সমতা ও সহনশীলতা: মুসলিম সভ্যতার দুটি অনন্য বৈশিষ্ট্য
Published: 7th, November 2025 GMT
ইসলামের আলোয় গড়া সভ্যতা যেন একটা ফুলের বাগান—যেখানে বিভিন্ন রঙের ফুল মিলে সৌন্দর্য ছড়ায়। এই সভ্যতার হৃদয়ে ছিল সহনশীলতা আর সমতা নামে দুটি মূল্যবান রত্ন, যা মানুষকে সে-সময় মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসতে ভূমিকা রেখেছে।
এই দুই নীতির কারণে ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে এই ধর্ম। কারণ ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম, যুক্তির সঙ্গে মিলে এই ধর্ম মানুষের আত্মা ও শরীরের চাহিদা পূরণ করে। এটি সর্বজনীন, মধ্যপন্থা, ভারসাম্যপূর্ণ—কোনো জাতি বা অঞ্চলের নয়, বরং সমগ্র মানবতার।
দেখুন, কোরআনের শুরু হয় প্রথম আয়াত “সকল স্তুতি আল্লাহর, যিনি সকল সৃষ্টির প্রতিপালক” (সুরা ফাতিহা, আয়াত: ২) দিয়ে, আর শেষ হয় মানুষের কথা বা বলা যায় মানুষ নামের সুরা ‘সুরা নাস’ দিয়ে।
এই নিবন্ধে আমরা দুটি মূল নীতির কথা বলব: অন্যদের প্রতি সহনশীলতা এবং মুসলিমদের মধ্যে সমতা—যা মুসলিম সভ্যতাকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।
১.সহনশীলতা: মানবতার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ
মুসলিম সভ্যতার সৌন্দর্যের একটা বড় অংশ হলো সহনশীলতা। এটি কোনো ধর্মের প্রতি সংকীর্ণতা দেখায় না, বরং সবাইকে আলিঙ্গন করে। কোরআন বলে, “যারা কথা শোনে এবং সবচেয়ে ভালোটি অনুসরণ করে, তাদের সুসংবাদ দাও।” (সুরা যুমার, আয়াত: ১৭-১৮
ইসলাম ন্যায় ও দয়ার ঐতিহ্য গড়েছে।পশ্চিমা ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডুরান্টএই সহনশীলতার কয়েকটা সুন্দর নিয়ম:
সব আসমানি ধর্ম একই উৎস থেকে: “তোমাদের জন্য ধর্মের যা নির্ধারিত করা হয়েছে, তা নুহকে যা বলা হয়েছিল... ইবরাহিম, মুসা ও ইসাকে যা বলা হয়েছিল।” (সুরা শুরা, আয়াত: ১৩)
সকল নবী ভাই ভাই, তাদের মধ্যে ভেদাভেদ নেই: “বল, আমরা আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছি... ইবরাহিম, ইসমাইল... মুসা, ইসা ও অন্য নবীদের প্রতি” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৩৬)
ধর্ম গ্রহণে জোর খাটানো যাবে না: “ধর্মে কোনো জোরজবরদস্তি নেই।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৫৬); “তুমি কি মানুষকে জোর করে মুমিন বানাবে?” (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৯৯)
সুন্দরভাবে তর্ক করা: “কিতাবিদের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো উপায়ে তর্ক করো।” (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৪৬); তাদের দেবতাকে গালি দেওয়া নিষেধ। (সুরা আনআম, আয়াত: ১০৮)
আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ: “তাদের সঙ্গে লড়াই করো যাতে ফিতনা না থাকে এবং ধর্ম শুধু আল্লাহর হয়।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৩)
জয়ের পর প্রতিশোধ নয়, শুধু রাষ্ট্রের আনুগত্য চাওয়া হবে। যেমনটি মহানবী (সা.)-এর মক্কা বিজয়ের সময় দেখা গেছে।
আরও পড়ুনমুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ থাকে১৬ অক্টোবর ২০২৫এই রীতিগুলো মুসলিমকে শেখায় সকল নবীকে সম্মান করতে, অন্যদের ধর্মীয় স্থান রক্ষা করতে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের অধিকার সমান রাখা। এভাবে মুসলিম সভ্যতা প্রথমবার দেখিয়েছে, একটা ধর্ম অন্য ধর্মকে দমন না করে সহাবস্থান করতে পারে।
রাসুল (সা.)-এর জীবন থেকে উদাহরণ
মদিনায় হিজরতের পর ইহুদিদের সঙ্গে চুক্তি করেন, তাদের ধর্ম রক্ষা করেন (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩১৬০)
ইহুদি প্রতিবেশীকে উপহার দিতেন, তাদের উপহার গ্রহণ করতেন। এক ইহুদি নারী বিষ মিশিয়ে খাবার দিয়েছিলেন, তবু তিনি ধৈর্য ধরেন।
নাজরানের খ্রিষ্টানদের তিনি মসজিদে থাকতে দেন, তাদের নামাজ পড়তে দেন। মিসরের শাসকের উপহার গ্রহণ করেন, তার দাসী মারিয়াকে বিয়ে করেন, যাঁর থেকে নবীজির সন্তান ইবরাহিম (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৫৮১)
জেরুসালেম জয়ের পর ওমর (রা.) ইহুদিদের শর্ত মেনে নেন, গির্জায় নামাজ পড়তে অস্বীকার করেন যাতে পরে মুসলিমরা তা মসজিদ না বানায়।সাহাবীদের উদাহরণ
ওমর (রা.) জেরুসালেম জয়ের পর ইহুদিদের শর্ত মেনে নেন, গির্জায় নামাজ পড়তে অস্বীকার করেন যাতে পরে মুসলিমরা তা মসজিদ না বানায়। এক খ্রিষ্টান নারীর বাড়ি মসজিদে অন্তর্ভুক্ত হলে ওমর (রা.) তা ফিরিয়ে দেন। (তারিখ আত-তাবারি, ৩/৬০৯, দার আল-কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৮৭)
পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা এই সহনশীলতার প্রশংসা করেছেন। উইলিয়াম ডুরান্ট বলেন, ইসলাম ন্যায় ও দয়ার ঐতিহ্য গড়েছে। (উইলিয়াম ডুরান্ট, দ্য স্টোরি অব সিভিলাইজেশন, ৪/৩০-২৪০, সাইমন অ্যান্ড শুস্টার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৫০)। থমাস আর্নল্ড বলেন, মুসলিমরা খ্রিষ্টানদের ন্যায় বিচার করেছে। (থমাস আর্নল্ড, দ্য প্রিচিং অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ৮০, লন্ডন, ১৯১৩)। গুস্তাভ লে বন বলেন, আরবরা সবচেয়ে দয়ালু বিজয়ী (গুস্তাভ লে বন, দ্য সিভিলাইজেশন অব দি অ্যারাবস, পৃষ্ঠা ১২৫, প্যারিস, ১৮৮৪)
আরও পড়ুনউমাইয়া যুগে আরব কারিগরদের স্থাপত্যের মহিমা২৭ আগস্ট ২০২৫২. সমতা: সকলে একই পরিবারের সদস্যমুসলিম সভ্যতার আরেক সৌন্দর্য সমতা—রঙ, জাতি নির্বিশেষে সবাই সমান। কোরআন বলে, “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে, যে সবচেয়ে খোদাভীরু।” (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)। বিদায় হজে রাসুল (সা.) বলেন, “তোমাদের প্রতিপালক এক, পিতা এক... খোদাভীতি চাড়া অনারবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই আরবের।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৩৫৩৬)
এই সমতা কেবল কথায় নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। মসজিদে সাদা-কালো পাশাপাশি দাঁড়ায়। হজে সবাই একই পোশাক। মক্কা জয়ের পর বিলাল (রা.)-কে কাবায় আজান দেওয়ার নির্দেশ দেন—যা জাহেলি সমাজে অকল্পনীয়। আবু জর (রা.) বিলালকে “কালো মায়ের ছেলে” বললে রাসুল (সা.) তাকে তিরস্কার করেন এই বলে যে, “তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত আছে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩০)।
মুসলিম যুগের উদাহরণ
মিসর জয়ের সময় কৃষাঙ্গ উবাদা বিন সামিত (রা.) ছিলেন দলের নেতা। সম্রাট মুকাওকিস ভয় পেলে সাহাবীরা বলেন, “সে আমাদের সেরা, আমরা তার কথা মানি।” (তারিখ আত-তাবারি, ৩/১০০, দার আল-কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৮৭)। আতা বিন আবি রাবাহ (রা.) ছিলেন কালো, অন্ধ, খোঁড়া। কিন্তু তথাপি তিনি মক্কার ইমাম হন, হজে ফতোয়া দিতেন। নুসাইব ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ কবি, খলিফাদের সঙ্গী। যাইলাই ছিলেন হাবশি, তবে ফিকহের বড় আলেম।
আবু জর (রা.) বিলালকে “কালো মায়ের ছেলে” বললে রাসুল (সা.) তাকে তিরস্কার করেন এই বলে যে, “তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত আছে।”আমরা সবাই এক বাবা-মা থেকে এসেছি। আল্লাহ বলেছেন, “হে মানুষ, তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদের এক আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা নিসা, আয়াত: ১)
জাতি-উপজাতি শুধু পরিচয়ের জন্য, যেমন কোরআন বলেছে, “যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো।” (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
মানুষের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সমান। আল্লাহ বলেছেন, “আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।” (সুরা ইসরা, আয়াত: ৭০)
আইনের সামনে সবাই সমান। দণ্ডের বেলায় “স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, দাসের বদলে দাস।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৭৮)
উদাহরণ হিসেবে মক্কা বিজয়ের পর একটি চুরির শাস্তির কথা বলা যায়। রাসুল (সা.) বলেন, শাস্তি সবার জন্য এক, ফাতিমা (রা.) চুরি করলেও হাত কাটা হতো (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৭৮৮)
আদি বিন হাতিম এক দরিদ্র নারীর সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর দাঁড়িয়ে কথা বলা দেখে বলেন, “এ তো রাজা নয়”। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১)
এই সহনশীলতা ও সমতা ইসলামকে ছড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বে। অনারবরাও পৃথিবীখ্যাত আলেম হয়েছে, সিবওয়াইহের মতো অনারব হয়েছেন বিশ্বসেরা আরবি ব্যাকরণবিদ।
আরও পড়ুনকোরআন যেভাবে মানুষের চেতনা পাল্টে দিয়েছে০২ অক্টোবর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র গ রহণ কর ক র কর ন আল ল হ স ন দর মসজ দ ক রআন ইসল ম সবচ য
এছাড়াও পড়ুন:
সমতা ও সহনশীলতা: মুসলিম সভ্যতার দুটি অনন্য বৈশিষ্ট্য
ইসলামের আলোয় গড়া সভ্যতা যেন একটা ফুলের বাগান—যেখানে বিভিন্ন রঙের ফুল মিলে সৌন্দর্য ছড়ায়। এই সভ্যতার হৃদয়ে ছিল সহনশীলতা আর সমতা নামে দুটি মূল্যবান রত্ন, যা মানুষকে সে-সময় মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসতে ভূমিকা রেখেছে।
এই দুই নীতির কারণে ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে এই ধর্ম। কারণ ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম, যুক্তির সঙ্গে মিলে এই ধর্ম মানুষের আত্মা ও শরীরের চাহিদা পূরণ করে। এটি সর্বজনীন, মধ্যপন্থা, ভারসাম্যপূর্ণ—কোনো জাতি বা অঞ্চলের নয়, বরং সমগ্র মানবতার।
দেখুন, কোরআনের শুরু হয় প্রথম আয়াত “সকল স্তুতি আল্লাহর, যিনি সকল সৃষ্টির প্রতিপালক” (সুরা ফাতিহা, আয়াত: ২) দিয়ে, আর শেষ হয় মানুষের কথা বা বলা যায় মানুষ নামের সুরা ‘সুরা নাস’ দিয়ে।
এই নিবন্ধে আমরা দুটি মূল নীতির কথা বলব: অন্যদের প্রতি সহনশীলতা এবং মুসলিমদের মধ্যে সমতা—যা মুসলিম সভ্যতাকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।
১. সহনশীলতা: মানবতার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশমুসলিম সভ্যতার সৌন্দর্যের একটা বড় অংশ হলো সহনশীলতা। এটি কোনো ধর্মের প্রতি সংকীর্ণতা দেখায় না, বরং সবাইকে আলিঙ্গন করে। কোরআন বলে, “যারা কথা শোনে এবং সবচেয়ে ভালোটি অনুসরণ করে, তাদের সুসংবাদ দাও।” (সুরা যুমার, আয়াত: ১৭-১৮
ইসলাম ন্যায় ও দয়ার ঐতিহ্য গড়েছে।পশ্চিমা ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডুরান্টএই সহনশীলতার কয়েকটা সুন্দর নিয়ম:
সব আসমানি ধর্ম একই উৎস থেকে: “তোমাদের জন্য ধর্মের যা নির্ধারিত করা হয়েছে, তা নুহকে যা বলা হয়েছিল... ইবরাহিম, মুসা ও ইসাকে যা বলা হয়েছিল।” (সুরা শুরা, আয়াত: ১৩)
সকল নবী ভাই ভাই, তাদের মধ্যে ভেদাভেদ নেই: “বল, আমরা আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছি... ইবরাহিম, ইসমাইল... মুসা, ইসা ও অন্য নবীদের প্রতি” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৩৬)
ধর্ম গ্রহণে জোর খাটানো যাবে না: “ধর্মে কোনো জোরজবরদস্তি নেই।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৫৬); “তুমি কি মানুষকে জোর করে মুমিন বানাবে?” (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৯৯)
সুন্দরভাবে তর্ক করা: “কিতাবিদের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো উপায়ে তর্ক করো।” (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৪৬); তাদের দেবতাকে গালি দেওয়া নিষেধ। (সুরা আনআম, আয়াত: ১০৮)
আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ: “তাদের সঙ্গে লড়াই করো যাতে ফিতনা না থাকে এবং ধর্ম শুধু আল্লাহর হয়।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৩)
জয়ের পর প্রতিশোধ নয়, শুধু রাষ্ট্রের আনুগত্য চাওয়া হবে। যেমনটি মহানবী (সা.)-এর মক্কা বিজয়ের সময় দেখা গেছে।
আরও পড়ুনমুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ থাকে১৬ অক্টোবর ২০২৫এই রীতিগুলো মুসলিমকে শেখায় সকল নবীকে সম্মান করতে, অন্যদের ধর্মীয় স্থান রক্ষা করতে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের অধিকার সমান রাখা। এভাবে মুসলিম সভ্যতা প্রথমবার দেখিয়েছে, একটা ধর্ম অন্য ধর্মকে দমন না করে সহাবস্থান করতে পারে।
রাসুল (সা.)-এর জীবন থেকে উদাহরণ
মদিনায় হিজরতের পর ইহুদিদের সঙ্গে চুক্তি করেন, তাদের ধর্ম রক্ষা করেন (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩১৬০)
ইহুদি প্রতিবেশীকে উপহার দিতেন, তাদের উপহার গ্রহণ করতেন। এক ইহুদি নারী বিষ মিশিয়ে খাবার দিয়েছিলেন, তবু তিনি ধৈর্য ধরেন।
নাজরানের খ্রিষ্টানদের তিনি মসজিদে থাকতে দেন, তাদের নামাজ পড়তে দেন। মিসরের শাসকের উপহার গ্রহণ করেন, তার দাসী মারিয়াকে বিয়ে করেন, যাঁর থেকে নবীজির সন্তান ইবরাহিম (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৫৮১)
জেরুসালেম জয়ের পর ওমর (রা.) ইহুদিদের শর্ত মেনে নেন, গির্জায় নামাজ পড়তে অস্বীকার করেন যাতে পরে মুসলিমরা তা মসজিদ না বানায়।সাহাবীদের উদাহরণ
ওমর (রা.) জেরুসালেম জয়ের পর ইহুদিদের শর্ত মেনে নেন, গির্জায় নামাজ পড়তে অস্বীকার করেন যাতে পরে মুসলিমরা তা মসজিদ না বানায়। এক খ্রিষ্টান নারীর বাড়ি মসজিদে অন্তর্ভুক্ত হলে ওমর (রা.) তা ফিরিয়ে দেন। (তারিখ আত-তাবারি, ৩/৬০৯, দার আল-কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৮৭)
পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা এই সহনশীলতার প্রশংসা করেছেন। উইলিয়াম ডুরান্ট বলেন, ইসলাম ন্যায় ও দয়ার ঐতিহ্য গড়েছে। (উইলিয়াম ডুরান্ট, দ্য স্টোরি অব সিভিলাইজেশন, ৪/৩০-২৪০, সাইমন অ্যান্ড শুস্টার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৫০)। থমাস আর্নল্ড বলেন, মুসলিমরা খ্রিষ্টানদের ন্যায় বিচার করেছে। (থমাস আর্নল্ড, দ্য প্রিচিং অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ৮০, লন্ডন, ১৯১৩)। গুস্তাভ লে বন বলেন, আরবরা সবচেয়ে দয়ালু বিজয়ী (গুস্তাভ লে বন, দ্য সিভিলাইজেশন অব দি অ্যারাবস, পৃষ্ঠা ১২৫, প্যারিস, ১৮৮৪)
আরও পড়ুনউমাইয়া যুগে আরব কারিগরদের স্থাপত্যের মহিমা২৭ আগস্ট ২০২৫২. সমতা: সকলে একই পরিবারের সদস্যমুসলিম সভ্যতার আরেক সৌন্দর্য সমতা—রঙ, জাতি নির্বিশেষে সবাই সমান। কোরআন বলে, “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে, যে সবচেয়ে খোদাভীরু।” (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)। বিদায় হজে রাসুল (সা.) বলেন, “তোমাদের প্রতিপালক এক, পিতা এক... খোদাভীতি চাড়া অনারবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই আরবের।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৩৫৩৬)
এই সমতা কেবল কথায় নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। মসজিদে সাদা-কালো পাশাপাশি দাঁড়ায়। হজে সবাই একই পোশাক। মক্কা জয়ের পর বিলাল (রা.)-কে কাবায় আজান দেওয়ার নির্দেশ দেন—যা জাহেলি সমাজে অকল্পনীয়। আবু জর (রা.) বিলালকে “কালো মায়ের ছেলে” বললে রাসুল (সা.) তাকে তিরস্কার করেন এই বলে যে, “তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত আছে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩০)।
মুসলিম যুগের উদাহরণ
মিসর জয়ের সময় কৃষাঙ্গ উবাদা বিন সামিত (রা.) ছিলেন দলের নেতা। সম্রাট মুকাওকিস ভয় পেলে সাহাবীরা বলেন, “সে আমাদের সেরা, আমরা তার কথা মানি।” (তারিখ আত-তাবারি, ৩/১০০, দার আল-কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৮৭)। আতা বিন আবি রাবাহ (রা.) ছিলেন কালো, অন্ধ, খোঁড়া। কিন্তু তথাপি তিনি মক্কার ইমাম হন, হজে ফতোয়া দিতেন। নুসাইব ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ কবি, খলিফাদের সঙ্গী। যাইলাই ছিলেন হাবশি, তবে ফিকহের বড় আলেম।
আবু জর (রা.) বিলালকে “কালো মায়ের ছেলে” বললে রাসুল (সা.) তাকে তিরস্কার করেন এই বলে যে, “তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত আছে।”আমরা সবাই এক বাবা-মা থেকে এসেছি। আল্লাহ বলেছেন, “হে মানুষ, তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদের এক আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা নিসা, আয়াত: ১)
জাতি-উপজাতি শুধু পরিচয়ের জন্য, যেমন কোরআন বলেছে, “যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো।” (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
মানুষের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সমান। আল্লাহ বলেছেন, “আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।” (সুরা ইসরা, আয়াত: ৭০)
আইনের সামনে সবাই সমান। দণ্ডের বেলায় “স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, দাসের বদলে দাস।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৭৮)
উদাহরণ হিসেবে মক্কা বিজয়ের পর একটি চুরির শাস্তির কথা বলা যায়। রাসুল (সা.) বলেন, শাস্তি সবার জন্য এক, ফাতিমা (রা.) চুরি করলেও হাত কাটা হতো (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৭৮৮)
আদি বিন হাতিম এক দরিদ্র নারীর সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর দাঁড়িয়ে কথা বলা দেখে বলেন, “এ তো রাজা নয়”। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১)
এই সহনশীলতা ও সমতা ইসলামকে ছড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বে। অনারবরাও পৃথিবীখ্যাত আলেম হয়েছে, সিবওয়াইহের মতো অনারব হয়েছেন বিশ্বসেরা আরবি ব্যাকরণবিদ।
আরও পড়ুনকোরআন যেভাবে মানুষের চেতনা পাল্টে দিয়েছে০২ অক্টোবর ২০২৫