জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী তাকাইচিকে কতটা জানেন
Published: 5th, October 2025 GMT
জাপানের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি হলো। দেশটির ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) শনিবার সানায়ে তাকাইচিকে নতুন সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করেছে। তাকাইচিই কার্যত জাপানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। প্রথমবারের মতো দেশটি পাচ্ছে নারী প্রধানমন্ত্রী।
জাপানের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে জানিয়েছে, ৬৪ বছর বয়সী তাকাইচি দলের পার্লামেন্ট সদস্য ও বর্তমান সদস্যদের ৩৪১ ভোটের মধ্যে ১৮৫টি পেয়েছেন। ভোটের লড়াই শেষ পর্যন্ত রানঅফে গড়ায়। তাকাইচির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ৪৪ বছর বয়সী শিনজিরো কোইজুমি। তিনি জিতলে জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী প্রধানমন্ত্রী হতেন।
বিজয়ের পর তাকাইচি বলেন, ‘শুধু উদযাপন করলেই চলবে না, আসল চ্যালেঞ্জ এখন শুরু। সামনে পাহাড়সম কাজ অপেক্ষা করছে, সবার সহযোগিতা নিয়েই তা মোকাবিলা করতে হবে। আমি চেষ্টা করব এলডিপিকে এমন একটি ইতিবাচক দলে রূপ দিতে, যে দলটি মানুষের দুশ্চিন্তা দূর করে আশাবাদ তৈরি করবে।’
পার্লামেন্টে ভোটের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকাইচি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার স্থলাভিষিক্ত হবেন। গত মাসে নির্বাচনী পরাজয়ের দায় নিয়ে ইশিবা পদত্যাগ করেন। ২০২৪ সালে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এলডিপি টানা দুটি নির্বাচনে হেরে যায়। ১৯৫৫ সালের পর প্রথমবারের মতো দলটি ও তার জোট সংসদের দুই কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং বর্তমানে তারা সংখ্যালঘু সরকার পরিচালনা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক কেলেঙ্কারির কারণে এলডিপির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাধারণত মধ্য-ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত এলডিপির নেতৃত্বে এবার অতিডানপন্থী তাকাইচি আসছেন এমন এক সময়ে, যখন দলে সংস্কারের দাবি বাড়ছে এবং ভোটাররা ক্রমশ দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকছেন।
জাপানের পুরুষ-আধিপত্যের রাজনীতিতে তাকাইচির এই বিজয় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তবে নারীর ক্ষমতায়নে দেশটির অবস্থান এখনও হতাশাজনক। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০২৫ সালের বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য সূচকে ১৪৮ দেশের মধ্যে জাপানের অবস্থান ১১৮তম। জি-৭ সদস্য দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সূচকে জাপানের অবস্থান আরও খারাপ।
২০২৫ সালের নির্বাচনে তাকাইচি প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁর মন্ত্রিসভা ও এলডিপির নির্বাহী কমিটিতে নর্ডিক দেশগুলোর মতো নারীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। অথচ বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইশিবার মন্ত্রিসভায় নারী সদস্য ছিলেন মাত্র দুজন, আর জাপানের সংসদে নারী সদস্যের সংখ্যা এখনো ১৫ শতাংশের উপরে নয়।তবে তাকাইচির বিজয় জাপানি নারীদের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বয়ে আনবে, এমনটা এখনও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। বরং বিশেষজ্ঞদের মতে, কঠোর রক্ষণশীল তাকাইচি বরাবরই ‘পুরুষসুলভ আচরণ’ করেন এবং তাঁকে অনেকেই সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে তুলনা করেন।
টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ের টোকিও ক্যাম্পাসের এশীয় অধ্যয়ন ও ইতিহাসের অধ্যাপক জেফ কিংস্টন টাইমকে বলেছেন, ‘লিঙ্গ বিষয়ক নীতি, পরিবারবান্ধব পদক্ষেপ কিংবা নারীর ক্ষমতায়নে তাকাইচির রেকর্ড খুব একটা ইতিবাচক নয়। তিনি দলের ডানপন্থী অংশ থেকে উঠে এসেছেন, যেখানে রক্ষণশীল পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ওপরই জোর দেওয়া হয়।’
জাপানের পশ্চিমাঞ্চলের নারা প্রিফেকচারে জন্ম সানায়ে তাকাইচির। তাঁর বাবা উৎপাদন কোম্পানির একজন কর্মী এবং মা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৮৪ সালে তিনি কোবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি নেন। ১৯৮৭ সালে কংগ্রেশনাল ফেলোশিপের অংশ হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এক বছর কাটান এবং সে সময় তিনি প্রয়াত নারীবাদী মার্কিন কংগ্রেসওম্যান প্যাট শ্রোডারের অধীনে কাজ করেন।
রাজনীতিতে প্রবেশের আগে তাকাইচি কিছুদিন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। সে সময় তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিম্নকক্ষে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি এলডিপিতে যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি টানা নয়বার পার্লামেনট সদস্য হয়েছেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাকাইচি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে। শিনজো ডানপন্থী রাজনীতির জন্য পরিচিত ছিলেন, আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। আবের প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকাল তাকাইচি পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যার মধ্যে একটি ছিল লিঙ্গসমতা ও জন্মহারসংক্রান্ত নীতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি-বিজ্ঞানী হিরোকো তাকেদা লিখেছেন, সেই সময় তাকাইচি পরিবারনীতি সংস্কারে ‘প্রথাগত’ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতেন।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে তাকাইচি এলডিপির নীতি-গবেষণা পরিষদের চেয়ারপারসন হন। ২০২৪ সালে তিনি শিনজো আবের সরকারে স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
তাকাইচি এর আগে ২০২১ ও ২০২৪ সালে দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। ২০২১ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘এলডিপিতে নারী প্রার্থী হওয়া মানে যেন একটি পিঁপড়া হাতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। এটাই হয়তো সবাই ভাবেন। আমি যখন প্রথমবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি, তখন নারী হওয়া ছিল এক ধরনের অসুবিধা। তবে এখনকার পরিস্থিতি ৩০ বছর আগের তুলনায় অনেক ভিন্ন।’
২০২৫ সালের নির্বাচনে তাকাইচি প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁর মন্ত্রিসভা ও এলডিপির নির্বাহী কমিটিতে নর্ডিক দেশগুলোর মতো নারীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। অথচ বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইশিবার মন্ত্রিসভায় নারী সদস্য ছিলেন মাত্র দুজন, আর জাপানের সংসদে নারী সদস্যের সংখ্যা এখনো ১৫ শতাংশের উপরে নয়।
জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকেদা টাইমকে বলেন, এ বছরের প্রচারে তাকাইচি তাঁর লিঙ্গ পরিচয়কে সামনে এনেছেন, যা আগে কখনো করেননি। তবে সমালোচকেরা মনে করছেন, অতীতে নারীবান্ধব নীতিতে তাকাইচির অবস্থান খুব একটা ইতিবাচক না হওয়ায় এই প্রচেষ্টা অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়।
দ্য টাইম ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
চ্যাড দে গুজম্যান টাইম প্রতিবেদক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এলড প র ন র অবস থ ন র র জন ত ড নপন থ সদস য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
‘উপদেষ্টাদের অনেকেই সেইফ এক্সিটের কথা ভাবতেছে’, নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য নিয়ে আলোচনা
‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে, তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের (নিরাপদ প্রস্থান) কথা ভাবতেছে’—সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নানা আলোচনা–সমালোচনা চলছে।
বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও অ্যাকাউন্ট থেকে নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্যের ভিডিও ও ফটোকার্ড পোস্ট করা হয়েছে। এসব পোস্টে পক্ষে–বিপক্ষে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় একাত্তর টেলিভিশনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ–সংক্রান্ত যে ফটোকার্ড পোস্ট করা হয়েছে, সেখানে আজ রোববার রাত ৯টা পর্যন্ত ১২ হাজার ব্যবহারকারী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আর ১ হাজার ৪০০টি মন্তব্য করা হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক দফা ঘোষণা করেছিলেন সে সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হয়েছিলেন তিনি। গত ফেব্রুয়ারিতে সরকার থেকে পদত্যাগ করে এনসিপির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন নাহিদ। অবশ্য ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে যোগ দেওয়া মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া এখনো উপদেষ্টা রয়েছেন।
টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, তাঁরা কেউ সরকারের উপদেষ্টা পদে যেতে চাননি। তাঁরা জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেটা হলে ছাত্রদের দায়িত্ব নিতে হতো না। রাজনৈতিক শক্তি বা অভ্যুত্থানের শক্তি সরকারে না থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার তিন মাসও টিকত না। প্রথম ছয় মাস সরকারকে উৎখাত করা বা প্রতিবিপ্লব করার নানা ধরনের চেষ্টা চলমান ছিল। এটা এখনো মাঝেমধ্যে আছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নেতাদের এবং যাঁরা উপদেষ্টা হয়েছেন, তাঁদের অনেককে বিশ্বাস করাটা আমাদের অবশ্যই ভুল হয়েছিল। আমাদের উচিত ছিল ছাত্র নেতৃত্বকেই শক্তিশালী করা, সরকারে গেলে সম্মিলিতভাবে যাওয়া। নাগরিক সমাজ বা রাজনৈতিক দলকে আমরা যে বিশ্বাসটা করেছিলাম, যে আস্থা রেখেছিলাম, সেই জায়গায় আসলে আমরা প্রতারিত হয়েছি। অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছে অথবা গণ–অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিট্রে (প্রতারণা) করেছে। যখন সময় আসবে, তখন আমরা এদের নামও উন্মুক্ত করব।’
সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম আরও বলেছেন, ‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে। তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবতেছে। এটা আমাদের অনেক পোহাতে হচ্ছে এবং পোহাতে হবে। কিন্তু তারা যদি এটা বিশ্বাস করত যে তাদের নিয়োগকর্তা ছিল গণ–অভ্যুত্থানের শক্তি, রাজপথে নেমে জীবন দেওয়া ও আহত সাধারণ মানুষজন এবং তারা যদি তাদের ওপর ভরসা করত, তাহলে উপদেষ্টাদের এই বিচ্যুতি হতো না।’
এসব বক্তব্যের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আজ রোববার রাতে মুঠোফোনে নাহিদ ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল প্রথম আলো। তবে তিনি সাড়া দেননি।