ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। পার্টি চাইলে আগের মতোই এমন সব নীতি চালিয়ে যেতে পারে, যেসব নীতি বস্তাপচা ও পক্ষপাতদুষ্ট অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আঁকড়ে বসে আছে। চাইলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেই ৬০ শতাংশ মানুষের কষ্টকে কোনো রকম পাত্তা না দিয়েও চলতে পারে, জীবন চালাতে হিমশিম খাওয়া যে মানুষগুলো সপ্তাহ শেষে বেতন পাওয়ার পরের দিনই পরবর্তী বেতনের জন্য দিন গোনে। 

ডেমোক্র্যাটরা চাইলে সেই তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নকে অবহেলা করতে পারেন, যে প্রজন্ম সম্ভবত তাদের মা-বাবার চেয়েও খারাপ সময়ের মুখোমুখি হবে। তাঁরা চাইলে কোটি কোটি ডলার চাঁদা দেওয়া ধনকুবের আর বাস্তবতা না-জানা সেই পরামর্শকদের ওপর নির্ভর করে চলতে পারেন, যাঁরা লাখ লাখ ডলার খরচ করে দলের প্রচারে একঘেয়ে, ক্লিশে ও সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বহীন ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন বানান। 

ডেমোক্র্যাটরা চাইলে সেই ভয়াবহ বাস্তবতাকেও এড়িয়ে যেতে পারেন, যে বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি নাগরিক গণতন্ত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারণ, তারা অনুভব করে না যে সরকার তাদের জীবনযন্ত্রণা বোঝে বা কোনো সমাধান দিতে চায়। অথবা ডেমোক্র্যাটরা চাইলে জোহরান মামদানির মঙ্গলবারের বিজয় থেকে একটি শিক্ষা নিতে পারেন। সেই শিক্ষা হলো, মানুষের মুখোমুখি হয়ে প্রকৃত অর্থনৈতিক ও নৈতিক সংকটগুলো সাহস করে তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে ধনিক শ্রেণির লোভ ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে এবং এমন একটি কর্মসূচির পক্ষে লড়তে হবে, যা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনকে উন্নত করতে পারে।

মোদ্দাকথা, ডেমোক্রেটিক পার্টির সামনে এখন দুটি রাস্তা। একটি হলো পুরোনো ভুল পথে চলতে থাকা; আরেকটি হলো, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু করা। অনেকে বলছেন, মামদানির বিজয় কেবল তাঁর ব্যক্তিত্ব আর ক্যারিশমার ফল। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি এক চমৎকার প্রার্থীর উদাহরণ। কিন্তু শুধু ভালো প্রার্থী থাকলেই এমন বিজয় আসে না। জয়ের পেছনে থাকতে হয় অসাধারণ এক তৃণমূল আন্দোলন। হাজার হাজার মানুষ যদি আগ্রহ নিয়ে দরজায় দরজায় গিয়ে তাঁর পক্ষে প্রচার না করত, তবে এমন জয় সম্ভব হতো না। 

বর্তমান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শিক্ষা নেবেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। সম্ভবত নেবেন না। কারণ, তাঁদের অনেকেই এমন অবস্থায় আছেন, যেখানে তাঁরা নিজেরাই সেই ডুবতে থাকা জাহাজ ‘টাইটানিক’-এর ক্যাপ্টেন হয়ে থাকতে চান; কিন্তু দিক পরিবর্তন করতে চান না।

আর এই আন্দোলন গড়ে ওঠে তখনই, যখন এর পেছনে থাকে এমন একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি, যা সাধারণ মানুষের প্রয়োজন আর কষ্টের কথা বলে। নিউইয়র্কের মানুষ এবং গোটা আমেরিকান জনতা জানে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত একটি দেশে কারও জন্য শুধু খাওয়া, ঘরভাড়া দেওয়া বা ডাক্তার খরচ মেটাতে যুদ্ধ করার মতো কষ্ট করা উচিত নয়।

ডেমোক্রেটিক পার্টির পেইড কনসালট্যান্টরা হয়তো জানেনই না, এই সাধারণ মানুষগুলো আসলে কী চায়, তারা কোথায় থাকে। মামদানির ‘চরমপন্থী’ বা ‘অবাস্তব’ অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু তৃণমূল মানুষ জানে, এই নীতিগুলো আসলে তাদেরই কথা বলছে।

আজকের দুনিয়ায় যেখানে ধনী আর সাধারণ মানুষের মধ্যে আয় ও সম্পদের পার্থক্য ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে, সেখানে ধনী ব্যক্তি আর বড় করপোরেশনগুলোর উচিত তাদের ন্যায্য পরিমাণ কর দেওয়া। মামদানির মতো নেতাদের দাবি এটিই। যখন অনেক নিউইয়র্কবাসী আর সস্তায় ভাড়া বাসা খুঁজে পাচ্ছে না, তখন ভাড়া না বাড়ানোর জন্য একটি স্থগিতাদেশ দরকার—এটিও মামদানির দাবি। যখন একজন শ্রমিকের প্রতিদিন কর্মস্থলে যাওয়া-আসার পেছনে বেতনের একটি বড় অংশ চলে যায়, তখন গণপরিবহন বিনা মূল্যের হওয়া উচিত। এটিও মামদানির ভাবনা। 

আরও পড়ুনজোহরান মামদানি যেভাবে ইতিহাস বদলে দেওয়ার পথে২৬ জুন ২০২৫

যখন অনেক নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া পরিবার ভালো খাবার কিনতে পারছে না; তাদের জন্য সরকার পরিচালিত পাড়াভিত্তিক মুদিদোকান প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এই দাবিও এসেছে তাঁর পক্ষ থেকে। এসব দাবি শুনে অনেকেই বলবে ‘চরমপন্থী’। কিন্তু আসলে এগুলো খুবই সাধারণ মানুষের বাস্তব চাহিদা। হ্যাঁ, ধনীরা বা বড় দাতারা বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা হয়তো এসব চান না। কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ঠিক এই জিনিসগুলোই চায়। তাই হয়তো এখন সময় এসেছে এই মানুষগুলোর কথা শোনার। 

মামদানির জয় কোনো তারকাখ্যাতির জন্য হয়নি। এটি হয়েছে সাধারণ মানুষের শক্তিতে। এই আন্দোলন মানুষকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়, বরং নিজের জীবনে যেসব সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলে, সেগুলো নিয়ে কথা বলার অধিকার দাবি করাও গণতন্ত্র। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মামদানি সেই নৈতিক প্রশ্ন থেকে পালিয়ে যাননি, যা শুধু নিউইয়র্ক নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কোটি মানুষের মনে আঘাত দিচ্ছে। সেটি হলো ইসরায়েলের চরমপন্থী নেতানিয়াহুর সরকারের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র যেন সামরিক সহায়তা না দেয়। গাজার শিশুদের অনাহারে মারা যাওয়া কেউ চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে পারে না।  

মামদানি জানেন, আসলেই, ইহুদিবিদ্বেষ (অ্যান্টিসেমিটিজম) একটি জঘন্য ও বিপজ্জনক চিন্তাধারা। কিন্তু নেতানিয়াহুর মতো একজন নেতার অমানবিক নীতির সমালোচনা করা মানেই ইহুদিবিদ্বেষ নয়। মামদানির নির্বাচনী লড়াই আমাদের শেখায়, শুধু ট্রাম্পের বা তাঁর ধ্বংসাত্মক নীতির সমালোচনা করলেই চলবে না; আমাদের দরকার একটি ইতিবাচক ভবিষ্যৎ চিন্তা। দরকার এ প্রশ্নের জবাব—এই পরিস্থিতি কেন হলো, কেন আজ অধিকাংশ আমেরিকান পিছিয়ে পড়ছে?

বর্তমান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শিক্ষা নেবেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। সম্ভবত নেবেন না। কারণ, তাঁদের অনেকেই এমন অবস্থায় আছেন, যেখানে তাঁরা নিজেরাই সেই ডুবতে থাকা জাহাজ ‘টাইটানিক’-এর ক্যাপ্টেন হয়ে থাকতে চান; কিন্তু দিক পরিবর্তন করতে চান না। তবে তাঁরা কী ভাবছেন, সেটা এখন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। কারণ, মামদানির বিরুদ্ধে এই ‘সিস্টেম’-এর পক্ষ থেকে সবকিছুই মাঠে নামানো হয়েছিল। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সুপার প্যাক অর্থায়ন, নামীদামি মানুষের সমর্থন, পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যম—সব নামানো হয়েছিল। তবু তাঁরা মামদানিকে হারাতে পারেননি।

বার্নি স্যান্ডার্স মার্কিন সিনেটর এবং সিনেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রম ও পেনশন-সংক্রান্ত কমিটির প্রধান সদস্যদের একজন

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ম মদ ন র র জন য ই এমন দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে ‘জনগণ’ কীভাবে কথা বলবে

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তর কীভাবে ঘটবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে যেমন নতুন ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তেমনি প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে শুরু হয়েছে তীব্র বাহাস বা বিতর্ক; যদিও নিকট অতীতের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলে, ক্রান্তিকালীন রূপান্তরের ক্ষেত্রে বিতর্ক, সংলাপ ও নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশেও অভূতপূর্ব সক্রিয়তা দৃশ্যমান।

আরও পড়ুনগণক্ষমতাবিরোধী ধ্যানধারণা বনাম গণরাজনৈতিক ধারা১৯ জুন ২০২৫২.

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের যে আলোচনা ছোট এবং অনেকটা বিশেষায়িত পরিসরে চলেছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থান তাকে সাধারণের আলোচনার বিষয়ে পরিণত করেছে। প্রশ্ন হলো, সংস্কার কিসের হবে? কীভাবে হবে? বা এর প্রক্রিয়া কী হবে?

এসব প্রশ্ন নিয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে সংবিধানের সংস্কার নিয়ে—কেউ নতুন গঠনতন্ত্রের পক্ষে, কেউ মৌলিক কিছু সংস্কারের পক্ষে। তবে এসবের কোনোটিই যেহেতু বিভিন্ন রাজনৈতিক সত্তার ঐকমত্য ছাড়া সম্ভব নয়, তাই সমঝোতার মাধ্যমেই এর পথ তৈরি হতে হবে। 

তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্ন এলেই একটি পুরোনো অভিযোগ বারবার সামনে আসছে—বাংলাদেশের গণতন্ত্রবিষয়ক সব ভাবনা কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক। এই ‘নির্বাচনমুখী’ গণতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করছেন অনেকেই। যেমন কবি, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার দীর্ঘদিন ধরে এমন ভাবনার কড়া সমালোচক। অভ্যুত্থানের পরও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই, ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় না।

সম্প্রতি বিআইজিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক মির্জা এম হাসানও একই ধরনের সমালোচনার সুরেই বলেছেন, মূলধারার রাজনীতিবিদেরা রাজনৈতিক স্বার্থে গণতন্ত্রকে নির্বাচনী গণতন্ত্রের ‘সীমাবদ্ধ ধারণার’ মধ্যে আটকে রেখেছেন।

৩.

ফরহাদ মজহার ও মির্জা এম হাসানের সমালোচনার মূল সুর—কেবল নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র কায়েম হবে না, নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু এই সমালোচনা বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতাকে আমলে নিতে প্রায়ই অপারগ।

■ ফরহাদ মজহার যখন ‘জনগণ’ এবং তাদের ‘সরাসরি অংশগ্রহণের’ কথা বলেন, সেই ‘জনগণ’কে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে, তা স্পষ্ট হয় না। ■ ‘জনগণ’-এর বিমূর্ত ধারণার বাইরে এসে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ও প্রতিষ্ঠানের অনিবার্যতাকে স্বীকার করে নিলে একটি মূর্ত ও কার্যকর পথ খুঁজে নেওয়া সম্ভব হবে। ■ রাষ্ট্রের বিদ্যমান নানা গোষ্ঠী ও অ্যাক্টরের মধ্যে ক্রমাগত সংলাপ-বাহাস-বিতর্কের মধ্য দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি; কেননা ঐকমত্য ব্যতিরেকে যেকোনো সংস্কার বা ছেদ টেকসই হবে না।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সংকট আদতে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। পাঁচ দশক ধরে এই জনগোষ্ঠী বেশির ভাগ সময়ই সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। অর্থাৎ যিনি বা যাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁদের ক্ষমতা থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সরানোর কোনো বন্দোবস্ত এখনো তৈরি হয়নি।

ফলস্বরূপ, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বরাবরই রক্ত ঝরাচ্ছে—অভ্যুত্থান, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন বা ক্যু ছাড়া ক্ষমতাসীন কাউকেই ক্ষমতা থেকে সরানো যায়নি। এমনকি নির্বাচনের দাবি আদায়েও লাশ পড়েছে বেশুমার। আমাদের অনেকের, যাঁদের জন্ম নব্বইয়ের দশকে, বয়স ৩০ পেরিয়ে গেলেও এখনো অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ মেলেনি।

এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রবিষয়ক যেকোনো আলোচনায় ‘নির্বাচন’ মুখ্য উপাদান হয়ে উঠবে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু উপরিউক্ত সমালোচনাগুলোয় এই কঠোর বাস্তবতার প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়।

অন্যদিকে দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের কারণে নির্বাচনী গণতন্ত্রের সমালোচনা আমাদের কাছে আচানকও নয়। বিগত শাসনামলেও আমরা দেখেছি, কীভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ‘তুলাধোনা’ করা হয়েছে বা গণতন্ত্রের বিপরীতে ‘উন্নয়ন’কে হাজির করা হয়েছে।

৪.

ভুল বুঝবেন না, দাবি করছি না যে ‘কেবল নির্বাচনই গণতন্ত্র’ বা নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে স্বৈরাচার কায়েম হয়নি—এমন কথাও বলা হচ্ছে না। বরং বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রের জন্য সর্বাধিক জরুরি হলো নির্বাচনব্যবস্থা।

পাঁচ বছরের জন্য শাসক পরিবর্তনের এই ‘এক দিনের ভোটাধিকার’ই গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক ধাপ। আমরা এই প্রাথমিক ধাপই এখনো অর্জন করতে পারিনি বা এটা করার জন্য সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক কোনো বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে পারিনি। যে রাষ্ট্রে পাঁচ দশকে বেশির ভাগ সময় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়নি, সেখানে যাবতীয় আলাপ যে নির্বাচনকে ঘিরে আবর্তিত হবে, সেটা যেমন সত্য, তেমনি রাজনৈতিক বাস্তবতা–বিবর্জিত নির্বাচনী গণতন্ত্রের সমালোচনা কার্যত গণতন্ত্রবিরোধী পক্ষগুলোকেই শক্তি জোগাবে।

ফলে কীভাবে এই ‘এক দিনের’ ভোটাধিকার প্রয়োগ নির্বিঘ্নে সম্ভব, ভোটাধিকার রক্ষার টেকসই বন্দোবস্ত কীভাবে তৈরি করব এবং কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রকে আটকাবে, এটা এ মুহূর্তে জরুরি আলাপ বলেই বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো না গেলেও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন—সর্বত্রই আলোচনা চলছে, এই সংস্কার কীভাবে সম্ভব?

৫.

সম্প্রতি সংস্কারবিষয়ক এ ধরনের আলাপ-আলোচনাকে ‘গণবিরোধী’ ও ‘প্রতিবিপ্লবী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ফরহাদ মজহার। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে একটি ‘বৈপ্লবিক ছেদ’ ঘটানোর তত্ত্বায়ন করে আসছেন এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে সেই ‘গঠনতান্ত্রিক মুহূর্ত’ হিসেবেই দাবি করেন।

বিখ্যাত তাত্ত্বিক আন্তোনিও নেগ্রিকে উল্লেখ করে সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, জনগণের গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতা বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের কাঠামোকে অস্বীকার করে নতুন ক্ষমতাকাঠামো ও ব্যবস্থা নির্মাণ করে। তিনি ‘প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র’ ও ‘প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার’কে ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে, এগুলোর উদ্দেশ্য হলো লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণিকে টিকিয়ে রেখে গণতন্ত্রে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করা।

লিবারেল ডেমোক্রেসি বা উদার গণতন্ত্র নিয়ে ফরহাদ মজহারের এ প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত ‘সুচিন্তিত’ ও ‘তীক্ষ্ণ’। কিন্তু রাজনৈতিক তাত্ত্বিক শান্তাল মোউফের বরাত দিয়েই এখানে একটি জরুরি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই।

আন্তোনিও নেগ্রি ও মিশেল হার্ডট তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সমালোচনা করে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যে ‘এক্সোডাস’ বা এসবের সম্পূর্ণ পরিত্যাগের কথা বলেন, তার সমালোচনা করেছিলেন শান্তাল মোউফ। তিনি নিজে একজন বামপন্থী চিন্তক ও উদার গণতন্ত্রের সমালোচক হলেও নেগ্রি ও হার্ডটদের এমন র‍্যাডিক্যাল অবস্থানকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

মোউফের কাছে রাজনীতি হচ্ছে ‘হেজিমোনির লড়াই’—একটি সাধারণ প্রতীকী পরিসরে সামষ্টিক ইচ্ছার গঠন ও পুনর্গঠন করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর (যদিও ত্রুটিপূর্ণ) মধ্যকার বিভিন্ন স্বার্থের দেনদরবার, জোট গঠন ও প্রভাবের জন্য প্রতিযোগিতা।

‘রাজনৈতিকতা’(অর্থাৎ রাজনীতিতে যে বন্ধু-শত্রুর বিভাজন অনিবার্যভাবে ক্রিয়াশীল থাকবে) মুছে ফেলা সম্ভব নয়। এই বিভাজন মুছে ফেলে কোনো একক ‘জনগণ’ ধারণা তৈরি করার ধারণা আদতে বাস্তবসম্মত নয়। বরং রাজনীতিতে বিদ্যমান এই অনিবার্য ‘শত্রুতা’ যেন একে অপরের প্রতি ‘ধ্বংসাত্মক’ (এন্টাগনিস্টিক) না হয়ে ‘বিরোধাত্মক’ (আগোনিস্টিক) ধারায় প্রবাহিত থাকে, সে জন্য প্রতিষ্ঠান ও হেজিমোনিক কাঠামোগুলোর প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কারণে তিনি প্রতিষ্ঠান ছাড়া ‘নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের’ ধারণাকে বিপজ্জনক ও অবাস্তব বলে মনে করেন।

মোউফের মতে, নেগ্রির এমন র‍্যাডিক্যাল অবস্থান ‘রাজনৈতিক’ ও প্রাতিষ্ঠানিকতার অনিবার্যতাকে খারিজ করে বলে রাজনীতির বাস্তবতাকে বুঝতে সহায়তা করে না। তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যাখ্যান না করে বরং সেগুলোকে ‘র‍্যাডিক্যাল’ করে তুলতে এবং আরও বেশি গণতান্ত্রিক করে তোলার ওকালতি করেন (শান্তাল মোউফ, এগোনিস্টিকস: থিঙ্কিং দ্য ওয়ার্ল্ড পলিটিক্যালি)। 

এ জন্য মোউফ যে হেজিমোনিক লড়াইয়ের কথা বলেন, সেটি একটি অংশীদারত্বমূলক পরিসরের ভেতরে এবং বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়েই চালিয়ে যেতে হবে। তাঁর মতে, লক্ষ্যটা খেলার মূল কাঠামোকে ধ্বংস করা নয়; বরং এর নিয়ম পরিবর্তন করা, যাতে ফলাফল আরও গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে।

মোউফ সতর্ক করেন যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান একটি কৌশলগত ভুল। এর ফলে এমন একটি ‘রাজনীতি-উত্তর’ বা ‘পোস্টপলিটিক্যাল’ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যেখানে প্রকৃত বিরোধিতা দমন করার আশঙ্কা তৈরি হয় এবং ডানপন্থী পপুলিজম বা জনতুষ্টিবাদের পথও প্রশস্ত হয়। 

৬.

মোউফকে উল্লেখ করার কারণ এটাই: ফরহাদ মজহার যখন ‘জনগণ’ এবং তাদের ‘সরাসরি অংশগ্রহণের’ কথা বলেন, সেই ‘জনগণ’কে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে, তা স্পষ্ট হয় না। সবাই এক সাধারণ ‘না’–তে একমত হয়ে যে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, সেখান থেকে একটি সুনির্দিষ্ট ‘হ্যাঁ’-তে পৌঁছানোর যাত্রা কীভাবে সম্ভব হবে, সেই স্পষ্ট দিশা এই ‘জনগণ’ ধারণার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। একে প্রায়ই একটি বিমূর্ত ধারণা হিসেবেই হাজির করা হচ্ছে।

মোউফ যে অনিবার্য ‘রাজনৈতিক’ (পলিটিক্যাল) বাস্তবতার কথা বলেন, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রবাহিত করা না গেলে তো গণতান্ত্রিক রূপান্তরই কঠিন হয়ে উঠবে। ফলে মজহার যখন বলেন, জনগণ নিজেরাই নিজেদের গঠনতন্ত্র রচনা করবে, অর্থাৎ ‘নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের’ কথা বলেন, এতে দুটি প্রধান সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে।

প্রথমত, ‘জনগণ’কে আমরা বিশুদ্ধরূপে চিনব কীভাবে? 

দ্বিতীয়ত, এই ‘রচনার প্রক্রিয়া’ কেমন হবে? 

এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।

৭.

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান যে বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, সেটি কাজে লাগানোর জন্য আমাদের ‘জনগণ’-এর বিমূর্ত ধারণার বাইরে এসে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ও প্রতিষ্ঠানের অনিবার্যতাকে স্বীকার করে নিলে একটি মূর্ত ও কার্যকর পথ খুঁজে নেওয়া সম্ভব হবে।

গত এক দশক, বিশেষত আরব বসন্তের পর আমাদের সামনে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ার বেশ কিছু নজির রয়েছে। রাষ্ট্রের বিদ্যমান নানা গোষ্ঠী ও অ্যাক্টরের মধ্যে ক্রমাগত সংলাপ-বাহাস-বিতর্কের মধ্য দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি। কেননা ঐকমত্য ব্যতিরেকে যেকোনো সংস্কার বা ছেদ টেকসই হবে না; অন্তত বৈশ্বিক নজির আমাদের এমন সিদ্ধান্তের দিকে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

আমাদের এই সতর্কতাও মনে রাখা দরকার, গভীরভাবে বিভাজিত ও ‘সহিংস’ সমাজে এ ধরনের প্রক্রিয়া কখনো কখনো বিভাজনকে নিরাময় না করে উল্টো আরও গভীর করে তুলতে পারে (নাথান জে ব্রাউন, কনস্টিটিউটিং কনস্টিটিউশনালিজম: লেসনস ফ্রম দ্য আরব ওয়ার্ল্ড)।

আমরা বর্তমানে এক বিশাল রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। নিঃসন্দেহে আমাদের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সাম্প্রতিক অভিযাত্রায় স্থানিক চরিত্র যুক্ত থাকবে; আবার দুনিয়ার সাম্প্রতিক নজিরগুলো থেকে আমাদের শিক্ষাও নেওয়া দরকার।

সহুল আহমদ লেখক ও গবেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নির্বাচন বিলম্বে কৌশল খুঁজছে কিছু দল: আসাদুজ্জামান
  • বিরোধীদের নিষিদ্ধ করা বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথ নয়: দ্য ইকোনমিস্ট
  • জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে মালয়েশিয়ায় ৩৬ বাংলাদেশি গ্রেপ্তার
  • গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে ‘জনগণ’ কীভাবে কথা বলবে
  • নেই অফিস, নিবন্ধনের আড়ালে লোক দেখানো রাজনীতি!
  • তরুণদের নিয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে: ড. কামাল হোসেন
  • এখন ‘মব জাস্টিস’ নামে এক হিংস্র উন্মাদনা মানবতার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে: তারেক রহমান
  • মানবতার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মব জাস্টিস’: তারেক রহমান
  • ‘মব জাস্টিস’ এক হিংস্র উন্মাদনা: তারেক রহমান