বাংলাদেশের ‘তরুণকম্পের’ সম্ভাবনা ও ঝুঁকি
Published: 13th, August 2025 GMT
গত এক বছরে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একের পর এক বৈপ্লবিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক ঝাঁকুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তরুণেরা রাস্তায় নেমে জবাবদিহিমূলক সরকার, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও কর্মসংস্থানের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। মানবাধিকারকর্মী বিনাইফার নওরোজি এই তরঙ্গকে যথার্থভাবে ‘ইয়ুথকোয়েক’ বা ‘তরুণকম্প’ বলে অভিহিত করেছেন।
সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশে। সেখানে সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণ নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার উৎখাতের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে এশিয়ার ‘আয়রন লেডি’র পতন ঘটে।
আরও পড়ুনগণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলও কি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে০৮ আগস্ট ২০২৫কেউ কেউ হাসিনার পতনকে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জনতার সাহসী সংগ্রামের বিজয় হিসেবে উদ্যাপন করেছেন। কিন্তু বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এটিকে অশান্তি ও অনিশ্চয়তায় ভরা এক নতুন সময়ের সূচনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এতে ইসলামপন্থী সহিংসতা ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে পারে।
আবার অন্যদের মতে, এই বিদ্রোহ মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপানো উদারনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি জনসাধারণের ক্ষোভ থেকে উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাকস আরও এক ধাপ এগিয়ে এই গণ-অভ্যুত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকার পরিবর্তনের অভিযান বলে আখ্যা দিয়েছেন।
কিন্তু এসব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণে ক্ষমতার একেবারে তলানি থেকে উঠে আসা তরুণদের নেতৃত্বে হওয়া বিপ্লবের বিরাট সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। হাসিনার পতনের পর গত এক বছরে বৈশ্বিক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখেও বাংলাদেশের তরুণদের আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়েছে। ফলে দুর্নীতি ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া রাজপথের আন্দোলন এখন বিস্তৃত হয়ে কাঠামোগত সংস্কারের বৃহৎ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
গত একটি বছর আমাদের দেখিয়েছে, বিভিন্ন শ্রেণি থেকে আসা প্রযুক্তি-সচেতন এই তরুণদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যুগ যুগ ধরে গেড়ে থাকা পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, আমাদের এই আশাবাদ স্থায়ী না-ও হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, সমাজে বড় ধরনের বিভেদ থাকায় বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আরব বসন্তের মতো অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে।অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরে তরুণ কর্মীরা অন্তর্বর্তী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে শুধু সহায়তাই করেননি, বরং তাঁরা নির্বাচনী গণতন্ত্রে রূপান্তরের ভিত্তিও তৈরি করেছেন। সামনের পথ এখনো যদিও চ্যালেঞ্জে ভরা, তবু পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আশা জাগাচ্ছে।
প্রথমত, তরুণদের আন্দোলন নতুন নাগরিক সমাজের প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। এটি অরাজনৈতিক গণ্যমান্য ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ জন-আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করেছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে নতুন তৃণমূল উদ্যোগ ও পেশাদারির সঙ্গে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) নাগরিক সম্পৃক্ততায় নতুন ঢেউ তুলেছে। এর ফলে বৈষম্য মোকাবিলা, কাঠামোগত অসাম্য দূর করা এবং নির্বাচনের আগে জরুরি সংস্কার এগিয়ে নেওয়া নিয়ে স্থানীয় পর্যায়েও আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তরুণদের এই আন্দোলন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য অর্জন করেছে। তরুণ সংগঠকেরা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সমর্থন সংগঠিত করেছেন। এর ফলে তাঁর দায়িত্বকাল বাড়ানো সম্ভব হয়েছে এবং তাঁর নির্বাচনী রোডম্যাপের জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত হয়েছে। তাঁরা বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের পক্ষে দাঁড়াতে চাপ দিয়েছেন। এই কমিশন সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন—এই পাঁচ ক্ষেত্রে সংস্কার আলোচনাকে এগিয়ে নেবে।
তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবি তোলার পাশাপাশি তরুণ কর্মীরা বাংলাদেশের প্রথম ছাত্রসমাজের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গঠন করে সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হতে পারলে দলটি ২০২৬ সালের শুরুতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের জন্য ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরবে।
চতুর্থত, বাংলাদেশের তরুণেরা রাস্তায় আন্দোলনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা ভোটের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার দাবি তুলছেন এবং অস্বচ্ছ বা বেআইনি রাজনৈতিক অনুদানের বদলে স্বচ্ছ, জনগণের অর্থায়নে নির্বাচনী তহবিল গঠনের পক্ষে কথা বলছেন।
সবশেষে দেশের বড় বড় নেতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তরুণ ও নাগরিক সংগঠনগুলো অনেক বড় সাফল্য পেয়েছে। তারা সব প্রধান রাজনৈতিক দলকে একত্র করে ১৬৬টি সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছে। কয়েক মাস ধরে আলোচনা চালানোর পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই সনদ’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মানুষের কথা বলার পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক কর ছ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের
প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগররাষ্ট্র ছিল। সেখানে নগরের অধিবাসীকেই বলা হতো নাগরিক, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সেই সব ব্যক্তিকে নাগরিক বলব, যাদের আইন প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে।’ তাঁর মতে, যে ব্যক্তি নগররাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে অক্ষম, তিনি প্রকৃত নাগরিক নন।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিককে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—যেকোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়ের সঙ্গে পালন করেন, তাঁকেই নাগরিক বলা যায়। একই সঙ্গে নাগরিককে অবশ্যই অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।
প্রতিটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সৎ, যোগ্য ও নীতিবান নাগরিক। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নাগরিকের চরিত্র ও আচরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক—যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত। এ জ্ঞান ও সচেতনতাই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন, তবে কি গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে? বাস্তবতা হলো নাগরিকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাই স্বৈরতন্ত্রকে জন্ম দেয়।
প্রথমত, যেখানে মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, সেখানে শাসকগোষ্ঠী সহজেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন—এসব বিষয়ে নাগরিক উদাসীন থাকলে শাসকের জবাবদিহি বিলীন হয়ে যায়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকলেও এর প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, নাগরিকেরা ভয়, অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যখন অন্যায় ও অনিয়ম মেনে নেন, তখনই স্বৈরতন্ত্র শিকড় গাড়ে। শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিলে সরকার জবাবদিহি এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—শক্তিশালী শাসকের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় কেবল তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি থেকে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অতীত—সবখানেই দেখা যায়, নাগরিক–সচেতনতার অভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল।
তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ দুর্বল হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন কিংবা নাগরিক সংগঠনগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন শাসকেরা সহজেই বিকল্প কণ্ঠরোধ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অর্থাৎ, নাগরিকের নীরবতাই শাসকের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়।
অতএব, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নাগরিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষকে জানতে হবে তাদের অধিকার, কর্তব্য ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার উপায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে হবে সত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, তোষণ বা প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়। মনে রাখতে হবে—অধিকার চর্চা না করলে অধিকার হারিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা ও তা প্রয়োগ করা।
সবশেষে বলা যায়, নাগরিকের অধিকার বিষয়ে অসচেতনতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; বরং তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর। সচেতন নাগরিক সমাজই পারে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে আর অসচেতন নাগরিক সমাজই সৃষ্টি করে স্বৈরতন্ত্রের জন্মভূমি।
ইসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়