যন্ত্র নয়—উন্নত, সহনশীল, মানবিক মানুষের কাছে নিবেদন
Published: 9th, August 2025 GMT
এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘আদিবাসীরা প্রাচীন জ্ঞানের অভিভাবক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক এবং জীববৈচিত্র্যের লালন–পালনকারী, যা সবার ভবিষ্যতের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।’
তিনি আরও বলেছেন, এ বছরের যে মূল সুর, আদিবাসী জনগণ ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ভবিষ্যৎ গঠনে এর ভূমিকা, যাতে একদিকে নানা ঝুঁকির চ্যালেঞ্জ রয়েছে, অন্যদিকে উপকারিতাও রয়েছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই বিপন্ন ভাষাগুলো পুনরুদ্ধার, ওরাল সংস্কৃতির সংরক্ষণ, প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত ভূমির ম্যাপিং, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রাচীন জ্ঞানকে প্রসারিত করতে পারে। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, নতুন এআই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিস্তারে আদিবাসী এক্সপার্ট ও গবেষকদের সক্রিয় ও যথাযথ অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা। যদি তাদের এ প্রক্রিয়ায় বাইরে রাখা হয়, তাহলে তাদের সংস্কৃতি বিপন্ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে।
আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, এআই প্রযুক্তি তৈরি ও পরিচালনা যেন ইনক্লুসিভ, নৈতিকতাসম্পন্ন ও ন্যায্য হয়। এর অর্থ হলো ডেটা সার্বভৌমত্ব, মেধাস্বত্ব অধিকার ও আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি এআই প্রয়োগে নিশ্চিত করতে হবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আদিবাসীদের মানবাধিকার, ভূমির অধিকার, বন, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় তাদের অবদান, অ্যাডভোকেসিসহ নানা বিষয়ে কাজ করতে পারি।
এবার ভিন্ন রকম পরিবেশে আমরা জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদ্যাপন করছি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা আশা করেছিলাম, সব বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসানে দেশ এগিয়ে যাবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। এটি জাতিসংঘও স্বীকার করে। এই কারণে জাতিসংঘ ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ বা ‘লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড’ স্লোগান নিয়ে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০৩০ এজেন্ডা গ্রহণ করেছে, যেখানে ইন্ডিজিনাস পিপলস বা আদিবাসীদের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজল্যুশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করে ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং তা উদ্যাপনের জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানায়।
এসব জাতির জীবনধারা, মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতি, সব মিলিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্যরাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করে তোলা এবং তাদের অধিকারের প্রতি সমর্থন বাড়ানোই হলো এই দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, আমাদের দেশে এসব কাজ বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারণী সদিচ্ছা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গীকার ও আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে।
বিশ্বের ৯০টি দেশে প্রায় ৪৮ কোটি আদিবাসী মানুষের বাস। তারা সাত হাজার ভাষায় কথা বলে। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার ভিন্ন ভিন্ন জাতি। তারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ ভাগ। অথচ তারা বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৮০ ভাগ সংরক্ষণ করে।
আমাদের দেশেও পার্বত্য চট্টগ্রাম, গারো পাহাড়, উত্তরবঙ্গ, গাজীপুর, মধুপুর বনাঞ্চল, পটুয়াখালী-বরগুনা, খাসিয়া অঞ্চল—সর্বত্র আদিবাসী মানুষ তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি হারিয়েছে। তাদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, এখন আত্মপরিচয়, মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে ৪১টি ভাষার সন্ধান পেয়েছে। তারা বলেছে, সমীক্ষায় পাওয়া ভাষাগুলোর মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন। ভাষাগুলো হলো: খাড়িয়া, কোরা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও পাত্র। তবে আমরা মনে করি, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিপন্ন ভাষার সংখ্যা আরও বেশি হবে। কমপক্ষে ২৫টি ভাষা ঝুঁকিপূর্ণ।
এখন আমরা কী করতে পারি, এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, জাতিসংঘের এজেন্সি, নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডার মিলে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার পথ তৈরি করতে পারে। শুধু আলোচনা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বাজেট বরাদ্দসহ, যাতে অ্যাকশন বা কাজ হয়। জাতিসংঘের অবশ্যই এখানে বিশেষ দায়িত্ব আছে। জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র আছে। এটি বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। এখন মানবাধিকার হাইকমিশনের নতুন অফিস হয়েছে ঢাকায়। তারা কাজ করতে পারে।
আমি দেখলাম, গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে উন্নত দেশে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, কানসাস ইউনিভার্সিটি, এডিনবরা ইউনিভার্সিটিসহ পশ্চিমে অনেক গবেষণা, সেমিনার, লেখালেখি হয়েছে এআই ও ইন্ডিজিনাস পিপলস বিষয়ে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে কাজ হচ্ছে। আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে আসতে পারে।
সব মিলিয়ে এআইয়ের প্রয়োগ নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় প্রযুক্তি বা মেশিন ভুল তথ্য ছড়ায়, যা খুব বিপজ্জনক। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণে আদিবাসী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এআইয়ের পক্ষে আদিবাসী মানুষের আবেগ, অনুভূতি, সংস্কৃতি ও ওয়ার্ল্ডভিউ, ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক, নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা জীবনের আকাঙ্ক্ষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বঞ্চনা ও বিচ্ছিন্নতার বেদনা—এই সব ধারণা করা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও আদিবাসী জনগণ—এই তিন পক্ষের ‘ত্রিপক্ষীয় সংলাপ’ ও শ্রদ্ধাবোধ অতি জরুরি। একটা রিকনসিলিয়েশন দরকার, যেখানে পারস্পরিক সম্মান ও স্বীকৃতি জরুরি। এআই বা মেশিন হয়তো সঠিকভাবে মানুষের হাহাকার ও কষ্ট অনুভব করতে পারবে না, কিন্তু মানুষ তো পারে। আমরা পারি। সেই উন্নত, সভ্য, সহনশীল, মানবিক, সাংস্কৃতিক চরিত্রে উঁচু, সূক্ষ্ম সহানুভূতিশীল ও হৃদয়বান মানুষের কাছে আজকের নিবেদন।
সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউন ভ র স ট ম নব ধ ক র আম দ র গ রহণ ত করত
এছাড়াও পড়ুন:
ডিসি জাহিদুল ইসলাম পেলেন 'শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক' সম্মাননা স্মারক
কর্ম দক্ষতা, জনকল্যাণমুখী ও মানবিক কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ রিপোর্টার্স ক্লাব ট্রাস্ট কর্তৃক 'শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক' সম্মাননা পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা। বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তার হাতে এই সম্মাননা স্মারক ও সনদপত্র তুলে দেওয়া হয়।
সংগঠনের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান সোহেল ও যুগ্ম মহাসচিব এসএম জহিরুল ইসলাম বিদ্যুৎ এই সম্মাননা হস্তান্তর করেন। বাংলাদেশ রিপোর্টার্স ক্লাব ট্রাস্ট জানায়, 'শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক' সম্মানটি দেওয়া হয়েছে তার জনসেবা, উন্নয়নমূলক কাজ এবং কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে। এই সম্মাননার মাধ্যমে অন্যদেরও জনকল্যাণমুখী কাজে উৎসাহিত করা হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।
ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, একটি জেলার উন্নয়নে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জেলার সার্বিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। জনগণের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজ করা এবং সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। তাই কর্ম দক্ষতা ও জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকার জন্য তাকে এই গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।