বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রাম হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের দিন সংঘর্ষ, থানায় হামলা, পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসীর মৃত্যুর পর সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর ‘পুলিশ হত্যা’র দাবি নিয়ে দর–কষাকষির এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। ওই দিন বিক্ষুব্ধ লোকজন বানিয়াচং থানায় আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্র লুট ও অগ্নিসংযোগ করে এবং অর্ধশতাধিক পুলিশকে অবরুদ্ধ করা হয়।

এর আগে সেখানে পুলিশের গুলিতে অন্তত আট গ্রামবাসী নিহত হয়। পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর হাজার হাজার গ্রামবাসী থানা ঘেরাও করে সেখানে থাকা সব পুলিশকে হত্যার হুমকি দেয়।

দিনভর আলাপ–আলোচনার পর গভীর রাতে পুলিশের সদস্যদের থানার ভেতর থেকে উদ্ধারের সময় উপপরিদর্শক (এসআই) সন্তোষ চৌধুরীকে বাছাই করে ছিনিয়ে নিয়ে থানা চত্বরেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন ৬ আগস্ট তাঁর মরদেহ থানার সামনে একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

বানিয়াচংয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা শেষ পর্যন্ত সন্তোষ চৌধুরীকে জনতার হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে অনঢ় অবস্থানে ছিল বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মানুষেরা।

সেনাবাহিনীর সঙ্গে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), জেলা প্রশাসক (ডিসি); এমনকি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা একযোগে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সন্তোষ চৌধুরীকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি।

ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে তারা সব পুলিশকে চাইতেছিল মারার জন্য, কিন্তু সেনাবাহিনী দেয় নাই। একপর্যায়ে তারা বলছিল যে “সন্তোষকে না দিলে আমরা রাস্তা ছাড়ব না। আপনারা একজনকেও নিয়ে যেতে পারবেন না।”’

ওই দিন থানায় অবরুদ্ধ পুলিশের অর্ধশতাধিক সদস্যকে উদ্ধার করে নিরাপদে হবিগঞ্জে সরিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। বানিয়াচং থানা থেকে সেদিন সেনাসহায়তায় উদ্ধার হওয়া একজন পুলিশ কর্মকর্তা মো.

আবু হানিফ বলেন, তাঁরা যে বেঁচে ফিরবেন, সেটা ভাবতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে যে “একটা লোককে কেমনে আমরা দিই।” পরে আর উপায় না পাইয়া আটকাতে পারে নাই। আমরা ভাবছিলাম, তারে থানার ভেতরে রাইখা আমাদের উঠায়া তারপর সেনাবাহিনী একটা কিছু করবে। সেনাবাহিনী হয়তো তাকে এসকোর্ট করে নেবে, কিন্তু দেখা গেছে যে সে (সন্তোষ) যখন থানার ভেতর থেকে বের হয়ে লাইনে দাঁড়াইছে, তখনই পাবলিক তাকে থাবা মেরে নিয়ে গেছে।’

এ ঘটনার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এসআই সন্তোষকে কেন টার্গেট করা হলো, তার পেছনে দুটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, ৫ আগস্ট গুলি করা এবং এলাকায় পুলিশ হিসেবে তাঁর অতীত ভূমিকা। উদ্ধার হওয়া পুলিশ কর্মকতা জানান, ওই দিন গুলি চালিয়ে একাধিক মানুষ হত্যার দায়ে সন্তোষ চৌধুরীকে অভিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া অতীতের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও একটি অংশ তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল বলে জানান এলাকার লোকজন।

বানিয়াচংয়ের স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী বলেন, তাঁর (এসআই সন্তোষ) ওপর কিছু মানুষের ক্ষোভ ছিল। ‘সে অনেক মানুষরে জ্বালাইছে। যারা আওয়ামী লীগ ভিন্ন আছিল, তাদের ধরছে, টেকা–পয়সা আদায় করছে। তার প্রতি ক্ষোভ ছিল।’

থানার কাছে গ্রামের একজন বাসিন্দা অবশ্য ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তোষকে টার্গেট করার বিষয়টি সামনে আনেন। তাঁর ভাষায়, ‘থানা থেকে সে (এসআই সন্তোষ) মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাইত। মাদক ব্যবসায়ী যারা আছে, তাদের সে গ্রেপ্তার করত। আইনের আওতায় আনত। কোর্টে দিত। একজন যদি ব্যবসার মধ্যে ক্ষতি করে, তারে চাইব জড়ানোর লাগি। যারা মাদকের ব্যবসা করে, তারাই উঠাল “সন্তোষ চাই, সন্তোষ চাই।”’

সন্তোষ কেন গুলি করতে গেলেন, এ প্রশ্নের জবাবে থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) আবু হানিফ বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে সন্তোষ ভেবেছিল, গুলি করলে ওরা চলে যাবে। হাজার হাজার মানুষ থানা ঘেরাও করে ইটপাটকেল মারতেছিল, থানা পোড়ায় দিছিল। যে দোতলা বিল্ডিং, তার প্রত্যেকটা রুম আগুন দিয়ে পোড়ায় দিছিল। নিচতলায় আগুন, ওপর তলায় একটা রুমে আমরা বন্দী ৬০–৬৫ জন। নিচে অস্ত্রাগার পুড়তেছিল আর ধোঁয়া আমাদের চোখে–মুখে লাগতেছিল। হয়তো আর ১০–১৫ মিনিট থাকলে আমরা শ্বাসকষ্টে মারা যাইতাম। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের মতো ঘটনা ঘটত আরকি।’

৫ আগস্ট সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের উপস্থিতির পরও সন্তোষকে কেন রক্ষা করা গেল না, সে রকম জিজ্ঞাসা আছে তাঁর পরিবারের। তাঁর বাবা বলেন, ‘সেনাবাহিনী উদ্ধার করতে গেছে, আমরা শুনেছি; তো যাওয়ার পর অন্যরা সবাই আসছে, ও একাই রয়ে গেছিল। প্রশ্ন জাগে, কিন্তু সদুত্তর পাই না।’

সন্তোষ চৌধুরী পরিবারের একমাত্র ছেলে। মৃত্যুর ১০ মাস আগে তিনি বিয়ে করেন। মৃত্যুর তিন মাস পর তাঁর একটি সন্তান হয়েছে। সন্তোষের মা বলেন, ‘আমার ছেলে তো চাকরিতে গেছিল। চাকরি করছিল। এটা তো আমার মা হইয়া অনবরত প্রশ্ন জাগে যে সব বাঁচল, আমার ছেলে কেনে বাঁচল না। কেনে আসল না?’

বানিয়াচং থানায় হামলা এবং পুলিশ হত্যায় গত বছরের ২২ আগস্ট পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে। সে মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বানিয়াচং থানার পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, মামলা তদন্তের অগ্রগতি সামান্য, কোনো গ্রেপ্তারও নেই।

এ রকম ঘটনা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘ও মাই গড! এটা তো হতে পারে না। এটা হতে পারে না। হয়তোবা পুলিশটা দোষী। হয়তোবা ওই পুলিশ অনেক বাড়াবাড়ি করেছে। বিচার করেন। বিচার করে তাকে শাস্তি দেন। দিয়ে জেলে রাখেন, এটাই তার শাস্তি। আপনি যদি তাকে মেরে ফেলেন, আপনি তো একটা এনার্কিকে উৎসাহিত করলেন।’

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশ পুলিশের কমপক্ষে ৪৪ জন সদস্য নিহত হন বলে সরকারি সূত্রে জানানো হয়। পুলিশের এই সদস্যদের অনেকেই সহিংস হত্যার শিকার হন। বিভিন্ন স্থানে, এমনকি থানার মধ্যে আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন পুলিশের সদস্যরা। জুলাই-আগস্টে পুলিশের বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পুলিশের ওপর মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ কাজ করেছিল। কিন্তু তার জন্য এভাবে হত্যা কাম্য নয় বলে মনে করেন আইনবিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবীরা।

মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী এলিনা খান বলেন, ‘আমার মনে হয়, এই বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। যাঁরা সম্পৃক্ত, তাঁদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। একটা হত্যা, যেটাই হোক না কেন, সবকিছুরই কিন্তু একটা ডায়েরি থাকা উচিত এবং সেটা লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত। সেটা থেকে কী ঘটনা ঘটেছিল, তার তদন্ত হোক, চার্জশিট হোক অথবা ফাইনাল রিপোর্ট হোক; যেটাই হোক না কেন, সেটাও কিন্তু থাকা উচিত। কারণ, এটা তো ইতিহাস, এই ইতিহাস অনেক বছর যাবে।’

থানায় হামলা চালিয়ে পুলিশের সদস্য মেরে ফেলার ঘটনায় মামলার অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া ২০২৪ সালের অক্টোবরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় একপ্রকার দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলেও সমালোচনা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাফিজুর রহমান বিবৃতির খবর দেখিয়ে বলেন, ‘মামলা করতে পারবেন না, গ্রেপ্তার করা যাবে না, হয়রানি তো প্রশ্নই ওঠে না। এইটাই তো দায়মুক্তি। ১৫ জুলাই থেকে শুরু করে ৮ আগস্ট পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেটা কি আপনার আইনের লঙ্ঘন, সেটা কি আপনার এমন কোনো ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে পড়ে যে আপনি সেটাকে দায়মুক্তি দিলেন? সুতরাং অনেকগুলো প্রশ্নের কিন্তু আমরা কোনো উত্তর পাই না।’ এ ধরনের দায়মুক্তি টিকবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধ করে থাকে, সে ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেওয়া যায় না। এগুলো টিকবে না।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ র মব স সদস য তদন ত ব যবস আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

পাঁচ দ্বীপে বাড়ি কিনলেই পাবেন পাসপোর্ট, দেড় শতাধিক দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশ সুবিধা

ছবি: Antigua and Barbuda

ক্যাপশন:

বডিতে যাবে ছবি: Grenada

ক্যাপশন: গ্রেনাডার সৈকত। ফাইল ছবি: এএফপি

ছবি বডিতে যাবে: St. Kitts

ক্যাপশন: যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক তাঁর সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের পাসপোর্ট দেখাচ্ছেন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

পূর্ব ক্যারিবীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশ এখন শুধু মনোমুগ্ধকর সৈকত আর নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দিয়ে সেসব দেশে বাড়ি বা সম্পদ কেনার জন্য ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে না; বরং ওই সব দেশে বাড়ি কিনলে বা বিনিয়োগ করলেই আপনি পেয়ে যাবেন পাসপোর্টও।

ওই অঞ্চলের পাঁচ দেশ অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, ডোমিনিকা, গ্রেনাডা, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস ও সেন্ট লুসিয়া এমন প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে সিটিজেনশিপ বাই ইনভেস্টমেন্ট (সিবিআই)।

সিবিআইয়ের অধীন কমপক্ষে দুই লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে একটি বাড়ি কিনলেই আপনি পেয়ে যাবেন এ পাসপোর্ট। এতে ইউরোপের শেনজেন অঞ্চল, যুক্তরাজ্যসহ ১৫০টির বেশি দেশে পাবেন ভিসামুক্ত প্রবেশের সুবিধা।

ধনীদের জন্য এসব দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে রয়েছে করছাড়–সংক্রান্ত আরও বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা, যেমন মূলধনি মুনাফা পাওয়া এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের ওপর থেকে কর অব্যাহতি। কয়েকটি ক্ষেত্রে আয়করেও রয়েছে ছাড়। এ পাঁচ দেশেই সিবিআই প্রকল্পের বিনিয়োগকারীরা দেশগুলোর নাগরিকত্ব পাবেন।

ধনীদের জন্য এসব দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে রয়েছে করছাড়–সংক্রান্ত আরও বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা, যেমন মূলধনি মুনাফা পাওয়া এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের ওপর কর অব্যাহতি। কিছু ক্ষেত্রে আছে আয়করেও ছাড়।

প্রকল্পে দারুণ সাড়া পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন অ্যান্টিগুয়ার লাক্সারি লোকেশনসের মালিক নাদিয়া ডাইসন। তিনি বলেন, ‘অ্যান্টিগুয়ায় সম্পত্তি বিক্রেতারা চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ মুহূর্তে ক্রেতাদের প্রায় ৭০ শতাংশই নাগরিকত্ব চাইছেন। আর তাঁদের বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা।’

প্রকল্পে সাড়া পাওয়ার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে নাদিয়া আরও বলেন, ‘(যুক্তরাষ্ট্রের) অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে একটি বড় কারণ, তা স্পষ্ট। গত বছর এ সময়ে শুধু ভালো আবহাওয়া ও অবকাশ কাটানোর সুবিধা বিবেচনায় বাড়ি কিনতে চাওয়া কিছু ক্রেতা ছিলেন। সঙ্গে অল্প কয়েকজন ছিলেন সিবিআই প্রকল্পের ক্রেতা। এখন সবাই বলছে, ‘‘আমি নাগরিকত্বসহ একটি বাড়ি চাই।’’ আমরা আগে কখনো এত বাড়ি বিক্রি করিনি।’

অ্যান্টিগুয়া এ কর্মসূচিতে বসবাস করার বিষয়ে কোনো শর্ত রাখেনি। তা সত্ত্বেও কয়েকজন ক্রেতা সারা বছর সেখানে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলে জানান নাদিয়া। তিনি বলেন, কয়েকজন ক্রেতা ইতিমধ্যে সেখানে স্থানান্তরিত হয়েছেন।

গত এক বছরে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সিবিআই কর্মসূচির আবেদনকারীদের সবচেয়ে বড় অংশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এমনটাই জানিয়েছে বিনিয়োগভিত্তিক অভিবাসনসংক্রান্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স। ইউক্রেন, তুরস্ক, নাইজেরিয়া ও চীনের নাগরিকেরাও উল্লেখযোগ্য হারে এ প্রকল্পে আবেদন করছেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠানটি আরও বলেছে, ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিক থেকে ক্যারিবীয় অঞ্চলের সিটিজেনশিপ বাই ইনভেস্টমেন্ট কর্মসূচিতে মোট আবেদনপত্রের সংখ্যা ১২ শতাংশ বেড়েছে।

অ্যান্টিগুয়ায় সম্পত্তি বিক্রেতারা চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ মুহূর্তে ক্রেতাদের প্রায় ৭০ শতাংশই নাগরিকত্ব চাইছেন আর তাঁদের বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা।-নাদিয়া ডাইসন, অ্যান্টিগুয়ার লাক্সারি লোকেশনসের মালিক।

হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের পরামর্শক ডমিনিক ভোলেক বলেন, বন্দুক সহিংসতা থেকে শুরু করে ইহুদিবিদ্বেষ—সবকিছুই মার্কিনদের চরম উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

ভোলেক আরও বলেন, (সিবিআই গ্রহণকারীদের) প্রায় ১০ থাকে ১৫ শতাংশ স্থানান্তরিত হন। অধিকাংশের কাছে এটি তাঁদের উদ্বেগ থেকে বাঁচার একটি বিমার মতো। দ্বিতীয় নাগরিকত্ব থাকা মানে একটা ভালো বিকল্প হাতে থাকা…।

ক্যারিবীয় পাসপোর্টের মাধ্যমে সহজ ভ্রমণের সুবিধাও ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করছে বলে মনে করেন ভোলেক। তিনি বলেন, অনেক মার্কিন ক্রেতা রাজনৈতিকভাবে অধিকতর নিরপেক্ষ পাসপোর্টে ভ্রমণ করতে বেশি পছন্দ করেন।

কোভিড মহামারির আগপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তালিকাতে ছিল না বলে জানান ভোলেক। সে সময়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে অবাধে ভ্রমণে অভ্যস্ত ধনীদের জন্য চলাচলে ওই বিধিনিষেধ ছিল এক ‘বড় ধাক্কা’। আর এটাই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে সিবিআই কর্মসূচিতে আগ্রহ বাড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০২০ ও ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনের পর সেই আগ্রহ আবারও ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।

২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিক থেকে ক্যারিবীয় অঞ্চলের সিটিজেনশিপ বাই ইনভেস্টমেন্ট কর্মসূচিতে মোট আবেদনপত্রের সংখ্যা ১২ শতাংশ বেড়েছে।

ভোলেক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে দুই বছর আগেও তাঁদের কোনো কার্যালয় ছিল না। অথচ গত দুই বছরে দেশটির বড় বড় শহরে তাঁরা আটটি কার্যালয় খুলেছেন। কয়েক মাসের মধ্যে আরও দুই থেকে তিনটি কার্যালয় চালু হতে যাচ্ছে।

কানাডার হ্যালিফ্যাক্সের রবার্ট টেইলর অ্যান্টিগুয়ায় একটি সম্পত্তি কিনেছেন। অবসর কাটাতে এ বছরের শেষ দিকে তিনি সেখানে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।

গত বছরের গ্রীষ্মে আবাসনে ন্যূনতম বিনিয়োগের শর্ত তিন লাখ ডলার করার ঠিক আগে দিয়ে টেইলর এ খাতে দুই লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। নাগরিকত্ব পাওয়া গেলে আরও বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়।

বন্দুক সহিংসতা থেকে শুরু করে ইহুদিবিদ্বেষ—সবকিছুই মার্কিনদের চরম উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।ডমিনিক ভোলেক, হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের পরামর্শক

বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টেইলর বলেন, নাগরিক হলে অবস্থান করার সময়সীমার বিধি এড়িয়ে যাওয়া যায়। এর ওপর ব্যবসায়িক সুযোগগুলো কাজে লাগানোর স্বাধীনতাও থাকে। তিনি বলেন, ‘আমি অ্যান্টিগুয়া বেছে নিয়েছি, কারণ, এখানে চমৎকার জলরাশি আছে, মানুষ খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আমার বাকি জীবন কাটানোর জন্য এখানকার আবহাওয়া দারুণ উপযোগী।’

তবে এসব কর্মসূচি একেবারে বিতর্কহীন নয়। ২০১২ সালে তৎকালীন অ্যান্টিগুয়া সরকার দেশের অর্থনীতি সচল রাখার উপায় হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে পাসপোর্ট বিক্রির ধারণা উত্থাপন করলে কেউ কেউ এর নৈতিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।

সিবিআই কর্মসূচি নেই, ক্যারিবীয় অঞ্চলের এমন কয়েকটি দেশের নেতারাও এর সমালোচনা করেছেন। তাঁদের একজন সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডাইনসের প্রধানমন্ত্রী রালফ গনসালভেস। তিনি বলেন, ‘নাগরিকত্ব বিক্রির পণ্য হওয়া উচিত নয়।’

এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের আশঙ্কা, অপরাধীরা এসব শিথিল শর্তের সুযোগ নিতে পারেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্যারিবীয় অঞ্চলের যেসব দেশ সিবিআই কর্মসূচি চালু করেছে, তাদের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র এসব কর্মসূচি কর ফাঁকি ও আর্থিক অপরাধের জন্য ব্যবহার হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

ইউরোপীয় কমিশনের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, তাঁরা ক্যারিবীয় অঞ্চলের ওই পাঁচ দেশের সিবিআই কর্মসূচি ‘পর্যবেক্ষণ’ করছেন এবং ২০২২ সাল থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ক্যারিবীয় অঞ্চলের যেসব দেশ সিবিআই কর্মসূচি চালু করেছে, তাদের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র এসব কর্মসূচি কর ফাঁকি ও আর্থিক অপরাধের জন্য ব্যবহার হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

মুখপাত্র আরও বলেন, এ মূল্যায়নের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে, ওই কর্মসূচির অধীন নাগরিকত্ব দেওয়ার বিনিময়ে যেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার ব্যবস্থার অপব্যবহার না হয়। সেই সঙ্গে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে কি না, তা-ও যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

এ নিয়ে ডোমিনিকার প্রধানমন্ত্রী রুজভেল্ট স্কেরিট তাঁর দেশের সিটিজেনশিপ বাই ইনভেস্টমেন্ট কর্মসূচিকে ‘নির্ভরযোগ্য ও স্বচ্ছ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এর গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ কঠোর পরিশ্রম করেছে।

সেন্ট লুসিয়ায় প্রধানমন্ত্রী ফিলিপ জে পিয়েরে বলেন, তাঁদের দ্বীপপুঞ্জের এ কর্মসূচি যেন কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডের সহায়ক না হয়, তা নিশ্চিত করতে তাঁরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা মানদণ্ড মেনে চলেন।

অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার প্রধানমন্ত্রী গ্যাস্টন ব্রাউন বলেন, গত এক দশকে এ কর্মসূচি থেকে অর্জিত অর্থ তাঁর দেশকে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে এনেছে।

সম্পত্তি কেনা ছাড়াও বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্যারিবীয় দেশগুলোতে নাগরিকত্ব পাওয়ার অন্যান্য সাধারণ উপায়ের মধ্যে রয়েছে জাতীয় উন্নয়ন তহবিল বা অনুরূপ কোনো খাতে এককালীন অর্থ প্রদান।

ডোমিনিকায় একজন একক আবেদনকারীর জন্য এ অর্থের পরিমাণ শুরু হয় দুই লাখ ডলার থেকে। আর ডোমিনিকা ও সেন্ট কিটসে মূল আবেদনকারী এবং তাঁর সঙ্গে সর্বোচ্চ তিনজন নির্ভরশীল সদস্যের জন্য এটি বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত।

ডোমিনিকায় একজন একক আবেদনকারীর জন্য এ অর্থের পরিমাণ শুরু হয় দুই লাখ ডলার থেকে। আর ডোমিনিকা ও সেন্ট কিটসে মূল আবেদনকারী এবং তাঁর সঙ্গে সর্বোচ্চ তিনজন নির্ভরশীল সদস্যের জন্য এটি বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত।

অন্যদিকে, অ্যান্টিগুয়ায় বিনিয়োগকারীরা চাইলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৬০ হাজার ডলার অনুদান দেওয়ার বিকল্প সুযোগও পান।

আন্তর্জাতিক চাপে ওই দ্বীপপুঞ্জগুলো নজরদারি শক্ত করার জন্য নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে মান নির্ধারণ, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং নিয়মনীতি মেনে চলা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন।

বর্তমানে পাসপোর্ট বিক্রি দ্বীপপুঞ্জগুলোর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অবদান রাখে।

সেন্ট কিটসের সাংবাদিক আন্দ্রে হুই বলেন, তাঁর দেশের সিবিআই কর্মসূচি ব্যাপক জনসমর্থিত। লোকজন অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব বোঝেন এবং তাঁরা সরকার যে কাজগুলো এ অর্থ দিয়ে সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছেন, তা কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করেছেন।

আরও পড়ুনদেশে দেশে এখন নাগরিকত্ব বিক্রির জমাটি ব্যবসা২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • স্কিন ব্যাংকে পর্যাপ্ত ত্বক থাকলে ৪০ শতাংশের বেশি দগ্ধ রোগীকেও বাঁচানো যায়
  • রাগ নিয়ন্ত্রণে হাদিসের ৭ উপদেশ
  • চুলে গুঁজে দিলেন ৭১১ গলফ ‘টি’
  • বাবা হারালেন চিত্রনায়িকা মিষ্টি জান্নাত
  • ‘নতুন একটি দলের কয়েকজন মহারথী’ বলার পর বক্তব্য বদলালেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে একজনের মৃত্যু
  • ভাসানীরা না থাকলে শেখ মুজিব কখনো তৈরি হতেন না: নাহিদ
  • কাভার্ড ভ্যানের পেছনে ধাক্কা দিয়ে দুমড়েমুচড়ে গেল যাত্রীবাহী বাস
  • নিউ ইয়র্কে নিহত বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা সম্পর্কে যা জানা গেলো
  • পাঁচ দ্বীপে বাড়ি কিনলেই পাবেন পাসপোর্ট, দেড় শতাধিক দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশ সুবিধা