Prothomalo:
2025-10-03@08:36:27 GMT

ভরসা তাঁর মানুষের শুভবোধে

Published: 23rd, June 2025 GMT

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তাঁর জন্মদিনের আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর কক্ষে ঢুকলেই চোখে পড়ে সামনে আর পাশে বইয়ের সারি। মাঝখানে বসে তিনি পড়ছেন, লিখছেন। বললেন, ‘পড়া আমার হবি। বাল্যকাল থেকে। অন্য বিনোদন নয়।’ ক্লাস সেভেনে ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যায়। মাসাধিককাল প্লাস্টার বাঁধা পায়ে শুয়ে থাকতে হয়। সেই নির্জনতায় বই হয়ে ওঠে সঙ্গী। সেখান থেকেই শুরু তাঁর অটুট পাঠযাত্রা। লিখতে বসেন, যখনই সময় পান, ‘আমি সময় পেলেই লিখি। ঘুম ভাঙার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত আমার পড়া আর লেখার কাজ চলতে থাকে। রাত জাগার অভ্যাস আমার কখনো ছিল না। সারা জীবন একটা নিয়মের মধ্যে চলেছি।’

জন্ম ১৯৩৬ সালে। শৈশব কেটেছে আজিমপুর কলোনিতে। সেখানে শ পাঁচেক পরিবার, সবাই সরকারি চাকুরে। তাঁর ভাষায়, এরাই তখনকার বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র। এখানেই বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষ দেখেছেন কাছ থেকে। ছেলেবেলা থেকেই মনে হতো, চারপাশে যা দেখছেন, সেখানে অনেক অন্যায় ঘটছে—‘কিন্তু তা দূর করবার কায়দা তো জানতাম না।’ ১৯৪৯ সালে আরমানিটোলায় মাওলানা ভাসানীর বক্তৃতা তাঁকে আলোড়িত করে। স্কুলজীবনে কারা যেন গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির লিফলেট দিয়ে যেত, সেখান থেকে তৈরি হয় অন্যায় ব্যবস্থা বদলের অস্পষ্ট বোধ। ১৯৫৯ সালে লিডস ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে সেই বোধ স্পষ্ট হয়। সেখানে বামপন্থীদের প্রভাব, অ্যাংরি ইয়াংম্যান মুভমেন্ট—সব মিলিয়ে ভাবনা স্পষ্ট হতে থাকে।

বাবার চাওয়া ছিল ছেলে সিভিল সার্ভিসে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ায় বাবা শেষ পর্যন্ত মেনে নেন। জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) চাকরির ডেমনেস্ট্রেশন দিতে যাওয়ার আগে বাবার কথাটি মনে পড়ে, ‘দেখিস বাবা, পা যেন না কাঁপে।’ পা কাঁপেনি তাঁর।

আজ পর্যন্ত। নিজেকে সামাজিক করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই পত্রিকা সম্পাদনা শুরু। কৌতুক করে বললেন, ‘আমার সম্পাদক হওয়ার মধ্যে একটা আমলাতান্ত্রিকতাও ছিল। বাবার সরকারি চাকুরের অভ্যাস কিছুটা উত্তরাধিকার সূত্রে এসেছে। সম্পাদক হিসেবে লেখা মনোনীত করতে পারি, সংশোধন করতে পারি। সামাজিক হওয়ার ইচ্ছে আর সেই আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চা মিলিয়ে পত্রিকা সম্পাদনা শুরু বলা যায়।’

চেয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হবেন, কিন্তু নিজেকে ফিরে দেখেছিলেন নির্মম চোখে, ‘১৯৪৯ সালে কাজী মোতাহার হোসেন তরুণদের উপদেশ দিয়েছিলেন, “যাদের কবিতা লেখার প্রতিভা নেই, তাদের কবিতার নবিশি না করাই ভালো।” আমারও মনে হয়েছিল, আমার কল্পনাশক্তি বা কাব্যপ্রতিভা নেই। আমি প্রবন্ধে চলে এলাম।’ সাহিত্যপাঠ আর অধ্যাপনা তাঁর মনকে বিশ্লেষণধর্মী করে তুলেছে। ফলে, ‘যাই লিখি মনে হয়, এটা ঠিক হয়নি। যে মানের সাহিত্য পড়ি, তার তুলনায় অতি সামান্য মনে হয়।’ তাই নিরুৎসাহ বোধ করেছেন। কথাসাহিত্যে অশুভ, বিয়োগাত্মক কিছু ভালো লাগত না। সমাজের নেতিবাচক কিছু সহ্য করতে পারেন না। মানুষের শুভবোধের ওপর ভরসা রাখেন।

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, জীবন দৈর্ঘ্যে নয়, প্রস্থে বাড়াতে হয়। তবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘সারা জীবন একটা শৃঙ্খলার মধ্যে কাটিয়েছি। সে জন্য হয়তো এখনো কর্মক্ষম আছি। শৃঙ্খলাটা হচ্ছে সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে উঠে পড়ি। কোনো আলস্য আমার কাছে অসহ্য মনে হয়। ঘুম ভেঙে গেলে শুয়ে থাকতে পারি না। ফাঁক পেলেই ঘুমিয়ে নেব, এটা আমি পারি না। আমার মনে হয়, সময় খুব মূল্যবান।’ এখন বাইরে যাওয়া হয় না।

ঘরের ভেতরেই হিসাব করে ১৫০ মিনিট হাঁটেন, ‘এই হাঁটাই আমার বিশ্রাম। তখন ভাবনারও সময় পাই।’

একবার ডিন নির্বাচিত হয়ে মনে হয়েছে, ‘আমার কাজ তো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি মনে করেছি পড়াশোনা আমার বিনোদন আর লেখা আমার কাজ। আমি আগাগোড়াই লেখক হতে চেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেলে অর্থ পাব হয়তো, কিন্তু আমার সময় নষ্ট হবে। আমি সময় নষ্ট করতে চাই না।’

যা করেছেন, লিখেছেন, তার মূল্যায়ন কীভাবে করবেন? ‘আমার একটা অসন্তুষ্টি আছে। বোধ হয় সময় আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারতাম। কিছু কাজ করেছি, যা না করে উপায় ছিল না। তবে আমার গর্ব যে আমি ওসমানী উদ্যান রক্ষার আন্দোলনে সভাপতি ছিলাম। আমরা উদ্যানটা রক্ষা করতে পেরেছি।’

মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে চারপাশে হতাশাই প্রবল। তবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বললেন, ‘এখন যে চূড়ান্ত আক্রমণটা, সেটা হচ্ছে এই মনুষ্যত্বের ওপর আক্রমণ। মানুষকে আর মানুষ থাকতে দিচ্ছে না। মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তোলা হচ্ছে, আত্মকেন্দ্রিক করে তোলা হচ্ছে। তবে মানুষের মনুষ্যত্বের ওপরই আমার ভরসা। মানুষ এটা হতে দেবে না। পৃথিবীকে মানুষের বাসের অনুপযোগী করার প্রক্রিয়া মানুষ প্রতিহত করবেই।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র ক

এছাড়াও পড়ুন:

মাও থেকে সি—কোন কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে চীন

১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চীনের বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ইতিহাস লেখা হলো। হাজার হাজার মানুষ এ স্কয়ারের দিকে ছুটছিলেন উত্তেজনা, আশা ও আগ্রহ নিয়ে। সেই সময় মাও সে তুং ঘোষণা দেন, ‘দ্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়না ইজ স্ট্যাবলিশড!’ (গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হলো)। শব্দগুলো যেন চীনের আকাশে এক নতুন সূর্যের আলো ছড়িয়ে দিল। সেই থেকে শুরু একটি জাতির নতুন অধ্যায়ের।

কিন্তু এ নতুন রাষ্ট্রের যাত্রা সহজ ছিল না। বহু বছর ধরে চীন অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ, বিদেশি আগ্রাসন ও সামাজিক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে শহরের নাগরিক—প্রত্যেকের জীবন ছিল চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা। কিন্তু সেই দীর্ঘ, জটিল ও রোমাঞ্চকর যাত্রার মধ্য দিয়েই চীন আজ বিশ্বশক্তি হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছে। এভাবে দেশটির ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনের রহস্য ছিল—রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা, সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক কৌশল।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিপ্লবের পটভূমি

১৯১১ সালে চীনের চিং রাজবংশের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো গভীরভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ দারিদ্র৵সীমার নিচে বাস করত, বিশেষ করে গ্রামীণ চীনে। শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা ছিল সীমিত, যা জনগণকে রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল দুর্বল। বিপরীতে প্রাদেশিক যুদ্ধবাজ নেতাদের ও স্থানীয় শক্তির প্রভাব ছিল অত্যধিক। এটি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার বিভাজন তৈরি করে।

চীনের অর্থনীতি ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে বছরে ৯–১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল; যার ফলে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার বাইরে আসে।

১৯২০-এর দশকে চীনের বড় শহর ও শিল্পকেন্দ্রে কুওমিনটাং (কেএমটি) দল প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তবে গ্রামীণ এলাকায় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে সমতার নীতি বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে জনসমর্থন বৃদ্ধি করে সিসিপি।

আরও পড়ুনচীনকে চোখ রাঙাবে না—শোডাউনে সি চিন পিং কি এটাই বললেন০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

১৯২৭ সালে শুরু হয় চীনের গৃহযুদ্ধ। কেএমটি এবং সিসিপির মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্ব গ্রামীণ চীনের জীবনকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। ১৯৩৪-৩৫ সালে লংমার্চ সিসিপির নেতৃত্ব ও আদর্শ দৃঢ় করে এবং বিপুল জনসমর্থন নিশ্চিত করে। সিসিপির গ্রামীণ শক্তি আরও বৃদ্ধি করে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ (১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫)। এ সময়ে সিসিপি জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং সামাজিক নীতি কার্যকর করতে সক্ষম হয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সূচনা ও প্রশাসনিক পুনর্গঠন

১ অক্টোবর ১৯৪৯, তিয়েনআনমেন স্কয়ারে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সমবেত হন। মাও সে–তুং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন রাষ্ট্র (পিআরসি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাও ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চৌ এনলাই দায়িত্ব নেন। এ মুহূর্তটি চীনের ইতিহাসে এক বিরাট মাইলফলক হয়ে আছে। সে হিসাবে আজ ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭৬ বছর পূর্তি।

বিশ্ব ভালো থাকলেই চীন ভালো থাকতে পারে। আর চীন ভালো করলে, বিশ্ব আরও ভালো হয়ে ওঠে।সি চিন পিং, চীনের প্রেসিডেন্ট

নতুন চীনের প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় কংগ্রেস, সামরিক ও বিচার বিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিসিপির লক্ষ্য ছিল, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার সমন্বয়, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, সামাজিক নীতির বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ।

প্রথম কর্মসূচিতে ভূমি সংস্কার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন এবং সামরিক সংহতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় ৫০ লাখ কৃষক নতুনভাবে জমি পান। প্রাথমিক শিল্পায়ন উদ্যোগে ১০০টি কারখানা পুনর্গঠন বা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সম্প্রসারণে প্রায় ১৫ হাজার নতুন বিদ্যালয় এবং ৫ হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়।

১৯৬১ সালে চীনের লুশান পর্বতে অবকাশযাপনকালে মাও।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মাও থেকে সি—কোন কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে চীন