সন্ত্রাসী বাহিনীর উপদ্রব কি চলতেই থাকবে
Published: 13th, January 2025 GMT
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে নাজুক, তা জানতে গবেষণার প্রয়োজন হয় না। প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে বিচিত্র ও ভীতিকর অপরাধের খবরই তার প্রমাণ। সাম্প্রতিক কালে ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদার দাবিতে ব্যবসায়ীকে হত্যা বা আহত করা এবং অপহরণের ঘটনাও ঘটছে একের পর এক। অপহরণের হাত থেকে রক্ষা পাননি চিকিৎসকও। এর পাশাপাশি যে খবরটি বেশি উদ্বিগ্ন করে, সেটি হলো আত্মগোপন অবস্থা থেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসা।
শুক্রবার রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বিপণিবিতান মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে চাঁদা না পাওয়ায় একজন ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহত করেছে ইমন গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। গত ২২ ডিসেম্বর ইমন গ্রুপের লোকজন এহতেশামুল হকসহ দুই ব্যবসায়ীর কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেছিল। শুক্রবার রাত ১১টার দিকে ব্যবসায়ী এহতেশামুল মাল্টিপ্ল্যান কম্পিউটার সিটি থেকে বেরিয়ে সড়কে এলে একদল দুর্বত্ত তাঁকে রাস্তায় ফেলে চাপাতি দিয়ে কোপাতে শুরু করে। এর আগে শেওড়াপাড়ায় অপহৃত হয়েছিলেন রাসেল নামের এক ব্যবসায়ী। মামলার এজাহার অনুযায়ী, অপহরণকারীরা রাসেলের গলায় চাকু ঠেকিয়ে তাঁর কাছে ১০ লাখ চাঁদা দাবি করেন এবং ওই টাকা আনতে তাঁকে দিয়ে তাঁর মা-বাবা ও স্ত্রীকে ফোন করান। পরে পুলিশ এলাকার একটি বাসা থেকে তাঁকে উদ্ধার করে।
গাজীপুরের শ্রীপুরে অপহরণের ৯ ঘণ্টা পর আমিনুর রহমান নামের এক চিকিৎসক মুক্তি পেয়েছেন। শনিবার সন্ধ্যায় মাওনা চৌরাস্তায় মহাসড়কের পাশ থেকে তাঁকে অপরহণ করা হয়। রোববার ভোরে গাজীপুরের হোতাপাড়া ও রাজেন্দ্রপুরের মাঝামাঝি স্থানে তাঁকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। তাঁর পরিবারের সদস্যদের দাবি অনুযায়ী, অপহরণকারীরা ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন। ৬ জানুয়ারি যশোরের চৌগাছায় ধীরেন্দ্র দে (৬৫) নামের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ঝালকাঠিতে সুদেব হালদার নামের এক মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। স্থানীয় বাউকাঠি বাজারে তাঁর মোবাইল ফোন বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের দোকান আছে।
ওপরে বর্ণিত ঘটনাগুলোর বাইরেও সাম্প্রতিক কালে অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যার খবর আমরা জানি না। অনেকে নিরাপত্তার ভয়ে থানা–পুলিশ করতেও সাহস পান না।
গত বছর আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে অপরাধীদের ধরতে বিভিন্ন এলাকায় রেইড ব্লক দেওয়া বলা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অনেক স্থানে পুলিশ নিষ্ক্রিয়। কিন্তু ৫ মাস পরও একই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়, যেখানে পুলিশ বহিনীর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সশস্ত্র বাহিনী, র্যাব ও বিজিবির সদস্যরাও সহায়তা করছেন।
উদ্বেগের বিষয় হলো, চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনীর যেসব সদস্য আগে কারাগারে ছিল, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাদের অনেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে রাজনৈতিক কারণে কারাবন্দী করা নিঃসন্দেহে অন্যায়। কিন্তু তার চেয়ে বেশি অন্যায় রাজনৈতিক হয়রানির শিকার দেখিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা। সে সময় এ নিয়ে প্রতিবাদ হলেও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা খুব আমলে নিয়েছেন বলে মনে হয় না।
হালে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, তার সঙ্গে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসার যোগসূত্র আছে। কিন্তু দৈত্য একবার কৌটা থেকে বের করার পর আবার কৌটায় ভরা কঠিন। প্রতিটি অপরাধের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। যে সমাজে অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, সেই সমাজে অপরাধ দমন করা কেবল কঠিন নয়, অসম্ভবও বটে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের ৪৫% রাজনৈতিক
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত ভুল তথ্য ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এ সময়ে যাচাই করা ভুল তথ্যের ৪৫ শতাংশই ছিল রাজনৈতিক। গতকাল বুধবার তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত ভুল তথ্য ছিল ১ শতাংশ। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা বেড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সংখ্যার হিসাবে গত প্রান্তিকে এ ধরনের ভুল তথ্য ছিল মাত্র ১১টি। সেটি এ বছরের প্রথম তিন মাসে সাত গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭টিতে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পেয়েছে ডিসমিসল্যাব।
সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠানগুলো ১ হাজার ২৩৬টি তথ্য যাচাইয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র ভুল তথ্য পাওয়া গেছে ৮৬৭টি, যা আগের প্রান্তিকে রেকর্ড করা ৮১৬টির তুলনায় কিছুটা বেশি। ভুল তথ্যের প্রায় অর্ধেকই (৪৫ শতাংশ) রাজনীতি সম্পর্কিত ছিল। এর পর ছিল ধর্ম-সংক্রান্ত ভুল তথ্য (১৩ শতাংশ), যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় সামান্য কম।
অপরাধ-সম্পর্কিত ভুল তথ্য বেড়েছে
বছরের প্রথম তিন মাসে প্রচারিত খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও ডাকাতি-সংক্রান্ত খবর ছিল ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা ছিল ভারতের, যা বাংলাদেশের বলে ভুলভাবে প্রচার করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে একটি ইউটিউব চ্যানেলে হোটেল থেকে লাফিয়ে পড়া এক ভিডিও প্রচার করে বাংলাদেশের বলে দাবি করা হয়, কিন্তু সেটি ছিল মূলত ইন্দোনেশিয়ার।
রাজনৈতিক ভুল তথ্য
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যাচাই করা ভুল তথ্যের ৪৫ শতাংশই রাজনৈতিক। আগের বছরও রাজনীতি-সংক্রান্ত ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ (৩৪.৮ শতাংশ) ও অন্তর্বর্তী সরকারকে (২১.৮ শতাংশ) নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। তবে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে প্রচারিত ভুল তথ্যগুলোর অধিকাংশই (৬৮ শতাংশ) ছিল ইতিবাচক। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াত-শিবির ও সমন্বয়কদের নিয়ে ছড়ানো অধিকাংশ ভুল তথ্য ছিল নেতিবাচক।
ধর্ম-সংক্রান্ত ভুল তথ্য
ধর্ম-সম্পর্কিত ভুল তথ্যের সংখ্যা সর্বশেষ প্রান্তিকে কিছুটা কমেছে। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে ধর্ম-সংক্রান্ত ভুল তথ্যের পরিমাণ ছিল মোট যাচাইকৃত ভুল তথ্যের ১৮ শতাংশ, যা চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। তবে এর ধরন ছিল একই রকমের। যেমন, পুরোনো বা সম্পাদিত ছবি-ভিডিও সাম্প্রতিক বলে প্রচার করা।
বেড়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্য
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্যের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে। ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ২৭টি ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন। সেখানে এ বছরের প্রথম তিন মাসে এই সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪টিতে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব ভুল তথ্যের ২৪ শতাংশ ছিল রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট।