আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দল তরুণদের কতটা ভোট পেতে পারে– এ নিয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেম। গত সোমবার প্রকাশিত জরিপটিতে অংশ নিয়েছেন ২০০ তরুণ; সবার বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। জরিপের ফল বলছে, আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ৩৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট পাবে বিএনপি। ২১ দশমিক ৪৫ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে জামায়াতে ইসলামী। তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থান তৃতীয়; ভোট ১৫ দশমিক ৮৪। এ ছাড়া ওই তরুণরা মনে করেন, বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পেলে ১৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ ভোট পাবে। অন্যান্য ইসলামিক দলের বাক্সে যেতে পারে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোট।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মাত্র ৯ মাস পর পরিচালিত জরিপটির ফল কৌতূহলোদ্দীপক। যে গণঅভ্যুত্থান দেশের রাজনীতিতে পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে ‘নতুন বন্দোবস্ত’ সৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা তৈরি করেছে বলে দাবি করা হলো, তা জরিপে তরুণদের অভিব্যক্তিতে উঠে এলো না কেন? বিএনপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদানের মধ্য দিয়ে তারা তো মনে হচ্ছে, সেই ‘পুরোনো’ বন্দোবস্তকেই সমর্থন জোগালেন। আরেকটি বিষয় হলো, গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ও কার্যত নতুন বন্দোবস্তের প্রবক্তা এনসিপির সমর্থন জামায়াতে ইসলামীর নিচে কেন? নিজেদেরই সম্ভাব্য ভোটব্যাংকের মধ্যে এমন অবস্থান জনগণের বাকি অংশের মধ্যে তাদের অবস্থান সম্পর্কে কী বার্তা দেয়? 

নিঃসন্দেহে জরিপটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। প্রথমত, এর নমুনার আকার খুবই ছোট; বিশেষত জরিপে অংশগ্রহণকারী জনগোষ্ঠী বা এজ গ্রুপের আকার বিবেচনায়। সরকারি পরিসংখ্যানমতে, ১৫-৩৪ বছর বয়সীরা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশের বেশি। মোট ভোটারের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। দ্বিতীয়ত, যদিও জরিপে শহর-গ্রাম ও জেন্ডার অনুপাত ভারসাম্যপূর্ণ (৫০:৫০); জরিপের জন্য আট বিভাগের দুটো করে জেলা এবং প্রতিটি জেলার দুই উপজেলা বাছাইয়ের সময় বিবেচনা কী ছিল, তা পরিষ্কার নয়। এখানে কিন্তু এমন বহু জেলা-উপজেলা আছে, যেখানকার বাসিন্দারা ব্যাপকভাবে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতের অনুসারী। 

অবশ্য জরিপের এই ফলাফল নিয়ে খোদ সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানই কিছু সতর্কবাণী দিয়েছেন। জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, শুধু ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। এখানে যে মতামত এসেছে, তা শুধু বাছাই করা তরুণদের মতামত। এটাকে দেশের পুরো জনগোষ্ঠী বা অন্যান্য বয়সের মানুষের মতামত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। বিশেষত রাজনীতির মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে তা সংগত হবে না (প্রথম আলো, ৮ জুলাই, ২০২৫)।

এমন প্রশ্নও করা যেতে পারে, জরিপে উঠে আসা মতগুলো কি সংশ্লিষ্ট তরুণরা ভোটার হিসেবে দিয়েছেন? অর্থাৎ তারা কি বলেছেন, নিজেরা আগামী নির্বাচনে আলোচ্য দলগুলোকে ভোট দেবেন? না, জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই তরুণরা মনে করেন, সংশ্লিষ্ট দলগুলো আলোচ্য হারে ভোট পেতে পারে। জরিপ প্রতিবেদনেই তো বলা আছে, মত প্রদানকারী তরুণদের ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ এখনও ভোটার হননি। উপরন্তু এই জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণদের ৭৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এখনও সিদ্ধান্ত নেননি ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। ভোট দেবেন না বলে জানিয়েছেন ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। মোট কথা, জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণদের মত কতটা প্রতিনিধিত্বমূলক, সে প্রশ্নও তোলা যায়।

কেউ কেউ জামায়াতে ইসলামীর ভোট ২১ শতাংশ অতিক্রম করা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দলটি বেশির ভাগ নির্বাচনে জোটবদ্ধ ছিল। সেসব নির্বাচনে তাদের ভোট ৫ শতাংশের নিচে ছিল। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে একা লড়ে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে দলটি বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছে, ঠিক। এর পর থেকে তার প্রচার-প্রচারণা অবাধে চলছে, এটাও ঠিক। কিন্তু তাতে দলটির ভোট লাফ দিয়ে এতটা বেড়ে যাবে? মনে রাখতে হবে, বর্তমানে অনুকূল পরিস্থিতি পেলেও মহান মুক্তিযুদ্ধকালের ভূমিকা নিয়ে দলটির বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য দলটির নেতাদের এখনও সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়।

শুধু তা কেন? কত সময়ের মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসবে– এ প্রশ্নও করা হয়েছিল সানেমের জরিপে। এর উত্তরে ৩৯ শতাংশের বেশি বলেছেন, তারা জানেন না। সাড়ে ২২ শতাংশ বলেছেন, কখনোই না। অন্যদিকে মাত্র ১১ শতাংশের কিছু বেশি বলেছেন, পাঁচ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় আসবে।

যা হোক, পদ্ধতিগতভাবে বা অন্যান্য বিবেচনায় জরিপটির যতই দুর্বলতা থাকুক, অন্তত এনসিপি বিষয়ে তা প্রতিনিধিত্বমূলক। কারণ এনসিপি এ তরুণদেরই দল। তরুণরা তাদের পক্ষে আছেন– এ কথা বলেই দলটির নেতারা দাবি করছেন। পুরোনো দ্বিদলীয় ব্যবস্থার এক পক্ষ আওয়ামী লীগ তো রাজনীতির মাঠছাড়া হয়েছেই; অপরপক্ষ বিএনপিরও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। কিন্তু জরিপটি দেখাল বিপরীত বাস্তবতা।

আসলে এই বাস্তবতা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেরই ফসল। এর বহিরাঙ্গ দেখে বলা যেতেই পারে, তা অতীতের গণঅভ্যুত্থানগুলোর মতো রাজনৈতিক দল বা জোটের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। কিন্তু ইতোমধ্যে এ গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন অংশীজনের আলাপ থেকে এটা পরিষ্কার, আপাত দলবিহীন শিক্ষার্থীরা এর সূচনা ঘটালেও এর মূল শক্তি ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত তরুণরা। সন্দেহ নেই, এই গণঅভ্যুত্থানে অতীতের যে কোনো আন্দোলনের চেয়ে শিক্ষার্থী-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল। কিন্তু এর আদি পুঁজি জুগিয়েছিল তৎকালীন সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। আন্দোলনের প্রবল জোয়ারে ভেসে আসা মানুষের মধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে নানা স্বপ্ন ছিল বটে; রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মুখে সেগুলোর মান্যতাও দিয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের রাশ যেহেতু ছিল প্রতিষ্ঠিত শেষোক্তদের হাতে; শেষ হাসিটা তারাই হাসতে চলেছে। অন্যদিকে সময় যত গড়িয়েছে ততই শিক্ষার্থী-জনতা জীবনের রূঢ় বাস্তবতার ধাক্কায় নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেছে। 

এনসিপিও একই বাস্তবতা থেকে স্বতন্ত্র পথ ছেড়ে বিএনপির এ মুহূর্তের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামপন্থি দলগুলোর শক্তির ওপর ভর করে চলার চেষ্টা করছে। এনসিপি নেতারা যে নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে জামায়াত-হেফাজত ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে প্রায় সহমত পোষণ করছে, তা কাকতালীয় নয়। এ দলগুলো আর যাই হোক, বহুলশ্রুত নতুন বন্দোবস্তের দল নয়– তা নিয়েও কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে?

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন ব স তবত বল ছ ন দলগ ল দলট র এনস প ইসল ম ব এনপ দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

দুর্দশা শহীদ হাসিবের পরিবারে, পাননি সরকারি সহায়তা 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হাসিবুর রহমান (১৭) ‘শহীদ’ হিসেবে গেজেটভুক্ত হলেও সরকারী সহায়তা পায়নি পরিবার। 

৬ জুলাই দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে হাসিবের পরিবার থেকে এ অভিযোগ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন হাসিবের বড় চাচা তোতা মিয়া ঢালী। 

তিনি জানান, শহীদ হাসিবের বাবা দেলোয়ার হোসেন ঢালী প্যারালাইসিসে আক্রান্ত শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। তার দেখভাল করেন হাসিবের বৃদ্ধ দাদি, যিনি নিজেও শারীরিকভাবে অক্ষম। পরিবারটি বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। 

তোতা মিয়া ঢালী বলেন, “ শহীদ হাসিব গেজেটভুক্ত হলেও আমরা অধিকাংশ সরকারি সাহায্য পাইনি। আমাদের পরিবারকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। যদিও হাসিব দেশের ছাত্রদের ন্যায্য অধিকারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে।”

‘‘ভাতার জন্য বিভিন্ন স্থানে আমরা ঘুরেছি। শিঘ্রই হয়ে যাবে এমন আশ্বাস পেলেও জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনি।’’ অভিযোগ তোতা মিয়া ঢালীর। 

শহীদ হাসিবুর রহমানের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার উত্তর কানাইপুর গ্রামে। অভাব অনটনের সংসারে বড় হয়েছিলেন হাসিব। প্রতিবন্ধী পিতা আর নিজের ভরণপোষণের জন্য রং মিস্ত্রির কাজ শুরু করেন ঢাকার সাভারে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তিনি ৫ আগস্ট সাভারে গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয়রা উদ্ধার করে তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট হাসিব মারা যান। পরে তাকে দাফন করা হয় পৈত্রিক ভিটায়। তার সরকারি গেজেট নং ৭৭৭। 

দাদীর কাছে বড়ো হতে থাকেন মা-হারা হাসিব। নাতির মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না দাদী সিরাতুননেছা। তিনি বলেন, ‘‘আমার নাতি অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছিল। ওর বাবা প্রতিবন্ধী। আমি তাকে মুখে তুলে খাওয়াই। আমার নিজেরই বয়সের কারণে চলাফেরা করতে কষ্ট হয়; তবু করি। এ অবস্থায় নাতিটা মারা গেলো। শহীদ পরিবারের সবাই ভাতা পেলেও আমার ছেলে দেলোয়ার অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত।’’ 

এ বিষয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন আক্তারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, হাসিবের পরিবারের প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা ও ভাতা প্রাপ্তির জন্য তিনি উদ্যোগ নিবেন।

বেলাল//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শেখ হাসিনার মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ ‘ট্রেলারমাত্র’: তাজুল ইসলাম
  • গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ ‘ট্রেলারমাত্র’: তাজুল ইসলাম
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে’ গুলি করে পুলিশ: সপ্রানের গবেষণা
  • গণঅভ্যুত্থানে গুলি চালানোর নির্দেশ হাসিনা নিজেই দিয়েছিলেন: নাহিদ
  • সিরাজগঞ্জে ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা
  • অভ্যুত্থানের অর্জন ধরে রাখতে চাই বৈষম্যের বিলোপ: সাইফুল হক
  • জুলাই আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীর চিকিৎসা করাবেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী
  • দুর্দশা শহীদ হাসিবের পরিবারে, পাননি সরকারি সহায়তা