গণভোটের প্রশ্ন নিয়েও ঐকমত্য প্রয়োজন
Published: 8th, October 2025 GMT
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নে একটি গণভোট অনুষ্ঠানে একমত হয়েছে। গণভোটের বিষয়টি এখন আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম আলোচিত বিষয়।
গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম, জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া উচিত হবে না। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অন্যতম বড় ঘটনা। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা এখন একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে রয়েছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই সনদের একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে এবং তা একটি যৌক্তিক দাবি।
প্রথমত, জুলাই সনদ রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি বড় মাপের রাজনৈতিক দলিল। রাজনৈতিক দলগুলো একে গণভোটের মাধ্যমে জনগণ কর্তৃক সমর্থন লাভের যে প্রস্তাব করেছে, তা সাংবিধানিকভাবে বৈধ। সেই বৈধতার ভিত্তি হচ্ছে আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১), যাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ—এই মর্মে স্বীকৃতি রয়েছে।
আরও পড়ুনদুর্বোধ্য প্রস্তাবে গণভোট জনগণের প্রতি অবিচার১ ঘণ্টা আগেএখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই গণভোটের প্রস্তাবনা বা প্রশ্নটি কী হবে এবং গণভোট কখন ও কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে? পৃথিবীজুড়ে গণভোটের ইতিহাস বেশ পুরোনো। একটু ভিন্ন আঙ্গিকে গ্রিক নগররাষ্ট্রে খ্রিষ্টপূর্ব সময়েও গণভোটের প্রচলন দেখা গেছে। ম্যাট ভরট্রুপ নামে এক সংবিধান বিশারদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অন দ্য রেফারেনডাম অ্যান্ড আদার এসেস অন কনস্টিটিউশনাল পলিটিকস বইয়ে ১৪০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণভোটের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ম্যাট ভরট্রুপ তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন, গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী—উভয় ধরনের সরকারই তাদের নিজেদের স্বার্থে গণভোটকে ব্যবহার করেছে। সাধারণত রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন কিংবা নাটকীয় কোনো সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য গণভোট ব্যবহৃত হয়েছে।
আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম দুবার হয়েছে সংবিধানবহির্ভূত সামরিক সরকারের বৈধতা অর্জনের জন্য। তৃতীয় গণভোট ছিল সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদের আলোকে দ্বাদশ সংশোধনী নিয়ে। এই গণভোটের উদ্দেশ্য ছিল, সংসদীয় সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের ক্ষেত্রে জনগণের সিদ্ধান্ত জানা। আমার জানামতে, প্রথম দুটি গণভোট অনুষ্ঠানের সময় গণভোট-সংক্রান্ত কোনো আইন বা অধ্যাদেশ ছিল না। তবে তৃতীয় বা শেষ গণভোটের জন্য ১৯৯১ সালের আগস্টে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়।
আরও পড়ুনসংসদকে দ্বৈত ভূমিকা দেওয়ার সুপারিশ করতে পারে কমিশন ২ ঘণ্টা আগেএকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে, বর্তমানে আলোচিত গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য আইনের প্রয়োজন হবে কি না? আমার মতে, গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য গণভোট-সংক্রান্ত আইনের আবশ্যকতা নেই। আইন ছাড়াও গণভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে। গণভোটে উত্থাপিত প্রশ্ন জনগণ কর্তৃক গৃহীত বা প্রত্যাখ্যাত হলে তা জনগণের রায় বলে বিবেচিত হবে এবং পরবর্তী কার্যক্রম বৈধতা পাবে।
তবে গণভোটের প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য এ-সংক্রান্ত একটি আইন সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি গণভোট আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। আরেকটি উপায় হলো ১৯৯১ সালের গণভোট আইনটি সংশোধন করা। আইনটি এখন শুধু সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য; এটি সংশোধন করে সব ধরনের গণভোটের জন্য প্রয়োগের বিধান করা যেতে পারে।
যদি জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেটা সাধারণ নির্বাচনের সময় একসঙ্গেই করতে হবে। সাধারণ নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন করা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে যথাযথ হবে না। কেননা আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত সাধারণ নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন করা ব্যয়বহুল একটি বিষয়। তা ছাড়া এ রকম একটি গণভোট আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনের হাতে যথেষ্ট সময়ও নেই।
আরও পড়ুনগণভোটে ঐকমত্য, তবে সেটা কখন তা নিয়ে বিএনপি–জামায়াতের ভিন্ন মত০৫ অক্টোবর ২০২৫জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের আয়োজন একটি জটিল বিষয়। পৃথিবীর সব দেশেই গণভোটের প্রশ্নটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ আকারে উপস্থাপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক গণভোটগুলো এভাবেই হয়েছে। জুলাই সনদে অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বা হবে। জুলাই সনদের জটিল বিষয়গুলো গণভোটে কীভাবে প্রশ্ন আকারে উপস্থাপিত হবে, সেই বিষয়েও ঐকমত্য প্রয়োজন। গণভোটের প্রশ্ন জনগণকে অবহিত করা সরকারের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব। জুলাই সনদ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই দীর্ঘসূত্রতা একটি সফল গণভোট আয়োজনের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
গণভোটের প্রক্রিয়া ও বিষয়বস্তুর ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার গুরুত্ব বোঝার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ওই গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানের যেকোনো সংশোধনীর জন্য গণভোটের প্রয়োজন হয়। ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার ওই গণভোটের প্রশ্নটি একটু দীর্ঘ ও অস্পষ্ট ছিল। ফলে জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও বিভাজন সৃষ্টি হয় এবং গণভোটটি প্রত্যাখ্যাত হয়।
কাজেই জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের আয়োজন করতে হলে অত্যন্ত দক্ষতা ও বিবেচনার সঙ্গে গণভোটের প্রশ্ন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা আগেই ঠিক করতে হবে; এ ব্যাপারে জনগণকেও সচেতন করতে হবে। গণভোটের প্রশ্ন ও প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।
রিদওয়ানুল হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও সংবিধানবিশেষজ্ঞ।
[মতামত লেখকের নিজস্ব]
আরও পড়ুনজুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে একমত০৫ অক্টোবর ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ট অন ষ ঠ ন র ই গণভ ট র জ ল ই সনদ অন ষ ঠ ত ন র জন য জনগণ র ঐকমত য আম দ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শঙ্কা ও ভীতি দূর না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে আরো বলিষ্ঠ ও স্বচ্ছ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেছেন, “নাগরিকদের মনে এখনো যে শঙ্কা ও ভীতি রয়েছে, তা দূর করা না গেলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়।”
আরো পড়ুন:
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা না গেলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি বাধাগ্রস্ত হবে: বিআরটিএ চেয়ারম্যান
অপশক্তি নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না: আইজিপি
বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) খুলনায় এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ আয়োজিত আঞ্চলিক পরামর্শ সভায় তিনি এ আহ্বান জানান। সকালে নগরীর হোটেল সিটি ইন-এ এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “জনগণ আস্থা না পেলে নির্বাচন গণতান্ত্রিক রূপ পায় না। মুক্ত আলোচনা, স্বচ্ছতা ও সততার ভিত্তিতে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার আজ সময়ের দাবি। দেশ নির্বাচনমুখী হয়ে উঠছে, নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী। আমরা কেমন নির্বাচন পাব- সেই প্রশ্ন জনগণের মনে রয়ে গেছে।”
খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভাবনা বহুদিন ধরে আলোচিত হলেও বাস্তবায়ন এখনো দৃশ্যমান নয়। পদ্মা সেতু চালুর পরে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জমির মূল্য বৃদ্ধি পেলেও কর্মসংস্থান বা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি বাড়েনি; সভায় এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন নাগরিকরা বলে জানান তিনি।
সিপিডির আহ্বায়ক বলেন, “নতুন প্রজন্মের শ্রমিককে আকৃষ্ট করতে অঞ্চলভিত্তিক শিল্পায়ন জরুরি। খুলনা অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্প, চিংড়ি ও মাছ উৎপাদন এবং পর্যটন খাতে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। সুন্দরবন ও সাংস্কৃতিক সম্পদকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠা সম্ভব।” এ বিষয়গুলো সভায় আলোচিত হয়েছে বলেও তিনি জানান।
খুলনা অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “এলাকা থেকে যারা নির্বাচন করবেন, তাদের অবশ্যই আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে দিতে হবে। নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম পরবর্তীতে এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে জবাবদিহিতা তৈরি করবে।”
“রপ্তানিমুখী অর্থনীতির জন্য দক্ষ বন্দর ব্যবস্থা অপরিহার্য। প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ জরুরি হলেও তা অবশ্যই স্বচ্ছ পদ্ধতিতে হতে হবে”, যোগ করেন তিনি।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “সঠিক সংস্কার যদি বেঠিক পদ্ধতিতে করা হয়, তাহলে তার সুফল পাওয়া যায় না। বন্দর সংস্কারে যে দ্রুততা ও অস্বচ্ছতা দেখা গেছে, তাতে ভালো উদ্যোগও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে।”
ড. দেবপ্রিয় জোর দিয়ে বলেন, “সংস্কার প্রয়োজন, বিনিয়োগও প্রয়োজন; কিন্তু তা হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, উন্মুক্ত আলোচনা ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তাহলেই সংস্কার টেকসই হবে।”
সভায় আগামী নির্বাচনের প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের কাছে নাগরিক নেতৃবৃন্দ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- নিরাপদ সড়ক, শিল্পের উন্নয়ন, পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জনসহ সুন্দরবনের পর্যটন শিল্পের বিকাশ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি। সভায় সমাপনী বক্তৃতা করেন সিপিডির ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর খুলনা মহানগর আমির অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর খুলনা মহানগর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শেখ মো. নাসির উদ্দিন, এনসিপির ডা. আব্দুল্লাহ চৌধুরী।
ঢাকা/নূরুজ্জামান/মাসুদ