উত্তরের হিমেল হাওয়া ও কনকনে শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম। তীব্র ঠান্ডায় কষ্টে রয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বিশেষ করে জেলার নদীতীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষ বেশি বিপদে পড়েছেন। এসব অঞ্চলের শিশু ও বয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছেন শীতজনিত রোগে। এরই মধ্যে গতকাল রোববার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে এ জেলায়।
রোববার বেলা ১১টার পর সূর্যের দেখা মিললেও দুপুর ২টার পর ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে। এর সঙ্গে হিমেল বাতাসে শীত অনুভূত হচ্ছে বেশি। কুড়িগ্রাম কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার জানান, রোববার সকাল ৯টায় জেলায় ১০ দশমিক শূন্য ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা দেশের সর্বনিম্ন। 

আগামী দুই-এক দিনেরর মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, পরে ফের নিম্নগামী হতে পারে তাপমাত্রা।
রাজারহাটের কৃষি শ্রমিক হযরত আলী বলেন, ‘সকালে মাঠত কাম করতে অসুবিধা হয়। চাইরপাশে কুয়াশার জন্য কিছুই দেখা যায় না।’ সদরের যাত্রাপুরের চর ইয়ুথনেট এলাকার বাসিন্দা মো.

সুলতান মিয়া বলছিলেন, ‘দুই দিন থাকি সূর্য দেখা গেলেও ঠান্ডা বাতাসের কারণে হাত-পাও কাঁপুনি দেয়। হামরা চরত থাকি। হামার সরকারের কোনো কম্বল এলাউ দেয় নাই।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দিনের সূর্যের তাপ না থাকা ও মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত বৃষ্টির মতো করে কুয়াশা পড়ায় সমগ্র জেলায় ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। সকালে হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। লোকজন দিনের বেলায়ও খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।

পোড়ারচরের বাসিন্দা তাহের আলী বলেন, ছোট নাতি দু’দিন ধরে অসুস্থ। হাসপাতালে নিতে চাইলেও এই ঠান্ডায় সকালে নৌকা ছাড়ে না। নাগেশ্বরী পৌরসভার বাসিন্দা অর্পণা সরকারের ভাষ্য, সকাল থেকে ঠান্ডা বাতাস। সূর্যের তেমন তাপ নেই। ফলে ঘরে ময়লা পোশাক জমলেও ধুতে পারছেন না।
শীতজনিত রোগে রোববার বেলা ১১টা পর্যন্ত ডায়রিয়া বিভাগে ৬৮ জন ভর্তি হয়েছে বলে জানান কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার জুলেখা খাতুন। তিনি বলেন, শিশু বিভাগে ৮১ ও বহির্বিভাগে ২১০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই শিশু ও বয়স্ক রোগী।
তীব্র শীত নিবারণের জন্য জেলায় সরকারিভাবে যে কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তবে কম্বলের চেয়ে গরম কাপড় বেশি প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলছেন, চাদর, মাফলার, জ্যাকেটের মতো গরম কাপড় নিম্ন আয়ের মানুষকে দেওয়া হলে তারা বেশি উপকৃত হবেন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার বলেন, ৯ উপজেলায় এ পর্যন্ত ১২ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। ৪৯ লাখ টাকার নতুন কম্বল কিনে বিতরণ করা হচ্ছে। মজুত থাকা ৫ হাজার কম্বল বিতরণের কাজ চলমান রয়েছে।

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক

অক্টোবরের প্রথম দিকে লম্বা এক ছুটিতে বেড়াতে গেলাম বগুড়া। দেশের উত্তরের জনপদ বরাবরই আমার পছন্দ। মানুষ কম, হালকা বসতি। পথে বা হাটবাজারে ততটা ভিড়ভাট্টা নেই। বাজারে কম দামে টাটকা শাকসবজি মেলে। এসব কেনার চেয়ে দেখেই তুমুল আনন্দ পাই। নিঝুম গ্রামের ভেতর ফসলের মাঠে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি বেশ উপভোগ করি। যত দূর চোখ যায়Ñ গ্রামের পর গ্রাম। মুঠো মুঠো সবুজের ভেতর এঁকেবেঁকে ছুটে চলা মেঠো পথ মাড়িয়ে আমরা প্রতিদিন দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। দিনের মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা নিপুণভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে পারে,Ñ এসব গ্রামে না এলে তা বোঝার উপায় নেই। কৃষিনির্ভর এই জনপদে প্রতিমুহূর্তের ব্যস্ততা যেন অনিবার্য নিয়তি।

বগুড়ার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে মনে হলো যথেষ্ট নয়! চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। মনের ক্ষুধাও যায়নি! তখনই মনে পড়ল নওগাঁর ঘুঘুডাঙ্গার বিখ্যাত তালসড়কটির কথা। এত কাছে এসে তালসড়কটি দেখতে যাব না, তা কি হয়? স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার পারভেজ বললেন, ‘বগুড়া থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টারই তো জার্নি। ঘুরে আসুন।’ আমারও মনে হলো, এমন একটি অসাধারণ দৃশ্যের জন্য এই দূরত্ব কিছুই না।

সকালে তুমুল বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার থেমেও গেল। গাড়িতে ওঠার সময় স্থলপদ্মের গাছটি চোখে পড়ল। গাছভর্তি ফুলগুলো বৃষ্টির দাপটে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। অথচ বিকেলে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে শরতের মধুর আলোয় স্থলপদ্মের ছবি তুলব। তা আর হলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে গেলাম নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন স্বপ্নমণ্ডিত সেই তালসড়কে পৌঁছাই, তখন ঠিক দুপুরবেলা।

কিন্তু দুপুর হলেও দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর তালসড়ক। শুধু বৃহত্তর রাজশাহী নয়, দূরদূরান্ত থেকেও পর্যটকেরা এখানে আসেন। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নে এই তালসড়কের অবস্থান। মূলত ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়কের দুপাশজুড়ে থাকা বীথিবদ্ধ তালগাছের জন্যই সড়কটি ‘তালসড়ক’ বা ‘তালতলী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। হাজীনগর গ্রামের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে এই তালসড়কের অবস্থান।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন রাস্তা ও খালপাড়ে ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে কয়েক লাখ তালগাছ। তখন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর উপজেলার রাস্তার দুপাশে রোপণ করা হয়েছে অনেক তালগাছ। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছই হারিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে বেঁচে আছে কিছু। তবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গার এই গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। বর্তমানে গাছগুলো ৫০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু হওয়ায় রাস্তার দুপাশে শোভাবর্ধন করছে।

একসময় নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়কটি ছিল একটি মেঠো পথ। ২০১২ সালের দিকে সড়কটি পাকা করা হয়। বর্তমানে তালসড়কের দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকায় সড়কটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

ভাদ্র মাসে তাল পাকার মৌসুমে তালসড়ক ঘিরে উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। নানা স্বাদের তালের পিঠা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তবে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এখানে মানসম্পন্ন পর্যটনসেবা থাকা প্রয়োজন।

শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলই নয়, বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানেও প্রচুর পরিমাণে তালগাছ চোখে পড়ে। খেতের আলপথ, বাড়ির সীমানা, খালপাড়, পুকুরপাড় বা পথের ধারে এসব সুদৃশ্য তালগাছ প্রকৃতিতে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে থাকা এসব তালগাছের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও আছে। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দৃশ্যমান তালগাছের রস থেকে ভালো মানের সুস্বাদু গুড় ও মিছরি তৈরি করা হয়। বাজারে এসব গুড়-মিছরির চাহিদাও ব্যাপক। আমাদের দেশেও এসব গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে তালের গুড় তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার।

 মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক