লাভজনক চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধি কী কারণে
Published: 11th, August 2025 GMT
দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এই বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার মধ্যে রয়েছে খাদ্যশস্য, সিমেন্ট, সার, কয়লা, লবণ, চিনি, জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল ইত্যাদি। বন্দর দিয়ে রপ্তানি করা হয় তৈরি পোশাক, পাট, পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, চা, হিমায়িত পণ্য ইত্যাদি। ফলে দেশের গোটা অর্থনীতি নির্ভর করে এই বন্দরের ওপর।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সেবার ট্যারিফ একলাফে গড়ে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। গড়ে ৪০ শতাংশ হলেও কোনো কোনো সেবার মাশুল বৃদ্ধির হার এর চেয়ে বেশি। যেমন জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো। এ খাতে প্রতি ২০ ফুট লম্বা কনটেইনারের মাশুল ৪৩ ডলার ৪০ সেন্ট থেকে ৭০ ডলার ১১ সেন্ট করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মাশুল বৃদ্ধির হার প্রায় ৬২ শতাংশ। এর আগে ১৫ জুলাই বেসরকারি কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) অ্যাসোসিয়েশন এক সার্কুলারে বেসরকারি কনটেইনার ব্যবস্থাপনার মাশুলের হার বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা অনুসারে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে সেবাভেদে ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ মাশুল বাড়বে।
আরও পড়ুনবন্দর পরিচালনা বিদেশিদের দেওয়া কতটা যৌক্তিক১৯ মে ২০২৫দেশের অর্থনীতিতে এমনিতেই একধরনের স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তা রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক নিয়ে উদ্বেগ ও বেসরকারি মালিকানাধীন অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোর সেবা মাশুল বৃদ্ধির ঘোষণা। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে হাজির হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বন্দরের বেশির ভাগ সেবার মাশুল ১৯৮৬ সালের পর আর বাড়েনি। বন্দর কর, বার্থিং ফি, ফর্কলিফট চার্জ, অন্য ইউটিলিটি খরচসহ পাঁচটি সেবার হার ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সামান্য পরিবর্তন হলেও বাকি সব চার্জ ১৯৮৬ সালের পর থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে। তাই বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মাশুল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ কথার মধ্যে একটি ফাঁকি আছে। বন্দরের মাশুল নেওয়া হয় ডলারে। ১৯৮৬ সালে ডলারের মূল্য ছিল ৩০ টাকা ৪১ পয়সা। বর্তমানে ডলারের দর ১২২ টাকা। কাজেই আনুষ্ঠানিকভাবে মাশুল না বাড়ানো হলেও ডলারের দর বাড়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাশুল চার গুণের বেশি বেড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে বন্দর কর্তৃপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গীকার হলো ন্যূনতম খরচে ও সবচেয়ে কম সময়ে বন্দর সেবা প্রদান করা। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরের মাশুল বাড়ানো যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, বর্তমান মাশুল নিয়ে বন্দর লোকসানে নেই। যেমন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা খরচের বিপরীতে আয় করেছে ৫ হাজার ২২৭ কোটি টাকা অর্থাৎ মুনাফা ২ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করার পরও কেন এভাবে মাশুল বৃদ্ধি করবে!
বিতর্কিত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের সঙ্গে বন্দরের চুক্তির মেয়াদ শেষে ৭ জুলাই থেকে ছয় মাসের জন্য এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে নৌবাহিনী পরিচালিত সংস্থা চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড। এতে বন্দরের কার্যক্রমে গতি আরও বেড়েছে, যা বন্দর ব্যবস্থাপনায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার সাক্ষ্য দেয়। কাজেই চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক দিক ইত্যাদি বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত বন্দরের মাশুল বৃদ্ধি ও টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।মাশুল বৃদ্ধি করলে একদিকে ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামালের আমদানি খরচ বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা ভোক্তার কাছ থেকেই আদায় করবেন। ফলে দেশে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। অন্যদিকে রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়বে, যার ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় রপ্তানিকারকেরা পিছিয়ে যেতে পারে।
অনেকের আশঙ্কা, ডিপি ওয়ার্ল্ডের জন্য বন্দরে বিনিয়োগ আকর্ষণীয় করতেই বন্দর লোকসানে না থাকা সত্ত্বেও এভাবে মাশুল বাড়ানো হচ্ছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি কোম্পানির জন্য আকর্ষণীয় করতে একই মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে কি না।
নিউমুরিং টার্মিনাল পিপিপির মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়া ও বন্দরের মাশুল বৃদ্ধির উদ্যোগ দুটিই বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছিল। পিপিপি কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুসারে আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড চট্টগ্রাম বন্দরে বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করে ২০২০ সালে। বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, ২০২২ সালে বন্দরের শুল্ককাঠামো পর্যালোচনা ও নতুন প্রস্তাব তৈরির জন্য স্পেনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আইডম কনসালটিংকে নিয়োগ করা হয়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে বন্দরের ভাড়া পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ডিপি ওয়ার্ল্ডের বিনিয়োগকে সামনে রেখে উদ্যোগটি গতি পেয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ডিপি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্দরের মাশুল ঘন ঘন বাড়ানোর বদনাম রয়েছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ায় ডিপি ওয়ার্ল্ড তার বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করতে একতরফাভাবে অবকাঠামোগত সারচার্জ নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়—মেলবোর্ন বন্দরে ২০১৭ সালে কনটেইনার প্রতি সারচার্জ ৩ দশমিক ৪৫ অস্ট্রেলিয়ান ডলার থেকে ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫ দশমিক ৩০ ডলার, যা ২০০০ শতাংশের বেশি। ব্রিসবেন ও সিডনিতেও একই রকম বাড়তি চার্জ আরোপ করা হয়, যা অস্ট্রেলিয়ার প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০১৯, আঙ্কটাড, ৩১ জানুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ৫২)
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডিপি ওয়ার্ল্ডের যেন এ ধরনের বদনাম না হয়, সে জন্যই কি আগাম মাশুল বৃদ্ধি করা হলো? অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা হলো এ বছরের নভেম্বরের মধ্যে দর-কষাকষি করে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা। চুক্তির পর টার্মিনালটি ডিপি ওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তারাই মাশুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে। বিনিময়ে বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থ দেবে। স্বাভাবিকভাবেই মাশুল বৃদ্ধির ফলে ডিপি ওয়ার্ল্ডের আয় এখনকার হারের চেয়ে বেশি হবে।
আরও পড়ুনযে কারণে চট্টগ্রামে বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার২৩ জুন ২০২৫যেকোনো বিবেচনাতেই বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বাড়ানো যৌক্তিক হবে না। চট্টগ্রাম বন্দর ও বেসরকারি কনটেইনার ডিপো উভয়ের মাশুল বাড়লে পণ্য আমদানি-রপ্তানির প্রতিটি ধাপেই খরচ বাড়বে। রপ্তানি পণ্য কারখানা থেকে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে রাখার সময় একবার বাড়তি মাশুল দিতে হবে, আবার বন্দর হয়ে রপ্তানির জন্য দ্বিতীয়বার বাড়তি মাশুল গুনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যোগ হতে পারে ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও প্রতিটি ধাপে বাড়তি মাশুল দিতে হবে। কাজেই ইতিমধ্যে লাভজনকভাবে চলতে থাকা চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। সেই সঙ্গে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর মালিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের মাশুল বৃদ্ধির হারও যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্তও পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিতর্কিত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের সঙ্গে বন্দরের চুক্তির মেয়াদ শেষে ৭ জুলাই থেকে ছয় মাসের জন্য এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে নৌবাহিনী পরিচালিত সংস্থা চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড। এতে বন্দরের কার্যক্রমে গতি আরও বেড়েছে, যা বন্দর ব্যবস্থাপনায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার সাক্ষ্য দেয়। কাজেই চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক দিক ইত্যাদি বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত বন্দরের মাশুল বৃদ্ধি ও টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
[email protected]
মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র ব সরক র পর চ ল র জন য অন স র ব যবস আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
লাভজনক চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধি কী কারণে
দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এই বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার মধ্যে রয়েছে খাদ্যশস্য, সিমেন্ট, সার, কয়লা, লবণ, চিনি, জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল ইত্যাদি। বন্দর দিয়ে রপ্তানি করা হয় তৈরি পোশাক, পাট, পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, চা, হিমায়িত পণ্য ইত্যাদি। ফলে দেশের গোটা অর্থনীতি নির্ভর করে এই বন্দরের ওপর।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সেবার ট্যারিফ একলাফে গড়ে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। গড়ে ৪০ শতাংশ হলেও কোনো কোনো সেবার মাশুল বৃদ্ধির হার এর চেয়ে বেশি। যেমন জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো। এ খাতে প্রতি ২০ ফুট লম্বা কনটেইনারের মাশুল ৪৩ ডলার ৪০ সেন্ট থেকে ৭০ ডলার ১১ সেন্ট করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মাশুল বৃদ্ধির হার প্রায় ৬২ শতাংশ। এর আগে ১৫ জুলাই বেসরকারি কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) অ্যাসোসিয়েশন এক সার্কুলারে বেসরকারি কনটেইনার ব্যবস্থাপনার মাশুলের হার বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা অনুসারে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে সেবাভেদে ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ মাশুল বাড়বে।
আরও পড়ুনবন্দর পরিচালনা বিদেশিদের দেওয়া কতটা যৌক্তিক১৯ মে ২০২৫দেশের অর্থনীতিতে এমনিতেই একধরনের স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তা রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক নিয়ে উদ্বেগ ও বেসরকারি মালিকানাধীন অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোর সেবা মাশুল বৃদ্ধির ঘোষণা। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে হাজির হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বন্দরের বেশির ভাগ সেবার মাশুল ১৯৮৬ সালের পর আর বাড়েনি। বন্দর কর, বার্থিং ফি, ফর্কলিফট চার্জ, অন্য ইউটিলিটি খরচসহ পাঁচটি সেবার হার ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সামান্য পরিবর্তন হলেও বাকি সব চার্জ ১৯৮৬ সালের পর থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে। তাই বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মাশুল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ কথার মধ্যে একটি ফাঁকি আছে। বন্দরের মাশুল নেওয়া হয় ডলারে। ১৯৮৬ সালে ডলারের মূল্য ছিল ৩০ টাকা ৪১ পয়সা। বর্তমানে ডলারের দর ১২২ টাকা। কাজেই আনুষ্ঠানিকভাবে মাশুল না বাড়ানো হলেও ডলারের দর বাড়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাশুল চার গুণের বেশি বেড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে বন্দর কর্তৃপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গীকার হলো ন্যূনতম খরচে ও সবচেয়ে কম সময়ে বন্দর সেবা প্রদান করা। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরের মাশুল বাড়ানো যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, বর্তমান মাশুল নিয়ে বন্দর লোকসানে নেই। যেমন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা খরচের বিপরীতে আয় করেছে ৫ হাজার ২২৭ কোটি টাকা অর্থাৎ মুনাফা ২ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করার পরও কেন এভাবে মাশুল বৃদ্ধি করবে!
বিতর্কিত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের সঙ্গে বন্দরের চুক্তির মেয়াদ শেষে ৭ জুলাই থেকে ছয় মাসের জন্য এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে নৌবাহিনী পরিচালিত সংস্থা চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড। এতে বন্দরের কার্যক্রমে গতি আরও বেড়েছে, যা বন্দর ব্যবস্থাপনায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার সাক্ষ্য দেয়। কাজেই চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক দিক ইত্যাদি বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত বন্দরের মাশুল বৃদ্ধি ও টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।মাশুল বৃদ্ধি করলে একদিকে ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামালের আমদানি খরচ বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা ভোক্তার কাছ থেকেই আদায় করবেন। ফলে দেশে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। অন্যদিকে রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়বে, যার ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় রপ্তানিকারকেরা পিছিয়ে যেতে পারে।
অনেকের আশঙ্কা, ডিপি ওয়ার্ল্ডের জন্য বন্দরে বিনিয়োগ আকর্ষণীয় করতেই বন্দর লোকসানে না থাকা সত্ত্বেও এভাবে মাশুল বাড়ানো হচ্ছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি কোম্পানির জন্য আকর্ষণীয় করতে একই মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে কি না।
নিউমুরিং টার্মিনাল পিপিপির মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়া ও বন্দরের মাশুল বৃদ্ধির উদ্যোগ দুটিই বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছিল। পিপিপি কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুসারে আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড চট্টগ্রাম বন্দরে বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করে ২০২০ সালে। বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, ২০২২ সালে বন্দরের শুল্ককাঠামো পর্যালোচনা ও নতুন প্রস্তাব তৈরির জন্য স্পেনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আইডম কনসালটিংকে নিয়োগ করা হয়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে বন্দরের ভাড়া পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ডিপি ওয়ার্ল্ডের বিনিয়োগকে সামনে রেখে উদ্যোগটি গতি পেয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ডিপি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্দরের মাশুল ঘন ঘন বাড়ানোর বদনাম রয়েছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ায় ডিপি ওয়ার্ল্ড তার বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করতে একতরফাভাবে অবকাঠামোগত সারচার্জ নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়—মেলবোর্ন বন্দরে ২০১৭ সালে কনটেইনার প্রতি সারচার্জ ৩ দশমিক ৪৫ অস্ট্রেলিয়ান ডলার থেকে ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫ দশমিক ৩০ ডলার, যা ২০০০ শতাংশের বেশি। ব্রিসবেন ও সিডনিতেও একই রকম বাড়তি চার্জ আরোপ করা হয়, যা অস্ট্রেলিয়ার প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০১৯, আঙ্কটাড, ৩১ জানুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ৫২)
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডিপি ওয়ার্ল্ডের যেন এ ধরনের বদনাম না হয়, সে জন্যই কি আগাম মাশুল বৃদ্ধি করা হলো? অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা হলো এ বছরের নভেম্বরের মধ্যে দর-কষাকষি করে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা। চুক্তির পর টার্মিনালটি ডিপি ওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তারাই মাশুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে। বিনিময়ে বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থ দেবে। স্বাভাবিকভাবেই মাশুল বৃদ্ধির ফলে ডিপি ওয়ার্ল্ডের আয় এখনকার হারের চেয়ে বেশি হবে।
আরও পড়ুনযে কারণে চট্টগ্রামে বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার২৩ জুন ২০২৫যেকোনো বিবেচনাতেই বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বাড়ানো যৌক্তিক হবে না। চট্টগ্রাম বন্দর ও বেসরকারি কনটেইনার ডিপো উভয়ের মাশুল বাড়লে পণ্য আমদানি-রপ্তানির প্রতিটি ধাপেই খরচ বাড়বে। রপ্তানি পণ্য কারখানা থেকে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে রাখার সময় একবার বাড়তি মাশুল দিতে হবে, আবার বন্দর হয়ে রপ্তানির জন্য দ্বিতীয়বার বাড়তি মাশুল গুনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যোগ হতে পারে ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও প্রতিটি ধাপে বাড়তি মাশুল দিতে হবে। কাজেই ইতিমধ্যে লাভজনকভাবে চলতে থাকা চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। সেই সঙ্গে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর মালিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের মাশুল বৃদ্ধির হারও যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্তও পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিতর্কিত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের সঙ্গে বন্দরের চুক্তির মেয়াদ শেষে ৭ জুলাই থেকে ছয় মাসের জন্য এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে নৌবাহিনী পরিচালিত সংস্থা চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড। এতে বন্দরের কার্যক্রমে গতি আরও বেড়েছে, যা বন্দর ব্যবস্থাপনায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার সাক্ষ্য দেয়। কাজেই চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক দিক ইত্যাদি বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত বন্দরের মাশুল বৃদ্ধি ও টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
[email protected]
মতামত লেখকের নিজস্ব