গত ২৭ মে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের উৎক্ষেপণকেন্দ্র থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটটি পরীক্ষামূলকভাবে উড়ে যায়। জানুয়ারি ও মার্চে দুটি মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর এ ধাপে স্পেসএক্স স্টারশিপ মিশনে সাফল্য আসবে বলে অনেক উচ্চাশা ছিল।

স্টারশিপ মূলত দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। ওপরের অংশটিকে বলা হয় ‘শিপ’। এটি বসানো থাকে নিচের বিশাল রকেট ইঞ্জিনের ওপর, যার নাম ‘সুপার হেভি’। এই দুই অংশ মিলিয়ে রকেটটির মোট উচ্চতা ১২০ মিটারের একটু বেশি। তবে সুপার হেভি থেকে আলাদা হওয়ার কয়েক মিনিট পরই বোঝা গেল, চালকবিহীন ওই মহাকাশযানে কিছু ভুল হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘুরতে শুরু করে দিল।

পরীক্ষামূলক উড়ালের সরাসরি সম্প্রচারে স্পেসএক্সের এক ধারাভাষ্যকার বলেন, ‘আমরা আসলে স্টারশিপের দিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি।’

কোম্পানিটি পরে নিশ্চিত করে যে হঠাৎ করেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মহাকাশযানটি ভেঙে পড়েছে।

ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্পেসএক্স কোম্পানির জন্য এটি ছিল অম্ল–মধুর ফলাফল।

তবে এযাবৎকালে এটাই এই মহাকাশযানের সর্বোচ্চ অর্জন, যা আগের দুবারের অগ্রগতিকে ছাপিয়ে গেছে। তা ছাড়া এবারের রকেট ইঞ্জিনটি ছিল পুরোনো। সেটা ভালো কাজ করেছে। পুরোপুরি পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট বানানোর যে পরিকল্পনা কোম্পানিটির রয়েছে, সেটা এক ধাপ এগিয়ে গেল।

স্টারশিপ মূলত দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। ওপরের অংশটিকে বলা হয় ‘শিপ’। এটি বসানো থাকে নিচের বিশাল রকেট ইঞ্জিনের ওপর, যার নাম ‘সুপার হেভি’। এই দুই অংশ মিলিয়ে রকেটটির মোট উচ্চতা ১২০ মিটারের একটু বেশি। তবে সুপার হেভি থেকে আলাদা হওয়ার কয়েক মিনিট পরই বোঝা যায়, চালকবিহীন ওই মহাকাশযানে কিছু ভুল হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘুরতে শুরু করে।

তবে শেষ কথা হলো, স্টারশিপের নবম পরীক্ষামূলক উড়ালটির পরপর তিনবার ব্যর্থ হওয়ার নজির তৈরি হলো। স্পেসএক্সের অন্য রকেট ফ্যালকন–৯ খুব সফল ও নির্ভরযোগ্য ছিল। কিন্তু স্টারশিপের এই তিনটি ব্যর্থতা দেখে অনেকেই ভাবছেন, এর সব কিছুতেই কি গন্ডগোল আছে?

স্পেসএক্সের সবচেয়ে সফল রকেট ফ্যালকন ৯-এর নির্ভরযোগ্যতা অনেক বেশি। তবে কয়েক মাসের মধ্যে তিনটি পরীক্ষা ব্যর্থ হওয়ার কারণে পর্যবেক্ষকদের কারও কারও মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটি হলো, স্পেসএক্সের স্টারশিপের সবকিছু কি ভুল পথে যাচ্ছে?

২৭ মের যাত্রায় সমস্যা কী ছিল?

সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরীক্ষাকালীন উপাত্তগুলো পরে আসবে। পরবর্তী অভিযানের আগে ভুল শুধরে নিতে স্পেসএক্স এসব উপাত্ত কাজে লাগাবে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী জনাথন ম্যাকডাওয়েল বলেন, ২৭ মের পরীক্ষার শুরুটা আগের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। মহাকাশযানটি সফলভাবে কক্ষপথে পৌঁছেছে, অর্থাৎ রকেট ঠিকমতো পুরো সময় কাজ করেছে।

জনাথন ম্যাকডাওয়েল আরও বলেন, মহাকাশযানটি তার কক্ষপথে ঠিকঠাক পৌঁছেছিল। তবে ইতিমধ্যে অভিযান পরিচালনাকারী দলটি সমস্যায় পড়ে। বুস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এটি নিয়ন্ত্রিতভাবে নামার বদলে সাঁ করে মেক্সিকো উপসাগরের পানিতে পড়ে। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যে মহাকাশযানটি নকল স্টারলিংক স্যাটেলাইট স্থাপনের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পে-লোড দরজা আটকে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে।

তবে ম্যাকডাওয়েলের মতে এ অভিযানের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, কক্ষপথে চলার সময় স্টারশিপের দিকটা ঠিক রাখতে পারেনি স্পেসএক্স।

স্টারশিপের এযাবৎকালের সেরা যাত্রা হওয়া সত্ত্বেও মহাকাশযানটিতে ফুটো দেখা দিতে লাগল। এটি ভেঙে পড়ে মুখ থুবড়ে পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ফিরে এল।

দ্রুত ব্যর্থ হও, দ্রুত শেখো

স্পেসএক্স একই কাজ বারবার করে শেখার নীতিতে পরিচালিত হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকে তারা বাধা নয়, বরং শেখার সুযোগ হিসেবে দেখে।

এ প্রবণতা স্পেসএক্সকে বড় সাফল্যের পথে নিয়ে গেছে। তবে বারবার ব্যর্থতা দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

তবু কোম্পানিটি আশা করে যে ব্যর্থ হতে হতে দ্রুত শেখার নীতি শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হবে। ফ্যালকনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট সিরিজ তৈরি করার সময় এমনটাই হয়েছিল।

বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও মহাকাশযান প্রকৌশলী লিয়া-নানি আলকনসেল মনে করেন, স্টারশিপের ক্ষেত্রে যে একই পন্থা কাজ করবে, তা নিশ্চিত নয়।

লিয়া-নানি আলকনসেল বিবিসিকে জানান, স্টারশিপের প্রতিবারের উৎক্ষেপণ ফ্যালকনের তুলনায় অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ। এর প্রধান লক্ষ্য হলো, মানুষকে মঙ্গল গ্রহে পাঠানো। অথচ এর বাজার কিন্তু এখনো তৈরি হয়নি। সুতরাং এর বড় আর্থিক ঝুঁকি রয়েছে।

শেষ পর্যন্ত স্টারশিপের নবম পরীক্ষামূলক মহাকাশযানটির তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা ব্যর্থ হলেও স্পেসএক্সের অন্য রকেট ফ্যালকন–৯ খুব সফল ও নির্ভরযোগ্য। কিন্তু স্টারশিপের এই তিনটি ব্যর্থতা দেখে অনেকেই ভাবছেন, এর ভবিষ্যৎ কী হবে।

লিয়া-নানি আলকনসেল আরও বলেন, স্টারশিপের এসব ব্যর্থতা এবং এগুলো আমলে না নেওয়ার, এমনকি সফল বলে উদ্‌যাপনের রেওয়াজটা ভালো কিছু বলছে না। এগুলো তাদের নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতার পরিচয় দেয় না।

ম্যাকডাওয়েল আভাস দিয়েছেন যে ভবিষ্যতে আরও ব্যর্থতা আসবে।

লিয়া-নানি আলকনসেল বলেন, ‘এই রকেটে সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্মের মহাকাশপ্রযুক্তি রয়েছে। তাই তাদের সমস্যার মুখোমুখি হওয়াটা আমাকে মোটেও অবাক করে না। আমি মনে করি, তারা শেষ পর্যন্ত এটাকে সফলভাবে চালু করতে পারবে।’

স্পেসএক্স কি অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী?

মাস্ক ও তার কোম্পানি স্বপ্ন দেখে, একদিন তাদের রকেট মানুষকে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে যাবে।

নাসা তার আর্টেমিস কর্মসূচির অংশ হিসেবে স্টারশিপকে ব্যবহার করতে চায়। এ কর্মসূচির লক্ষ্য হলো, চাঁদে দীর্ঘ মেয়াদে মানববসতি স্থাপন করা।

সাংবাদিক ও লেখক ডেভিড হোয়াইট হাউস বলেন, মানুষ বহনকারী প্রথম ফ্লাইটটি ২০২৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের জন্য নির্ধারিত। সময় কিন্তু ফুরিয়ে আসছে।

ম্যাকডাওয়েল বলেন, চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য স্টারশিপের প্রস্তুত হতে অনেক বছর লাগতে পারে, যা নাসার জন্য ‘খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি’ তৈরি করতে পারে।

ম্যাকডাওয়েল আরও বলেন, ‘মহাকাশের খেলায় আমরা “ইলন টাইম” কথাটা বলি। যদি তিনি বলেন যে তিনি এক বছরের মধ্যে কিছু করবেন, তাহলে সেটাকে তিন বছর ধরে রেখে আপনার ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে রাখুন।’

আশাবাদের কোনো কারণ আছে কি?

বাণিজ্যিক মহাকাশযাত্রা দ্রুত বাড়ছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিগুলো মহাকাশকে পুঁজি করে পৃথিবী ছাপিয়ে নতুন অর্থনীতি গড়ার চেষ্টা করছে।

ম্যাকডাওয়েল বলেন, জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন এবং কিছু চীনা উদ্যোক্তা প্রতিযোগিতায় আছে। স্পেসএক্সের মতো বড় পরিসরে কেউ চেষ্টা করছে না। স্পেসএক্স যদি স্টারশিপকে চালু করতে পারে, পারতে তাদের হবেই, তবে এ শিল্পে তারাই নেতৃত্ব দেবে।

তাহলে শেষ তিনটি পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পরও কি আশার কোনো জায়গা আছে?

ম্যাকডাওয়েল বলেন, হয়তো আশাবাদ নয়, তবে হিসাবি আত্মবিশ্বাস অবশ্যই আছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র ভরয গ য স প সএক স র ল বল ন অন ক ব য রক ট র জন য আরও ব

এছাড়াও পড়ুন:

সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী

চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।

বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

নিখুঁত নয়

জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।

গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’

জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।

জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।

তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।

আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন

তবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।

ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।

বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’

তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’

কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’

আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।

এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’

আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ