সৃজনশীল সাহিত্য, বিশেষত ছোটগল্প দ্বিবিধ প্রক্রিয়ায় রচিত হয়, বানিয়ে ও ঘটিয়ে। বানিয়ে তোলা ছোটগল্পের আবেদন অপ্রতুল। ধ্রুপদী সাহিত্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক সাংঘর্ষিক না হলেও প্রীতিপ্রদ ও টেকসই নয়। অপরদিকে, ঘটিয়ে তোলা ছোটগল্প পাঠককে ঘটনার সাথে একাত্ম করে নিবিড় পর্যবেক্ষক কিংবা সহযাত্রীতে রূপান্তর করে। ঘটিয়ে তোলা কৌশলের অর্থবহ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রক্ষিত হয়, সাহিত্যের শিল্পমান। প্রশ্ন হলো, এই বিষয়ে অবতারণা কেন? আর তার শানেনযুলই বা কী? 

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প পাঠান্তে বানিয়ে তোলা ও ঘটিয়ে তোলার প্রসঙ্গ হাজির হয়েছে। তাঁর গল্প মূলত: ঘটিয়ে তোলা পদ্ধতির আশ্রয়ে রচিত। তিনি জ্ঞাত হোক কিংবা অজ্ঞাতসারে এ পদ্ধতির যথার্থ ও স্বার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। যা এই সময়ের গল্পভুবনের বাইরে স্বাতন্ত্র্য এক সত্তায় উদ্ভাসিত হয়েছে পাদপ্রদ্বীপের আলোয়। ছোটগল্পের সারাৎসার বলতে প্রচলিত ও অর্থবহ যে ধারণা, বোধ ও ইমেজ রয়েছে, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প সেসব আবেদন পূরণ করার পরও সৃষ্ট করেছে অন্যরকম এক আবহ ও আবেদন। এ কারণে তাঁর গল্পে ছোটগল্পের যে জার্নি তার উপস্থিতি থাকলেও বর্তমানের প্রাসঙ্গিকতা উৎকীর্ণ হয়েছে অনিবার্যভাবে। ‘হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে কাজ করে যাও গোপনে গোপনে’ রবীন্দ্রনাথের এই উপদেষণা সৈয়দ মনজুরের গল্পে চিত্রিত হয়েছে নানাভাবে। এ কারণে তাঁর গল্প সমকালীন ও চিরায়ত সাহিত্যের আধার ও আধেয় রূপে পালন করেছে আগ্রহদ্দীপক ভূমিকা।

‘সুখ-দুঃখের গল্প’র ২০টি গল্প এই লেখার প্রধান উপজীব্য। যাকে সমতলে রেখে বিস্তার করা হয়েছে আলোচ্য লেখার শাখা প্রশাখা। অবশ্য, লেখকের সামগ্রিক সত্তাকে উপলব্ধিপূর্বক জার্নিটা অনুধাবন ও মূল্যায়নের নিরীখে আমাদের উদ্দিষ্ট বইয়ের বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। অবশ্য, সুখ-দুঃখের গল্পই প্রধান আলোচ্য। প্রধান এ কারণে যে, পরম্পরা এবং সৃজনশীলতার অন্তর্নিহিত বাস্তবতাকে উপলব্ধির জন্য আমাদের সকল মনোযোগ এখানে নিবিষ্ট হলেও পরিধির বাইরের প্রসঙ্গ ও প্রকরণ সমূহকেও কখনও কখনও বিবেচনায় রাখতে হবে অভিমুখ অন্বেষনের জন্য।

ছোটগল্প সাহিত্যের নবীনতম সহযাত্রী। বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের কনিষ্ঠতম এই শাখা; পাঠকপ্রিয়তা (আমপাঠককে এই জরিপের বাইরে রাখাই শ্রেয়) ও আপন শক্তি সৌন্দর্যে নিরীখে ও তাৎপর্য বিচারে কনিষ্ঠ তো নয়ই, কখনো কখনো জ্যেষ্ঠকেও ছাড়িয়ে যায় কিংবা সর্বাগ্রে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করে। আমপাঠক, কিংবা হঠাৎ সাহিত্য সমঝদারদের জন্য ছোটগল্প পাঠ সুখকর ও তৃপ্তিদায়ক অভিজ্ঞতার জন্য সাংঘর্ষিক ও বৈরী। সাহিত্যের প্রধান দুটি ধারা হলো, সৃজনশীল ও মননশীল। সাহিত্যের যে কোনো অংশ বা শাখাকে স্থান দেয়া হয় এই দুই ধারায়। সাহিত্যের স্বরূপ ও প্রকৃতি নিরূপণে ছোটগল্পের অবস্থান সৃজনশীল শাখায় (?)। যদিও বিষয়টা এতটা সহজ ও সরলরৈখিক নয়। এর উত্তর নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেয়াও সম্ভব নয়।

বার্ট্রান্ড রাসেলে সংশয়বাদ এখানে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। সুলুকসন্ধান করতে হয়, গৌতম বুদ্ধের মধ্যমপন্থার। সমাধান খুঁজতে হয় সংশয়, মধ্যমপন্থা প্রভৃতির আলোকে। কারণ, সাহিত্যের অন্যান্য শাখাকে যত সহজে ও নির্দ্বিধায় ধারাশ্রয়ী করা যায়, ছোটগল্পের ক্ষেত্রে ততটা নয়। আজকাল অবশ্য, বাজার চলতি সাহিত্যের স্রোতে এবং সর্ববিদ্যা পারদর্শী সাহিত্যিকের উপর্যুপরি আবির্ভাবের কারণে ছোটগল্পকে ঘিরে সৃষ্ট এই সংশয়বাদ ও মধ্যমপন্থা লুপ্ত হতে বসেছে। অথচ এই সংশয়বাদই হলো ছোটগল্পের অজেয় শক্তি ও সৌন্দর্যের আধার। 

কেননা, ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রে সৃজন ও মনন-দুটোরই সর্বৈব প্রয়োগ ঘটানোর মুন্সিয়ানাটা থাকা শুধু জরুরি নয়, অপরিহার্য। যা আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ছোটগল্পে। এক্ষেত্রে ঊনিশ-বিশ গ্রহণীয়, তবে তার কম-বেশি হলে ছোটগল্পের শিল্পমান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ছোটগল্প তখন ছোটগল্প না হয়ে রিপোর্টার্জ হয়ে ওঠে, যাতে সংক্রমিত ইদানীংকার বেশিরভাগ ছোটগল্পকার। রিপোর্টারের মুশকিলটা হলো তাকে অপেক্ষা করতে হয় ঘটনার জন্য। রিপোর্ট লিখতে হয় পুরোপুরি ঘটনার ভিত্তিতে। অন্যদিকে গল্পের নামে যারা রিপোটার্জ লেখেন তাদের এসবের কোনো কিছুর দ্বারস্থ হতে হয় না। কল্পনার ঘোড়া যেমন আকাশ দিয়ে ওড়ে, তেমনি এদের গল্প আকারে-আয়তনে মেদবহুল হলেও ছোটগল্প, রিপোটার্জের কোনটাই হয়ে ওঠে না। কারণ প্রাকশর্তসমূহ অনুপস্থিত রয়েছে তাদের লেখায়। 

ছোটগল্প সৃজনশীল শাখাভূক্ত হলেও এতে যেমন মননের প্রয়োগ থাকে, তেমনি এর পাঠককে সৃজন ও মনন চেতনায় ঋদ্ধ না হলেও সংস্পর্শী হওয়াটা অবশ্যাম্ভাবি। কেননা, ছোটগল্প প্রবন্ধ ও উপন্যাসের (কখনও কবিতা ও নাটকের মিলিতরূপেও ছোটগল্প রচিত হয়।) নিবিড় রসায়নে সৃষ্ট সৃজন ও মননধর্মী এক সাহিত্য। সৈয়দ মনজুরুলের গল্প পাঠে যার ইঙ্গিত ও অবস্থান দৃষ্ট হয় প্রবলভাবে। তাঁর পূর্বসূরীদের গল্পে আমরা যার অনিবার্য উপস্থিতি প্রায়শ খুঁজে পাই। কিন্তু উত্তরসূরী ও সতীর্থদের ক্ষেত্রে প্রত্যাশার খামতি উচ্চকিত হয়। ‘সুখ দুঃখের গল্প’র ‘কাঁঠাল কন্যা’ কিংবা ‘অমরত্ব’ গল্পে আমরা সৃজন ও মননের দ্বৈতাবস্থান আমাদের প্রতীতি আরও বেশি দীপ্র ও বাঙময় করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃত ছোটগল্পের চিরন্তন যে পরিচয় আমরা জ্ঞাত, তাতে অন্তর্দৃষ্টি দিলে মেলে এই সত্যের নির্যাস ও সারাৎসার। ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা .

.. অন্তরে, অতৃপ্ত রবে সাঙ্গ করে মনে হবে শেষ হইয়াও হইল না শেষ।’ এই ‘ছোট প্রাণ’কে আর ‘শেষ হওয়া-না হওয়া’কে হৃদয়ঙ্গম ও ধারণ করে তার যথার্থ বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হলে ছোটগল্প ও তার রচয়িতাকে সৃজন-মননে হতে হবে উৎকর্ষ সন্ধানী। সৈয়দ মনজুর এই প্রত্যয় পূরণে শতভাগ সচেষ্ট যে ছিলেন সুখ-দুঃখের গল্প তার জ্বাজ্বল্যমান প্রতিভূ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রযত্নে ও পরিচর্যায় ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে প্রভাব বিস্তারী ভূমিকা পালন করলেও তা মহীরূহ হয়ে উঠতে পারেনি। ছোট গল্পকার ও তার পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না, তা নিয়ে হতে পারে প্রণালীবদ্ধ গবেষণা। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি জুড়ে আয়োজিত ফি-বছরের বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে ছোটগল্পের বইয়ের সংখ্যা শুধু যৎসামান্য নয়, তার পাঠক সংখ্যাও নগণ্য। ছোটগল্পের এই দীনহীন ও করুণ বাস্তবতায় গল্পকার সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রকৃতার্থেই ব্যতিক্রম। তাঁর শিল্পকুশলতায় কাহিনী, চরিত্র ও বর্ণনার ত্রিমাত্রিক দ্যুতি পঠনকালে ও সমাপ্তিরেখা পেরিয়েও পাঠককে করে আলোড়িত ও বিমুগ্ধ । তাঁর গল্প শুধু সমকালস্পর্শী ও নন্দনধর্মী নয় অন্যান্য প্রসঙ্গ ও মাত্রাকেও করে করতলগত। তিনি পূর্বসূরীর ভূগোল অতিক্রম করেছেন পাশাপাশি উত্তরসূরির জন্য নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যা তাঁকে দিয়েছে ছোটগল্পকার হিসেবে স্বতন্ত্র মহিমা ও মর্যাদার আসন। বিশ্বসাহিত্যের ছোটগল্পকার হিসেবে কয়েকজনের নাম উচ্চারিত হলে অনিবার্যভাবে যেমন উঠে আসে মোপাসাঁ, জ্যাক লন্ডন প্রমুখের নাম। ঠিক তেমনি বাংলা ছোটগল্পের মানচিত্রে তিনি উজ্জ্বল আলোর প্রতিভূরূপে হয়ে উঠেছেন কতিপয় বিশিষ্ট ছোটগল্পকারদের অন্যতম।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক ও সঙ্গত যে, সাহিত্যের অন্যান্য শাখা-প্রশাখার সহযাত্রায় কতটা এগোল বাংলা ছোটগল্প? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তী সময়ে শিল্প হিসেবে ছোটগল্প কি অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হয়েছে তার ঋদ্ধ শৈশবের সৌন্দর্য, শক্তি ও বৈভব। এই প্রশ্নের একরৈখিক উত্তর দুরুহ ও অবিভাজ্য। কেননা ছোটগল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সৃজন ও মনন ভূমি, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায় বিদ্যমান রয়েছে দীর্ঘমেয়াদী ঊষরাবস্থা। বৈরী সময় ও ধ্রুপদ শিল্পের বন্ধ্যাপীড়িত সময়ে আশার আলো যুগিয়ে যে কয়েকজন বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁদের অন্যতম হলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। 

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে ছোটগল্প কীর্তিমান সাহিত্যিকদের প্রযত্নে প্রবহমানতা অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হলেও তা ক্রমশ শীর্ণদশায় উপনীত হয়ে মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে। যার অভিক্ষেপ স্বরূপ বৃত্তবন্দী হাহাকার এখানে অনুরণিত হচ্ছে। সেই তুলনায় ছড়া, কবিতা, উপন্যাসের মতো সৃজনশাখায় এখন বন্যাপ্লাবিত, তার দু’কূল উপচে উঠেছে আষাঢ়ের ভরানদীর জলরাশিতে। সংকট আর সম্ভাবনা যেমন হাত ধরাধরি করে চলে সংকটগ্রস্ত, ক্ষীন সঞ্জীবনী সময়েও তেমনি কয়েকজন বাতিঘর হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁদের সৃজনপ্রতিভায় ছোটগল্পও তার সংকটাবস্থার মাঝে সম্ভাবনার বীজ থেকে ফলিয়েছেন আশা জাগানিয়া স্বর্ণশস্য। সৈয়দ মনজুরের গল্প এই সত্যের বার্তাবাহি, কতিপয় ব্যতিক্রমের সমুজ্জ্বল স্মারক।

‘সুখ দুঃখের গল্প’র বিষয় ও উপস্থাপন ভঙ্গি এই সময়ের জীবন বাস্তবতা ও তার জটিল সমীকরণের দুর্নিরীক্ষ ভগ্নাংশ সমূহকে হাজির করেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং উপনিবেশ পতন পরবর্তী বিশ্ববাস্তবতায় বাংলা ছোটগল্প অভিজ্ঞতাস্নাত হলেও তাতে রিয়েলিটিই মূর্ত হয়েছে। বিশ্ব বাস্তবতা রিয়েলিজম, নিউ রিয়েলিজম অ্যাবস্ট্রাক্ট, অ্যাবসার্ড, এক্সপ্রেশনিজম, দাদাইজমের মতো শিল্পান্দোলনের চেতনবাহী শিল্পভঙ্গি ও ইশারায় একাত্ম, অংশীজন ও অভ্যস্ত আমরা (বাঙালি সমাজ মানস) তার কিছুই নয়। সেসবের ব্যাপারে আমাদের শিল্পপুঁজি ও সামর্থ্য ওয়াকিবহালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের এই ভূখণ্ডে কিংবা দুই বাংলার ভৌগলিক সাহিত্য ও শিল্পপ্রয়াসকে চিহ্নিত ও বিশেষায়িত করার জন্য ইজম বা প্রতীকি আন্দোলনের উপস্থিতি অপ্রতুল। বাংলা সাহিত্য ও শিল্প পরিমণ্ডল সংজ্ঞায়িত ও শনাক্তকরণের প্রয়াস এখানে দুর্লক্ষ্য। বিশ্বসাহিত্য যেখানে এইসবের সঙ্গে সহজ ও সাবলীল, এবং তাদের সৃজনসম্ভারকে আইডেন্টিফাই করার মধ্য দিয়ে সৃজনবৈভবকে নানা মাত্রায় উত্তীর্ণ করছে, আমরা তখন ঈর্ষাচ্ছন্ন হয়ে একে অপরের দোষ, দুর্বলতা নিয়ে নিজেদের মেধা ও শক্তির বিনাশ সাধন করছি।

আমাদের লেখক, গবেষক ও একাডেমিক পন্ডিতদের এসব বিষয়ে আগ্রহোদ্দীপক ভূমিকা কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি। যৌথ প্রয়াসে, দীর্ঘমেয়াদে সুচিন্তিত কিংবা অভিনব কিছু করার নজির অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নয়। আমরা যৌথকর্মে যতটা সংগঠন মনস্ক তার চেয়ে অধিক বিশৃঙ্খল। স্বার্থবাদিতা ও সুযোগ সন্ধানই সংগঠনের ছায়াতলে যুক্ত হওয়ার প্রকৃত ও নেপথ্য কারণ। আদর্শবাদিতা বা দেশীয়, মানবীয় কিংবা বিশ্ব মানচিত্রে, ‘দাগ রেখে’ যাওয়ার অভিপ্রায় ও দুর্নিবার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা চেতনা এখানে অপ্রতুল ও প্রশ্নবিদ্ধ। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, মানব জন্মে ‘দাগ রেখে’ যাওয়াটা জরুরি ও অপরিহার্য। 

রাজনীতি শুধু নয় সমাজ-রাষ্ট্রের কোন স্তরেই যুক্ত প্রয়াস ও তার সফল পরিণতি এবং চর্চা অব্যাহত রাখার দৃষ্টান্ত শুভ্র নয় পঙ্কিল ও কৃষ্ণকায়। এ কারণে আমাদের ব্যক্তিক কিছু সাফল্য ও স্বার্থকতা গোচর হলেও সামষ্টিক অর্জনও বিশ্ব পরিধিতে আমাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তির ধারাবাহিকতা তৈরি হচ্ছে না। রাজনীতিবিদ-সংস্কৃতিকর্মী-সমাজকর্মী থেকে শুরু করে লেখক সাহিত্যিকরাও নিজেদের বৃত্তে ঘুর্ণমান। আন্তর্জাতিকতায় প্রতিনিধিত্ব বা প্রতিস্থাপন করার জন্য প্রত্যয়ী নয়। 

বাংলাদেশের নাটক পাড়ায় একজন কবির উপস্থিতি যেমন আকস্মিক ও প্রয়োজন নিরীখে তেমনি চিত্রশালায় একজন নাট্যকর্মীর পদচারণা দৈব ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এ কারণে এখানকার সাহিত্যের সৃজন-মনন ভুবন ছাড়াও চিত্রকলা, নাট্যকলায় যতটা নবমাত্রা সংযোজিত হয়েছে, ততটা হয়নি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন ও মূল্যায়ন। সৈয়দ মনজুরের গল্প পাঠে এইসব প্রসঙ্গের অবতারণা কারও কারও কাছে ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মতো শোনালেও প্রকৃত বাস্তবতা রুঢ় ও লজ্জাকর। যা অনুসন্ধান ও নির্মাণে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস ও প্রচেষ্টা। সংঘবদ্ধ ও যৌথ চ্যালেঞ্জ ব্যতিরেকে শিখরস্পর্শ ও চূড়ান্তমাত্রায় উপনীত হওয়ার সম্ভাবনাও বাধাগ্রস্ত হয়। রুঢ় ও অনতিক্রম্য এই বাস্তবতায় বোধ করি মুখ্য কারণ সৈয়দ মনজুরের গল্পের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন না হওয়া। 

‘সুখ দুঃখের গল্প’র গল্পগুলোর কাহিনী শেকড়ের ডানা হওয়ার মতো পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছে। রিয়েলিজম থেকে অ্যাবস্ট্রাক্টে যাওয়ার এই প্রয়াস বাংলা সাহিত্যে একেবারে অনাস্বাদিত ও অচর্চিত না হলেও, তাঁর মতো করে পরিলক্ষিত হয় না অন্যদের উপস্থিতি। এখানে তিনি স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। তাঁর ‘খড়ম, ‘কাঠাল কন্যা’, ‘পাতকুয়া’, ‘এলেন সাহেবের চোখ’র মতো গল্পগুলো আমাদের যেমন অতিশয় বাস্তবতার কথা বলে তেমনি আধুনিক জীবনের বাস্তবপীড়িত অনুষঙ্গ সমূহকেও ছুঁয়ে যায়। শিল্পকলার এই কৌশল ও ভঙ্গির প্রয়োগ দেখা যায় মুর্তজা বশীরের চিত্রকলায়। যার নাম তিনি দিয়েছেন ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজম’। সৈয়দ মনজুর এই অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজমকেই তাঁর গল্পশৈলীতে প্রয়োগ করেছেন। যার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য শুধু তত্ত্ব বা ইজম’র দিক দিয়ে নতুন ধারা ও রীতি গল্প পায়নি, বর্তমানের বিষয় ও বিধেয়কেও ‘গল্প’র বিষয়ে পরিগণিত করেছে, যা পাঠকের আপাতদৃষ্টে দুর্বোধ্য কিংবা অমীমাংসিত-অযৌক্তিক মনে হলেও ঠিক তার উল্টো হলো প্রকৃত বার্তা। আধুনিক জীবন যে সমাজ ও সময়ের ছায়াতলে নিজের বিস্তার ঘটায় তার প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় সৈয়দ মনজুরের গল্পে। 

একদা যে জীবন শুধু বাস্তবতার যাঁতাকলে পিষ্ট হতো, যার স্বরূপ উপস্থাপিত হতো বাস্তবতার রং ও রূপে। সেই বাস্তবতায় এখন যুক্ত হয়েছে এসবের অধিক কিছু। তার যতটা স্পষ্ট, ঠিক ততটাই অস্পষ্ট। এ সময়ের যাপিত জীবন, জীবনের কাছে সমর্পিত নয়। পাশ্চাত্যে এই প্রবণতা অনেক আগে দৃশ্যমান হলেও প্রাচ্য এবং ইদানীংকালের বাংলাদেশে সেই প্রবনতার বিস্তার ঘটেছে মহীরুহরূপে। সৈয়দ মনজুরের গল্পে সেসবই মূর্ত হয়েছে। তাঁর গল্প ইদানীংকালের জীবন ও সময়কে উপলব্ধি করার আরশিস্বরূপ। যা পাঠ ও পর্যালোচনার জন্য অপরিহার্য হলো বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ। 

‘কাঁঠাল কন্যা’ গল্পর কথা ধরা যাক, ঠিক যেন গল্প না, গল্পেরও অধিক কিছু। ‘টেলিফোন’, ‘মলিনার এক রাত্রি’ও একই সত্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে। বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ- তিন স্তরেই এলিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতা হাজির হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প চিরায়ত সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করলেও বর্তমানের নয়। এই সময় যা চায়, তা প্রতিবিম্বিত হয়েছে সৈয়দ মনজুরের গল্পে। অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজমের চর্চা তাঁর গল্পকে করে তুলেছে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র ও স্বমহিম। 

গল্পকারের প্রতিটি বইয়ের নাম শিরোনামেই স্পষ্ট যে, তিনি জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারেই হোক ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজম’কেই ধরতে চেয়েছেন, তার প্রকাশ ভঙ্গিতে যেমন তেমনি কাহিনীর গতিময়তা, বাঁকবদল কিংবা পরিণতিতেও মিলেছে এসব সত্যের বারতা। ‘থাকা না থাকার গল্প’, ‘কাঁচ ভাঙ্গা রাতের গল্প’, ‘অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প’, ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’, ‘তালপাতার সেপাই ও অন্যান্য গল্প’ এসবের উজ্জ্বল সাক্ষী। লক্ষ্যণীয় গল্পগুলোকে দুই মলাটে বন্দি করেই গল্পকার ক্ষান্ত হননি ‘গল্প’র ছাপ্পড়ও লাগিয়ে দিয়েছেন। অথচ তাঁর গল্পগ্রন্থগুলো কোনোভাবেই ঈশপের গল্পের মতো যেমন নয়, তেমনি নয় আর দশজন প্রচল ধারার গল্পকারের গল্পের সঙ্গেও তুলনীয়। কাহিনী ও চরিত্রের সাথে দর্শন এবং অধুনাসময়ের রসায়নে তাঁর গল্প সাষ্টাঙ্গে গল্পই হয়ে উঠেছে। যাকে ছাপ্পড় কিংবা ট্যাগ লাগানোর মতো করে শিরোনামে ‘গল্প’ বলা জরুরি নয়, যতটা জরুরি গল্পগুলোর ভেতরবাইরের প্রকৃতি বিচার ও সৌন্দর্য অবলোকন করা। গল্পকার প্রতিটি বইয়ে ‘গল্প’ শিরোনাম চয়ন ও ধারাবাহিকভাবে তা নির্বাচন করে আমাদের (পাঠক ও সমালোচককে) আবেশিত করেছেন অদ্ভুত ও অভিনব এক গোলক ধাঁধায়। যে ধাঁধা খোলতাই কসরতে ও রসাস্বাদনে খুঁজে পাওয়া যায় গল্পের ভেতরে অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজম কিংবা অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজমের ভেতরে গল্প।

‘সুখ দুঃখের গল্প’র গল্পকার যেন হ্যামেলিওনের সেই বাঁশিওয়ালা, যিনি বাঁশির সুরে শিশুদের মুগ্ধ করে শহরের বাইরে নিয়ে গেলেও তার উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় অন্যকিছু। বাঁশি বাদনের মধ্য দিয়ে তিনি শিশুদের হিপনোটাইজ করলেও প্রতিশোধ স্পৃহায় অনঢ় ও অনন্য এক বংশীবাদক। যার বাঁশীতে শুধু সুর নয় প্রতিবাদ ও বিপ্লবের ভাষাও নিনাদিত হয় সুরের মূর্চ্ছনায়। সৈয়দ মনজুরও আপাতদৃষ্টে গল্প বলেন কিন্তু তাঁর অভিপ্রায় অন্যকিছু। যা তাঁর গল্পের চরিত্ররা যেমন জানে না, তেমনি পাঠকের কাছেও স্পষ্ট হয়েও শেষাবধি থেকে যায় অস্পষ্ট বা অজ্ঞাত। কেননা, কোন কোন গল্প শেষ দাড়িতে পৌঁছেও শেষ হয় না। গল্পকার সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্বটা পাঠকের ওপরই ছেড়ে দেন।

সৈয়দ মনজুরের গল্পের বুনন শৈলীতে রয়েছে নক্সীকাঁথার কারিগরদের মতো সূক্ষ্ম কারুকার্যের ছাপ। ‘পাতকুয়া’ গল্পের কথাই ধরা যাক। নক্সী কারিগর যেমন শূন্য থেকে শুরু করেন, উপকরণ-উপাদানসমূহ আটপৌরে জীবনের চেনা-চৌহদ্দি থেকে নেওয়া হলেও শেষাবধি এমন এক জায়গায় উপনীত হন, যা হয়ে ওঠে অপূর্ব এক শিল্প সম্ভার। পাতকুয়া গল্পের নিবিড় পাঠে আমরা যেন সেই খুঁজে পাই সেই অভিজ্ঞতার প্রচ্ছদপট। এভাবে প্রতিটি গল্পই মীমাংসা কিংবা অমীমাংসা, উপলব্ধি কিংবা অনপলব্ধির মিথস্ক্রিয়ায় হয়ে উঠেছে অধুনা সময়ের বিশ্বস্ত এক ফটোকপিয়ার।

‘ব্রাজিলের জার্সি’ ‘সুখ দুঃখের গল্প’র যোগ্য প্রতিভূ। হাসি-কান্না, দুঃখ-আনন্দ, পাওয়া-না পাওয়ার সবটাই এখানে হয়েছে মূর্ত। যার সঙ্গে অন্য এক মাত্রা যুক্ত হয়েছে বাস্তবতা আর জাদুবাস্তবতায় মিশেলে। গল্পকারের কৃতিত্ব হলো, অভিজ্ঞতা ও চারপাশের জগৎকে ফ্রেমবন্দি করে, রঙ ও রেখায় আশ্রয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পের ক্যানভাস।

‘ইয়েটস-এর কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব’ যেন তাঁর গল্পের শরীরেও অনুশীলনরত। কবিতা আর দর্শন তার গল্পেও সপ্রতিভ। ‘মেয়ে’ খড়ম, ‘কাঁঠালকন্যা’য় মেলে তার অনুপম সাক্ষ্য। ‘কাঁঠালকন্যা’ অবাস্তব, অতিবাস্তব একথা যেমন সত্য, তার চেয়েও অধিক সত্য হলো তার উপস্থিতি। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ তত্ত্বে উপস্থিতি রয়েছে। তাঁর গল্পে ইবনে বতুতার সাক্ষাৎ যেমন মেলে তেমনি লর্ড ক্লাইভের স্বজনরাও ভীড় করে। এভাবে তিনি গল্পের শরীরে ইতিহাস-ঐতিহ্য, দেশ-বিদেশ আর চেনা-অচেনা মানুষ ও সময়কে হাজির করার মধ্য দিয়ে পূরণ করেন গল্পের সকল শর্ত।

‘নোলক’ গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবন খুঁজে পাই। তাদের দৈনন্দিন, দ্রোহ, প্রতিবাদ আর অসহায়ত্ব কোনোটাই আমাদের কাছে অচেনা নয়। তবে অচেনা থেকে যায় বা বোধে নিষ্কম্প হয়ে রয় যতক্ষণ পর্যন্ত গল্পকার আমাদের চিনিয়ে না দেন অন্তর্গত সত্য ও ক্লেদাক্তরূপ। অর্থাৎ সৈয়দ মনজুরের বিশেষত্ব হলো তার গল্পের মানুষেরা আমাদের কাছ ততটা স্পষ্ট ঠিক যতটা তিনি আমাদের দেখাতে চান বা ইচ্ছুক। যার মধ্য দিয়ে হাজির হয় অ্যাবাস্ট্রাক্ট রিয়েলিজম। ভাবনার স্বাধীনতায় আমরা অস্পষ্ট, অজানা, অচেনা চরিত্র বা ঘটনায় আমরা রং লাগালেও তার প্রকাশ ও কার্যকারণ অভিন্ন নয়, ভিন্ন। এই ভিন্নতায় হলো এলিয়েনেশন। যা ব্যক্তি, সময় ও সমাজ সংলগ্নতায় সুখ দুঃখের গল্প- প্রতিভাত হয়েছে অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজমরূপে।

‘এক সন্ধ্যা’ গল্পের নাম শিরোনাম দেখেই আমাদের মস্তিষ্কের  নিউরনে এসে হাজির হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘একরাত্রি’ গল্প। কিন্তু না ওই ‘একরাত্রি’ আর ওই ‘একসন্ধ্যা’ কোনো দিক থেকেই কাছাকাছি নয়। বরং দুই অভিজ্ঞতায় স্নাত হয়ে আমরা দু’জন স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাই। রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ প্রেমের গল্প, যে গল্পে প্রেম পরিণতি না পাওয়ার ট্রাজিক বাস্তবতা, আকাঙ্ক্ষা আর ইচ্ছাপূরণ-অপূরণের মোড়কে উপস্থাপিত হয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ অনেক বেশী সবল ও সমাধান নিষ্পন্ন হওয়া জীবনের পাটিগণিত যেখানে গ্রাফ এঁকে উত্থান-পতন নির্ণয় করলেও যেমন নেই বেশি প্যাঁচগোছ, তেমনি নেই রঙ ও রেখার বহুধা ব্যবহার। অন্যদিকে ‘এক সন্ধ্যা’র গ্রাফ আঁকতে হলে রঙ ও রেখার বহুধা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ তার চরিত্রেরা এই সময়ের ঘূর্ণিপাকে আবর্ত। গল্পকার এমন বিষয় বেছে নিয়েছেন যার যথার্থ উপস্থাপনে শতভাগ অভিনিবেশ দেওয়া জরুরি। সৈয়দ মনজুর বিরল মুন্সিয়ানায় সিনেমার ছোট্ট একটা চরিত্রে অভিনয় করা যুবকের প্রকৃত চিত্র উপস্থাপন করেছেন। প্রকৃত গল্পকারের পক্ষেই কেবল সম্ভব এই বিষয়ের ডিটেইল উপস্থাপন করা। যুব সমাজ কেন উচ্ছন্নে যায়, তাতে সমাজের দায় কতটা তার চিত্ররূপ ‘একসন্ধ্যা’ গল্পে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উঠে এসেছে। একটা ঘটনা কতটা বাঁক বদলের মধ্য দিয়ে যেতে পারে, তার জটিল ও দুর্বোধ্য গ্রন্থিসমূহকে উন্মোচন করেছেন গল্পকার।  জীবনের বিবিধ ঘটনা ও আচানক অভিজ্ঞতা কতটা আঁচড় কাটে সময় ও চারপাশকে তার অকৃত্রিম চিত্র হলো একসন্ধ্যা। 

সৈয়দ মনজুরের গল্পের বয়নশৈলী মুগ্ধ হওয়ার মতো। জনপ্রিয়তা রূপে কখনোই তিনি উচ্চকিত নন। অথচ ঘটনা, কাহিনি, চরিত্রসমূহকে তিনি উচ্চকিত মাত্রায় যেমন নিয়ে গেছেন, তেমনি উচ্চকিত স্তর থেকে চয়ন করেছেন। গল্পে তিনি কখনও কখনও নিজেই হাজির হয়েছেন কিংবা মন্তব্য করেছেন, যা অতি পুরনো এক রীতি। কিন্তু অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজমের কারণে এ রীতির ব্যবহার আমাদের কাছে যেমন ক্লিশে বা বেখাপ্পা মনে হয় না, তেমনি বিরক্তিও উদ্রেক করে না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। ‘সুখ দুঃখের গল্প’ কথক সহজ করে সহজ কথা নয়, কঠিন কথা বলেছেন। ‘এলেন সাহেবের চোখ’ গল্পের বিষয় বস্তু আমাদের মরচেপড়া, দুগর্ন্ধযুক্ত রাজনীতির ক্লেদাক্তরূপ কাঠিন্যের অবয়বে আচ্ছাদিত হলেও তা প্রকাশিত হয়েছে সহজ ও সাবলীলভাবে। এই সমাজ, এই দেশ, মানুষেরা কেন পিছিয়ে ও সুকুমার চর্চায় অভ্যস্ত নয় তার অন্যতম কারণ আমাদের রাজনীতিবিদরা অনগ্রসর, অচল সময় ও প্রতিভার পৃষ্ঠপোষক। গল্পকার সেই সত্য নির্মোহভাবে রিপোটার্জ ধর্মীতায় নয়, শিল্পের দাবি মিটিয়ে উপস্থাপন করেছেন। যার পাঠ প্রতিক্রিয়ায় আমরা হই শিহরিত। 

ট্রাজেডি হলো, আমাদের রাজনীতির মানুষেরা এইসব গল্পের পাঠাভ্যাসে অভ্যস্ত নন। সাহিত্যের সীমাবদ্ধতা বা বাধ্যবাধকতা হলো, তাকে জীবনের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে হয়। এ কারণে সৈয়দ মনজুরের গল্প পড়ে আমরা উৎকণ্ঠিত ও অবিশ্বাসী হলেও গল্পকারের উৎকলন ও নির্বাচন পারঙ্গমতায় বিস্ময়াভিভূত হই এই ভেবে যে, এই বাস্তবতায় আমাদের নিত্য বসবাস হলেও তা যেন ততটা চেনা বা জানা নয়, যতটা চেনা বা জানা গল্পকারের। যার সুলুকসন্ধান করতে গিয়ে গল্পকার জাদু বাস্তবতায় উপনীত হলে আমাদের অভিজ্ঞতাও তখন হয়ে ওঠে অতিবাস্তবতার সারথী। এলিয়েনেশন কম-বেশি আমাদের সকলের অভিজ্ঞতাজাত হলেও স্পষ্ট নয় তার স্বরূপ ও সংজ্ঞা। গল্পের ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজম’ও ঠিক তাই। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গল্পে কবিতা, দর্শন, এলিয়েনেশন, অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজম, বাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা প্রভৃতির সাবলীল ও সপ্রতিভ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শেষাবধি তিনি আমাদের গল্পই বলেছেন।

‘একজীবন’, ‘কান্নার ইতিহাস’, ‘গাছের বিছানা’, ‘অমরত্ব’ গল্পে একটিমাত্র সুরের অনুরণন শোনা গেলেও গভীর অভিনিবেশ দিলেই বোঝা যায় তাতে অজস্র সুরের অনুরণন রয়েছে। সঙ্গীত শ্রবণের জন্য শ্রবণেন্দ্রীয় অপরিহার্য হলেও অবশ্যাম্ভাবি হলো সঙ্গীতবোধ ও সুরের ইন্দ্রজাল উপলব্ধি করার ক্ষমতা। চিত্রকলা বোঝার জন্য যেমন দর্শনেন্দ্রীয় শুধু যথেষ্ট নয়, জানা প্রয়োজন রঙ ও রেখার ভাষা, জ্যামিতিক ফর্ম, ইজম আর চিত্রকলার ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি। ঠিক তেমনি সৈয়দ মনজুরের গল্প পাঠের জন্য পাঠ যোগ্যতা অর্জন করা জরুরি। শুধু বাংলা পড়তে পারলে কিংবা হঠাৎ গল্প পাঠের শৌখিন পাঠকের কাছে তার গল্প আবেদনগ্রাহী হওয়ার যৌক্তিকতা বাতুলতা মাত্র। তা না হলে খটকা তৈরি হতে পারে, দেখা দিতে পারে কুহক বিভ্রম এবং অস্বস্তি ও অবিশ্বাসের দোলাচাল। দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে  আগামাথা আর আগাপাশতলা নিয়ে। 

গল্প ‘অমরত্ব’র শেষ হয়েছে এভাবে : ‘তবে সলিমউদ্দিনের দুই ছেলে বারো বছর করে জেল খেটে বেরিয়ে কিছুদিন চোখে অন্ধকার দেখল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, কিন্তু দেশের অবস্থা খারাপ হয়েছে। তারা অনেক ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি বার করল। আহকামের কবরটা তারা চুনকাম করল। ওপরে চাঁদোয়া টানাল। চারিদিকে ওঠাল লোহার রেলিং। রেলিং এর সঙ্গে বসাল দুটি দানবাক্স। এখন যদি আপনি মঙ্গল চন্ডি যান, মানুষ আপনাকে বাজ-বাবার মাজারটা দেখাবে। সলিমউদ্দিনের ছোট ছেলে, যার নাম রমিজ উদ্দিন, এখন শেখ রমিজ উদ্দিন, প্রায় সত্তরের মতো যার বয়স, এগিয়ে আসবে আপনার দিকে। ইনি মাজারের খাদেম। তাকে সালাম করে একশটা টাকা রেখে দিন দান বাক্সে।
অথবা এই টাকায় গোটা দশেক পরোটা আর আধা কেজি হালুয়া কিনে রেখে দিতে পারেন আহকামের পায়ের কাছে।
আপনার যা মর্জি।’

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘লালসালু’র প্রসঙ্গ এই গল্প পাঠে আপনার নিউরনে উদিত হতে পারে। আবুল মনসুর আহমদ’র ‘হুজুরের কেবলা’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘বৃষ্টি’র মতো কোন গল্প বা তার চরিত্র হাজির হতে পারে আপনার স্মৃতিকোষে। কিন্তু তারা কেউই ‘অমরত্ব’র মতো নয়। বিশিষ্টতার এই প্রসাদগুণই হলো সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পের শক্তি ও ভরকেন্দ্র। গল্পকে তিনি প্রচল গণ্ডিতে না বেঁধে, খোল-নলচে পাল্টে ব্রতী হয়েছেন নবতর এক নির্মাণ-সৃজনে। বিস্তর-অভিজ্ঞতা ও পড়াশোনার বিশাল ব্যাপ্তি যুগিয়েছে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা। এ কারণে তাঁর গল্প নানা অলিগলি আর দেশ-বিদেশ ঘুরে অতীত-বর্তমানের কুহক বাস্তবতা পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যকে যুগিয়েছে নবতর এক মাত্রা। ঋদ্ধ এই মাত্রার শেকড় তাঁর গল্পের মতোই ভূমিসংলগ্ন কিন্তু শাখা-প্রশাখা বর্হিলোকে।

সৈয়দ মনজুর এই সময়ের একজন গল্পকার হিসেবে অনুকরণযোগ্য ও ঈর্ষনীয় এক নাম। তাঁর সবিশেষ প্রাপ্তি  হলো বাংলা সাহিত্যে গল্পকারদের যে কোন শর্টলিস্টে তাকে না রেখে উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিশ্বজয়ী প্রতিভার হাতে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলা ছোটগল্পের। তারপর বাংলা ছোটগল্প আদল বদলেছে নানান জনের সৃজনে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন সেই ধারাবাহিকতার উজ্জ্বল এক প্রতিভূ। অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজমের গল্পকার। স্বাতন্ত্রিক প্রতিভার গল্পের মানুষ। বাংলা ছোটগল্পে জারি রেখেছেন কীভাবে শেকড়সন্ধানী হতে হয় আর কীভাবে জারি রাখতে হয় আকাশে উড্ডয়নের কোশেশ ও গল্পবিদ্যা।

লেখক: চিন্তক, সাংবাদিক ও গবেষক।
 

তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র গল প প ঠ খ র গল প র র র গল প র র গল প র ম র গল প র ব র উপস থ ত ছ টগল প র ব স তবত য় অপর হ র য ব স তবত র এই সময় র স ন দর য অন য ন য রঙ ও র খ ত র গল প হ জ র হয় ম র গল প য় উপন ত স জনশ ল উপস থ প একর ত র ব যবহ র চ ত রকল প রসঙ গ উপলব ধ অমরত ব উদ দ ন ন গল প জ বন র র লক ষ র প রক সন ধ য জ জ বল র জন ত ত হয় ছ র র জন ত হল ও ব শ বস বন র ব ষ ত হয় বস থ ন গল প স কর ছ ন র জন য কর ত র হল ও ত প রক ত আম দ র স বর প হয় ছ ন সন ধ ন প রক শ চর ত র র স জন র অন য অবশ য প ঠকক আপন র অবস থ সময় ও য় আমর করল ও হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

দলের অবস্থান নিয়ে অসন্তোষ, জয়পুরহাটে এনসিপির প্রধান সমন্বয়কের পদত্যাগ

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জয়পুরহাট জেলার প্রধান সমন্বয়ক মো. ফিরোজ আলমগীর পদত্যাগ করেছেন। আজ সোমবার দলের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব বরাবর পদত্যাগপত্র দিয়েছেন তিনি। পদত্যাগপত্রে তিনি দলের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ও অবস্থান নিয়ে অসন্তোষের কথা উল্লেখ করেছেন।

পদত্যাগপত্রে ফিরোজ আলমগীর বলেন, সম্প্রতি এনসিপির বিভিন্ন কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত বিপ্লবের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে চিহ্নিত আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের দলে নেওয়ার বিষয়ে দলের অবস্থান তাঁর ব্যক্তিগত আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘আমি আশা করেছিলাম, বিপ্লবপরবর্তী সময়ে এনসিপি নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করবে। কিন্তু বর্তমানে দলটি গতানুগতিক রাজনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছে, যা আমাকে মর্মাহত করেছে।’

ফিরোজ আলমগীর তাঁর পদত্যাগপত্রে আরও লিখেছেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি এনসিপির কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পারছি না। তাই পদ ও দলের সব কার্যক্রম থেকে পদত্যাগ করছি।’ তিনি এনসিপির প্রতি আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, দলটি যেন আন্দোলনে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের ত্যাগকে শ্রদ্ধা জানায় এবং জেলা পর্যায়ের জনমতের ভিত্তিতে কাজ করে।

আজ সোমবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে দল থেকে পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফিরোজ আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমি দলের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব বরাবর পদত্যাগপত্র হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছি। সেখানে পদত্যাগের কারণ উল্লেখ করেছি।’

এনসিপির জয়পুরহাট জেলার যুগ্ম সমন্বয়ক ওমর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলার প্রধান সমন্বয়ক ফিরোজ আলমগীর পদত্যাগ করেছেন। আমি বিষয়টি জেনেছি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ