ইরানকে ধাক্কা দেওয়ার কৌশল যে কারণে ব্যর্থ
Published: 18th, June 2025 GMT
কয়েক দশকের মধ্যে ১৩ জুন ইরানে আগ্রাসী হামলা চালায় ইসরায়েল। লেবাননে অতীত সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে হামলার ছক কষেছিল দেশটি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চালানো ওই হামলায় হিজবুল্লাহর অভিজাত রাদওয়ান ইউনিটকে নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছিল। অত্যন্ত দ্রুতগতির সঙ্গে পরিচালিত সেই হামলায় শেষ পর্যন্ত মহাসচিব হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছিল তেল আবিব। তবে ইরানে সেই কৌশল কাজ করেনি।
প্রথম দিন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ইরানজুড়ে একাধিক আক্রমণ চালায়। একটি আবাসিক টাওয়ারে ৬০ জন বেসামরিক লোক নিহত হন, বেশ কয়েকজন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সিনিয়র সামরিক কমান্ডারকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিমান প্রতিরক্ষা এবং পারমাণবিক অবকাঠামোগত স্থাপনাগুলোয় আঘাত করা হয়।
একটি ব্যর্থ কৌশল
অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে শত্রুর ওপর দ্রুত আধিপত্য অর্জনের এই কৌশল লেবাননে সাফল্য পেয়েছিল। তবে ইরানের আরও অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক জাতির সঙ্গে এ কৌশলে সফলতা পাওয়া সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। তবে অন্তত কৌশলগতভাবে ইসরায়েল তার হামলার মাধ্যমে ইরানকে হতবাক করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এর বেশির ভাগই অভ্যন্তরীণ অনুপ্রবেশ এবং নাশকতামূলক অভিযানের কারণে হয়েছিল।
তেহরানের জবাব
ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরানের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তেহরান তিনটি উল্লেখযোগ্য প্রতিশোধমূলক অভিযান শুরু করে। দেশের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, ড্রোন ইউনিট পুনরায় সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কমান্ড পোস্টগুলো পূরণ করা হয়। আবার অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ইরানি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর ছবি ও ভিডিও তেহরানের অপারেশনাল পুনরুদ্ধার এবং কৌশলগত বার্তারও ইঙ্গিত দেয়।
সবার জন্য অথবা কারও জন্য নয়
যুক্তরাষ্ট্র যদি আক্রমণ করে, তবে ইরান স্পষ্টভাবে তার কৌশল ঘোষণা করেছে। সবার জন্য অথবা কারও জন্য নয়– যার অর্থ সমুদ্র নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন ঘাঁটির নিরাপত্তা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতি উপদেষ্টা জাওয়াদ লারিজানি যেমনটা বলেন, পারস্য উপসাগরে একটি পুরোনো নিয়ম রয়েছে। যদি আমাদের (ইরানের) তেল স্থাপনাগুলো গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমরা এই অঞ্চলের কোনো দেশকে তাদের তেল ব্যবহার করতে দেব না।
সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কাউসারির যুক্তি– হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার মাধ্যমে সহজেই ইরান এ কাজ করতে পারে।
ইরানের যুদ্ধক্ষেত্রের ভুল ব্যাখ্যা
তেল আবিব ভুল করে ধরে নিয়েছে যে, লেবাননের কৌশলটি ব্যাপক ফলপ্রসূ। ইরানের নেতৃত্বকে সরিয়ে দিতে তাদের কপি-পেস্ট পরিকল্পনায় বেশ কিছু ভুল গণনা দুর্বল করে দিয়েছে। প্রথমত, ইরানের সামরিক কমান্ড বিশাল, অভিজ্ঞ ও দ্রুত পরিবর্তনযোগ্য।
দ্বিতীয়ত, ইরানের বিশাল আকার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের কৌশলগত বিস্তৃত করার সুযোগ করে দেয়। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোয় হামলা করলেও দেশটির বেশির ভাগ অবকাঠামো পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে রাখা আছে।
তৃতীয়ত, ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যবস্থা ইরানি কমান্ড পর্যায়ে প্রবেশ করলেও এটি পূর্ণমাত্রায় আধিপত্য অর্জন করতে পারেনি। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স অপারেশনের ক্ষমতা ধরে রেখেছে।
সংহতির ইরানি সংস্করণ
তেল আবিবের সবচেয়ে বড় ভুল হিসাব ছিল, ইরানের অভ্যন্তরীণ সংহতির বিচার করায়। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিশ্বাস, হঠাৎ বহিরাগত হামলা ইরানের বিরোধী শক্তিগুলোকে সক্রিয় করবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী, জঙ্গি ও সরকার সমালোচকরা রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে দেবে। কিন্তু বহিরাগত হুমকির মুখে ইরানের রাজনৈতিক ঐক্য বারবার প্রদর্শিত হয়েছে।
তেল আবিব তিন দিনের মধ্যে ২২৪ জন ইরানি নাগরিককে হত্যা করেছে, যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। এই ধরনের উস্কানির পরিণতি রয়েছে। এই সংঘাতে ইরানের প্রতিরোধ কেবল সামরিক নয়, এটি সামাজিক।
যে কোনো সংঘাতের মতো এ যুদ্ধের ফলাফলও অনিশ্চিত। এটি আরও বিস্তৃত যুদ্ধে পরিণত হবে নাকি আরেকটি আঞ্চলিক অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেবে, তা ইসরায়েলের ওপর কম নির্ভর করছে। বরং তেল আবিবকে অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র পুরো অঞ্চলকে আগুনে পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছুক কিনা, তার ওপর বেশি নির্ভর করে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল কম ন ড ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রে ঘাটতির মুখে ইসরায়েল: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল
ইসরায়েল বর্তমানে প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ‘অ্যারো ইন্টারসেপ্টর’-এর সংকটে রয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইরান থেকে নিক্ষিপ্ত দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার সক্ষমতা এতে হুমকির মুখে পড়তে পারে।
পত্রিকাটি যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায়, ওয়াশিংটন বেশ কয়েক মাস ধরেই ইসরায়েলের এই সক্ষমতা সংকট সম্পর্কে অবগত। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে অতিরিক্ত প্রতিরক্ষাপ্রণালী মোতায়েন করছে।
তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাদের গোলাবারুদ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এদিকে গত রাতে ইসরায়েলের দিকে ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র ফাত্তাহ-১ নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)।
এক বিবৃতিতে আইআরজিসি বলেছে, ‘তাদের শক্তিশালী ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঢাল ভেঙে দেশটির আকাশের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হয়েছে।’
সিএনএন জানিয়েছে, ইরানের আধা-সরকারি মেহের সংবাদ সংস্থা দাবি করেছে- ইরান ইসরায়েলের দিকে ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। তবে এই দাবির সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
২০২৩ সালে ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচন করে ইরান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ক্ষেপণাস্ত্রটির নামকরণ করেন।
আইআরজিসি এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘ইসরায়েল বিধ্বংসী’ বলে উল্লেখ করেছে। এটি উন্মোচনের সময় ইরানের রাজধানী তেহরানে একটি বিশাল ব্যানার টাঙানো হয়েছিল, যেখানে হিব্রু ভাষায় লেখা ছিল: ‘৪০০ সেকেন্ডে তেল আবিবে।’
অন্যদিকে গত কয়েক ঘণ্টায় দেশটির বিমানবাহিনীর ৫০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ— ‘সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্র’ এবং দেশটির ‘বেশ কয়েকটি অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র’ লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ দিনে ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর গোলাবর্ষণ এবং ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৮৫ জন। এছাড়াও এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ৩২৬ জন নাগরিক।
যদিও ইরান সংঘাতের ঘটনায় নিয়মিত মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করেনি। গত সোমবার প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদে মৃতের সংখ্যা ২২৪ জন এবং আহতের সংখ্যা ১২৭৭ জন বলে জানানো হয়েছে। সূত্র: আল জাজিরা