‘পুশ ইন’ কি দিল্লির বৈরী নীতির অংশ নয়
Published: 11th, June 2025 GMT
ইতিহাস যা-ই বলুক, একটি জনগোষ্ঠীকে তাদের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদেরই ভূখণ্ড থেকে তুলে নিয়ে অন্য দেশে চালান করে দিচ্ছে আজকের ভারত।
অন্যদিকে যে বাংলাদেশ প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ হওয়া দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠীকেও আশ্রয় দিয়েছে, তার ভূখণ্ডেই ঠেলে (পুশ ইন) দেওয়া হচ্ছে আরেক সীমান্ত-সংলগ্ন দেশের নাগরিক মুসলমান নর-নারীকে।
এভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মুসলমানদের পণ বানানোর পাশাপাশি নিজ দেশের ইস্যুকে আন্তসীমান্ত দ্বন্দ্বে পরিণত করা হচ্ছে। মুসলমান ভোটার-সমৃদ্ধ পশ্চিম বাংলা ও আসামে নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারতের কেন্দ্রীয় হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের এমন পদক্ষেপ সে দেশের ভেতরকার গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও বিবেকবান মানুষের কাছেও কি প্রশংসিত হচ্ছে?
এ পর্বে কিছু মুসলমান ভারতীয়র গলা ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর এ কাজটি দিল্লি করছে জুলাই ২০২৪ বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে। ঢাকার প্রতি বৈরী নীতির অংশ হিসেবেই যে এই উদ্যোগ, সেটা বাংলাদেশের মানুষের না বোঝার কিছু নেই।
প্রথমে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর ভিসা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ এবং একপর্যায়ে বাংলাদেশের জন্য ভারত দিয়ে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করা হলো।
গণতন্ত্র হত্যাকারী শাসক হাসিনার বিরুদ্ধে একটি সফল ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি তৎপরতা আখ্যা দিয়ে ভারতীয় ‘গদি মিডিয়া’ ব্যাপক গুজব ও কুৎসা রটনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এর আগে বাংলাদেশের গণমানুষের বিক্ষোভের মুখে পিছু হটা হাসিনাকে দিল্লিতেই আশ্রয় দেওয়া হলো বাংলাদেশিদের আবেগের প্রতি স্পর্শকাতরতা না দেখিয়েই।
এ-জাতীয় পরিস্থিতিতে যৌথ নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা, চোরাচালানের মতো দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো কি তাহলে বাংলাদেশের দৃষ্টির আড়ালেই রাখা যাবে?
দিল্লিওয়ালাদের এহেন মনোভাব এবং কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ভারত ও বাংলাদেশের বাইরে পররাষ্ট্রনীতির পণ্ডিত, এমনকি কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন বৈশ্বিক নাগরিকেরা বোঝেন না, এমন তো নয়!
আরও পড়ুনভারত থেকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ কেন গ্রহণযোগ্য নয়১৪ মে ২০২৫ভারত এখন বলতে চায় ‘পুশ ইন’ করানো ব্যক্তিরা তার দেশে অনুপ্রবেশকারী এবং অনেকে অনেক দিন ভারতে বসবাস করলেও তারা সেখানকার বৈধ নাগরিক নয়।
নিজের নাগরিকদের রাষ্ট্রহীন করার বিষয়ে বিদেশি গণমাধ্যম, যেমন বিবিসি ভিকটিমের নাম ধরে রিপোর্ট করেছে, নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশের দিকে ‘পুশ ইন’ করা মুসলমানেরা ভারতের নাগরিক।
তাদের কেউ যদি সত্যি বেড়াতে যাওয়া বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে থাকে, তাহলে প্রমাণ সাপেক্ষে নিয়ম অনুযায়ী সসম্মানে তাদের ফেরত পাঠানো যেত। তাই বলে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশ তার নাগরিক মানবে, সে রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই ঢাকার। নরেন্দ্র মোদির বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প কি ‘অবৈধ’ ভারতীয়দের আমেরিকায় স্বাগত জানাচ্ছেন?
নিজের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির দাবার চাল দিতে ব্যবহার করে রাষ্ট্র এবং সভ্যতা হিসেবে ভারত নিজের ভয়াবহ দৈন্য প্রকাশ করছে এবং এটা তার নেতৃবৃন্দ ও নীতি পরিচালনাকারীরা করছেন সচেতনভাবেই।
বাংলাদেশকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলায় ফেলে কতটা ঠিক আচরণ করছে, সেই আত্মসমালোচনা ‘দূর কি বাত’, দিল্লি সেই আত্মোপলব্ধির ধারকাছে আছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং বাংলাদেশ নিয়ে তার পদক্ষেপ, যেমন প্রফেসর ইউনূস সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পারতপক্ষে যোগাযোগ না রাখার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে ক্রোধ, যে ক্রোধের উৎস ঢাকায় তার অনুগত শাসকের পতন।
ভারত বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে ক্রুদ্ধ হবে তার যথাযথ কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না, এর উল্টোটা ছাড়া। দিল্লির গোপন ও প্রকাশ্য মদদে হাসিনা এ দেশের মানুষকে দেড় যুগ গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকারবঞ্চিত রেখেছে, এক ফ্যাসিবাদী শাসককে মহান প্রমাণ করতে সচেষ্ট থেকেছে।
ভুলে গেলে চলে না ২০২৪-এর ডামি নির্বাচনের পর পরই সংক্ষুব্ধ বাংলাদেশিরা দেশে-বিদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জন শুরু করেছিল, হাসিনা খেদাও আন্দোলনের আগেই। সে অবস্থায় বাংলাদেশের জনগণের ওপর নতুন দিল্লির রাগ-ক্ষোভ পরাজিত পক্ষের ক্রোধের সঙ্গে তুলনীয়। যদিও দিল্লির ক্রোধ বেশি থাকার কথা সীমান্ত সংঘাতে জড়ানো পারমাণবিক শক্তি পাকিস্তান এবং অধিক শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ওপর।
বাংলাদেশের দিকে তার মুসলমান নাগরিকদের সংকীর্ণ কারণে ঠেলে পাঠিয়ে ভারত বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে শুধু সংখ্যালঘুর প্রতি জুলুমই প্রমাণ করছে না, যাকে এত দিন ধরে বলত ১৯৪৭-এর দেশভাগ, সেই মুসলমান জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি পাকিস্তান এবং এখনকার বাংলাদেশ গঠনের যথার্থতাকেই নিশ্চিত করে।শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতি নমনীয়তা আর পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন প্রতিবেশীর সামনে এসে অগ্নিমূর্তি ধারণ করাটা চাণক্য কৌটিল্যের ‘মাৎস্যন্যায়’ নীতিরই আধুনিক রূপ, যে নীতিতে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে।
দিল্লির শাসকেরা ওই পুরোনো নীতিতেই বুঁদ হয়ে আছেন, যখন বাংলাদেশের মানুষের প্রতি শান্তি ও সৌহার্দ্যের হাত বাড়ালে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অচলাবস্থার বরফ গলা শুরু হতে পারত।
জাপান, জার্মানি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা একসময় তাদের পূর্বের শাসকদের অন্যায় কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চেয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের কাছে; তাতে তাদের ক্ষতি হয়নি।
বাংলাদেশে বিগত দেড় দশকে হাসিনার কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়ার মতো কোনো নৈতিক যুক্তি নেই দিল্লির। অস্বীকার করা যাবে না, গুমের বাংলাদেশি ভিকটিম আবিষ্কৃত হয়েছে ভারতে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর রিপোর্টে উঠে এসেছে হাসিনা শাসনকালের গুম, খুন, অত্যাচারের কাহিনি। সারা বিশ্ব দেখেছে কেমন হয়েছে তখনকার বাংলাদেশের তিন তিনটি জাতীয় নির্বাচন।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বইয়ে এবং ২০১৪-এর নির্বাচনের আগে পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের ঢাকা সফরকালে হাসিনার অনুকূলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে দিল্লির নগ্ন হস্তক্ষেপ এখানকার রাজনৈতিক শক্তি ও সচেতন মানুষকে ভীষণভাবে আহত আর অপমানিত করে।
সেই অত্যাচারী হাসিনা রাজত্বের যখন অবসান হলো, সভ্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল এক রকম, ভারতের ভিন্ন। অতঃপর ইউনূস সরকারের প্রতি দিল্লি ও ভারতীয় মিডিয়ার আচরণ হয়ে পড়ে অনেকটাই খড়্গহস্ত অথচ বাকি পৃথিবী প্রফেসর ইউনূসের প্রতি প্রবলভাবে শ্রদ্ধাশীল।
আবার হাসিনা আমলে, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের মধুচন্দ্রিমার কালেও, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সীমান্তে হোক বা জাতিসংঘে ভোটাভুটিতে হোক, বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি ভারত।
তাহলে কেউ তো ধরে নিতেই পারে ভারত বাংলাদেশকে প্রতিবেশী হিসেবে বন্ধু রাষ্ট্র জ্ঞান করে না, যদি না সে ‘করদ রাজ্য’ হয়। এবং কৌটিল্যেরই ফর্মুলায়, যদি ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ হয়, ভারতের ‘জানি দোস্ত’ ইসরায়েলের শত্রু ইরানের স্ট্যাটাস কী দাঁড়ায় বা ভারত বন্ধু রাশিয়ার শত্রু আমেরিকার? অথবা চিরশত্রু পাকিস্তানের বন্ধু তুরস্ক বা চীনের বন্ধু যখন বাংলাদেশ?
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় ‘মানব পাচারের’ মতো কূটচালের সাফল্য ও নেতিবাচক প্রভাব দুই-ই ভালো করে জানেন সে দেশের কূটনীতিক ও কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা। যেমন কিঞ্চিৎ জানেন অন্য বন্ধুপ্রতিম দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও, যাদের কাছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কেমন তা অজানা নয়।
বাংলাদেশের দিকে তার মুসলমান নাগরিকদের সংকীর্ণ কারণে ঠেলে পাঠিয়ে ভারত বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে শুধু সংখ্যালঘুর প্রতি জুলুমই প্রমাণ করছে না, যাকে এত দিন ধরে বলত ১৯৪৭-এর দেশভাগ, সেই মুসলমান জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি পাকিস্তান এবং এখনকার বাংলাদেশ গঠনের যথার্থতাকেই নিশ্চিত করে।
যে মুহূর্তে বাংলাদেশ সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, হত্যাকাণ্ড, গুম, জেল, জুলুম, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ বড় বড় অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে, এবং দেশকে বিশ্ব সমাজে একটি মর্যাদাশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট, তখন ভারত গঠনমূলক যোগাযোগ ও সংলাপ থেকে দূরে সরে আছে।
হাসিনা আমলে সই করা কিছু অসম এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী গোপন যুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে জনমতের চাপ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ঢাকা এখন পর্যন্ত চুক্তিগুলো ঢেকেই রেখেছে, সম্ভবত সম্পর্কের অবনতি ঠেকাতে।
কূটনীতি পারস্পরিক সৌজন্যের দাবি রাখে, যা বোধ হয় শুধুই গোপন ব্যাপার বা পেঁচিয়ে অর্ধেক কথা বলার বিষয় নয়; আগামী দিনে দিল্লি ঢাকার সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক গড়তে ও রাখতে চায়, তার ধারণা বাংলাদেশের জনগণকে সরাসরি দিয়ে দিলেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন যুগ শুরু হতে পারে।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল দ শ র জন জনগ ষ ঠ ম সলম ন পরর ষ ট সরক র র প শ ইন র শত র প রক শ র বন ধ র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী
চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’
মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।
মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
নিখুঁত নয়
জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।
গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’
জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।
জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।
তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি
চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।
আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনতবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।
ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।
আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।
বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’
তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’
কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’
আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।
এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’
এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’
আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫