটি বন্ধ সিস্টেম বলা হয়। এর মানে পৃথিবী কার্বন লাভ করে না বা হারায় না। কিন্তু কার্বন ক্রমাগত নড়াচড়া করে। যে প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ, প্রাণী এবং জীবাণুর মধ্যে কার্বন স্থানান্তরিত হয় তাকে ‘কার্বন চক্র’ বলে।
কার্বন চক্র যেভাবে সংঘটিত হয়: উদ্ভিদ, শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং সূর্যালোক ব্যবহার করে জৈব পদার্থে (যেমন গ্লুকোজ) রূপান্তর করে। এই কার্বন ডাই অক্সাইডের বেশির ভাগই শিকড়, পারমাফ্রস্ট (আর্কটিক, সাইবেরিয়া, আলাস্কায় হিমায়িত), তৃণভূমি এবং বনভূমিতে সংরক্ষিত হয়। গাছপালা এবং মাটি ক্ষয় হলে বায়ুমণ্ডলে আবার কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয়। অন্যান্য জীবগুলিও কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয় যখন তারা বেঁচে থাকে তখন এবং যখন মারা যায় তখনও।
উদাহরণস্বরূপ, প্রাণীরা যখন শ্বাস নেয় তখন কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে এবং যখন তারা পচে যায় তখন কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয়। মহাসাগরগুলি কার্বন শোষণ করে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে কার্বন বিনিময় করে, যেখানে এটি দ্রবীভূত হয় এবং কার্বনিক অ্যাসিড তৈরি করে। এটি বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, কিন্তু সমুদ্রের অম্লীকরণের দিকেও পরিচালিত করে। উপরন্তু, শিলা এবং অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক আমানতে কার্বন সংরক্ষিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, কয়লা এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি (যেমন তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস) উদ্ভিদ থেকে কার্বন দিয়ে তৈরি যা পৃথিবীর পৃষ্ঠের নিচে লাখ লাখ বছর ধরে সংরক্ষিত আছে। যখন আমরা কাঠ, জীবাশ্ম জ্বালানি এবং অন্যান্য ধরনের কার্বন পোড়াই তখন তা কার্বন চক্রের প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে ব্যাহত করে। সঞ্চিত কার্বন পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে আবার কার্বন অবমুক্ত হয়, যেখানে এটি একটি গ্রিনহাউস গ্যাসে পরিণত হয়।
কার্বন নিজেই দূষণের কারণ নয়। বরং কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনক্সাইড, মিথেন, কার্বোনিল সালফাইড, ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের মতো কার্বন যৌগগুলি, যখন অত্যধিক পরিমাণে নির্গত হয়, তখনই তারা জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কার্বন মনক্সাইড কার্বন-ভিত্তিক জ্বালানির অসম্পূর্ণ দহনের মাধ্যমে উৎপন্ন একটি বিষাক্ত গ্যাস। এটি মিথেন অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় হাইড্রোক্সিল র্যাডিকেলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তাদের প্রাপ্যতা হ্রাস করে। ফলে, যদিও কার্বন মনক্সাইড নিজে একটি গ্রিনহাউস গ্যাস নয়, কিন্তু পরোক্ষভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নে অবদান রাখে।
মিথেন জৈবিক এবং ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া দ্বারা উৎপাদিত একটি গ্রিনহাউস গ্যাস; বিশ্ব উষ্ণায়নে অবদান রাখে। কার্বোনিল সালফাইড আগ্নেয়গিরির গ্যাস এবং বায়ুমণ্ডলে পাওয়া যায়। এর গ্রিনহাউস প্রভাব নগণ্য; তবে এটি স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারিক সালফেট অ্যারোসলে অবদান রাখে, যা সূর্যালোক প্রতিফলিত করে গ্রহকে শীতল করতে পারে। সিএফসি গ্যাস বা তরল অবস্থায় থাকে। এটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস, যা কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে তাপ ধরে রাখে। তাছাড়া সিএফসি বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের বহিরাবরণের প্রায় ১৫-৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ওজোন স্তরের ক্ষতিসাধন করে থাকে। মানুষের কার্যকলাপ থেকে সিএফসি বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়। রাসায়নিকভাবে স্থিতিশীল হওয়ায় তারা নিম্ন বায়ুমণ্ডলে (ট্রপোস্ফিয়ার) ভেঙে যায় না এবং ধীরে ধীরে স্ট্রাটোস্ফিয়ারে উঠে যায়। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে সিএফসি অতি বেগুনি বিকিরণের সংস্পর্শে আসে, যা তাদের রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে ক্লোরিন পরমাণু নির্গত করে।
ক্লোরিন পরমাণুগুলো অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল এবং ওজোনকে অক্সিজেনে ভাঙনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। বিক্রিয়ায় ক্লোরিন পরমাণু ব্যবহৃত হয় না; এটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে, যার অর্থ একটি একক ক্লোরিন পরমাণু নিষ্ক্রিয় হওয়ার আগে হাজার হাজার ওজোন অণু ধ্বংস করতে পারে। ওজোন অণু ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে যায়, যার ফলে আরও বেশি অকি বেগুনি বিকিরণ পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে।
মুশকিল হচ্ছে সিএফসি মানব সৃষ্ট যৌগ। এর কিছু দরকারি বৈশিষ্ট্যও আছে। এটি অ-বিষাক্ত, অ-দাহ্য এবং রাসায়নিকভাবে স্থিতিশীল, যা এটিকে রেফ্রিজারেটর (এয়ার কন্ডিশনার এবং রেফ্রিজারেটরে), প্রোপেলেন্ট (ডিওডোরেন্ট এবং হেয়ারস্প্রে এর মতো অ্যারোসল স্প্রেতে), ফোমিং এজেন্ট (ফোম ইনসুলেশন এবং প্যাকেজিং তৈরির জন্য)-এ ব্যবহারে উপযোগী করেছে। এটি সস্তা এবং প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা সহজ। কিন্তু গোল বাঁধে যন্ত্রপাতি থেকে লিকেজের ফলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রেফ্রিজারেশন বা এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেমের সিল এবং জয়েন্টগুলি ক্ষয় হতে পারে, যার ফলে সিএফসি বেরিয়ে যেতে পারে।
যদি সিস্টেমগুলি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামত না করা হয়, তাহলে লিকেজ হতে পারে। দুর্ঘটনাক্রমেও এটি বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। উপরিউক্ত যন্ত্রপাতি যখন ফেলে দেওয়া হয় বা ভাঙা হয়, তখন সিএফসি বেরিয়ে যেতে পারে। অতীতে অ্যারোসল স্প্রে ও ফোম পণ্যতে যখন সিএফসি ব্যবহৃত হতো, তখন স্প্রে করার সময় এটি সরাসরি বায়ুমণ্ডলে চলে আসত। ইনসুলেশন এবং প্যাকেজিং উপকরণ তৈরি করতেও একই ঘটনা ঘটতো। একবার বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়লে সিএফসি নিম্ন বায়ুমণ্ডলে রাসায়নিকভাবে স্থিতিশীল থাকে, কারণ তারা অন্যান্য গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না। তারা কয়েক দশক ধরে টিকে থাকে এবং ধীরে ধীরে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে উঠে আসে; সমগ্র বায়ুমণ্ডলে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যার অর্থ তাদের প্রভাব বিশ্বব্যাপী, স্থানীয় নয়।
১৯৮০-এর দশকে ‘ওজোন গহ্বর’ আবিষ্কারের ফলে সিএফসি পর্যায়ক্রমে নির্মূল করার জন্য আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়; মন্ট্রিল প্রোটোকল (১৯৮৭) গৃহীত হয়। এই আন্তর্জাতিক চুক্তির লক্ষ্য ছিল সিএফসি এবং অন্যান্য ওজোন-ক্ষয়কারী পদার্থের উৎপাদন এবং ব্যবহার হ্রাস করা এবং অবশেষে নির্মূল করা। মন্ট্রিল প্রোটোকলকে সবচেয়ে সফল পরিবেশগত চুক্তিগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বায়ুমণ্ডলে সিএফসির মাত্রা হ্রাস পেয়েছে এবং ওজোন স্তর ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হচ্ছে।
গ্রিনহাউস গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনে কতটা প্রভাব ফেলে, তা বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপ হচ্ছে ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট’। কার্বন ফুটপ্রিন্ট বলতে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দেশ বা কার্যক্রমের মাধ্যমে নির্গত মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বোঝায়, যা সাধারণত কার্বন ডাইঅক্সাইড সমতুল্য হিসেবে প্রকাশ করা হয়। কার্বন ফুটপ্রিন্টের প্রধান উৎসসমূহ:
১. জ্বালানির ব্যবহার: গাড়ি, প্লেন, বাস, ট্রেন ইত্যাদির মাধ্যমে ফসিল ফুয়েল পোড়ালে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়।
২. বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহার: কয়লা, তেল বা গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে কার্বন নির্গত হয়।
৩. খাদ্য উৎপাদন: গবাদিপশুর খামার (যেমন গরু, ভেড়া) থেকে মিথেন নির্গত হয়।
৪. শিল্প ও উৎপাদন: কারখানায় পণ্য তৈরির সময় অনেক কার্বন নির্গত হয়, বিশেষ করে প্লাস্টিক, স্টিল, ও সিমেন্ট উৎপাদনের ক্ষেত্রে।
৫. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: আবর্জনা পোড়ানো বা পচনের মাধ্যমে মিথেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়।
কার্বন ফুটপ্রিন্ট কীভাবে মাপা হয়?
ব্যক্তিগত, শিল্প বা দেশের কার্বন ফুটপ্রিন্ট পরিমাপের জন্য টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট ব্যবহার করা হয়। অনলাইনে বিভিন্ন কার্বন ফুটপ্রিন্ট ক্যালকুলেটর রয়েছে, যেখানে ব্যক্তির দৈনন্দিন অভ্যাস অনুযায়ী আনুমানিক হিসাব করা যায় যে তার কার্বন ফুটপ্রিন্ট কত।
উদাহরণ (একজন ব্যক্তির কার্বন ফুটপ্রিন্ট কেমন হতে পারে?)
১. গাড়ি চালালে: বছরে ১০,০০০ কিলোমিটার গাড়ি চালালে আনুমানিক ২ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট নির্গত হতে পারে।
২. প্লেনে ভ্রমণ: একবার আন্তর্জাতিক ফ্লাইট (দুই দিক) আনুমানিক ১-২ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট যোগ করতে পারে।
৩. খাদ্যাভ্যাস: বেশি গরুর মাংস খেলে বছরে আনুমানিক ১-২ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট যুক্ত হতে পারে (কারণ গরুর খামার থেকে মিথেন নির্গত হয়)।
৪. বিদ্যুৎ খরচ: ফসিল ফুয়েল-চালিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে বার্ষিক আনুমানিক ৩-৪ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট হতে পারে।
বিশ্বের কিছু গড় কার্বন ফুটপ্রিন্ট (প্রতি বছর প্রতি ব্যক্তি, টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট):
যুক্তরাষ্ট্র: আনুমানিক ১৬+ টন
চীন: আনুমানিক ৭-৮ টন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন: আনুমানিক ৭-১০ টন
বাংলাদেশ: আনুমানিক ০.৫ টন (বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন)
বিশ্বের গড়: আনুমানিক ৪-৫ টন
(একজন ব্যক্তি গড়পড়তা বছরে তার দৈনন্দিন কার্যকলাপের মাধ্যমে মোট যত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে, তার পরিমাণ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট হিসেবে প্রকাশ করা হয়। প্রতিটি গ্যাসের গ্লোবাল ওয়ার্মিং পটেনশিয়াল ভিন্ন; সব গ্রিনহাউস গ্যাসকে একই স্কেলে মাপার জন্য কার্বন ডাইঅক্সাইড ইকুইভ্যালেন্ট ব্যবহার করা হয়।)
কার্বন ফুটপ্রিন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে প্রতি ব্যক্তির গড় কার্বন ফুটপ্রিন্ট বছরে আনুমানিক ২ টনের নিচে রাখা দরকার। কিন্তু বর্তমানে উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটি অনেক বেশি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ। তাই, আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর দিকে নজর দিতে হবে।
এমতাবস্থায়, মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো বা কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে করণীয় কী ? আমাদের যা করতে হবে:
১. নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার: সৌর বা বাতাসের শক্তি ব্যবহার করলে ফসিল ফুয়েলের ওপর নির্ভরতা কমবে।
২. পরিবহন পরিবর্তন: গাড়ির পরিবর্তে সাইকেল, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, বা ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবহার করা।
৩. টেকসই খাদ্যাভ্যাস: বেশি সবজি ও স্থানীয় খাবার খাওয়া, গরুর মাংস কম খাওয়া, খাদ্যের অপচয় কমানো।
৪. কম বিদ্যুৎ খরচ: এলইডি লাইট ব্যবহার, বিদ্যুৎ অপচয় রোধ করা।
৫. ‘কার্বন ডুবি’/‘কার্বন সিঙ্ক’ সংরক্ষণ এবং এর পরিধি বিস্তৃতকরণ।
‘আকাশ যুড়িয়া ফাঁদ যাইতে পথ নাই
কহে বড়ু চণ্ডীদাস মিলিবে হেথাই’- চণ্ডীদাসের পদাবলি
আকাশ (ট্রপোস্ফিয়ার) জুড়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড যেমন তাপকে ফাঁদে আটকে রাখে, মহাশূন্যে ফিরে যেতে বাধা দান করে, পৃথিবীর বুকেও তেমন ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে কার্বন ডাইঅক্সাইডকই আটকে রাখা যায়, আকাশে যেতে দেয়া হয় না। একে ‘কার্বন অবরোধ প্রযুক্তি’ (কার্বন ক্যাপচার টেকনোলজি) বলে। কৃত্রিমভাবে কার্বন সিঙ্ক তৈরির একটি আধুনিক ব্যবস্থা হচ্ছে এই ‘কার্বন ফাঁদ’। কার্বন অবরোধ প্রযুক্তি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার লক্ষ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কারখানার মতো শিল্প উৎস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমানো। এর মধ্যে রয়েছে বায়ুমণ্ডলে নির্গত হওয়ার আগে কার্বন ডাইঅক্সাইড অবরোধ করা, এটিকে একটি স্টোরেজ সাইটে পরিবহন করা এবং তারপর মাটির নিচে সংরক্ষণ করা। একবার কার্বন ডাইঅক্সাইড ধারণ করা হয়ে গেলে, এটি সাধারণত পাইপলাইন বা জাহাজের মাধ্যমে একটি সংরক্ষণ স্থানে পরিবহন করা হয়। এরপর কার্বন ডাইঅক্সাইড ভূগর্ভস্থ গভীর ভূতাত্ত্বিক কাঠামো, যেমন লবণাক্ত জলাধার বা ক্ষয়প্রাপ্ত তেল ও গ্যাস জলাধার বা অখনিযোগ্য কয়লা সিমে প্রবেশ করানো হয়। একবার কার্বন ডাইঅক্সাইড ভূগর্ভে সংরক্ষণ করা গেলে, এটি মূলত বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শ থেকে দূরে আটকে থাকে।
বাংলাদেশ যদিও কার্বন অবরোধ প্রযুক্তিতে আগ্রহ দেখিয়েছে, বর্তমানে সরকার বা বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা কোনও বাণিজ্যিক প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে না। তবে দেশের বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় কার্বন অবরোধ প্রযুক্তির ওপর গবেষণা ও উন্নয়ন পরিচালনা করছে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং জ্ঞান-ভাগাভাগির উদ্যোগে অংশগ্রহণ করছে, দেশে সম্ভাব্য প্রয়োগগুলি অন্বেষণ করছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সিমেন্ট শিল্প কার্বন ক্যাপচারের জন্য একটি সম্ভাব্য লক্ষ্য হতে পারে, কারণ এটি কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। বাংলাদেশ যদি তার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রসারিত করে, তাহলে নির্গমন কমাতে এই প্ল্যান্টগুলোর জন্য কার্বন ক্যাপচার বিবেচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে কার্বন অবরোধ প্রযুক্তির বাস্তবায়ন এখনও ভবিষ্যতের অপেক্ষায় রয়েছে; জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন কৌশলের অংশ হিসাবে সক্রিয়ভাবে এর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা উচিত। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে কার্বন ক্যাপচারের পরিবেশগত প্রভাবগুলি বিবেচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ, যেমন স্টোরেজ সাইট থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের লিকেজ হওয়ার সম্ভাবনা।
মানুষের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একেবারে কার্বন শূন্য করা অসম্ভব। ইদানীং অনেক পণ্যকে ‘কার্বন-ফ্রি’ বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, কিন্তু আসলে কোনো কিছুই পুরোপুরি কার্বনমুক্ত হতে পারে না। কারণ, কার্বন প্রাণী, উদ্ভিদ, এবং প্লাস্টিক, কাপড়সহ নানা বস্তু তৈরির প্রধান উপাদান। কার্বন নিঃসরণ শূন্য হওয়ার অর্থ হলো নিঃসরণ এবং শোষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা, সম্পূর্ণরূপে কার্বন মুক্ত হওয়া নয়। পরিবর্তে, টেকসই উপায়ে কার্বন ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া উচিত। কার্বন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান আমাদের পরিবেশ এবং জলবায়ু সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কথায় বলে ‘ঠাঁই গুণে কাজলই, ঠাঁই গুণে কালি’। কলমের কালো কালি বানাতে কার্বন লাগে, তা বলাই বাহুল্য। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্প-উদ্যোক্তা হেমেন্দ্র মোহন বোস বাজারে নতুন কালি আনলেন, নাম ‘সুলেখা’, তার প্রচার দরকার। তিনি বিজ্ঞাপনের ভাষার জন্য গেলেন বন্ধুপ্রতিম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। রবিঠাকুর যা লিখে দিলেন তার প্রভাবে সুলেখা কালির জনপ্রিয়তা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, বিদেশি কালি বাজার হারিয়ে ফেলে। একপর্যায়ে মাসে ১০ লাখ বোতল বিক্রি হয়েছিল সুলেখা কালি। কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো’।
বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ল র ন পরম ণ র ক র বন ড ই ব যবহ র কর ব র ক র বন ক র বন ম অন য ন য ক র বন র ও ক র বন ক র বন শ ত ক র বন ক র বন ন ক র বন স য় ক র বন প রক র য় র অর থ পদ র থ পর ম ণ স রক ষ উপ দ ন র জন য আম দ র সময় র জলব য় র একট ব যবস সবচ য় একব র হওয় র স এফস উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে হারাল বায়ার্ন, চ্যাম্পিয়ন পিএসজির গোল উৎসব
বায়ার্ন মিউনিখ ৩–১ চেলসি
২০১২ সালে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ইতিহাস গড়েছিল চেলসি। ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথমবারের মতো পরেছিল ইউরোপসেরার মুকুট।
তবে এরপর থেকে বায়ার্নের সঙ্গে মুখোমুখি সব ম্যাচেই হেরেছে চেলসি। লন্ডনের ক্লাবটি পারল না আজও। হ্যারি কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে ৩–১ ব্যবধানে হারিয়েছে বায়ার্ন।
আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ম্যাচের ২০ মিনিটে বায়ার্ন প্রথম গোলটা পেয়েছে উপহারসূচক। চেলসির সেন্টার–ব্যাক ট্রেভোহ চালোবাহ নিজেদের জালে বল জড়ালে এগিয়ে যায় বাভারিয়ানরা।
কিছুক্ষণ পরেই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন কেইন। এবার ভুল করে বসেন চেলসির মইসেস কাইসেদো। নিজেদের বক্সে কেইনকে কাইসেদো অযথা ট্যাকল করলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি।
নতুন মৌসুমে গোলের পর গোল করেই চলেছেন হ্যারি কেইন