রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে গতকাল বুধবার দিনভর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, রাজশাহী অঞ্চলে আম বেচাকেনা হবে কেজি দরে। সভায় রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা সম্মত হয়েছিলেন, আমের মণ আর ৪৮ বা ৫২ কেজিতে ধরা হবে না। কেজিতে দেড় টাকা কমিশনে আম বিক্রি হবে। তবে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের মোকাম ঘুরে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চিত্র দেখা যায়নি।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহীর বড় আমের মোকাম পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা আগের নিয়মেই (ঢলন প্রথায়) বেচাকেনা করছেন। বাজারের কোথাও ৪০ কেজি মণ দরে বা কেজি দরে আম বিক্রির দৃশ্য দেখা যায়নি। স্থানীয় আমচাষি ও ব্যবসায়ী মো.

আবুল হোসেন (৪২) বলেন, ৪০ মণ আম বিক্রি করেছেন। ৪৫ কেজিতে মণ দিতে হয়েছে। কেজি দরে আম বিক্রির আইন কেউ মানছেন না।

বানেশ্বরের চাষি ও ব্যবসায়ী আজমল হক (৬২) বলেন, আগের ‘ঢলন প্রথাতেই’ আম বেচাকেনা হচ্ছে। ৪৮ বা ৫২ কেজি—যে যেমন পারছেন, তেমন নিচ্ছেন। কেউ কেজি দরে আম কিনছেন না। বানেশ্বরের নাসিম ফল ভান্ডারে ঢুকে আড়তদারকে পাওয়া গেল না। কয়েকজন কর্মচারী ছিলেন। তাঁরা কেজি দরে আম বেচাকেনার প্রসঙ্গ শুনেই বললেন, ‘আমরা ওসব মানি না।’

বানেশ্বর বণিক সমিতির সভাপতি ওসমান আলী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সভায় ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাষি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ‘ঢলন প্রথা’ চলবে না। কেজি দরে আম বেচাকেনা করতে হবে। এ জন্য আড়তদারেরা কেজিতে দেড় টাকা কমিশন পাবেন। রাতে বানেশ্বর বাজারে সভা করে সিদ্ধান্ত সবাইকে জানিয়ে দেন। রেজল্যুশনে ব্যবসায়ীদের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়েছে। সকালে মাইকিং করা হয়। এরপরও না মানা দুঃখজনক। তিনি বলেন, এখন তাঁদের আর কী করার আছে। চাপাচাপি করলে তাঁরা আম কেনা বন্ধ করে দেবেন। চাষিদের আম পচে যাবে।

দেশের বৃহত্তম আমের বাজার হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট বাজারেও একই চিত্র দেখা গেছে। আজ বেশির ভাগ বেচাকেনা হয়েছে আগের নিয়মেই। হঠাৎ নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হতে পারেননি ক্রেতা–বিক্রেতারা। আড়তদারেরা বলছেন, তাঁদের কিছুই করার নেই।

কানসাটের আমচাষি রায়হান আলী (৪৯) বলেন, ‘কেজি দরে আম বিক্রি করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। দরদাম ঠিক করে আড়তে নেওয়ার পর ব্যাপারী বলেছেন, “ছোটগুলো নেব না। ছোটগুলোর দাম দেবেন অর্ধেক। বেচলে বেচ, না বেচলে নিয়ে যাও।” ছোট আমগুলো জুস কোম্পানির কাছে নিয়ে গেলে অর্ধেকও দাম পাব না। আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেলে হয়রানি ও সময় নষ্ট হবে। বাধ্য হয়ে ক্ষতি হলেও কম দামে বিক্রি করেছি। আবার আড়তদারকে কমিশনও দিয়েছি। নতুন নিয়ম করে কী লাভ হলো?’

আরও পড়ুনরাজশাহীতে আম পাড়া শুরু, ৪৮ কেজিতে মণ১৬ মে ২০২৫

আড়তে থাকা পাবনার সাঁথিয়া থেকে আসা ব্যাপারী জোবায়ের হোসেন বলেন, ছোট বা দাগওয়ালা আম কেন তিনি বড় আমের সঙ্গে মিলিয়ে কিনবেন? আগে যে নিয়ম ছিল, সেটাই বরং ভালো ছিল। এতে বিক্রেতারা কেউই নতুন নিয়মে লাভ মনে করছেন না। লাভ হলে আড়তদারের হতে পারে।

আড়তদার শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আজ আম বিক্রি হয়েছে সব আগের নিয়মে। আমাদের করার কিছু নেই।’ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ী শহিদ মিয়া গতকালের সভায় ছিলেন। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘একটা হযবরল অবস্থা হয়ে গেছে। কেউ মানছে না। যে যার মতো বেচাকেনা করছে।’

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাট

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প ইনব বগঞ জ আম ব চ ক ন ও ব যবস য় ব ন শ বর আম ব ক র আড়তদ র আম ক ন

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ

রাজধানীর গাবতলী–মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে বিজিবি মার্কেটে গড়ে ওঠা দ্বীপনগর মাছের আড়ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বেশ জমজমাট থাকে। এই তিন ঘণ্টায় বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে এসব নানা জাতের দেশি-বিদেশি মাছ।

এ আড়তে গরিবের মাছখ্যাত পাঙাশ থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়। নদীর পাশাপাশি সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছ পাওয়া যায়। ওমান, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা মাছ সরাসরি এখানে আসে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রথমে বিজিবি মার্কেটে মাছ বিক্রি শুরু হয়। তবে ২০০৯ সালে এ বাজারে দ্বীপনগর আড়তের যাত্রা শুরু হলেও বাজার জমে ওঠে ২০১৫ সালের পর থেকে। পরে পাঁচটি হিমাগার ও একটি বরফকল নিয়ে এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ মৎস্য আড়তে পরিণত হয়, যেখানে ছোট–বড় প্রায় ৪০০ পাইকারি দোকান রয়েছে।

আড়তদার ও বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, দ্বীপনগর আড়তে জ্যান্ত মাছের পাইকারদের বিনা মূল্যে পানি সরবরাহ করায় তাঁদের প্রত্যেকের প্রায় ৫০০ টাকা করে সাশ্রয় হয়। তার ওপর যাতায়াতের সুবিধা ভালো, ওজনে কেউ মাছ কম দেয় না, চুরিও হয় না এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশে বেচাকেনা করা যায়। এসব কারণে এটি এরই মধ্যে ঢাকার অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় আড়তে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে দিন দিন পাইকার বাড়ছে এবং মোকামও আশপাশে বিস্তৃত হচ্ছে।

দ্বীপনগর আড়তের ‘অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি’র সভাপতি মো. ইনসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার কেজি পাঙাশ বিক্রি হয়, যা কারওয়ান বাজারেও হয় না। সব ধরনের মাছ মিলিয়ে দৈনিক দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়।’

* দ্বীপনগর আড়তে পাঙাশ, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়।
* নদী ও সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছও বিক্রি হয়।
* প্রতিবেশী ভারত থেকে শুরু করে ওমান, সুদান, জর্ডান, চীন ও জাপান থেকে আমদানি করা মাছ এখানে বিক্রি হয়।

আড়তদার ও পাইকারদের দাবি, এটি দেশে পাঙাশ মাছের সবচেয়ে বড় আড়ত। এখানে দিনে ৩৫ থেকে ৪০ ট্রাক পাঙাশ মাছ আসে। এসব ট্রাকে ৩০ থেকে ৪০টি করে পাঙাশের ড্রাম থাকে। এর একেকটিতে ৪০ কেজি মাছ থাকে। গড়ে ৩৫টি ট্রাকে ৩৫টি করে ড্রাম এবং প্রতি ড্রামে ৪০ কেজি ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, এখানে দৈনিক ৪৯ হাজার কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৬৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

বিশেষ করে রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, শ্যামলী, গাবতলী, সাভার, উত্তরা এবং আবদুল্লাহপুর এলাকার পাইকারেরা দ্বীপনগর আড়তে মাছ কিনতে আসেন। অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মনির হোসেন বলেন, কম দামে পাওয়া যায় বলে পাইকারেরা এখানে মাছ কিনতে আসেন। তাঁর নিজস্ব বরফকল রয়েছে। ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বরফের পাটা বিক্রি করেন। তাই বাইরে থেকে বরফ আনতে হয় না।

সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা মাছ কিনতে দ্বীপনগর আড়তে চলে আসেন। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নিলামের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো আড়ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তাজা ও হিমায়িত মাছের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আনা মাছের বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়। ৯টার পরপরই সব ব্যস্ততা শেষে ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়ে যায়।

সাভার নবীনগর থেকে আসা পাইকার ফরিদুল ইসলাম জানান, তিনি এখান থেকে দৈনিক ১৫০–২০০ কেজি সাগরের মাছ নিয়ে এলাকার বাজারে বিক্রি করেন।

আড়তদারেরা জানান, দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, টেকেরহাট, খুলনা, রাজশাহী, মোংলা, সাতক্ষীরাসহ সব অঞ্চল থেকেই মিঠাপানি এবং নদী ও সাগরের মাছ আসে দ্বীপনগর আড়তে। ওমান, সুদান, জর্ডান, জাপান, চীন এবং ভারত থেকেও সামুদ্রিক মাছ আনা হয়।

মেসার্স ঢাকা গাবতলী ফিশ আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দৈনিক ৫ টনের মতো মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মতো।’ তাঁদের হিমাগারে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মাস পর্যন্ত মাছ ঠিক থাকে। প্রয়োজনে তাপমাত্রা আরও কমানো যায় বলে জানান তিনি। তবে আড়তদারদের হিসাবে এসব হিমাগার থেকে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়।

৫৫০ টাকা করে বাইম মাছ কেনার পর আদাবর বাজারের একজন পাইকার প্রথম আলোকে জানান, তিনি এই মাছ বিক্রি করবেন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। পোয়া মাছ কিনেছেন ৩৩০ টাকা কেজি দরে, বেচবেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। ওই পাইকার আরও জানান, আগে কারওয়ান বাজার থেকে মাছ কিনলেও এখন সুবিধা থাকায় দ্বীপনগরে আসেন। প্রতিদিন পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ থেকে ৭০ কেজি মাছ কেনেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সামুদ্রিক মাছে ভরপুর আড়ত, দাম কেমন
  • মেঘনার পাড়ে ‘আড়াই ঘণ্টার হাট’, দৈনিক বেচাকেনা ২৫-২৬ লাখ টাকার টাটকা মাছ
  • দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ