বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে
Published: 12th, June 2025 GMT
আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির এ পূর্বাভাসের পেছনে দুটি অনুমান রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে উন্নতি। দ্বিতীয়ত, ব্যবসা পরিবেশের উন্নতি এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে সংস্কারের সফল বাস্তবায়ন। বিশ্বব্যাংকের অনুমান বাস্তবে রূপ নিলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরের চেয়ে বাড়বে।
বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস বা বিশ্ব অর্থনীতির সম্ভাবনা শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন পূর্বাভাস রয়েছে। গত মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বিশ্বব্যাংক প্রতি ছয় মাস অন্তর ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি অঞ্চল ও দেশভিত্তিক পর্যালোচনা এবং পূর্বাভাস থাকে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাণিজ্য বাধা ও নীতি অনিশ্চয়তার প্রভাবে ২০২৫ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে, যা ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার পর সর্বনিম্ন।
বিশ্বব্যাংক গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছিল। জুনের প্রতিবেদনে তা কমিয়ে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এর আগে গত এপ্রিলে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে একই প্রাক্কলন ছিল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চলতি অর্থবছরে সাময়িক হিসাবে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করেছে।
বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ প্রতিবেদনে আগামী অর্থবছরে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে একই পূর্বাভাস ছিল। তবে গত জানুয়ারির ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ প্রতিবেদনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি যে বাজেট পেশ করেছে, সেখানে আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অনুমান করেছে।
বিশ্বব্যাংক মনে করছে, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে গিয়ে প্রবৃদ্ধি আরও বেড়ে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। সরকারের অনুমান হলো সাড়ে ৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক আগামী দুই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বাড়ার পূর্বাভাসের পেছনে মূল্যস্ফীতি কমে আসার প্রবণতাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। মূল্যস্ফীতি কমে ব্যক্তি খাতে ভোগ ব্যয় বাড়বে, যা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুদহার বাড়ানোর পর বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু এখনও তা লক্ষ্যমাত্রার পর্যায়ে নামেনি। আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি আরও কমতে পারে। মূল্যস্ফীতি কমলে মুদ্রানীতির সংকোচনমূলক অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে। সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সরকারি ব্যয় প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী অর্থবছরে সরকারের মূলধন ব্যয় কমতে পারে। অন্যদিকে বাড়তে পারে চলতি ব্যয়।
গত এপ্রিলে প্রকাশিত বাংলাদেশের ওপর আলাদা প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অপর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং শিল্প এলাকায় শ্রম অসন্তোষ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হওয়ার পথে মূল তিনটি বাধা। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের শুরুতে আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বিনিয়োগ ও শিল্প খাতের কার্যক্রমে ধীরগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থায়ন সংকোচনসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের প্রভাবে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ প রব দ ধ র ব শ বব য অন ম ন প রক শ সরক র দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
কী চমৎকার চামড়া-বাজার!
কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিশেষত ছোট ব্যবসায়ীদের দুর্গতি আর গেল না। এবারও চামড়া ব্যবসায় লাভবান হলেন ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা। সংবাদমাধ্যমের খবর, লবণযুক্ত চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম গতবারের চেয়ে এবার ৫ টাকা বাড়িয়ে ৬০-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে সরকার, ঢাকার বাইরের জন্য যা নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা। সেই হিসাবে ঢাকায় কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারিত হয় ১ হাজার ৩৫০ টাকা, ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা। তবে সমকালের খবর, শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লবণ ছাড়া বড় ও মাঝারি গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তুলনামূলক ছোট ও মান কিছুটা খারাপ এমন চামড়া ৬০০-৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের খবর, গত বছর গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে প্রায় একই দরে।
আর খাসির লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২-২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হলেও ছাগলের চামড়া কেনায় ব্যবসায়ীদের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। অনেক স্থানে ব্যবসায়ীরা বিনা মূল্যেই ছাগলের চামড়া পেয়েছেন।
ঢাকার বাইরে গরুর চামড়ার দাম ছিল আরও কম। ‘আড়তদাররা প্রতিটি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় কিনতে চেয়েছে।’ বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেছেন, এবার চামড়ার দাম ৬০০-৭০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অর্থাৎ তিনিও স্বীকার করেন, চামড়া সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে অনেক কমে বিক্রি হচ্ছে।
কোরবানির চামড়া প্রথমত মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করেন। তারা তা বিক্রি করেন আড়তদারের কাছে। আড়তদার চামড়াটি বিক্রি করেন ট্যানারি মালিকের কাছে।
পুঁজিস্বল্পতার পাশাপাশি সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীকে দিনের মধ্যেই চামড়াটি বিক্রি করতে হয়। তুলনামূলক বড় পুঁজি এবং আয়োজন থাকার কারণে আড়তদার চামড়াটি সংরক্ষণ করে ট্যানারি মালিকের সঙ্গে দরাদরিও করতে পারেন। ফলে এ ব্যবসায় লাভের গুড় সাধারণত শেষ দুই পক্ষেরই ভাগে যায়।
এমন কথা বলার কারণ হলো, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যখন ধার-কর্জ করে সংগৃহীত পুঁজি ধরে রাখতে হিমিশিম খাচ্ছেন, তখন কিন্তু চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিতে বেশ ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ১০৬ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। অন্তত এ পরিসংখ্যান বলছে, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের লোকসানের দায় রপ্তানির ওপর দেওয়া হলেও বাস্তবতা তা নয়।
নিঃসন্দেহে কাঁচা চামড়ার রপ্তানি বাজারে এক যুগ আগের রমরমা ভাব এখন নেই। বিশেষত বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে। সে সমস্যা কাটাতেই রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পকে সাভারের হেমায়েতপুরে নেওয়া হয়। কিন্তু ২১ বছরেও এই চামড়া শিল্পনগরকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। ফলে বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে চীন। কম দামে বাংলাদেশি চামড়া তারা কিনে নেয়।
এ অবস্থা জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। এটি বড় ব্যবসায়ীদের ছোট চামড়া ব্যবসায়ীদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে সাহায্য করছে– সেটি স্পষ্ট। না হলে হেমায়েতপুরের এ অচলাবস্থা প্রায় দুই যুগ ধরে চলত না।
এখানেই সরকারের ভূমিকা নিয়ামক হয়ে আসে। তাদের বোঝা উচিত, গতানুগতিক পন্থায় চামড়ার একটি দর নির্ধারণ করে বসে থাকলেই চলে না। তা বাস্তবায়ন ও তদারক করতে হয়। আরও যা গুরুত্বপূর্ণ, হেমায়েতপুরে যে বর্জ্য শোধনাগার-সংক্রান্ত জটিলতা, সেখানকার কারখানাগুলো পরিবেশ সার্টিফিকেট পাচ্ছে না। সে সমস্যার সমাধান দ্রুতই হওয়া উচিত।
মনে রাখতে হবে, কোরবানিই হলো সারাবছরের চামড়া সংগ্রহের প্রধান উৎস। তদুপরি এ চামড়ার প্রধান হকদার গরিব মানুষ। ফলে বছরের পর বছর চামড়া নিয়ে তেলেসমাতির অর্থ শুধু জাতীয় লোকসানই নয়, গরিব মানুষের হক নষ্ট করাও বটে।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল