এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘আদিবাসীরা প্রাচীন জ্ঞানের অভিভাবক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক এবং জীববৈচিত্র্যের লালন–পালনকারী, যা সবার ভবিষ্যতের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।’

তিনি আরও বলেছেন, এ বছরের যে মূল সুর, আদিবাসী জনগণ ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ভবিষ্যৎ গঠনে এর ভূমিকা, যাতে একদিকে নানা ঝুঁকির চ্যালেঞ্জ রয়েছে, অন্যদিকে উপকারিতাও রয়েছে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই বিপন্ন ভাষাগুলো পুনরুদ্ধার, ওরাল সংস্কৃতির সংরক্ষণ, প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত ভূমির ম্যাপিং, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রাচীন জ্ঞানকে প্রসারিত করতে পারে। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, নতুন এআই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিস্তারে আদিবাসী এক্সপার্ট ও গবেষকদের সক্রিয় ও যথাযথ অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা। যদি তাদের এ প্রক্রিয়ায় বাইরে রাখা হয়, তাহলে তাদের সংস্কৃতি বিপন্ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে।

আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, এআই প্রযুক্তি তৈরি ও পরিচালনা যেন ইনক্লুসিভ, নৈতিকতাসম্পন্ন ও ন্যায্য হয়। এর অর্থ হলো ডেটা সার্বভৌমত্ব, মেধাস্বত্ব অধিকার ও আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি এআই প্রয়োগে নিশ্চিত করতে হবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আদিবাসীদের মানবাধিকার, ভূমির অধিকার, বন, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় তাদের অবদান, অ্যাডভোকেসিসহ নানা বিষয়ে কাজ করতে পারি।

এবার ভিন্ন রকম পরিবেশে আমরা জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদ্‌যাপন করছি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা আশা করেছিলাম, সব বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসানে দেশ এগিয়ে যাবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। এটি জাতিসংঘও স্বীকার করে। এই কারণে জাতিসংঘ ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ বা ‘লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড’ স্লোগান নিয়ে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০৩০ এজেন্ডা গ্রহণ করেছে, যেখানে ইন্ডিজিনাস পিপলস বা আদিবাসীদের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজল্যুশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করে ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং তা উদ্‌যাপনের জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানায়।

এসব জাতির জীবনধারা, মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতি, সব মিলিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্যরাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করে তোলা এবং তাদের অধিকারের প্রতি সমর্থন বাড়ানোই হলো এই দিবস উদ্‌যাপনের মূল লক্ষ্য। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, আমাদের দেশে এসব কাজ বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারণী সদিচ্ছা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গীকার ও আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে।

বিশ্বের ৯০টি দেশে প্রায় ৪৮ কোটি আদিবাসী মানুষের বাস। তারা সাত হাজার ভাষায় কথা বলে। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার ভিন্ন ভিন্ন জাতি। তারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ ভাগ। অথচ তারা বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৮০ ভাগ সংরক্ষণ করে।

আমাদের দেশেও পার্বত্য চট্টগ্রাম, গারো পাহাড়, উত্তরবঙ্গ, গাজীপুর, মধুপুর বনাঞ্চল, পটুয়াখালী-বরগুনা, খাসিয়া অঞ্চল—সর্বত্র আদিবাসী মানুষ তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি হারিয়েছে। তাদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, এখন আত্মপরিচয়, মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে ৪১টি ভাষার সন্ধান পেয়েছে। তারা বলেছে, সমীক্ষায় পাওয়া ভাষাগুলোর মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন। ভাষাগুলো হলো: খাড়িয়া, কোরা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও পাত্র। তবে আমরা মনে করি, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিপন্ন ভাষার সংখ্যা আরও বেশি হবে। কমপক্ষে ২৫টি ভাষা ঝুঁকিপূর্ণ।

এখন আমরা কী করতে পারি, এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, জাতিসংঘের এজেন্সি, নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডার মিলে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার পথ তৈরি করতে পারে। শুধু আলোচনা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বাজেট বরাদ্দসহ, যাতে অ্যাকশন বা কাজ হয়। জাতিসংঘের অবশ্যই এখানে বিশেষ দায়িত্ব আছে। জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র আছে। এটি বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। এখন মানবাধিকার হাইকমিশনের নতুন অফিস হয়েছে ঢাকায়। তারা কাজ করতে পারে।

আমি দেখলাম, গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে উন্নত দেশে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, কানসাস ইউনিভার্সিটি, এডিনবরা ইউনিভার্সিটিসহ পশ্চিমে অনেক গবেষণা, সেমিনার, লেখালেখি হয়েছে এআই ও ইন্ডিজিনাস পিপলস বিষয়ে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে কাজ হচ্ছে। আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে আসতে পারে।

সব মিলিয়ে এআইয়ের প্রয়োগ নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় প্রযুক্তি বা মেশিন ভুল তথ্য ছড়ায়, যা খুব বিপজ্জনক। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণে আদিবাসী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এআইয়ের পক্ষে আদিবাসী মানুষের আবেগ, অনুভূতি, সংস্কৃতি ও ওয়ার্ল্ডভিউ, ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক, নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা জীবনের আকাঙ্ক্ষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বঞ্চনা ও বিচ্ছিন্নতার বেদনা—এই সব ধারণা করা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও আদিবাসী জনগণ—এই তিন পক্ষের ‘ত্রিপক্ষীয় সংলাপ’ ও শ্রদ্ধাবোধ অতি জরুরি। একটা রিকনসিলিয়েশন দরকার, যেখানে পারস্পরিক সম্মান ও স্বীকৃতি জরুরি। এআই বা মেশিন হয়তো সঠিকভাবে মানুষের হাহাকার ও কষ্ট অনুভব করতে পারবে না, কিন্তু মানুষ তো পারে। আমরা পারি। সেই উন্নত, সভ্য, সহনশীল, মানবিক, সাংস্কৃতিক চরিত্রে উঁচু, সূক্ষ্ম সহানুভূতিশীল ও হৃদয়বান মানুষের কাছে আজকের নিবেদন।

সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউন ভ র স ট ম নব ধ ক র আম দ র গ রহণ ত করত

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশের জন্য পিআর পদ্ধতির নির্বাচন কতটা যৌক্তিক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র সংস্কারবিষয়ক আলাপ যখন শুরু হয়, তখন থেকেই এর সঙ্গে আরও একটি আলাপ আমরা দেখতে পাই, সেটি হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতির প্রচলন।

সাম্প্রতিক সময়ে এ আলাপ কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না; বরং বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই দাবিসহ আরও কিছু দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে আসে।

খুব সহজ করে বললে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ধারণা এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা, যেখানে সংসদে প্রার্থী বা সদস্য তাঁর দলের মোট ভোটের অনুপাতে নির্বাচিত হন।

অনেক সময় ভোটের অনুপাতের বাইরেও প্রথাগত ভোট, যা ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) নামেও পরিচিত এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ধারণার যৌথ সমন্বয়ের মাধ্যমেও নির্বাচন করা হয় কোনো কোনো দেশে। এর মধ্যে জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলস উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশ।

আরও পড়ুনআনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব: দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় প্রয়োগ করা কি সম্ভব০৮ নভেম্বর ২০২৪

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর মধ্য দিয়ে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের যথাযথ প্রতিফলন থাকে, যেখানে ভোটারের প্রতিটি ভোট প্রার্থী বা দল হেরে গেলেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

বর্তমানে এফপিটিপি ব্যবস্থায় সেটি থাকে না। এ কারণেই ছোট দলগুলোর জন্য পিআর পদ্ধতি একটি কার্যকর ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়। তবে এখানে প্রশ্ন হলো, এর বাস্তবায়নের জন্য যে রাষ্ট্রকাঠামো ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রয়োজন, সেই অবকাঠামো কি বাংলাদেশের আছে বা নিকট ভবিষ্যতে কি সেটি আমার অর্জন করতে পারব?

তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে মনে হবে, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কার্যকর একটি পদ্ধতি। অনেক দেশেই এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এখানে আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের মতো একটি দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতায় পিআর পদ্ধতি যথাযথভাবে কাজ করবে কি না, সে বিষয়ে গভীর পর্যালোচনা প্রয়োজন। তা না হলে হুট করে আবেগের বশবর্তী হয়ে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি নামের একটি নতুন ব্যবস্থার প্রচলন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে আসতে পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যেমন দুর্বল নির্বাচন কমিশন এবং বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য একদমই সহায়ক নয়। যেখানে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে হঠাৎ এত স্বল্প সময়ের মধ্যে পিআরের মতো একটি নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংবিধানিক কাঠামো বাংলাদেশের সামনে নেই।

বাংলাদেশের বর্তমান দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যেমন দুর্বল নির্বাচন কমিশন এবং বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য একদমই সহায়ক নয়। যেখানে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে হঠাৎ এত স্বল্প সময়ের মধ্যে পিআরের মতো একটি নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংবিধানিক কাঠামো বাংলাদেশের সামনে নেই।

এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক সংস্কার। আমরা যদি গত এক বছরের অধিক সময়ের রাষ্ট্র পরিচালনার দিকে তাকাই, তাহলে সংস্কার নিয়ে আমাদের খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো ইঙ্গিত মেলে না। আবার রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্য না এলে এ ধরনের একটি ব্যবস্থা আমাদের জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে না। পাশাপাশি এ বিষয়ে দক্ষ জনবল প্রয়োজন, যা স্বল্প সময়ে তৈরি করা করাও অসম্ভব।

আরও পড়ুনসংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফেরার শঙ্কা যেখানে০৭ জুলাই ২০২৫

আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, প্রথাগতভাবে বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ভোট দিয়ে অভ্যস্ত, সেখানে আমরা দেখতে পাই যে তাঁরা তাঁদের পছন্দমতো প্রার্থীদের সরাসরি ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন বা করতে পছন্দ করেন। সেখানে পিআর পদ্ধতিতে একজন ভোটারের সেই স্বাধীনতা থাকে না।

এখানে ব্যক্তির পরিবর্তে দলকে ভোট দিতে হয়, যেখানে দল পরবর্তী সময়ে প্রার্থী নির্বাচন করার প্রক্রিয়ায় থাকে। যদিও কোনো কোনো দেশে একটি মিশ্র পদ্ধতির প্রচলন করে আসছে, যেখানে ব্যক্তি ও দল—উভয়কেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ ধরনের ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রার্থীর সঙ্গে জনগণের যে প্রথাগত যোগাযোগ থাকে, সেটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়ে জনগণ রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে আরও দূরে সরে যেতে পারে।

আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। প্রস্তুতিহীন অবস্থায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার প্রচলন সে প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং ভোটারদের মধ্যে একধরনের আস্থার অভাব গড়ে উঠতে পারে।

আরও পড়ুনসংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা: আরও স্বৈরাচারী হবে দল ও দলপ্রধান০৭ নভেম্বর ২০২৪

বিগত সময়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করার যে অক্ষমতা আমরা বারবার দেখিয়েছি, সে অক্ষমতার কারণে নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে এখনো আস্থার অভাব রয়েছে। আমাদের সবার আগে সে আস্থার জায়গা অর্জন করতে হবে। নির্বাচন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যথাযথ সময় এখন নয়।

এর সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোটারদের মধ্যে পিআর-বিষয়ক সঠিক ধারণার অভাব। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য যেমন একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন এ বিষয়ে জনসাধারণের বোঝাপড়ার ইতিবাচক পরিবর্তন। যার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন, যা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের নেই।

সে কারণেই অনেক গবেষক মনে করেন, একটি দুর্বল সাংবিধানিক কাঠামোতে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি রাজনৈতিক দলগুলোকে যেমন বিভাজিত করবে, তেমনই দেশের জনগণকেও দ্বিধাবিভক্ত করে রাখবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অন্তরায়। এখানে আমাদের প্রধান যুক্তি হতে হবে এই পদ্ধতি কি দেশের জন্য কোনো ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে আসবে?

আরও পড়ুনআনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ১৮ অক্টোবর ২০২৪

বিশ্বজুড়ে দুর্বল সাংবিধানিক কাঠামোযুক্ত দেশগুলোয় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি ভালোভাবে কাজ করছে না। এর প্রচলন ধাপে ধাপে শুরু করতে হবে। এ জন্য একটি লম্বা সময়ের প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে যুক্তিযুক্ত নয়।

গবেষণা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাভিত্তিক নীতির সঙ্গে আমাদের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সম্ভাব্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক কী হতে পরে, সে বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে। বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া কোনো পদ্ধতি আসলে সমাধান নয়। আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও চর্চার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ভবিষ্যতে একটি মিশ্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি।

পাশাপাশি জনপরিসরে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলমান রাখতে হবে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, থিঙ্কট্যাংক, নাগরিক সমাজ, সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলকে আলোচনায় আনা এবং তাদের মধ্যে সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, যা ভবিষ্যতে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের আলোচনাকে একটি জনভিত্তি দেবে।

আরও পড়ুনআনুপাতিক পদ্ধতির ভোট: নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা কী বলছে১৭ অক্টোবর ২০২৪

এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, একটি অস্থায়ী রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ ধরনের মৌলিক পরিবর্তন জনমনে আরও বিভ্রান্তি তৈরি করবে, যা পরবর্তী সময়ে আমাদেরই বয়ে বেড়াতে হবে। তাই এ সিদ্ধান্ত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গবেষণাভিত্তিক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে নিতে হবে, যা একটি নির্বাচিত সরকারের অধীন হওয়া অধিক জরুরি। সেটি হতে হবে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে, যে প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘ সময় ধরে বঞ্চিত। তাই কিছু রাজনৈতিক দলের তুষ্টি লাভের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়, যা একটি প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবস্থা হিসেবে রয়ে যায়।

বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত লেখকের নিজস্ব

[ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এ লেখা ‘পিআর বাংলাদেশের জন্য কতটা যৌক্তিক পদ্ধতি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছয় বিভাগে এগিয়ে বিএনপি, একটিতে জামায়াত
  • জনগণ নির্বাচনমুখী হয়ে গেলে কেউ আটকাতে পারবে না
  • জনগণের নির্বাচন–ভাবনা জরিপ: কোন দলের প্রতি কত সমর্থন
  • পিআর পদ্ধতি নিয়ে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব জাকসু ভিপি জিতুর
  • বাংলাদেশের জন্য পিআর পদ্ধতির নির্বাচন কতটা যৌক্তিক
  • জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহারের নির্দেশ দেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর
  • গালির জবাবে দোয়া হবে আমাদের কর্মসূচি: জামায়াত আমির
  • বিএনপির উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক পরিবেশ অর্জনে সহায়ক
  • সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা
  • রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের জন্য বিশ্বব্যাংকের ৭০ কোটি ডলারের প্রকল্প চালু