মণিপুরে জমি ঘিরে সংঘাত, ‘ক্রসফায়ারে’ কুকি গ্রামপ্রধান নিহত
Published: 20th, June 2025 GMT
ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যে কুকিদের সঙ্গে মেইতেই সম্প্রদায়ের সংঘাত আবার বাড়ছে। দক্ষিণ মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর জেলার লাংচিয়াংমানবি নামের একটি গ্রামে পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ কুকিদের লাংচিয়াংমানবির গ্রামপ্রধানের স্ত্রী নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম হৈখোলহিং হাওকিপ।
মণিপুর পুলিশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, তাদের ওপরে গুলি চালানো হলে তারা পাল্টা গুলি চালায়। এতে হাওকিপ নিহত হন।
কুকি-জো সম্প্রদায়ের বক্তব্য
তবে এই মুহূর্তে মণিপুরে আদিবাসীদের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংগঠন ইন্ডিজিনাস ট্রাইবাল লিডারস ফোরাম (আইটিএলএফ) জানিয়েছে, হৈখোলহিং হাওকিপ গ্রামপ্রধানের স্ত্রী ছিলেন না। তিনি নিজেই লাংচিয়াংমানবি গ্রামে কুকি-জো সম্প্রদায়ের প্রধান ছিলেন।
আইটিএলএফ বলছে, হাওকিপের একমাত্র অপরাধ, তিনি কুকি-জো সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত থেকেই চূড়াচাঁদপুর জেলায় ‘ধর্মঘটের’ ডাক দিয়েছে আইটিএলএফ। কুকি-জো নাগরিক সংগঠন নামে আদিবাসীদের একটি সংগঠন ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছে।
আইটিএলএফ বলেছে, এ জঘন্য কাজটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি আরেকটি লক্ষ্যবস্তুকে টার্গেট করে হামলা। এটি কুকি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জাতিগত নির্মূলের পদ্ধতিগত একটি কৌশলে পরিণত হয়েছে৷ নিরাপত্তা বাহিনীকে এই ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অনুমতি দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে সরাসরি দায়ী করছে আইটিএলএফ।
কী কারণে সংঘাত
কুকি-জো ও মেইতেইরা পাশাপাশি বসবাস করে। ফলে তাদের বসবাস বা চাষের জমিও পাশাপাশি। ফলে জমি বা জমির সীমানা নিয়ে কুকি-জো ও মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। দুই জমির মধ্যবর্তী অঞ্চলকে এখন সীমান্তের মতো ‘বাফার জোন’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে যাতে জমি নিয়ে বিবাদ না হয়, তা মাথায় রেখে সরকারের তরফে এই ‘বাফার জোন’ তৈরি করা হয়েছিল।
ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা জানিয়েছে, ১৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পরে জমি নিয়ে এই ধরনের বিরোধের খবর পাওয়া যায়নি। অবশ্য ২০২৩ সালের মে মাসে যখন মেইতেইদের সঙ্গে কুকি-জোসহ অন্যান্য আদিবাসীর সংঘাত শুরু হয়, তখন জমি নিয়ে বিবাদের নানা ঘটনা ঘটেছিল। তখন সরকার দুই পক্ষকে আলাদা রাখতে ‘বাফার জোন’ তৈরি করে। ফলে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পরে জমি নিয়ে বিবাদ হয়নি।
গত এক সপ্তাহে অন্তত দুবার ফুবালা গ্রামে কৃষকদের মধ্যে জমির সীমানা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ১৫ জুন এক দফায় সংঘর্ষ হওয়ার পরে আবার হলো গতকাল, যার জেরে একজনের মৃত্যু হলো। এলাকায় উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে।
আইটিএলএফ গতকালের এ ঘটনার জন্য মেইতেইদের দায়ী করেছে। তারা বলেছে, মেইতেইরা ‘বাফার জোনে’ নিয়মিত আক্রমণ চালাচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে নিরাপত্তাবাহিনী জানে। কিন্তু তারা দুর্বল সম্প্রদায়কে সাংবিধানিক সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণেই আরও একজনের প্রাণ গেল।
এই ‘বাফার জোনে’ সংঘাত দিয়েই গতকাল নতুন করে লড়াই শুরু হয়। মণিপুর পুলিশ গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিষ্ণুপুর জেলার ফুবালা গ্রামের চাষি নিংথৌজাম বীরেন সিংকে বেলা ৩টার দিকে একজন অজ্ঞাত ও সশস্ত্র দুষ্কৃতি বাম হাতে গুলি করে। তিনি ধানখেতে কাজ করার সময় তাঁকে গুলি করা হয়। পরে তাঁকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ইম্ফলের আঞ্চলিক ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানানো হয়েছে।
পুলিশ দাবি করছে, এ ঘটনার জেরে গতকাল বিকেলে নিরাপত্তা বাহিনী লাংচিয়াংমানবি, হেইচাংলোক, ফুবালা গ্রামের পশ্চিমাঞ্চলে এবং তার আশপাশে তল্লাশি অভিযান শুরু করে। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপরে ‘গুলি’ চালানো হলে তারা পাল্টা গুলি চালায়, যাতে হৈখোলহিং হাওকিপ নিহত হন।
হাওকিপের মরদেহ চূড়াচাঁদপুর জেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। চূড়াচাঁদপুর কুকিপ্রধান জেলা। ফলে হাওকিপের মরদেহ নিয়ে যাওয়ায় সেখানে ব্যাপক বিক্ষোভের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওই জেলাসহ মণিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
মেইতেই সম্প্রদায়ের অভিযোগ
মেইতেই সম্প্রদায়ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করছে।
মেইতেইরা বলছে, কুকি-জো সম্প্রদায়ের মানুষ ‘বাফার জোনে’ সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে, অথচ সব জেনেও সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী চুপচাপ রয়েছে। এই ঘটনার জেরে মেইতেইরা তাদের নিয়ন্ত্রিত রাজধানী ইম্ফল এবং সংলগ্ন অঞ্চলে আজ শুক্রবার থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। গতকালের ঘটনার পরে তারা বিষ্ণুপুর এবং চূড়াচাঁদপুরের মধ্যবর্তী জাতীয় সড়কও দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। এতে মেইতেই নিয়ন্ত্রিত ইম্ফল ও বিষ্ণুপুর এবং কুকি-জো নিয়ন্ত্রিত চূড়াচাঁদপুর আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাড়তি বাহিনী মোতায়ন করা হয়েছে।
২০২৩ সালের মে মাস থেকে জাতিগত সহিংসতায় মণিপুরে ২৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গৃহহীন হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: মণ প র গতক ল ঘটন র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি সেবায় প্রতি তিনজনের একজন ঘুষ-দুর্নীতির শিকার
গত এক বছরে সরকারি সেবা গ্রহণ করেছেন এমন নাগরিকের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ এসব সরকারি সেবা গ্রহণে প্রতি তিনজনের মধ্যে গড়ে একজনকে ঘুষ দিতে হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সিটিজেন পারসেপশন সার্ভের প্রাথমিক ফলাফলে এ চিত্র উঠে এসেছে। জরিপের ফল প্রকাশ উপলক্ষে আগারগাঁও পরিসংখ্যান ভবনে এদিন সংবাদ সম্মেলন করে বিবিএস। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৬ নম্বর অভীষ্টের ছয়টি সূচক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে এ জরিপ পরিচালিত হয়। গত ৬ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই জরিপে দেশের ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানার ৮৪ হাজার ৮০৭ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ অংশ নেন।
জরিপ অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এ প্রতিষ্ঠানে ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ নাগরিক ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এর পর রয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ৬১ দশমিক ৯৪, পাসপোর্ট অফিস ৫৭ দশমিক ৪৫ এবং ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।
জরিপের ফল বলছে, ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় একা চলাফেরা করতে নিরাপদ বোধ করেন। তবে এখানে রয়েছে স্পষ্ট লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য। পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ৮৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ, নারীর ক্ষেত্রে ৮০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলের নিরাপত্তা বোধ ৮৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও গ্রামাঞ্চলের তুলনায় ৮৫ দশমিক ৩০ শতাংশের কিছুটা কম। নিজ বাসায় নিরাপত্তা বোধের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি– ৯২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
মতপ্রকাশ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তারা সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে মতপ্রকাশ করতে পারেন। অন্যদিকে, ২১ দশমিক ৯৯ শতাংশ নাগরিক বিশ্বাস করেন, তারা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে প্রভাব ফেলতে পারেন।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় আস্থার চিত্র
গত এক বছরে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন ৪৭ দশমিক ১২ শতাংশ নাগরিক। সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৭২ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবাকে সহজপ্রাপ্য এবং ৮৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ সেবার ব্যয়কে সহনীয় মনে করেন। তবে স্বাস্থ্যসেবার মান ৬৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, স্বাস্থ্যকর্মীদের আচরণ ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং সময় দেওয়া ৬৩ দশমিক ১৯ শতাংশ– এসব ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম সন্তুষ্টি দেখা গেছে।
সরকারি শিক্ষায় ইতিবাচক প্রবণতা
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪০ দশমিক ৯৩ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছেন, তাদের অন্তত একটি সন্তান সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। প্রাথমিক স্তরে ৯৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ নাগরিক বিদ্যালয়ে সহজ প্রবেশাধিকার ও ৯২ দশমিক ৬৬ শতাংশ ব্যয়কে সহনীয় বলে মন্তব্য করেন। মাধ্যমিক স্তরে এ হার কিছুটা কম– ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ ও ৮০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। শিক্ষার মান বিষয়ে প্রাথমিক স্তরে ৬৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৭১ দশমিক ৮৬ শতাংশ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
অন্যান্য সরকারি সেবার মান
পরিচয়পত্র বা নাগরিক নিবন্ধনের মতো সেবায় ৭৮ দশমিক ১২ শতাংশ নাগরিক সেবার প্রাপ্যতা এবং ৮৬ দশমিক ২৮ শতাংশ ব্যয়কে গ্রহণযোগ্য মনে করেন। তবে কার্যকারিতা ৬২ দশমিক ৬০ শতাংশ, সময়মতো সেবা ৫১ দশমিক ২৮ শতাংশ ও সমআচরণ ৫৬ দশমিক ২৬ শতাংশ– এ তিনটি সূচকে সন্তুষ্টির হার তুলনামূলকভাবে কম।
বিচারপ্রাপ্তি ও বিরোধ নিষ্পত্তি
গত দুই বছরে ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো বিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বিচারপ্রক্রিয়ার আওতায় আসতে পেরেছেন। এর মধ্যে ৪১ দশমিক ৩৪ শতাংশ আনুষ্ঠানিক (আদালত বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) এবং ৬৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক (কমিউনিটি নেতা বা আইনজীবী) প্রক্রিয়ায় সেবা পেয়েছেন।
বৈষম্য ও হয়রানি
জরিপ অনুযায়ী, গত এক বছরে ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারীদের মধ্যে এই হার ১৯ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলে বৈষম্যের হার ২২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, যা গ্রামাঞ্চলের ১৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশের চেয়ে বেশি।
জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ঘুষ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল সবাইকে ঘুষ দিতে হয়। তারপরও জরিপে উঠে এসেছে ৩১ শতাংশ নাগরিককে ঘুষ দিতে হয়। নারীদের কাছে তুলনামূলক ঘুষ কম চাওয়া হয়েছে। তুলনামূলক উচ্চবিত্তরা ঘুষ দেন বেশি। ঘুষ দিয়ে তারা মূলত সেবা কিনে নেন।’
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতির তথ্যে হতাশা ব্যক্ত করে উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা তো এখনও দাঁড়াতেই পারেনি, তারপরও তারা দ্বিতীয় অবস্থানে। এটি ভালো কথা নয়। আমার জানামতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি ঘুষ বাণিজ্য হয়। সেটি বেশির ভাগই বদলিকে কেন্দ্র করে। এখানে মধ্যস্বত্বভোগী অনেক।’ পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতিও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।