গত এক বছরে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একের পর এক বৈপ্লবিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক ঝাঁকুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তরুণেরা রাস্তায় নেমে জবাবদিহিমূলক সরকার, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও কর্মসংস্থানের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। মানবাধিকারকর্মী বিনাইফার নওরোজি এই তরঙ্গকে যথার্থভাবে ‘ইয়ুথকোয়েক’ বা ‘তরুণকম্প’ বলে অভিহিত করেছেন। 

সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশে। সেখানে সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণ নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার উৎখাতের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে এশিয়ার ‘আয়রন লেডি’র পতন ঘটে।

আরও পড়ুনগণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলও কি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে০৮ আগস্ট ২০২৫

কেউ কেউ হাসিনার পতনকে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জনতার সাহসী সংগ্রামের বিজয় হিসেবে উদ্‌যাপন করেছেন। কিন্তু বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এটিকে অশান্তি ও অনিশ্চয়তায় ভরা এক নতুন সময়ের সূচনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এতে ইসলামপন্থী সহিংসতা ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে পারে।

আবার অন্যদের মতে, এই বিদ্রোহ মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপানো উদারনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি জনসাধারণের ক্ষোভ থেকে উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাকস আরও এক ধাপ এগিয়ে এই গণ-অভ্যুত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকার পরিবর্তনের অভিযান বলে আখ্যা দিয়েছেন।

কিন্তু এসব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণে ক্ষমতার একেবারে তলানি থেকে উঠে আসা তরুণদের নেতৃত্বে হওয়া বিপ্লবের বিরাট সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। হাসিনার পতনের পর গত এক বছরে বৈশ্বিক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখেও বাংলাদেশের তরুণদের আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়েছে। ফলে দুর্নীতি ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া রাজপথের আন্দোলন এখন বিস্তৃত হয়ে কাঠামোগত সংস্কারের বৃহৎ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। 

গত একটি বছর আমাদের দেখিয়েছে, বিভিন্ন শ্রেণি থেকে আসা প্রযুক্তি-সচেতন এই তরুণদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যুগ যুগ ধরে গেড়ে থাকা পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, আমাদের এই আশাবাদ স্থায়ী না-ও হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, সমাজে বড় ধরনের বিভেদ থাকায় বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আরব বসন্তের মতো অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে। 

অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরে তরুণ কর্মীরা অন্তর্বর্তী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে শুধু সহায়তাই করেননি, বরং তাঁরা নির্বাচনী গণতন্ত্রে রূপান্তরের ভিত্তিও তৈরি করেছেন। সামনের পথ এখনো যদিও চ্যালেঞ্জে ভরা, তবু পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আশা জাগাচ্ছে। 

প্রথমত, তরুণদের আন্দোলন নতুন নাগরিক সমাজের প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। এটি অরাজনৈতিক গণ্যমান্য ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ জন-আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করেছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে নতুন তৃণমূল উদ্যোগ ও পেশাদারির সঙ্গে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) নাগরিক সম্পৃক্ততায় নতুন ঢেউ তুলেছে। এর ফলে বৈষম্য মোকাবিলা, কাঠামোগত অসাম্য দূর করা এবং নির্বাচনের আগে জরুরি সংস্কার এগিয়ে নেওয়া নিয়ে স্থানীয় পর্যায়েও আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। 

দ্বিতীয়ত, তরুণদের এই আন্দোলন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য অর্জন করেছে। তরুণ সংগঠকেরা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সমর্থন সংগঠিত করেছেন। এর ফলে তাঁর দায়িত্বকাল বাড়ানো সম্ভব হয়েছে এবং তাঁর নির্বাচনী রোডম্যাপের জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত হয়েছে। তাঁরা বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের পক্ষে দাঁড়াতে চাপ দিয়েছেন। এই কমিশন সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন—এই পাঁচ ক্ষেত্রে সংস্কার আলোচনাকে এগিয়ে নেবে। 

তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবি তোলার পাশাপাশি তরুণ কর্মীরা বাংলাদেশের প্রথম ছাত্রসমাজের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গঠন করে সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হতে পারলে দলটি ২০২৬ সালের শুরুতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের জন্য ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরবে। 

চতুর্থত, বাংলাদেশের তরুণেরা রাস্তায় আন্দোলনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা ভোটের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার দাবি তুলছেন এবং অস্বচ্ছ বা বেআইনি রাজনৈতিক অনুদানের বদলে স্বচ্ছ, জনগণের অর্থায়নে নির্বাচনী তহবিল গঠনের পক্ষে কথা বলছেন।

সবশেষে দেশের বড় বড় নেতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তরুণ ও নাগরিক সংগঠনগুলো অনেক বড় সাফল্য পেয়েছে। তারা সব প্রধান রাজনৈতিক দলকে একত্র করে ১৬৬টি সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছে। কয়েক মাস ধরে আলোচনা চালানোর পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই সনদ’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।

২০২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মানুষের কথা বলার পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক কর ছ ন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপির নতুন স্লোগান ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্রায়ণ’: আমীর খসরু

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, তারা ক্ষমতায় এলে মেগা প্রকল্প থেকে সরে এসে দক্ষতা উন্নয়ন (স্কিল ডেভেলপমেন্ট) খাতে বিনিয়োগের ওপর জোর দেবেন।

দেশের অর্থনীতিকে কোনো ‘গোষ্ঠী বিশেষের কাছে জিম্মি’ না রেখে এর সুফল প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছে দিতে বিএনপি ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্রায়ণ’ মডেল গ্রহণ করবে। এটি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নতুন স্লোগান।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীর খসরু এই ঘোষণা দেন।

শনিবার (১৫ নভেম্বর) বিকালে ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদ হলরুমে ফরিদপুর বিভাগের ব্যবসায়ীদের নিয়ে এই সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম।

আমীর খসরু বলেন, “আমরা কোনো মেগা প্রজেক্টের দিকে যাব না, তার চেয়ে স্কিল ডেভেলপমেন্টের দিকে জোর দেব। আগামীর বাংলাদেশ গড়তে হলে বর্তমানে ফলো করা মডেল থেকে বেরিয়ে এসে এমন মডেলে যেতে হবে, যাতে এর সুফল প্রত্যেকটা নাগরিক পেতে পারে।”

বিনিয়োগের প্রধান লক্ষ্য হবে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “পাশাপাশি বিনামূল্যে জনগণকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি। এই লক্ষ্য পূরণে অনেকগুলো নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে হবে।”

বিএনপির এই নেতা দেশের ব্যবসায়িক জটিলতা কমাতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অনুমোদনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

তিনি বলেন, “একটা রেস্টুরেন্ট করতে গেলে ১৯টা অনুমতি নিতে হয় বাংলাদেশে। এই অনুমতি নিতে নিতে আর ব্যবসা করা হয়ে ওঠে না। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যেই অনুমোদনের দরকার, সেটি ১৫ দিনের মধ্যে করার ব্যবস্থা করতে হবে।”

“আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঘুষ-দুর্নীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেক ডিসিশনের মধ্যে টাইম ফ্রেম থাকতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সূচির মধ্যে যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে,” বলেন আমীর খসরু।

দেশের পুঁজিবাজার (ক্যাপিটাল মার্কেট) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমীর খসরু বলেন, “আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেট শেয়ারবাজার নিয়ে গেছে। এই ক্যাপিটাল মার্কেটকে বড় করতে আমাদের বিগ প্ল্যান রয়েছে।”

পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ব এখন গ্রিন ইকোনমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিএনপিও সেই ধারা অনুসরণ করবে।

“আমাদের বিনিয়োগগুলো এমন হবে, যেখানে আমাদের টাকা অপচয় হবে না, পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হবে না,” যোগ করেন তিনি।

আমীর খসরু বলেন, ব্যবসাকে সহজ করতে যত আইন, পরিবেশ বদলান এবং বিনিয়োগ বাড়ান দরকার, তার সবকিছুই বিএনপি করবে।

তিনি বলেন, “আমরা আগে থেকেই এসব করে নিচ্ছি, কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার পরে এসব করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। আমরা ডে ওয়ান থেকেই এ কাজ শুরু করতে চাই।”

স্পোর্টস ইকোনমি ও থিয়েটার ইকোনমির মতো পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেন আমীর খসরু।

সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রাশেদ আল মাহমুদ আগামী ১৮ মাসে এক কোটি কর্মসংস্থান তৈরির ওপর জোর দেন।

বিএস জুট মিলের চেয়রাম্যানের বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া প্রচলিত আইনের পরিবর্তন করে নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যাংক সলভেন্সি সনদকে প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান জানান।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এসএম ফজলুল হক ঘুষ ছাড়া কাজ না হওয়ার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। ফরিদপুর জুট ফাইবার্সের পরিচালক চৌধুরী ফারিয়ান ইউসুফ জুট সেক্টরের উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেন।

সভাপতি শামা ওবায়েদ ইসলাম তার বক্তব্যে ফরিদপুরে যুবকদের জন্য একটি আইটি হাব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের কথা জানান।

ঢাকা/তামিম/রাসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সফল নির্বাচন হলে গণতান্ত্রিক উত্তরণের অর্ধেকপথ পার করা সম্ভব হবে: মান্না
  • বিভ্রান্তি-হতাশা-অনিশ্চয়তার মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে: ফখরুল
  • নানা দাবির নামে নির্বাচন ব্যাহত করার চেষ্টা চলছে: মির্জা ফখরুল
  • কী হবে যদি গণভোটে ‘না’ জয়ী হয়
  • বিএনপির নতুন স্লোগান ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্রায়ণ’: আমীর খসরু
  • সেই গণতন্ত্র যেন আর কোন ফ্যাসিবাদের জন্ম না দেয় : মামুন মাহমুদ
  • পারভেজের কথায় ‘বিজয় নেবে ধানের শীষ’
  • প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ জাতির সঙ্গে প্রতারণা: বাম জোট
  • ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি রুখতে বামপন্থি সরকার গড়তে হবে: সেলিম
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে কোন দলের দাবি কতটা রাখা হলো