ঘড়ির কাঁটায় নেপালে সময় সকাল সাতটা। মোবাইলের অ্যালার্ম জানান দিচ্ছে এবার ঘুম থেকে উঠতে হবে। কিন্তু এতো ঠান্ডা রুমে হিটারের সঙ্গে দুটো লেপ গায়ে দেবার পরেও ঠান্ডা কমছিল না। আড় চোখে মোবাইলে নেপালের বর্তমান তাপমাত্রা দেখে চোখ মাথায় ওঠার জোগাড়!
থামেলের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস! ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও লেপের নিচ থেকে উঠতে মন চাইছিল না। কিছু সময় পর আবার অভিনব দাদার ফোন। আর ঘুমিও না, এবার উঠে তৈরি হয়ে নাও। আজ আমার আর সানন্দার নেপাল ভ্রমণের তৃতীয় দিন। হিমালয়কন্যা নেপালের সৌন্দর্যে মুগ্ধ বিশ্ববাসী। এজন্যই দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা নেপাল ভ্রমণে গিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও মাউন্ট এভারেস্ট, শত বছরের পুরনো মন্দির, আকাশচুম্বী পর্বতমালা, জলপ্রপাত, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, বিভিন্ন উৎসব রয়েছে দেশটিতে।
পৃথিবীর যেসব দেশে সহজেই একা ভ্রমণ করা যায়, তার মধ্যে নেপাল অন্যতম। বিশ্বের পর্বতারোহীদের পছন্দের স্থান নেপাল। অন্নপূর্ণা কিংবা এভারেস্ট জয়ের জন্য সারা বছরই তারা এখানে ভিড় করেন। নেপাল পর্বতারোহীদের পছন্দের দেশ হলেও সাধারণ পর্যটকরাও এখানে যান হিমালয়ের পাশ থেকে সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে। অন্নপূর্ণা পর্বতের শুভ্রচূড়া দেখতেও কেউ কেউ ভিড় করেন সেখানে। প্রত্যেক বছর হাজারো পর্যটক ভ্রমণ করেন এই পাহাড়ি কন্যার দেশে। সার্কের সদস্যদের মধ্যে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর একটি হলো নেপাল, যার কোনো সমুদ্র নেই, সমুদ্র পথে যবার সুযোগও নেই।
কাঠমান্ডু নেপালের রাজধানী ও বৃহত্তম মহানগর যেখানে বাস করছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। নেপালে ঘুরতে হলে কাঠমান্ডুতে আসাই ভালো। অনেকেই পাহাড় দেখবার আশায় কাঠমান্ডুর মতো শহরকে ঘুরবার তালিকায় প্রাধান্য প্রথমে দিতে চান না কিন্তু ঐতিহ্য, বাণিজ্য, নানাবিধ আরকিটেকচারাল নিদর্শন নিয়ে কাঠমান্ডু কিন্তু তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নিলাম নতুন গন্তব্যে যাবার জন্য। আমাদের আজকের ভ্রমণ গন্তব্য চন্দ্রগিরি হিল। ঢাকার মতো যানজট আছে, রাস্তার হাল আরও খারাপ কাঠমান্ডুর। দিনভর বেশ তাপ। তবে শেষরাতে গা কিছুটা শিনশিন করে। সূর্যদেবের ছোঁয়ায় উঁচুনিচু পথ পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। দূরের পাহাড় চূড়ায় সাদা বরফের আনাগোনা আমাদের মুগ্ধ করছিল! চলতি পথে আমাদের ঢাকা শহরের মতো যানজটে মন অতিষ্ঠ হবার জোগাড়। সকালে ঠান্ডার প্রকোপ দেখে মোকাবেলার লক্ষে কয়েকটি কাপড় পরেছি বৈকি কিন্তু এবার ঘেমে উঠছি বারবার। তখনই অভিনব দাদা বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করো। ঠান্ডায় কাঁপবে।’
কাঠমান্ডু শহর থেকে দেড় ঘণ্টার পথ চন্দ্রগিরি। সেখানেই এত শীত হবে! ঠিক বিশ্বাস হলো না। মেঘেদের দেশে এসে অনেকের আবদার ছিল মেঘ ছোঁয়ার। স্বল্প সময়ে এভারেস্টের কাছে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই সেই মেঘের ছোঁয়া পেতে অভিনবদার আমাদের নিয়ে চন্দ্রগিরি যাবার প্রয়াস। আমার ভ্রমণসঙ্গী সানন্দা আগে থেকেই চন্দ্রগিরি হিলের ট্র্যাভেল ব্লগ দেখিয়েছিল। কিন্তু উচ্চতাভীতি আছে আমার, তাই যাব না বলেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ভ্রমণসঙ্গীর জোরাজুরিতে যেতে হলো।
সবাই মিলে চন্দ্রগিরির পথ ধরলাম। কাঠমান্ডু মূলত একটি উপত্যকা। এর চারপাশ ঘিরে আছে পাহাড়। প্রায় দুই ঘণ্টা মাইক্রোবাসে চেপে নামলাম থানকোট। সেখান থেকে শুরু হলো পাহাড়ি পথ। এরপর পাহাড় কেটে তৈরি শক্ত কংক্রিটের সুদৃশ্য পথ এঁকেবেঁকে গিয়ে থামল চন্দ্রগিরি কেবল কার স্টেশনে। বিশাল এই এলাকা থেকে নিচের থানকোট শহর স্পষ্ট। একটি পাহাড় ডিঙিয়ে কাঠমান্ডু। সেটা খুব একটা স্পষ্ট না। কিন্তু চন্দ্রগিরিতে এসে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছি! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট। কাঁপুনি তো ধরবেই। এত উঁচু পাহাড়ে উঠে আসার পথটাও রোমাঞ্চকর। সময় দিবা দ্বিতীয় প্রহর আমরা এসে পৌঁছালাম চন্দ্রগিরির প্রবেশ পথে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে এগিয়ে যেতে লাগলাম। হিমশীতল বাতাসে একটু পরপর শরীর কেঁপে উঠছিল।
আমাদের মতো অনেকেই এসেছেন চন্দ্রগিরি দর্শনে। দেখা পেলাম দর্শনীয় ফোয়ারার। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম কেবল কারের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উঁচু একটি ভবনে উঠে কেবল কারের মূল স্টেশনে পৌঁছালাম। এর আগে টিকিট কাটতে হলো। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মাথাপিছু টিকিট ১ হাজার ১০০ নেপালি রুপি। ভবনের ভেতরে প্রবেশের পর সহস্রাধিক মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখতে পেলাম। আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অভিনব দাদা বললেন সম্ভবত চন্দ্রগিরি হিলের পৌরাণিক তাৎপর্য বিবেচনা করে নেপাল সরকার চন্দ্রগিরি দর্শনে কেবল কার নির্মাণ করেন। চন্দ্রগিরির উচ্চতা ৮২৬৮ ফিট। পৌরাণিক যুগে এই উচ্চতা কীভাবে পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের মাথায় ভালেশ্বর মন্দির গড়ে উঠেছিল, সে তথ্য অজ্ঞাত। যেমন অজ্ঞাত মিশরের সুউচ্চ পিরামিডগুলোয় বিশাল বিশাল পাথর স্থাপন।
সে যাই হোক, কেবল কারের যাত্রা মোটামুটি ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। পাহাড়ের উচ্চতায় যেতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট, সেটি আবার নির্ভর করে বাতাসের গতির ওপর। কেবল কার থেকে কাঠমান্ডু উপত্যকা, প্রকৃতিক দৃশ্য ও অন্নপূর্ণা থেকে এভারেস্ট পর্যন্ত হিমালয় পর্বতমালার চমৎকার দৃশ্য অবলোকন করা যায়। কেবলওয়ে সিস্টেমে ৩৪টি গন্ডোলা রয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় ১০০০ যাত্রী বহনে সক্ষম।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর আমরা উঠে বসলাম কেবল কারে। কারের দুই পাশে মুখোমুখি আমরা মোট ছয়জন বসে আছি। যারা নিচের দৃশ্য দেখতে চান না, তারা উল্টো দিকে বসলেন। সরসর করে উঠছে কেবল কার। যত ওপরে উঠছি, নিচে শহর তত ছোট হয়ে যাচ্ছে। নিচে ঘন সবুজ বন কালচে হচ্ছে। খানিকটা উঠেছি, এরই মধ্যে কোত্থেকে এক দল মেঘ এসে লাগল কারে, গায়ে। ভিজিয়ে দিয়ে গেল গ্লাস। মেঘের ছোঁয়ায় বিন্দু বিন্দু জলকণা জমে আছে সেখানে। আমাদের গায়ে লাগল হিমেল পরশ। একটু ঠান্ডা লাগছে। আমি নিচের দিকে তাকাতেই পিলে চমকে উঠলো। আমার অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। অন্যদিকে কেবল কারের যাত্রীদের মধ্যে এখন শুধু ‘ওয়াহ’ ‘কী সুন্দর’ ‘বাহ’ ধ্বনি! মাঝেমধ্যে একটি দুটি কার চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কিছু দূর উঠে নিচে শুধু মেঘের খেলা চোখে পড়ল। এখন বনও অদৃশ্য। কালচে মেঘের চাদর ঢেকে দিয়েছে সবুজ। ঠান্ডা আরও বাড়ছে। মেঘের খেলা দেখতে দেখতে, ভয়মিশ্রিত তীব্র ভালো লাগায় ভাসতে ভাসতে, অনেক ভাসা মেঘের পরশ গায়ে মেখে তারের ওপর দিয়ে চলা আমাদের ছোট গাড়িটি গিয়ে থামল চন্দ্রগিরি স্টেশনে। আড়াই কিলোমিটারের কেবল কার ভ্রমণ শেষ হলো।
আমরা কেবল কার থেকে নেমে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। চারপাশের শীতল বন্য ফুলের সুবাসিত স্নিগ্ধ বাতাসে মন প্রফুল্ল হবে যে কারো। এ যেন চারদিকের দূষিত জঞ্জাল যান্ত্রিকতা থেকে কোন এক স্বর্গে পৌঁছে যাওয়া; চোখ বন্ধ করে অনুভবে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে যাওয়া। মাঝে মাঝে মেঘ আমাদের ছুঁয়ে গেল। মেঘের ঠান্ডা শীতলতা আমাদের চোখে মুখে দোলা দিয়ে গেল। আমি একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না স্রষ্টার সৃষ্টি। সৌন্দর্যের সীমা থাকা দরকার। মনে মনে ভাবলাম, উচ্চতার ভয়ে যদি এখানে না আসতাম তাহলে মিস করতাম নেপাল ভ্রমণের সবচেয়ে সুন্দর ও রোমাঞ্চকর জায়গার দর্শন। একটু পরে দেখা পেলাম মেঘেদের। আর ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকল তীব্র শীত। কাঁপতে লাগলাম রীতিমতো।
ঠান্ডা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে অর্ডার দিলাম গরম গরম চায়ের, সাথে নিলাম পপকর্ণ। গরম চা পানের ফলে শরীর বেশ খানিকটা উষ্ণ হলো। একটি নয়, দুটি নয়, তিনটি রেস্তোরাঁ এখানে। আছে নিরামিষ-আমিষের ভিন্ন ব্যবস্থা। কেউ অর্ডার দিলে সামনাসামনি রান্না করে দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে। এখানে এখন তৈরি হচ্ছে একটি রিসোর্ট। আছে শিশুদের ছোট পার্ক, ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ি পথে চলার ব্যবস্থা। বেলা গড়িয়ে এল। এবার নামতে হবে। আবার কেবল কারের স্টেশনে গিয়ে চড়লাম কারে। এবার ভয় খানিকটা কমে গেছে। আবারও বিস্ময়, আনন্দ, মেঘ ছোঁয়ার আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম।
সপ্তাহের সাত দিনই যাওয়া যায় চন্দ্রগিরি। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলে প্রতি কর্মদিবসে কেবল কার। ছুটির দিন চলে সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। ভাড়া প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১ হাজার ১০০ নেপালি রুপি। তিন ফুটের নিচে উচ্চতার শিশুদের ভাড়া দিতে হবে না। তিন থেকে চার ফুট উচ্চতার শিশুরা ৪০ শতাংশ কম ভাড়ায় ভ্রমণ করত পারবে।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক বল ক র র স ন দর ল গল ম আম দ র ভ রমণ
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক কমেছে, বাংলাদেশে স্বস্তি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর দেশটির আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এ কথা বলা হয়। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহার কমে প্রতিযোগীদের কাছাকাছি অবস্থানে আসার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।
২৯ জুলাই থেকে তিন দিনের আলোচনা ও দর-কষাকষির শেষ দিন ৩১ জুলাই এ ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে।
পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনতে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও বেশ কিছু সুবিধা দিতে হয়েছে। একদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান গত ২১ জানুয়ারি। এর দুই মাস পর গত ২ এপ্রিল হঠাৎ বিশ্বের ৭০ দেশের জন্য বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। অনেকেই ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে একধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে সমালোচনা করেছেন।
প্রথমে গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয় ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। মাঝখানে তিন মাস স্থগিত রাখার পর ৮ জুলাই তা কমিয়ে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ করেন। বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ করায় মোট শুল্কহার দাঁড়াবে এখন ৩৫ শতাংশে।
দর-কষাকষির মাধ্যমে ঘোষিত শুল্কহার কমিয়ে আনাকে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের আলোচকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আলোচকদের মধ্যে আরও ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে বলেছে, অনেক বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু শুল্ক কমানোর সঙ্গেই যুক্ত ছিল না; বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্যঘাটতি ও নিরাপত্তা–সংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগও ছিল এর সঙ্গে। সমাধানের বিষয়টি নির্ভর করছিল একটি দেশের সদিচ্ছার ওপরও।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’
প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্কহারযুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা এবং ১৯ শতাংশ হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯ শতাংশ। তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ; জাপান, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৪১ শতাংশ শুল্কহার সিরিয়ার ওপর। বেশি হার আরোপ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ; সুইজারল্যান্ডের ওপর ৩৯ শতাংশ; ইরাক ও সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ এবং লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিচ্ছে বাংলাদেশসরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেশন পুরোপুরি মেনে চলারও অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে পাঁচ বছর ধরে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।
দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হচ্ছে। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯ থেকে ১১ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সফল না হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সেসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ১৭ থেকে ২৩ জুলাই সপ্তাহব্যাপী অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বৈঠকগুলো করেন।
গত ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করার কারণে সরকারি প্রতিনিধিদলে অন্য কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভেতরে-ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
সরকারের আহ্বানে সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেন তাঁরা। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩ কোটি ডলারে ৩ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রায় ১০ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
এ ছাড়া ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ১৯ হাজার টন তুলা আমদানির সমঝোতার চুক্তি করেছে বস্ত্র খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্গিল ইনকরপোরেটের কাছ থেকে এশিয়া কম্পোজিট ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে ৬ হাজার টন আমদানির এমওইউ করেছে। একই দরে একই পরিমাণ তুলা আমদানির এমওইউ করেছে সালমা গ্রুপও। এ ছাড়া মোশাররফ গ্রুপ মার্কিন লুইস ড্রেফাস গ্রুপ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন তুলা আমদানির এমওইউ করেছে।
কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ২০ শতাংশ শুল্কহার ঠিক করতে পেরেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।’
ট্রেড ইউনিয়ন, মজুরি, শ্রমিক নিপীড়ন, মামলা—এসব বিষয় আলোচনায় উঠেছিল কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখতে জোর দিয়েছে তারা। আমরা আইএলও কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ জন্য শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে।’
‘অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা’ওয়াশিংটনে দর-কষাকষিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্ক কমার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, তাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে রেহাই পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘সময়সীমার মধ্যেই জটিল আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। নইলে ৩৫ শতাংশের গুরুভার বহন করে যেতে হতো।’
খলিলুর রহমান আরও বলেন, প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান অথবা যত্সামান্য বেশি এবং ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য এখন প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। তৈরি পোশাকশিল্প ও এর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টার উদ্দেশে ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (শেখ বশিরউদ্দীন) সমালোচকদের হতাশ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেন, হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিশ্বশক্তির চাপের মুখে এই সাফল্য অর্জনের জন্য সরকার ও আলোচক দলের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন। এটি সম্ভবত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোর একটি ছিল, যা পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাঁরা।