ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর অনেক বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছেন। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলিয়ন ডলার ফেডারেল ফান্ড বন্ধ করে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছেন। ট্রাম্পের আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্ট হার্ভার্ডের ফান্ড বন্ধ করার নির্দেশ দেননি।

ট্রাম্প তাঁর আগের মেয়াদেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন। হার্ভার্ড ও এমআইটি মিলে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের জুলাই মাসে মামলাও করেছিল। এলিট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ট্রাম্পের এই ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে বিভিন্ন বিশ্লেষক বিভিন্নভাবে দেখছেন।

যদিও ট্রাম্প যুক্তি দিয়েছেন, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ‘ইহুদিবিরোধী কর্মকাণ্ড বা অ্যান্টিসেমিটিজম’ বেড়ে গেছে। বস্তুত এ কথা প্রচার করে মানুষের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করছেন। তবে স্কলার সমাজে এই যুক্তি তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো তাদের দেশের প্রেসিডেন্টকে সাধারণত আলাদা করে গুরুত্ব দেয় না; বলা চলে, আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়ার সংস্কৃতি নেই। প্রেসিডেন্টরাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্বে জড়াতে যান না।

বিশ্ব র‍্যাঙ্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির বেশির ভাগ বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো হলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। হার্ভার্ড, এমআইটি, প্রিন্সটন, স্ট‍্যানফোর্ড, কলোম্বিয়া, ইয়েল, ইউপ‍্যান ইত‍্যাদি সবই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায়, সেগুলো বস্তুত রাজ‍্য বা স্টেটের প্রতিষ্ঠান।

যেমন ইউনিভার্সিটি অব ক‍্যালিফোর্নিয়া-বার্কলে (ইউসি-বার্কলে), মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি, ভার্জিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি—এমন অনেক প্রতিষ্ঠান। প্রাইভেট হোক কিংবা পাবলিক, বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোয় প্রেসিডেন্ট কিংবা ফেডারেল সরকারের সরাসরি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের সুযোগ বা সংস্কৃতি নেই।

ফলে বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। এমনকি ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো অনেক বেশি স্বায়ত্তশাসিত ও স্বাধীন।

আরও পড়ুনপাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সংস্কার এখনই প্রয়োজন৩০ এপ্রিল ২০২৫

একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকলেও ফান্ড বা আর্থিক অনুদান এবং গবেষণানীতিতে প্রভাব রাখে। ফেডারেল সরকারের ফান্ড বা অর্থায়ন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই কমবেশি বরাদ্দ থাকে।

সেই ফান্ড বণ্টন ও প্রদানে ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো ফেডারেল সরকারের ফান্ড ছাড়াও প্রাইভেট ফান্ড, স্টুডেন্টদের টিউশন ফি ও ডোনেশন পেয়ে থাকে। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের গবেষণা কার্যক্রম থাকে। ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে অনেক টাকা পায়।

তা ছাড়া অনেক ধনী পরিবার থেকে ডোনেশন পায়। পাবলিক বা স্টেট ইউনিভার্সিটিগুলো রাজ‍্য সরকার থেকেও অর্থ পায়। যেমন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এনডোর্মেন্ট বা আর্থিক তহবিল ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। পৃথিবীর যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে তাদের আর্থিক তহবিল বেশি।

সুতরাং ট্রাম্প যে ফান্ড বন্ধ করেছেন, তাতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কার্যক্রম ব‍্যাহত হবে, তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে না। ট্রাম্প বস্তুত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেডারেল ফান্ড বন্ধ করেছেন, প্রাইভেট ফান্ড বন্ধ করতে পারবেন না।

ট্রাম্প তাহলে কোন ক্ষমতাবলে হার্ভার্ডের ফান্ড বন্ধ করলেন? রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টেরও অনেক প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে। নির্বাহী আদেশ বা এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখেন।

সেই ক্ষমতাবলেই তিনি এই কাজ করেছেন। হার্ভার্ড প্রশাসনও চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে নেই। কারণ, প্রেসিডেন্টের কাজের বিরুদ্ধেও মামলা করার অধিকার এ দেশের প্রতিষ্ঠানের আছে।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট (উপাচার্য–তুল‍্য) এলেন গার্বার লড়ে যাচ্ছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ মামলা করেছে ও আইনি লড়াই চলছে।

আরও পড়ুনহার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বনাম আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত২৯ এপ্রিল ২০২৫

ট্রাম্প চার বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না, কিন্তু হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থাকবে। ট্রাম্প হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ফান্ড বন্ধ করতে পারবেন, কিন্তু সেটা কত দিন টিকবে, সময়ই বলে দেবে।

চলমান আইনি লড়াইয়ে যদি ট্রাম্প জিতেও যান, তাতেও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির উজ্জ্বলতা বাড়বে। চার বছর পর হার্ভার্ড হয়তো আরও প্রবলভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু এই যে একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পৃথিবীর শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে লড়তে পারে—এর নামই ব‍্যবস্থাপনা, এর নামই সাহস।

এই ব‍্যবস্থাপনা যেসব সমাজে গড়ে উঠেছে, সেসব সমাজ সহজে ভেঙে পড়ে না। সব দিক দিয়ে ভেঙে পড়ে না। আর একটা প্রতিষ্ঠানের এমন সাহস, স্বতন্ত্রতা অন‍্য প্রতিষ্ঠানকে শক্তি দেয়। অন‍্য প্রতিষ্ঠানকেও স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।

যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোর উপাচার্য (অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রেসিডেন্টও বলা হয়) নিয়োগে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রি এই নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। সার্চ কমিটি গঠনের মধ‍্য দিয়ে উপাচার্য পদের জন‍্য আবেদন চাওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে সেরা প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া হয়।

অন‍্যদিকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোয় রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। সে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী, এমনকি দলের অন্য নেতাদেরও প্রত্যক্ষ সুপারিশ থাকে।

এ জন্য একজন উপাচার্য কখনোই সরকারের অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে চান না। কারণ, তাঁর চাকরি হারানোর ভয় থাকে। উপাচার্য যতটা দলীয় হয়ে উঠতে পারেন, চাকরির নিশ্চয়তা তাঁর ততই বেশি থাকে।

আহমদ ছফা ৩০ বছর আগে তাঁর গাভী বিত্তান্ত বইয়ে এমনই উপাচার্যের চরিত্র তুলে ধরেছেন এবং দুর্ভাগ‍্যজনকভাবে সেই চর্চা থেকে, সেই মানের উপাচার্যদের বলয় থেকে দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো মুক্ত হয়নি আজও।

বর্তমানের মতো তখনো ট্রাম্প সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইমিগ্রেশন–বিষয়ক বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করেছিলেন। ইউপ‍্যানের প্রেসিডেন্ট এমি গুটম‍্যান সেসব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতেন। তাঁর সেসব প্রতিবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হতো। সরকারের বিভিন্ন নিয়মনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার কথা ব‍্যক্ত করতেন। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, এ দেশের একজন উপাচার্য দেশের সরকারের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান! এই সব দেশে যেন বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই একটি রাষ্ট্রতুল‍্য প্রতিষ্ঠান! দেশের ভেতর যেন এক আলাদা দেশ। সরকারের পালাবদলের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক রূপ বদলায় না।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো দেশের যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে জ্ঞান–গরিমায় ভিন্ন। সেখানে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পণ্ডিত, বিশ্লেষক, গবেষক, লেখক, অধ‍্যাপক থাকেন। বিশ্ববিদ‍্যালয়ই যদি ক্রমে সরকারের হুকুমের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, তাহলে আর অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কি করে মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াবে?

যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে যায়, সে দেশের অন্য বহু প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই সরকারের অনুগত প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, উঠতে বাধ্য।

দুর্ভাগ‍্যজনক হলো, আমাদের সরকারগুলো বিশ্ববিদ‍্যালয়কে তাদের হুকুম বা ইচ্ছার বলয়ের মধ্যেই রাখতে চায়। ফলে ইচ্ছা করেই সরকারের পছন্দমতো উপাচার্য, সহ–উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ রাখাই সরকারের মূল লক্ষ‍্য থাকে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় মূলত সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে এবং ক্ষমতা থেকে সরাতে বেশ ভূমিকা রাখে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটে গেছে, সেই সরকার ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়েছে।

এ দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো তাই রাজনৈতিক মাঠে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে যতটা ভূমিকা রেখেছে, জ্ঞান-গবেষণায় ততটাই পিছিয়েছে। এটা আমাদের জন‍্য ঐতিহাসিক এক অভিশাপ বলেই আমি বিবেচনা করি। এবং এই জটিলতা থেকে উত্তরণের চেষ্টা কোনো সরকারই করেনি; বরং নিজেদের দলের ছাত্রদের নগ্নভাবে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছে। দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে।

শিক্ষক সমিতিগুলো ছিল সরকারের মুখপাত্র। আর ছাত্রসংসদগুলোতে নির্বাচন না দিয়ে দলীয় ছাত্রদের দিয়ে ক‍্যাম্পাস, হল দখল একটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সবই এখন প্রতিষ্ঠিত চর্চা এবং এই চর্চার মধ‍্যে থেকে আগামীর তরুণেরাও বেরিয়ে আসতে পারছেন না।

সরকারকে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা কী আশা করে। কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বলয় থেকে মুক্ত হতে না পারলে দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো কোনো দিনই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে না।

ট্রাম্প যখন প্রথম ক্ষমতায় আসেন, আমি তখন ইউনিভার্সিটি অব প‍েনসিলভানিয়াতে (ইউপ‍্যান) পোস্টডক্টরাল গবেষক হিসেবে কাজ করছিলাম। তখন ইউপ‍্যানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এমি গুটম‍্যান।

বর্তমানের মতো তখনো ট্রাম্প সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইমিগ্রেশন–বিষয়ক বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করেছিলেন। ইউপ‍্যানের প্রেসিডেন্ট এমি গুটম‍্যান সেসব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতেন। তাঁর সেসব প্রতিবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হতো। সরকারের বিভিন্ন নিয়মনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার কথা ব‍্যক্ত করতেন।

আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, এ দেশের একজন উপাচার্য দেশের সরকারের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান! এই সব দেশে যেন বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই একটি রাষ্ট্রতুল‍্য প্রতিষ্ঠান! দেশের ভেতর যেন এক আলাদা দেশ। সরকারের পালাবদলের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক রূপ বদলায় না।

আমাদের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো কি কখনো এমনভাবে গড়ে উঠবে? এতটুকু না হোক অন্তত কাছাকাছি? আমরা চাই, আমাদের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোর মেরুদণ্ড কিছুটা হলেও হার্ভার্ডের মতো হোক। বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো হোক তারুণ‍্যের ও দেশের মানুষের আলোকবর্তিকা।

রউফুল আলম টেকসই শিক্ষা ও গবেষণাবিষয়ক লেখক

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ র ভ র ড ইউন ভ র স ট য ক তর ষ ট র র প ফ ড র ল সরক র র দ শ র ব শ বব দ অবস থ ন ন য় সরক র র ন ই সরক র র উপ চ র য র ক ষমত য লয়গ ল আম দ র কর ছ ন প বল ক

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ