সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তাঁর জন্মদিনের আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর কক্ষে ঢুকলেই চোখে পড়ে সামনে আর পাশে বইয়ের সারি। মাঝখানে বসে তিনি পড়ছেন, লিখছেন। বললেন, ‘পড়া আমার হবি। বাল্যকাল থেকে। অন্য বিনোদন নয়।’ ক্লাস সেভেনে ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যায়। মাসাধিককাল প্লাস্টার বাঁধা পায়ে শুয়ে থাকতে হয়। সেই নির্জনতায় বই হয়ে ওঠে সঙ্গী। সেখান থেকেই শুরু তাঁর অটুট পাঠযাত্রা। লিখতে বসেন, যখনই সময় পান, ‘আমি সময় পেলেই লিখি। ঘুম ভাঙার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত আমার পড়া আর লেখার কাজ চলতে থাকে। রাত জাগার অভ্যাস আমার কখনো ছিল না। সারা জীবন একটা নিয়মের মধ্যে চলেছি।’
জন্ম ১৯৩৬ সালে। শৈশব কেটেছে আজিমপুর কলোনিতে। সেখানে শ পাঁচেক পরিবার, সবাই সরকারি চাকুরে। তাঁর ভাষায়, এরাই তখনকার বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র। এখানেই বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষ দেখেছেন কাছ থেকে। ছেলেবেলা থেকেই মনে হতো, চারপাশে যা দেখছেন, সেখানে অনেক অন্যায় ঘটছে—‘কিন্তু তা দূর করবার কায়দা তো জানতাম না।’ ১৯৪৯ সালে আরমানিটোলায় মাওলানা ভাসানীর বক্তৃতা তাঁকে আলোড়িত করে। স্কুলজীবনে কারা যেন গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির লিফলেট দিয়ে যেত, সেখান থেকে তৈরি হয় অন্যায় ব্যবস্থা বদলের অস্পষ্ট বোধ। ১৯৫৯ সালে লিডস ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে সেই বোধ স্পষ্ট হয়। সেখানে বামপন্থীদের প্রভাব, অ্যাংরি ইয়াংম্যান মুভমেন্ট—সব মিলিয়ে ভাবনা স্পষ্ট হতে থাকে।
বাবার চাওয়া ছিল ছেলে সিভিল সার্ভিসে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ায় বাবা শেষ পর্যন্ত মেনে নেন। জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) চাকরির ডেমনেস্ট্রেশন দিতে যাওয়ার আগে বাবার কথাটি মনে পড়ে, ‘দেখিস বাবা, পা যেন না কাঁপে।’ পা কাঁপেনি তাঁর।
আজ পর্যন্ত। নিজেকে সামাজিক করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই পত্রিকা সম্পাদনা শুরু। কৌতুক করে বললেন, ‘আমার সম্পাদক হওয়ার মধ্যে একটা আমলাতান্ত্রিকতাও ছিল। বাবার সরকারি চাকুরের অভ্যাস কিছুটা উত্তরাধিকার সূত্রে এসেছে। সম্পাদক হিসেবে লেখা মনোনীত করতে পারি, সংশোধন করতে পারি। সামাজিক হওয়ার ইচ্ছে আর সেই আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চা মিলিয়ে পত্রিকা সম্পাদনা শুরু বলা যায়।’
চেয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হবেন, কিন্তু নিজেকে ফিরে দেখেছিলেন নির্মম চোখে, ‘১৯৪৯ সালে কাজী মোতাহার হোসেন তরুণদের উপদেশ দিয়েছিলেন, “যাদের কবিতা লেখার প্রতিভা নেই, তাদের কবিতার নবিশি না করাই ভালো।” আমারও মনে হয়েছিল, আমার কল্পনাশক্তি বা কাব্যপ্রতিভা নেই। আমি প্রবন্ধে চলে এলাম।’ সাহিত্যপাঠ আর অধ্যাপনা তাঁর মনকে বিশ্লেষণধর্মী করে তুলেছে। ফলে, ‘যাই লিখি মনে হয়, এটা ঠিক হয়নি। যে মানের সাহিত্য পড়ি, তার তুলনায় অতি সামান্য মনে হয়।’ তাই নিরুৎসাহ বোধ করেছেন। কথাসাহিত্যে অশুভ, বিয়োগাত্মক কিছু ভালো লাগত না। সমাজের নেতিবাচক কিছু সহ্য করতে পারেন না। মানুষের শুভবোধের ওপর ভরসা রাখেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, জীবন দৈর্ঘ্যে নয়, প্রস্থে বাড়াতে হয়। তবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘সারা জীবন একটা শৃঙ্খলার মধ্যে কাটিয়েছি। সে জন্য হয়তো এখনো কর্মক্ষম আছি। শৃঙ্খলাটা হচ্ছে সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে উঠে পড়ি। কোনো আলস্য আমার কাছে অসহ্য মনে হয়। ঘুম ভেঙে গেলে শুয়ে থাকতে পারি না। ফাঁক পেলেই ঘুমিয়ে নেব, এটা আমি পারি না। আমার মনে হয়, সময় খুব মূল্যবান।’ এখন বাইরে যাওয়া হয় না।
ঘরের ভেতরেই হিসাব করে ১৫০ মিনিট হাঁটেন, ‘এই হাঁটাই আমার বিশ্রাম। তখন ভাবনারও সময় পাই।’
একবার ডিন নির্বাচিত হয়ে মনে হয়েছে, ‘আমার কাজ তো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি মনে করেছি পড়াশোনা আমার বিনোদন আর লেখা আমার কাজ। আমি আগাগোড়াই লেখক হতে চেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেলে অর্থ পাব হয়তো, কিন্তু আমার সময় নষ্ট হবে। আমি সময় নষ্ট করতে চাই না।’
যা করেছেন, লিখেছেন, তার মূল্যায়ন কীভাবে করবেন? ‘আমার একটা অসন্তুষ্টি আছে। বোধ হয় সময় আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারতাম। কিছু কাজ করেছি, যা না করে উপায় ছিল না। তবে আমার গর্ব যে আমি ওসমানী উদ্যান রক্ষার আন্দোলনে সভাপতি ছিলাম। আমরা উদ্যানটা রক্ষা করতে পেরেছি।’
মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে চারপাশে হতাশাই প্রবল। তবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বললেন, ‘এখন যে চূড়ান্ত আক্রমণটা, সেটা হচ্ছে এই মনুষ্যত্বের ওপর আক্রমণ। মানুষকে আর মানুষ থাকতে দিচ্ছে না। মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তোলা হচ্ছে, আত্মকেন্দ্রিক করে তোলা হচ্ছে। তবে মানুষের মনুষ্যত্বের ওপরই আমার ভরসা। মানুষ এটা হতে দেবে না। পৃথিবীকে মানুষের বাসের অনুপযোগী করার প্রক্রিয়া মানুষ প্রতিহত করবেই।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র ক
এছাড়াও পড়ুন:
ভরসা তাঁর মানুষের শুভবোধে
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তাঁর জন্মদিনের আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর কক্ষে ঢুকলেই চোখে পড়ে সামনে আর পাশে বইয়ের সারি। মাঝখানে বসে তিনি পড়ছেন, লিখছেন। বললেন, ‘পড়া আমার হবি। বাল্যকাল থেকে। অন্য বিনোদন নয়।’ ক্লাস সেভেনে ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যায়। মাসাধিককাল প্লাস্টার বাঁধা পায়ে শুয়ে থাকতে হয়। সেই নির্জনতায় বই হয়ে ওঠে সঙ্গী। সেখান থেকেই শুরু তাঁর অটুট পাঠযাত্রা। লিখতে বসেন, যখনই সময় পান, ‘আমি সময় পেলেই লিখি। ঘুম ভাঙার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত আমার পড়া আর লেখার কাজ চলতে থাকে। রাত জাগার অভ্যাস আমার কখনো ছিল না। সারা জীবন একটা নিয়মের মধ্যে চলেছি।’
জন্ম ১৯৩৬ সালে। শৈশব কেটেছে আজিমপুর কলোনিতে। সেখানে শ পাঁচেক পরিবার, সবাই সরকারি চাকুরে। তাঁর ভাষায়, এরাই তখনকার বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র। এখানেই বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষ দেখেছেন কাছ থেকে। ছেলেবেলা থেকেই মনে হতো, চারপাশে যা দেখছেন, সেখানে অনেক অন্যায় ঘটছে—‘কিন্তু তা দূর করবার কায়দা তো জানতাম না।’ ১৯৪৯ সালে আরমানিটোলায় মাওলানা ভাসানীর বক্তৃতা তাঁকে আলোড়িত করে। স্কুলজীবনে কারা যেন গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির লিফলেট দিয়ে যেত, সেখান থেকে তৈরি হয় অন্যায় ব্যবস্থা বদলের অস্পষ্ট বোধ। ১৯৫৯ সালে লিডস ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে সেই বোধ স্পষ্ট হয়। সেখানে বামপন্থীদের প্রভাব, অ্যাংরি ইয়াংম্যান মুভমেন্ট—সব মিলিয়ে ভাবনা স্পষ্ট হতে থাকে।
বাবার চাওয়া ছিল ছেলে সিভিল সার্ভিসে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ায় বাবা শেষ পর্যন্ত মেনে নেন। জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) চাকরির ডেমনেস্ট্রেশন দিতে যাওয়ার আগে বাবার কথাটি মনে পড়ে, ‘দেখিস বাবা, পা যেন না কাঁপে।’ পা কাঁপেনি তাঁর।
আজ পর্যন্ত। নিজেকে সামাজিক করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই পত্রিকা সম্পাদনা শুরু। কৌতুক করে বললেন, ‘আমার সম্পাদক হওয়ার মধ্যে একটা আমলাতান্ত্রিকতাও ছিল। বাবার সরকারি চাকুরের অভ্যাস কিছুটা উত্তরাধিকার সূত্রে এসেছে। সম্পাদক হিসেবে লেখা মনোনীত করতে পারি, সংশোধন করতে পারি। সামাজিক হওয়ার ইচ্ছে আর সেই আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চা মিলিয়ে পত্রিকা সম্পাদনা শুরু বলা যায়।’
চেয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হবেন, কিন্তু নিজেকে ফিরে দেখেছিলেন নির্মম চোখে, ‘১৯৪৯ সালে কাজী মোতাহার হোসেন তরুণদের উপদেশ দিয়েছিলেন, “যাদের কবিতা লেখার প্রতিভা নেই, তাদের কবিতার নবিশি না করাই ভালো।” আমারও মনে হয়েছিল, আমার কল্পনাশক্তি বা কাব্যপ্রতিভা নেই। আমি প্রবন্ধে চলে এলাম।’ সাহিত্যপাঠ আর অধ্যাপনা তাঁর মনকে বিশ্লেষণধর্মী করে তুলেছে। ফলে, ‘যাই লিখি মনে হয়, এটা ঠিক হয়নি। যে মানের সাহিত্য পড়ি, তার তুলনায় অতি সামান্য মনে হয়।’ তাই নিরুৎসাহ বোধ করেছেন। কথাসাহিত্যে অশুভ, বিয়োগাত্মক কিছু ভালো লাগত না। সমাজের নেতিবাচক কিছু সহ্য করতে পারেন না। মানুষের শুভবোধের ওপর ভরসা রাখেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, জীবন দৈর্ঘ্যে নয়, প্রস্থে বাড়াতে হয়। তবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘সারা জীবন একটা শৃঙ্খলার মধ্যে কাটিয়েছি। সে জন্য হয়তো এখনো কর্মক্ষম আছি। শৃঙ্খলাটা হচ্ছে সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে উঠে পড়ি। কোনো আলস্য আমার কাছে অসহ্য মনে হয়। ঘুম ভেঙে গেলে শুয়ে থাকতে পারি না। ফাঁক পেলেই ঘুমিয়ে নেব, এটা আমি পারি না। আমার মনে হয়, সময় খুব মূল্যবান।’ এখন বাইরে যাওয়া হয় না।
ঘরের ভেতরেই হিসাব করে ১৫০ মিনিট হাঁটেন, ‘এই হাঁটাই আমার বিশ্রাম। তখন ভাবনারও সময় পাই।’
একবার ডিন নির্বাচিত হয়ে মনে হয়েছে, ‘আমার কাজ তো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি মনে করেছি পড়াশোনা আমার বিনোদন আর লেখা আমার কাজ। আমি আগাগোড়াই লেখক হতে চেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেলে অর্থ পাব হয়তো, কিন্তু আমার সময় নষ্ট হবে। আমি সময় নষ্ট করতে চাই না।’
যা করেছেন, লিখেছেন, তার মূল্যায়ন কীভাবে করবেন? ‘আমার একটা অসন্তুষ্টি আছে। বোধ হয় সময় আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারতাম। কিছু কাজ করেছি, যা না করে উপায় ছিল না। তবে আমার গর্ব যে আমি ওসমানী উদ্যান রক্ষার আন্দোলনে সভাপতি ছিলাম। আমরা উদ্যানটা রক্ষা করতে পেরেছি।’
মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে চারপাশে হতাশাই প্রবল। তবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বললেন, ‘এখন যে চূড়ান্ত আক্রমণটা, সেটা হচ্ছে এই মনুষ্যত্বের ওপর আক্রমণ। মানুষকে আর মানুষ থাকতে দিচ্ছে না। মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তোলা হচ্ছে, আত্মকেন্দ্রিক করে তোলা হচ্ছে। তবে মানুষের মনুষ্যত্বের ওপরই আমার ভরসা। মানুষ এটা হতে দেবে না। পৃথিবীকে মানুষের বাসের অনুপযোগী করার প্রক্রিয়া মানুষ প্রতিহত করবেই।’