খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এখনো হলে উঠতে পারেননি। বাধ্য হয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে একটি ছাত্রীনিবাসে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। এ জন্য প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাইরে থাকলে খাওয়ার সমস্যা, পানির সমস্যা, যাতায়াতের সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা নিরাপত্তা। চুরির আশঙ্কা থাকে। তার ওপর ভাড়া তো অতিরিক্ত গুনতেই হচ্ছে। হলে সিট না পেয়ে আমরা নানা দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন অপরাজিতা হলের অনাবাসিক আরেক ছাত্রী। তিনিও নাম গোপন রাখার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা হলে থাকাকেই নিরাপদ মনে করি। ক্যাম্পাসের মধ্যে পড়াশোনা করা সুবিধাজনক। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর সিট পেতে দেরি হয়। তখন বাধ্য হয়ে বাইরে থাকতে হয়। নিরাপত্তাহীনতা তো থাকেই, পড়াশোনায়ও মনোযোগ নষ্ট হয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দেওয়া হিসাব বলছে, বর্তমানে অধ্যয়নরত প্রায় ৬৩ শতাংশ ছাত্রী হলে সিট না পেয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ছাত্রদের অবস্থা আরও করুণ; তাঁদের প্রায় ৭৩ শতাংশকে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্যাম্পাসের বাইরে থাকার কারণে তাঁরা সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক থাকছেন। ভাড়াসহ যাতায়াতে বাড়তি খরচ পরিবারকে ফেলছে চাপের মধ্যে।

আবাসনসংকট নিরসনের জন্য শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়েছেন। গত বছরের ২৭ অক্টোবর ‘দাবি উত্থাপন মঞ্চে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে শিক্ষার্থীরা ৩৭ দফা দাবি তুলে ধরেন। এতে নিরাপদ ও আধুনিক সুযোগসহ শতভাগ আবাসন নিশ্চিতকরণ, হলের শৃঙ্খলাবিধি পুনর্লিখন, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এবং সারা বছর হল খোলা রাখার দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

প্রাধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক খসরুল আলম বলেন, ‘তিনটি ১০ তলা হলের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে—খান জাহান আলী ও অপরাজিতা হলে এক্সটেনশন এবং একটি নতুন হল। এতে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা হবে।’ সংকট সামলানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখনই কিছু করার নেই। আবাসন ভাতা বা এ রকম খাত আমাদের নেই।’

শিক্ষার্থী বেড়েছে, বাড়েনি হল

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯টি ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) ১৩টি হয়েছে ২০০৯ সালের পরে। অথচ একই সময়ে হল হয়েছে মাত্র দুটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ছাত্রীদের জন্য নতুন হল বিজয়-২৪ চালু হয় ২০১৬ সালে। আর ছেলেদের জন্য সর্বশেষ হল বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন হল চালু হয়েছে তারও এক বছর আগে, ২০১৫ সালে। ওই সময়ের পর আরও পাঁচটি নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-সংক্রান্ত গত পাঁচ শিক্ষাবর্ষের তথ্য বলছে, ছাত্রী ভর্তির হার দিন দিন বাড়ছে। গত তিন বছরে স্নাতক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪৯ শতাংশ ছাত্রী। গত দুই বছরে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর ৪৩ শতাংশই ছাত্রী। গত পাঁচ বছরে ছাত্রীদের ভর্তির হার ৩৯ শতাংশের নিচে নামেনি। সে অনুপাতে তাঁদের আবাসনসুবিধা বাড়েনি।

ফলে বর্তমানে অধ্যয়নরত প্রায় ৬৩ শতাংশ ছাত্রী হলে সিট না পেয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সিট না পাওয়া ছাত্রদের হার আরও বেশি—প্রায় ৭৩ শতাংশ।

বাংলা ডিসিপ্লিনের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শিহাব হোসেন বলেন, ‘তৃতীয় বর্ষেও হলে সিট পাইনি। হলে সিট না পেয়ে বাধ্য হয়ে অনেক টাকা দিয়ে রুম ভাড়া নিতে হয়। বাইরে থাকলে নিরাপত্তার শঙ্কা অনেক বেশি। মেসের পাশের রুমের একজনের ফোন-ল্যাপটপ সব নিয়ে গেছে চুরি করে। যেকোনোভাবে হলে থাকতে চাই। প্রশাসন যদি নতুন হল নির্মাণের ব্যবস্থা করত, তাহলে শিক্ষার্থীদের এ সমস্যা সমাধান হতো।’

বর্তমানে অধ্যয়নরত প্রায় ৬৩ শতাংশ ছাত্রী হলে সিট না পেয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সিট না পাওয়া ছাত্রদের হার আরও বেশি—প্রায় ৭৩ শতাংশ।

‘সোনার হরিণ পাওয়ার মতো’

বর্তমানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯ হাজার ১৪৭ জন। এর মধ্যে ৫ হাজার ৩১ জন ছাত্র, ৪ হাজার ১১৬ জন ছাত্রী। ছাত্রদের জন্য তিনটি হলে সিট আছে ১ হাজার ৩৬৪টি। অন্যদিকে দুটি হলে ১ হাজার ৫৫০টি সিট রয়েছে ছাত্রীদের জন্য। অর্থাৎ প্রায় চারজন ছাত্রের এবং তিনজন ছাত্রীর জন্য একটি করে সিট রয়েছে।

ছাত্রীদের সবচেয়ে বড় হল বিজয়-২৪। ২০১৬ সালে চালু হওয়া ছয়তলা এই হলে দুটি ব্লক আছে। প্রতিটি ফ্লোরে ১৮টি কক্ষ। মোট ২১৬টি কক্ষে ৮৬৪ জন ছাত্রী থাকেন। ১৯৯৫ সালে নির্মিত প্রথম ছাত্রী হলের নাম ছিল ‘ছাত্রী হল’, পরে ২০০৭ সালে নাম হয় ‘অপরাজিতা’। চারতলা এই হলে সিট আছে ৬৮৬টি।

ছেলেদের প্রথম হল ‘খান জাহান আলী’, ১৯৯৫ সালে নির্মিত। ১২৯টি কক্ষে ৪০৪টি আসন রয়েছে। ২০০২ সালে নির্মিত দ্বিতীয় ‘ছাত্র হল’-এর নাম ২০০৬ সালে হয় ‘খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ হল’। এর আসনসংখ্যা ৩৮৪। ২০১৫ সালে নির্মিত তৃতীয় হলের নাম রাখা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, পরে ২০২৫ সালে নামকরণ হয় বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন হল। এতে ১৪৪ কক্ষে ৫৭৬টি সিট রয়েছে।

সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের ২২ ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তফা কামাল দীর্ঘ অপেক্ষার পর খান জাহান আলী হলে সিট পেয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের সকাল নয়টা-দশটা থেকে ক্লাস শুরু হয় আর শেষ হয় পাঁচটায়। একটা দীর্ঘ সময় পর হলে সিট পেয়েছি, সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। হলের বাইরে থেকে পড়ালেখা করা খুবই কষ্টের। আমরা যারা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের, তাদের জন্য বাইরে থেকে থাকা-খাওয়ার টাকা ম্যানেজ করা খুবই কঠিন।’

আরও কয়েকটা হল বাড়ানোর ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প) প্রস্তুত করা হচ্ছে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক পরিচালক অধ্যাপক নাজমুস সাদাত বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের জন্য ২০৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ দরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল যে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ একরের বেশি জায়গা পাবে না। আমাদের ১০৬ একর জায়গা আছে। আগের সরকারের এই নিপীড়নমূলক সিদ্ধান্তের কারণে ঝামেলা হচ্ছে। আমরা লেগে আছি।’

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা মানে নিরাপত্তাহীনতা, বাড়তি খরচ আর মানসিক চাপ। প্রশাসনের উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়িত না হলে সংকট আরও বাড়বে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জন ছ ত র দ র জন য প রথম সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

ফ্লোটিলা বহরে ভেসে চলা একমাত্র জাহাজ ম্যারিনেট কোথায়

ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখে যাত্রা করা ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’-এর একটি মাত্র নৌযান এখনো আটক করতে পারেনি ইসরায়েলি বাহিনী। এই নৌযানটি হলো দ্য ম্যারিনেট।

পোল্যান্ডের পতাকাবাহী এই নৌযানে ছয়জন আরোহী রয়েছেন ।

ফ্লোটিলার লাইভ ট্র্যাকার অনুযায়ী, ম্যারিনেট আন্তর্জাতিক জলসীমায় ভেসে চলেছে। এর গতি ঘণ্টায় প্রায় ২.১৬ নট (ঘণ্টায় প্রায় ৪ কিলোমিটার) , গাজার আঞ্চলিক জলসীমা থেকে ম্যারিনেটের দূরত্ব  প্রায় ১০০ কিলোমিটার।

বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে জাহাজটির ক্যাপ্টেন বলেন, ম্যারিনেটের ইঞ্জিনে সমস্যা হচ্ছিল। এটি  এখন সারানো  হয়েছে।

ফ্লোটিলা আয়োজকেরা বলছেন, ম্যারিনেট নৌযান এখনো স্টারলিঙ্কের মাধ্যমে সংযুক্ত। এটি যোগাযোগের আওতার মধ্যেই রয়েছে। লাইভস্ট্রিমও সক্রিয় আছে।  

ইনস্টাগ্রামে দেওয়া এক পোস্টে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা জানিয়েছে, অন্য জাহাজগুলো আটক করলেও ম্যারিনেট এখনো ভেসে চলছে।

ম্যারিনেট ফিরে যাবে না বলেও ওই পোস্টে জানানো হয়েছে।  পোস্টে বলা হয়েছে, ‘ম্যারিনেট শুধু একটি জাহাজ নয়। ম্যারিনেট হলো ভয়, অবরোধ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ়তা।’

ফ্লোটিলা আয়োজকরা আরও লিখেছেন, ‘গাজা একা নয়।’ ‘ফিলিস্তিনকে কেউ ভুলে যায়নি। আমরা কোথাও যাচ্ছি না।’

ফ্লোটিলা বহরের প্রায় সব নৌযানে থাকা অধিকারকর্মীদের আটক করেছে ইসরায়েল। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। ইসরায়েলের এমন পদক্ষেপকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছে অনেক দেশ। বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভও হয়েছে।

আরও পড়ুনগাজা অভিমুখী নৌবহরে ইসরায়েলি সেনাদের আক্রমণ, ধরে নেওয়া হলো অধিকারকর্মীদের৬ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ