কোরবানির ঈদের পরই চাঙা হওয়ার কথা দেশের কাঁচা চামড়ার বাজার। বছরে ব্যবহৃত ৮০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয় এই মৌসুমে, যা চামড়া শিল্পের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। তবে সেই ‘স্বর্ণসময়ও’ এবার রঙ হারিয়েছে। সরকার বর্গফুট প্রতি দাম নির্ধারণ করলেও উত্তরাঞ্চলের বাজারে তার প্রতিফলন নেই। চাহিদা নেই, নেই ন্যায্যমূল্যও। খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মৌসুমি সংগ্রাহক সবাই লোকসানে বিক্রি করছেন চামড়া। কেউ কেউ বলছেন, প্রতি বছরই একই দৃশ্য দেখা যায়, কাগজে থাকে দাম, কিন্তু মাঠে নামে ধস। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উত্তরাঞ্চলের সেই ব্যবসায়ীরা, যারা প্রান্তিক পর্যায় থেকে চামড়া সংগ্রহ করে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছেন। তারা দামের স্বপ্ন দেখেই লোকসানে হেঁটে যাচ্ছেন।

এবারও ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৬০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। ছাগলের চামড়ার দাম ছিল ২০-২৫ টাকা। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নওগাঁসহ অন্তত ১২টি জেলার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চামড়ার দাম কোথাওই সরকারি রেট ছুঁতে পারেনি, বরং অনেক জায়গায় চামড়া বিক্রি হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৪৫-৫০ টাকায়।

গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার চামড়া ব্যবসায়ী জহুরুল হক বলেন, গতবারও লোকসান গুনেছি, এবার ভেবেছিলাম দাম উঠবে। কিন্তু এবারও গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৭৫০ টাকায় বিক্রি করতে পেরেছি, যেখানে সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এটা হওয়া উচিত ছিল অন্তত ১২০০ টাকা।

দিনাজপুর সদর উপজেলার চামড়া সংগ্রাহক রহিম উদ্দিন বলেন, তিনটা গরুর চামড়া তুলেছিলাম, সবগুলো মিলে বিক্রি করেছি মাত্র দুই হাজার একশ’ টাকায়। লবণ, ভ্যান, লেবারের খরচ দিয়ে এখনও হিসাব মিলাতে পারিনি। প্রতি বছরই এমনটা হয়। কিন্তু কেউ আসে না দেখতে, আমরা কেন লোকসান করছি।

কুড়িগ্রামের রাজারহাটের খুচরা ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক বলেন, এই এলাকায় কোনো ট্যানারি মালিক আসে না সরাসরি। যাদের কাছে বিক্রি করতে হয়, তারা নিজেদের মতো করে দর বলে। এবার ৬৫০ টাকার বেশি কেউ দেয়নি, অথচ সরকার বলছে, দাম নাকি ১২০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এই দামের চিহ্নও আমরা দেখিনি।

জয়পুরহাট সদর উপজেলার হাটে চামড়া বিক্রি করতে আসা কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, গরুর চামড়া দিয়েছি ৭০০ টাকায়। অথচ কোরবানির আগে শুনেছি দাম বেড়েছে। প্রশ্ন হলো, কার জন্য বেড়েছে? যারা শহরে বড় বড় গোডাউনে বসে? 

নওগাঁর পত্নীতলার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বলেন, ঈদের দিন ভোর ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ঘুরেছি শুধু চামড়া সংগ্রহ করতে। সবমিলিয়ে ১৮টা গরুর চামড়া তুলেছি। কিন্তু দাম উঠেছে এত কম যে একরকম ভেঙেই পড়েছি। মনে হচ্ছে এই ব্যবসা আর করব না।

রংপুরের বদরগঞ্জের এক সাধারণ কোরবানিদাতা জাকির হোসেন বলেন, ছাগলের চামড়া নিতে কেউ রাজি হয়নি। মসজিদে দিলেও বলেছে- রাখার জায়গা নেই। শেষ পর্যন্ত পাশের ডোবাতে ফেলে দিয়েছি। কষ্ট লাগে, কিন্তু কিছু করারও নেই।

ঈদের মৌসুমে চামড়া সংগ্রহে নামেন কয়েক হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীরাই মূলত গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করেন। কিন্তু পরিবহন, লবণ, লেবার ও সংরক্ষণ ব্যয় শেষে অনেকেরই ঘরে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে।

একসময় ছাগলের চামড়াও যুক্ত হতো চামড়া শিল্পে। এখন সেই চামড়া কেউ নিতে চায় না। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছাগলের চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।

রংপুরের মিঠাপুকুরে স্থানীয় মসজিদের খাদেম মোজাম্মেল হক বলেন, লোকে ছাগলের চামড়া মসজিদে দিতে আসছে, কিন্তু কেউ নিতে চায় না। দুই-তিন জায়গায় ফোন দিয়েও কেউ নেওয়ার আগ্রহ দেখায়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, ছাগলের চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণে খরচ বেশি, অথচ চূড়ান্ত উৎপাদনে মূল্য কম। ফলে চাহিদা কমে যাওয়ায় এই চামড়া এখন প্রাসঙ্গিকতাই হারাচ্ছে।

বাংলাদেশে চামড়া শিল্পে বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের সম্ভাব্য রপ্তানি আয় হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও দূরদর্শিতার অভাবে এই শিল্প নিয়মিত ক্ষতির খাতায় নাম লেখাচ্ছে। 

সাভার ও হেমায়েতপুরের ট্যানারি মালিকদের প্রতিনিধি আজিজুল হক অভিযোগ করে বলেন, জেলায় জেলায় চামড়া ঠিকমতো সংরক্ষণ হয় না। লবণের পরিমাণ কম থাকে, অনেক সময় পচে যায়। তাই দাম কম দিতে হয়।

তবে খুচরা ব্যবসায়ীদের পাল্টা অভিযোগ, ট্যানারি মালিকরাই বাজারে একচেটিয়া দখল করে রেখেছে। তারা সিন্ডিকেট করে দরপতন ঘটায়। প্রতিবারই ঈদের পর তারা অজুহাত দেয় চামড়া ভালো না, সংরক্ষণ ঠিক হয়নি। অথচ তারাই আগে কোনো দিকনির্দেশনা দেন না।

বগুড়া, জয়পুরহাট ও গাইবান্ধার কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ঈদের সময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো তদারকি দেখা যায়নি। কোথাও কোথাও দাম লিখে রাখার জন্য কাগজ দেওয়া হলেও কেউ তা মানেনি। স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টিকে ‘ব্যবসায়িক বিষয়’ বলে এড়িয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.

সেলিম রায়হান এক গবেষণায় উল্লেখ করেন, চামড়া বাজারে সরকার নির্ধারিত দাম মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা বারবার লোকসানে পড়ছেন। তার মতে, মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য, পরিবহন ও সংরক্ষণ সংকট এবং বাজারে স্বচ্ছতার অভাবে মৌসুমি এই বাজার প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই, কেবল দাম ঘোষণা করলেই চলবে না, মাঠ পর্যায়ে কার্যকর নজরদারি ও সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন।

বগুড়া চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির নেতা নাজির হোসেন বলেন, বছরের পর বছর আমরা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের বাস্তবায়ন দেখি না। ট্যানারি মালিকরা মাঠ পর্যায়ের চামড়া কিনতে আগ্রহী নন, বরং বিভিন্ন দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কম দামে সংগ্রহ করেন। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা। তারা চামড়া কিনে সঠিক দামে বিক্রি করতে পারে না, অথচ সরকারের কাছে তাদের কথা পৌঁছায় না। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরে অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, একসময় দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত ছিল চামড়া শিল্প। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে সেই শিল্পকেই গলা টিপে ধরা হচ্ছে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সিন্ডিকেট, নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মাঠ পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বছরের একমাত্র উৎসবকালেই যখন ক্ষতির মুখোমুখি হন, তখন প্রশ্ন ওঠে এই শিল্প আসলে কার স্বার্থে চলছে?
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প র ন ত ক ব যবস য় ম ঠ পর য য় ব যবস য় র ই ব যবস ক বল ন ন বল ন ক রব ন র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

অপ্রাপ্তবয়স্কের যৌন হয়রানির ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে রিয়াল ডিফেন্ডারের আড়াই বছরের কারাদণ্ড দাবি

এক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে জড়িয়ে তৈরি করা যৌন হয়রানির ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে রিয়াল মাদ্রিদের ডিফেন্ডার রাউল আসেনসিওর বিরুদ্ধে আড়াই বছর কারাদণ্ডের আবেদন জানিয়েছে স্পেনের সরকারি কৌঁসুলি দপ্তর।

খেলাধুলাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য অ্যাথলেটিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিয়াল যুব দলের সাবেক দুই খেলোয়াড় এক অপ্রাপ্তবয়স্ক ও আরেক তরুণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন এবং তাঁদের অজান্তে সেই দৃশ্য গোপনে ভিডিও করেন। আসেনসিও ওই ঘটনার অংশ ছিলেন না, তবে তিনি ভিডিওটি চেয়ে নিয়ে দেখেন এবং পরে তা আরেক বন্ধুকেও দেখান।

স্পেনের ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৭৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এটি গোপনীয়তা লঙ্ঘনের দুটি অপরাধ। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, ঘটনাটির পর ওই অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ও তরুণী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হন। তাঁদের প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ হাজার ইউরো করে দেওয়ার জন্যও আবেদন জানানো হয়েছে। একই মামলায় আরও তিনজনের বিরুদ্ধেও কারাদণ্ড চাওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুননিষেধাজ্ঞা মেসির পিছু ছাড়ছে না, এবার নিষিদ্ধ হলেন তাঁর দেহরক্ষী৪ ঘণ্টা আগে

গত মে মাসেই এক প্রতিবেদনে দ্য অ্যাথলেটিক জানায়, এক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে নিয়ে তৈরি করা যৌন হয়রানির ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হতে পারেন রিয়ালের মূল দলের সদস্য আসেনসিও। ঘটনাটি ঘটেছে ২০২৩ সালে স্পেনের গ্রান ক্যানারিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের এক বিচ ক্লাবে।

রাউল আসেনসিকে গত মৌসুমে নিয়মিত মাঠে দেখা গেছে

সম্পর্কিত নিবন্ধ