আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের হলেও গদ্যের ইতিহাস মাত্র সোয়া দুই শ বছরের। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে বাংলা গদ্যের খুব বেশি নমুনা মেলে না। যে যৎকিঞ্চিৎ উদাহরণের দেখা মেলে, তা দলিল-দস্তাবেজে ও চিঠিপত্রে। তবে তাতে ঠিক গদ্যের স্বাদ পাওয়া যায় না। তা দিয়ে প্রয়োজনও মোটানো যায় না। সেই অবস্থা থেকে বাংলা গদ্যের আজকের অবস্থায় আসতে যে সময় পাড়ি দিতে হয়েছে, এই যে গদ্যে নিজের বলার কথাটি স্পষ্ট করে তুলছি এবং বাংলা গদ্যের আজকের যে অবস্থান, এর পেছনে যাঁদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখতে হয়, শুনতে অস্বস্তি হলেও সে তালিকায় বিদেশি লোকের সংখ্যাই বেশি।

আঠারো শতকের শুরুতে এবং তার একটু আগে থেকে ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে বণিকদের সঙ্গে ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বিদেশিরা আসতে থাকেন। এ সময় প্রয়োজনের তাগিদেই তাঁদের বাংলা ভাষা শিখতে হয়। সেই শেখা থেকেই নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য তাঁরা বাংলা ভাষাকে একটি বিজ্ঞানসম্মত কাঠামোর ওপর দাঁড় করান। এ পর্বে আমরা পর্তুগিজ পাদরি মানুয়েল-দা-আসঁসুম্পসাম এবং ইংরেজ ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের কথা মনে রেখেও যাঁকে সবচেয়ে বেশি সম্মানের সঙ্গে সামনে এগিয়ে রাখি, তিনি উইলিয়াম কেরি। 

জন্ম ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট নরদামটনশায়ারের পলাস-পিউরি গ্রামে। ছোটবেলায় তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কাহিনিতে। সে কাহিনি তাঁকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, যে তাঁকেও ওই সময়ে সহপাঠীদের অনেকে কলম্বাস বলে ডাকত। ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের পাশাপাশি তাঁর নেশা ছিল প্রকৃতি। ভাষা ও উদ্ভিদবিজ্ঞান ছিল আগ্রহের শীর্ষে। তাঁর জীবনের তিনটি গুণকে আলোচকেরা সব সময় সামনে রেখেছেন—পরিশ্রম করার ক্ষমতা, অধ্যবসায় এবং শেখার অদম্য আগ্রহ। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে হাতেকলমে উদ্ভিদবিজ্ঞান আলোচনায় তিনি এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন যে একসময় তাঁকে কলকাতার কোম্পানির বাগানের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব উঠেছিল। শুধু তা–ই নয়, সে সময়ের বিখ্যাত উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ডক্টর রক্সবার্গের অকালমৃত্যুতে তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘ফ্লোরা ইনডিকা’ নামের বইটিও প্রকাশিত হয় উইলিয়াম কেরির সম্পাদনায়।

আঠারো শতকের শুরুতে এবং তার একটু আগে থেকে ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে বণিকদের সঙ্গে ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বিদেশিরা আসতে থাকেন। এ সময় প্রয়োজনের তাগিদেই তাঁদের বাংলা ভাষা শিখতে হয়। সেই শেখা থেকেই নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য তাঁরা বাংলা ভাষাকে একটি বিজ্ঞানসম্মত কাঠামোর ওপর দাঁড় করান।

উইলিয়াম কেরি মাত্র ১২ বছর বয়সে পণ্ডিত টমাস জোনসের কাছে লাতিন ভাষা শেখা শুরু করেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় এ সময়ই তাঁকে উপার্জনের চেষ্টাও করতে হয়। কিছুদিন কৃষিকাজে সময় দেওয়ার পর একটি জুতা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে তিনি জুতা সেলাইয়ের কাজ শিখতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে শুরু হয় গ্রিক ভাষা শেখার পাঠ। এই দোকানের মালিকের মৃত্যুর পর অন্য আরেকটি জুতার দোকানে শিক্ষানবিশ হিসেবে নিযুক্ত হন কেরি। সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন মদ্যপ, বদমেজাজি ও ধর্মবাতিকগ্রস্ত। তাঁর সঙ্গে প্রায়ই বালক কেরির ধর্ম বিষয়ে তর্ক হতো। এই তর্কে জেতার জন্য তিনি ধর্মগ্রন্থ পাঠে মনোযোগী হন। একই সঙ্গে মনোযোগ দেন হিব্রু ভাষা শেখায়ও। উইলিয়াম কেরির জীবনীকাররা বলেন, ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং তর্কে জেতার জন্য আগ্রহ থাকলেও এ সময় তাঁর নৈতিক চরিত্র সংসর্গদোষে কলুষিত হয়। তবে শিগগিরই তাঁর জীবনের গতি পরিবর্তিত হয় এবং মনে সত্যিকার ধর্মভাব জেগে ওঠে। এ পর্বে চার্চ অব ইংল্যান্ডের বিখ্যাত প্রচারক রেভারেন্ড টমাস স্কটের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তত দিনে (১৭৮৬) প্রকাশিত হয়েছে ক্যাপ্টেন কুকের ভ্রমণবৃত্তান্ত। সে বই পাঠের পর পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ধর্মের আলোবঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য কেরির মন কেঁদে ওঠে। তিনি ‘হিদেন’ জাতিগুলোর মুক্তির উপায় চিন্তার সঙ্গে ডাচ্‌, ইতালিয়ান ও ফরাসি ভাষাও শিখতে শুরু করেন। একটি ডাচ্‌ বই অনুবাদও করেন ইংরেজিতে। এর আগেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন একটি অবৈতনিক স্কুলে। সে চাকরি ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি পাদরিরূপে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর উদ্যোগেই ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয় ‘দ্য পারটিকুলার ব্যাপ্টিস্ট সোসাইটি ফর প্রপাগেটিং দ্য গেসপাল অ্যামনগেস্ট দ্য হেথেন’ নামক সমিতি। এই সমিতির কাছে ১৭৮৩ সালের প্রথম প্রথম ব্যাপটিস্ট মিশনারি হিসেবে বাংলাদেশে আসা জন টমাস একা একা ধর্ম প্রচারের কাজ কঠিন উল্লেখ করে সাহায্য প্রার্থনা করেন। সমিতির পক্ষ থেকে টমাসের প্রস্তাব এবং তাঁর সম্পর্কে অনুসন্ধানের পর ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হলে কেরি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে টমাসের সহকর্মী হতে চান। এরপর ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুন ক্যাপ্টেন ক্রিসমাসের অধীনে পরিচালিত ড্যানিশ ইন্ডিয়াম্যান (জাহাজ) ‘প্রিন্সেস মারিয়া’–যোগে জন টমাসের নেতৃত্বে উইলিয়াম কেরি—স্ত্রী ডরোথি, শ্যালিকা ক্যাথারিন প্লাকেট, পুত্র ফেলিক্স, উইলিয়াম, পিটার ও সদ্যজাত জ্যাবেজকে নিয়ে বঙ্গদেশ অভিমুখে যাত্রা করেন। এই যাত্রাই ছিল মাতৃভূমি থেকে তাঁর চিরবিচ্ছেদের যাত্রা। ওই বছরের ১১ নভেম্বর তিনি কলকাতায় পৌঁছান। তারপর বেঁচে ছিলেন ৪১ বছর। কিন্তু বঙ্গদেশ ছাড়ার কথা ভাবেননি। যদিও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে আর শুধু সেই উদ্দেশ্যেই স্থির থাকতে পারেননি। তাঁর সাধনা ব্যয় হয়েছে বাংলা ভাষার উন্নতিতে। ৯ জুন ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই পুরো সময় বাংলা গদ্যের গঠনপর্বের প্রারম্ভিক বা প্রাথমিক সময়, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন উইলিয়াম কেরি।

বাংলাদেশে আসার পথে জাহাজেই জন টমাসের কাছে বাংলা শেখার পাঠ শুরু করেন উইলিয়াম কেরি। ১১ নভেম্বর তারিখে কলকাতায় পৌঁছানোর পর জাহাজঘাটে রামরাম বসুর সঙ্গে পরিচয় হয়। যিনি আগে থেকেই জন টমাসের মুনশি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সেদিন থেকেই এই রামরাম বসুকেই জন কেরি মাসিক কুড়ি টাকা বেতনে নিজের মুনশি নিযুক্ত করেন। তবে বাংলাদেশে আসার পর উইলিয়াম কেরির চলার পথ মসৃণ ছিল না। তাঁর এ সময়ের অবস্থা বর্ণনা করে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে বৈশাখ ১৩৪৯ সালে প্রকাশিত ‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’ সিরিজের জীবনগ্রন্থ ‘উইলিয়াম কেরি’ বইয়ে শ্রীসজনীকান্ত দাস লিখেছেন, ‘বঙ্গদেশে পদার্পণ করিয়া পুরো সাড়ে সাত মাস কেরি হালভাঙা নৌকার মতো সমগ্র পরিবার, মুনশিসমেত সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় কলিকাতা হইতে ব্যান্ডেল, ব্যান্ডেল হইতে নদীয়া, নদীয়া হইতে ব্যবসায়ী নীলু দত্তের বদান্যতায় তাহার মানিকতলার বাগানবাড়িতে এবং শেষ পর্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলের দেবহাট্টায় ভাসিয়া বেড়াইতে থাকেন।’ 

১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ায় উইলিয়াম কেরি মালদহের মদনাবাটীর নীলকুঠির তত্ত্বাবধায়কের পদে নিযুক্ত হন। সে বছরের ১৫ জুন তিনি সপরিবার রামরাম বসুসহ নৌকাযোগে ইছামতী, জলাঙ্গী, গঙ্গা ও মহানন্দা নদীপথে মদনাবাটীতে পৌঁছান। পথিমধ্যে সুন্দরবনের কাছাকাছি চাঁছুরিয়া নামক স্থানে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেন। এ সময়ই কেরি নিজের সুখ-সুবিধার জন্য নিজেই বাংলা ভাষার একটি সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ ও একটি ব্যাকরণ তৈরি করেন। অবশ্য তার আগেই প্রকাশিত হয়ে গেছে মানুয়েল-দা-আসঁসুম্পসাম রচিত ব্যাকরণ। যদিও সেটি তখনো কেরির হাতে এসে পৌঁছায়নি। ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতেই বাংলা ভাষায় কেরি দক্ষতা অর্জন করেন। লিখতে ও বলতে তাঁর আর অসুবিধা হয় না। এ সময় মদনাবাটীতে স্থানীয় কৃষক প্রজাদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা ছিল দেশীয় লোকেদের ইউরোপীয়মতে শেখানোর দ্বিতীয় স্কুল। প্রথম স্কুলটি মালদহের গোয়ামালটিতে স্থাপন করেছিলেন জন এলারটন। 

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুন ক্যাপ্টেন ক্রিসমাসের অধীনে পরিচালিত ড্যানিশ ইন্ডিয়াম্যান (জাহাজ) ‘প্রিন্সেস মারিয়া’–যোগে জন টমাসের নেতৃত্বে উইলিয়াম কেরি—স্ত্রী ডরোথি, শ্যালিকা ক্যাথারিন প্লাকেট, পুত্র ফেলিক্স, উইলিয়াম, পিটার ও সদ্যজাত জ্যাবেজকে নিয়ে বঙ্গদেশ অভিমুখে যাত্রা করেন।

বঙ্গদেশে আসার পর থেকে কেরির বাংলা শেখা, বাংলায় বক্তৃতা দেওয়া, বাইবেলের অনুবাদ বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া গেলেও এ সময় পর্যন্ত এর কোনো নমুনা ইতিহাসবিদদের হাতে নেই। তবে মদনাবাটীতে আসার পর ১৭৯৫ সালের ১৩ আগস্ট তারিখে একটি চিঠিতে তিনি নিজেই বাংলা লেখার উদাহরণ হাজির করেন। যা কেরির লেখা বাংলা গদ্যের প্রথম দৃষ্টান্ত। সেই চিঠিতে কেরি লিখছেন, ‘Ram Ram Boshoo and Mohun Chund are now with me….

I often exhort them, in the words of the apostle, 2 Cor. VI. 17, which in their language I thus express—বাহিরে আইস এবং আলাদা হও এবং অপবিত্র বস্তু স্পর্শ করিয়ো না এবং আমি কবুল করিব তোমাদিগকে এবং তোমরা হইবে আমার পুত্রগণ এবং কন্যাগণ এই মত বলেন সর্ব্বশক্ত ভগবান।’

এ সময় কেরি সংস্কৃত ও চলতি বাংলা, এই দোটানার মধ্যে পড়ে কিছু কাল অত্যন্ত বিচলিত ছিলেন। তাঁর হাতে কোনো ব্যাকরণ-অভিধানও ছিল না। ফলে তিনি নিজেই সংস্কৃতকে আদর্শ ধরে ব্যাকরণ-অভিধান রচনায় মন দেন। এই ব্যাকরণ মুদ্রিত হয় ১৮০১ সালে। তিনিও ব্যাসি হ্যালহেডের মতোই ব্যাকরণটি সম্পূর্ণ ইংরেজিতে লিখেছিলেন। কেরি ব্যাকরণে বর্ণপরিচয়, যুক্তবর্ণ, শব্দ ও তার বিভিন্ন রূপ (বিশেষ্য), গুণবাচক শব্দ (বিশেষণ), সর্বনাম, ক্রিয়াপদ, শব্দ গঠন, সমাস, অব্যয় উপসর্গ, সন্ধিপ্রকরণ ও অন্বয় শিরোনামের ১১টি অধ্যায় ছিল। এ ছাড়া তাঁর রচিত বাংলা-ইংরেজি অভিধানে (১৮১৫-২৫) স্থান পেয়েছিল প্রায় ৮৫ হাজার শব্দ। 

১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দ শেষ হওয়ার আগেই কেরি ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এর সম্পূর্ণ অনুবাদ শেষ করেন। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কেরির সঙ্গে পঞ্চানন কর্মকারের পরিচয়, এর কিছুদিন পরই বাইবেল মুদ্রণের জন্য একটি কাষ্ঠনির্মিত মুদ্রাযন্ত্র নিলামে কিনে কেরিকে দান করেন ধর্মপ্রাণ মদনাবাটী কুঠির মালিক জর্জ উডনি। তবে কেরি যখন ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে টাইপ অর্ডার দেওয়ার জন্য কলকাতায় যাবেন বলে মনস্থির করেছেন, সে সময় জর্জ উডনি মদনাবাটী কুঠির কাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। বিপন্ন কেরি তাঁর সব সঞ্চয় দিয়ে নিকটবর্তী খিদিরপুর গ্রামে একটি নীলকুঠি ক্রয় করে সেখানে মুদ্রাযন্ত্রটি নিয়ে নতুন সংসার পাতেন। এদিকে মার্শম্যান, ওয়ার্ড, ব্রান্সডন, গ্রান্ট প্রভৃতি নতুন মিশনারির দল কলকাতায় আশ্রয় না পেয়ে ডেনিশ রাজ্য শ্রীরামপুরে আসে। মিশনারিরা ভবিষ্যতের কর্মপন্থা বিষয়ে কেরির মতামতের জন্য ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ ডিসেম্বর কেরির গৃহে পৌঁছান। নিজের ও মিশনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে কয়েক সপ্তাহ সময় নেওয়ার পর কেরি খিদিরপুরের সব সম্পত্তি পরিত্যাগ করে মুদ্রাযন্ত্র নিয়ে নৌকাযোগে ২৫ ডিসেম্বর শ্রীরামপুর অভিমুখে যাত্রা করেন। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি কেরির শুভাগমনে পত্তন হয় শ্রীরামপুর মিশনের এবং পরদিন ১১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় মিশনের কাজ। 

১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে এই শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশ পায় ‘মঙ্গল সমাচার মতীয়ের রচিত’। শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত এটাই ছিল প্রথম গদ্য পুস্তক। ১২৫ পৃষ্ঠার বইটির গদ্যভাষার নমুনা, ‘আবরাহামের সন্তান দাউদ তাহার সন্তান যিশু খ্রিষ্ট তাহার পূর্ব্ব পুরুষাখ্যান। আবরাহাম হইতে য়িসহকের উদ্ভব ও য়িসহক হইতে য়াকুবের উদ্ভব...

‘অতএব তোমরা এইমতো প্রার্থনা করহ হে আমারদের স্বর্গস্থ পিতঃ তোমার নাম পুণ্য করিয়ান মানা যাউক। তোমার রাজ্য আইসুক তোমার ইচ্ছা যে মত স্বর্গেতে সেই মত পৃথিবীতে পালিত হউক।’

১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরি যোগ দেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে। এখানে যুক্ত ছিলেন ১৮৩১ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলা ভাষাসংক্রান্ত ব্যাকরণ, অভিধান ও বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার পাশাপাশি বাংলা ও অন্যান্য বহু ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ ও প্রকাশ করেছিলেন।

১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরি যোগ দেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে। এখানে যুক্ত ছিলেন ১৮৩১ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলা ভাষাসংক্রান্ত ব্যাকরণ, অভিধান ও বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার পাশাপাশি বাংলা ও অন্যান্য বহু ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ ও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বাংলা হরফ সংস্কারেও বড় ভূমিকা রাখেন। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রসিদ্ধ সতীদাহ-নিবারক আইনের অনুবাদও তাঁর হাত ধরেই। মূলত শ্রীরামপুর ব্যাপস্টিট মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পর্বেই তিনি বাংলা গদ্যের বিকাশে সামনে থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কলেজের ছাত্রদের প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটাতে নিজে যেমন একের পর এক বইয়ের কাজ করেছেন, তেমনি স্থানীয় পণ্ডিতদেরও উৎসাহিত করেছেন। তাঁর সেই উদ্যোগ ও উৎসাহেই বাংলা গদ্য পায় প্রাথমিক রূপ। কেরির বিখ্যাত বই ‘কথোপকথন’ ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে প্রকাশিত। বইয়ের ভূমিকায় ‘৪ঠা আগস্ট’ তারিখ দেওয়া রয়েছে। কেরির রচিত বইগুলোর মধ্যে কথোপকথন বইটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এই বই যেমন বাংলা প্রবাদ ও প্রবচনের বৈচিত্র্যে ভরপুর, তেমনি সে যুগে মৌখিক ভাষা শেখার জন্য এর বিকল্প ছিল না। এই বইয়ে ‘চাকর ভাড়াকরণ’, ‘সাহেবের হুকুম’, ‘সাহেব ও মুনশি’, ‘ভোজনের কথা’, ‘যাত্রা’, ‘পরিচয়’, ‘ভূমির কথা’, ‘মহাজন আসামি’, ‘বাগান করিবার হুকুম’, ‘ভদ্রলোক ভদ্রলোক’, ‘মজুরের কথাবার্ত্তা’, ‘ঘটকালি’, ‘হাটের বিষয়’সহ মোট ৩১টি অধ্যায় আছে। বইয়ের বাঁ পাতায় মূল বাংলা এবং বইয়ের ডান পাতায় কেরির ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়েছে। এই বইয়ের ভাষার একটি উদাহরণ:

‘মজুরের কথাবার্ত্তা

‘ফলনা কায়েতের বাড়ী মুই কায করিতে গিয়াছিনু তার বাড়ী অনেক কায আছে। তুই যাবি।

‘না ভাই। মুই সে বাড়ীতে কায করিতে যাব না। তারা বড় ঠেঁটা। মুই আর বছর তার বাড়ী কায করিয়াছিলাম মোর দুদিনের কড়ি হারামজাদগি করিয়া দিলে না মুই সে বেটার বাড়ী আর যাব না।

‘কেন ভাই? মুইত দেখিলাম সে মানুষ বড় খারা মোকে আগু এক টাকা দিয়াছে আর কহিয়াছে তুই আর লোক নিয়া আসিস মুই আগাম টাকা দিব তাকে।

‘আচ্ছা ভাই। যদি তুই মোকে সে বাড়ী নিয়া যাবি, তবে মুই তোর ঠাঁই মোর খাটুনি নিব।

‘ভালো ভাই। তুই চল, তোর যত খাটুনি হবে তা মুই তোকে দিব।’

বাংলা গদ্যের প্রথম যুগকে এ জন্য অনেকে উইলিয়াম কেরির প্রভাবের যুগও বলেন। উইলিয়াম কেরির লেখা অন্য বইগুলো হলো ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ (১৮০১); ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট-মোশার ব্যবস্থা’ (১৮০২); ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত’ (১৮০২); ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট-দাউদের গীত’ (১৮০৩); ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট-ভবিষ্যদ্বাক্য’ (১৮০৭); ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট-য়িশরালের বিবরণ’ (১৮০৯); ‘ইতিহাসমালা’ (১৮১২)।

বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য তাঁহার পরিশ্রমের তুলনা হয় না। দীর্ঘ একচল্লিশ বৎসরকাল তিনি এই কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন এবং তাঁহারই উদ্যোগে ও উৎসাহে দেশীয় পণ্ডিতেরা বাংলা গদ্যের প্রাথমিক রূপ দান করিয়াছিলেন; বাংলা গদ্যের প্রথম যুগকে আমরা বিশেষভাবে উইলিয়াম কেরির প্রভাবের যুগ বলিতে পারি।শ্রীসজনীকান্ত দাস

‘উইলিয়াম কেরি’ জীবনীগ্রন্থের শুরুতে শ্রীসজনীকান্ত দাস লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের সহিত কয়েকজন বৈদেশিক পণ্ডিত ও কর্ম্মীর নাম যুক্ত হইয়া আছে। বাংলা গদ্যের গঠনের প্রারম্ভে ইঁহাদের উদ্যম ও অধ্যবসায় কোনো কালেই বিস্মৃত হইবার নহে। পর্তুগিজ প্রভাবের যুগে পাদরি মানুয়েল-দা-আসঁসুম্পসাম এবং ইংরেজ প্রভারের যুগে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড, জনাথন ডানকান, এন বি অ্যাডমনস্টোন, হেনরি পিটস ফরস্টার, জন টমাস ও উইলিয়াম কেরির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বস্তুত ইঁহাদের সহযোগিতা না থাকিলে বিজ্ঞান ও অভিধানের আশ্রয়ে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইতে বাংলা গদ্যের বিলম্ব ঘটিত। লজ্জার সহিতও এ কথা আজ আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে যে প্রধানতঃ এই সকল বৈদেশিক কর্ম্মীর চেষ্টায় বাংলা গদ্যসাহিত্যের গোড়াপত্তন হইয়াছে, ইঁহাদের উৎসাহে বাঙালী পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে সচেতন হইয়াছেন।

‘উপরি-উক্ত বৈদেশিক পণ্ডিত-সমাজে উইলিয়াম কেরি প্রধান এবং শ্রেষ্ঠ; বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য তাঁহার পরিশ্রমের তুলনা হয় না। দীর্ঘ একচল্লিশ বৎসরকাল তিনি এই কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন এবং তাঁহারই উদ্যোগে ও উৎসাহে দেশীয় পণ্ডিতেরা বাংলা গদ্যের প্রাথমিক রূপ দান করিয়াছিলেন; বাংলা গদ্যের প্রথম যুগকে আমরা বিশেষভাবে উইলিয়াম কেরির প্রভাবের যুগ বলিতে পারি।’

ধর্ম প্রচারের জন্য এলেও উইলিয়াম কেরি ভালোবেসেছিলেন বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলা ভাষাকে। সতীদাহ প্রথা বিলোপেও তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। উইলিয়াম কেরির মূল্যায়নে শ্রীসজনীকান্ত দাস লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে তিনি সব মিলিয়া একজন উইলিয়াম কেরি, কোনো অপ্রিয় তুলনার দ্বারা অথবা বৈদেশিকত্বের কারণ দর্শাইয়া আজ তাঁহার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা চলে না।...কেরিকে স্বীকার করার মধ্যে আমাদের পূর্ব্বপুরুষকে স্মরণের পুণ্য আছে।’ তিনি বাংলা ভাষাকে একটি বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টায় অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ র সজন ক ন ত দ স ন উইল য় ম ক র উইল য় ম ক র র কর ছ ল ন র জন য ত ত র জন য প রক শ ত ও উৎস হ কলক ত য় ব য করণ মদন ব ট গ রন থ অন ব দ ন কর ন আস স ম র জ বন পর ব র অবস থ বছর র এ সময় সময় প র একট আগস ট সময় র বইয় র

এছাড়াও পড়ুন:

২০২৬ বিশ্বকাপ: ৩২ দল নিশ্চিত, টিকিট পাওয়ার অপেক্ষায় ১৬

২০২৬ বিশ্বকাপকে ঘিরে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকো- এই তিন দেশে আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ে বসছে ফুটবলের ২৩তম মহাযজ্ঞ। ইতিহাসে এবারই প্রথম ৪৮ দল নিয়ে হতে যাচ্ছে টুর্নামেন্টের মূল পর্ব।

বাছাই পর্বের লড়াই শেষ হওয়ার আগেই বিশ্বকাপের টিকিট পকেটে পুরে ফেলেছে ৩২ দল। বাকি ১৬ জায়গা এখনো খোলা। যেগুলোর মালিকানা নির্ধারণ হবে মার্চের প্লে-অফে। সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে এখন চলছে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের শেষ ম্যাচ, দাবায় উত্তেজনাপূর্ণ গাণিতিক হিসাব।

আরো পড়ুন:

পূর্ণ ২৪ পয়েন্ট ও কোনো গোল হজম না করেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড

অদম্য স্পেন বিশ্বকাপের দোরগোড়ায়

ইউরোপে রোমাঞ্চ, ইতালির সামনে কঠিন পথ:
রবিবার ইউরোপিয়ান বাছাইয়ে দুই বড় জয়ের মধ্য দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে নরওয়ে ও পর্তুগাল। চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে নরওয়ে নিশ্চিত করেছে তাদের জায়গা। অন্যদিকে আর্মেনিয়ার জালে গোলের বন্যা বইয়ে ৯-১ ব্যবধানে বড় জয় তুলে নিয়ে টিকিট নিশ্চিত করেছে পর্তুগালও।

ইতোমধ্যে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়া, পর্তুগাল ও নরওয়ে জায়গা পেয়ে গেলেও স্পেন, জার্মানি, বেলজিয়ামদের অপেক্ষা এখনো শেষ হয়নি। আর ইতালিকে যেতে হবে মহাদেশীয় প্লে-অফের কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে।

এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকা: কোটা পূর্ণ
এশিয়া থেকে আটটি দল ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেছে- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, সৌদি আরব, জর্ডান, কাতার, উজবেকিস্তান। আরেকটি সুযোগ আছে প্লে-অফে। যেখানে লড়বে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরাক।

দক্ষিণ আমেরিকা থেকেও নির্ধারিত ছয় দলের সবাই জায়গা পেয়ে গেছে- আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর ও প্যারাগুয়ে। বলিভিয়া অপেক্ষায় আছে আন্তঃমহাদেশীয় প্লে-অফের।

আফ্রিকা তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ৯ দলের কোটা পূরণ করেছে- আলজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, মিশর, ঘানা, মরক্কো, তিউনিসিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেপ ভার্দে ও সেনেগাল। প্লে-অফে সুযোগ পেয়েছে কঙ্গো।

ওশেনিয়া ও কনকাকাফে শেষ লড়াই:
ওশেনিয়া অঞ্চলে নিশ্চিত হয়েছে নিউ জিল্যান্ড। নিউ ক্যালেডোনিয়া যাবে প্লে-অফে।

কনকাকাফে আয়োজক তিন দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকো আগেই নিশ্চিত। বাকি তিন আসনের দৌড়ে এগিয়ে আছে সুরিনাম, কুরাসাও ও হন্ডুরাস। দু’টি দল পাবে আন্তঃমহাদেশীয় প্লে-অফ খেলার সুযোগ।

চূড়ান্ত প্লে-অফ: মার্চে ভাগ্য নির্ধারণ
মার্চ ২০২৬ অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপের শেষ এবং সবচেয়ে নাটকীয় লড়াই- ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লে-অফ।

এখানের ৬ দলের মধ্য থেকে দুটি দল পাবে মূল পর্বের শেষ দুটি টিকিট।
অংশ নেবে—
১টি দল আফ্রিকা থেকে
১টি এশিয়া থেকে
২টি কনকাকাফ থেকে
১টি ওশেনিয়া থেকে
১টি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে।

এই ম্যাচগুলো আয়োজক দেশের মাঠে অনুষ্ঠিত হবে, টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি যাচাইয়ের অংশ হিসেবে।

৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপের ড্র:
সব দল চূড়ান্ত হওয়ার পর ৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্ঠান। এরপরই জানা যাবে কোন দল কোন গ্রুপে। আর কাদের বিপক্ষে শুরু হবে ফুটবলের পরবর্তী মহাযুদ্ধ। 

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ