জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আমার কথা হয়েছে। তাঁরা ইউএনও ও ডিসিদের ওপর বিন্দুমাত্র আস্থা রাখেন না। তাঁদের ওপর যে খবরদারি করেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা, তাঁরা একে জবরদস্তি মনে করেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সিভিল সার্জনদের কাছে শুনেছি চরম বিরক্তির কথা। তাঁরা কিছুতেই ইউএনও–ডিসিদের কাছে যেতে চান না। তাঁদের অভিযোগও বিস্তর।

শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হলেই তাঁদের সাধারণ মন্তব্য, ‘প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যত এড়িয়ে চলা যায়, ততই ভালো।’ পরিবেশবিষয়ক কর্মকর্তাদের কাছে শুনেছি, ‘আমাদের বিভাগীয় কর্মকর্তা কেন প্রশাসন ক্যাডারের কাউকে হতে হবে?’ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে ডিসিরা জেলা–উপজেলার পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর খবরদারি করত বলে শুনেছি। এখন হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। 

আরও পড়ুন‘আমাদের লোক’ হওয়ার সুফল আমলারা বুঝে গেছেন০১ জুলাই ২০২১

বিগত সরকারের আমলে সরকারি দুর্বৃত্তায়নে ডিসি–ইউএনও ও জেলা–উপজেলার পুলিশ কর্মকর্তারা উভয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। তারপরও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডিসি-ইউএনওদের বিভেদের রেখাটা ছিল স্পষ্ট।

ডিসি-ইউএনওদের সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন, ‘প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যা-ই বলুন, মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকৌশলীদের কাছেও শুনেছি, ইউএনও, ডিসিরা তাঁদের ওপর বাড়াবাড়ি করেন।

বিসিএস ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তা নন, দেশের সব মন্ত্রণালয়ের জেলা ও উপজেলাভিত্তিক মাঠপর্যায়ের যত কর্মকর্তা আছেন, তাঁরা প্রত্যেকে প্রশাসন ক্যাডারের ওপর বিরক্ত। এত বিরক্তি-অনাস্থা-অবিশ্বাস-অশ্রদ্ধা নিয়ে জেলা পর্যায়ে কিংবা উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কাজ ভালো হবে, এটি মনে করার কোনো কারণ নেই।

বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মানুষ যে অপছন্দের চোখে দেখছে, তা দীর্ঘদিন আগে শুরু হয়েছে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা কী চান, কেবল সেই আলোকে নয়, জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে কোন পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়, সেদিকে যেতে হবে। ক্যাডার–বৈষম্য শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।

আমলাদের লাগাম টেনে ধরার বদলে বিগত সরকারের আমলে সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর্থিক সুবিধা, ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার সুবিধা, ড্রাইভার কিংবা কুকের সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে এই সুবিধা প্রদান একধরনের কৃতজ্ঞতার প্রকাশমাত্র। কারণ, এসব আমলা বিনা ভোটে কিংবা নিশি ভোটে ওই সময়ের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন।

ব্রিটিশরা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে ১৯৪৭ সালে, কিন্তু ব্রিটিশ পদ্ধতির আমলারা এখনো শোষণ-অপরাধ যন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়ার কাজ করেই চলেছেন। রাজনৈতিকভাবে যাঁরাই দেশ পরিচালনা করতে এসেছেন, তাঁরাই ব্রিটিশ পদ্ধতির আমলাতন্ত্রের দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন। শাসকেরা ব্রিটিশদের মতো শোষক হয়ে উঠলে, তাঁদের নিরাপত্তাবলয় হিসেবে কাজ করেন আমলারা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের যেহেতু এসবের অভিপ্রায় নেই, তাই তাদের মাধ্যমে সংস্কার সম্ভব।

কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও আমলাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। প্রশাসন ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এ জন্য বঞ্চিত যাঁরা অবসরে গেছেন কিংবা মারা গেছেন, তাঁদেরও বঞ্চনা দূরীকরণে অন্তর্বর্তী সরকার তৎপর। এই দেশে অপরাপর অনেক ক্যাডারের কর্মকর্তারা যে সীমাহীন বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, তাঁদের প্রতি সরকারের সমপরিমাণ নজর নেই।

একই ক্যাডারের মধ্যে কয়েকজনের বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা সরকারের কাছে বড় হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে যে অন্যান্য ক্যাডারের চরম বৈষম্য, সেটি কি ধর্তব্য নয়? অন্তর্বর্তী সরকারও যখন আমলাদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন অপরাপর ক্যাডারের কর্মকর্তারা বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে আরও সোচ্চার হয়েছেন।

আরও পড়ুনআমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন কেন প্রয়োজন১৯ নভেম্বর ২০২৪

অতীতের যেকোনো সরকারের আমলাপ্রীতির চেয়ে বর্তমান সরকারের আমলাপ্রীতি কম, এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই। অথচ এসব আমলা বিনা ভোটের নির্বাচন কিংবা নিশি ভোটের নির্বাচন করার মূল কারিগর। একেকটি নির্বাচনের পর অনেক ইউএনও ও ডিসি কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন বলেও জনশ্রুতি আছে। এসব আমলা মূলত এমপি-মন্ত্রীদের পরিচালনা করেছেন।

সরকারের নানা অপকর্মের সঙ্গে পুলিশও জড়িত। তারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে। এখন পুলিশই চায় বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন। তারা ন্যায় কাজ করার পরিবেশ চায়। প্রশাসন ক্যাডার কি পদ্ধতির পরিবর্তন চায়? জুলাই আন্দোলনের সময় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল সরকার। তখন ডিসিরা ক্ষেত্রবিশেষে বিভাগীয় কমিশনাররা জেলা কিংবা মহানগরের দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময়ের অত্যাচারের জন্য পুলিশ দায়ী হলে ডিসি কিংবা বিভাগীয় কমিশনাররা নন কেন?

আন্তক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণের এখনই উপযুক্ত সময়। এ জন্য ব্যাচভিত্তিক সবার পদোন্নতি সমপর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সব ক্যাডারের জন্য সমসংখ্যক পদোন্নতির বিধান রাখতে হবে। কেবল বেতন নয়, কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তা ব্যতিরেকে অন্য সব সুবিধা সবার জন্য সমান হতে হবে।

আমলাদের লাগাম টেনে ধরার বদলে বিগত সরকারের আমলে সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর্থিক সুবিধা, ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার সুবিধা, ড্রাইভার কিংবা কুকের সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে এই সুবিধা প্রদান একধরনের কৃতজ্ঞতার প্রকাশমাত্র। কারণ, এসব আমলা বিনা ভোটে কিংবা নিশি ভোটে ওই সময়ের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন।

আমলাদের একটি অংশ জাতির সঙ্গে প্রতারণামূলক কাজের মধ্য দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারকে যেভাবে কলুষিত করেছেন, তার সংশোধন সহজে হবে না।

তবে প্রশাসন ক্যাডারে অনেক কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা ভোট চুরির বিপক্ষে ছিলেন। অনেকে আছেন যাঁরা চান, তাঁদের ওপর থেকে মানুষের ঘৃণা উঠে যাক। নিশ্চয়ই সবাই অন্যায় নির্দেশনা পালনের জন্য আমলা হতে প্রশাসন ক্যাডার বেছে নেন না।

এ রকম অনেক আমলা আছেন, যাঁরা সমন্বয়বাদী ধারণায় বিশ্বাস করেন, অকারণ কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা তাঁদের অভিপ্রায় নয়। সেই আমলাদের সংখ্যা কম। কেবল রাষ্ট্রকে সেবা দিতে গিয়ে বিরোধের কোনো কারণ নেই। বিভেদ না করে সবার সমন্বয়ে একটি উন্নত রাষ্ট্র গড়াই আমাদের হোক লক্ষ্য।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

মাদ্রাসার বরাদ্দের দুম্বার মাংস ছিনতাইয়ের অভিযোগ

সৌদি আরব থেকে মাদ্রাসা ও এতিমখানার জন্য পাঠানো দুম্বার মাংস ছিনতাই করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ছিনতাইকারীদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি এখনো।

বুধবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা পরিষদের মসজিদের পাশে এ ছিনতাই হয়।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তাড়াশ উপজেলার ৪৪টি মাদ্রাসা ও এতিমখানার জন্য ১৬৪ কার্টন দুম্বার মাংস বরাদ্দ দেওয়া হয়। বুধবার বিকেলে উপজেলা পরিষদ চত্বরে সেই মাংস বিতরণের খবর পেয়ে শত শত মানুষ ভিড় জমান। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত জাহানের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও দুই দিনের সরকারি প্রশিক্ষণ থাকায় উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সালেহ্ মোহাম্মদ হাসনাত উপস্থিত হন। তিনি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আবু ছাঈদ মল্লিককে সঙ্গে নিয়ে পুলিশি পাহারায় মাংস বিতরণ শুরু করেন। বরাদ্দের তালিকা অনুযায়ী সদর ইউনিয়নের মথুরাপুর মহিলা মাদ্রাসার পক্ষে শিক্ষক সুলতান মাহমুদ এক কার্টন দুম্বার মাংস বুঝে নেন। পরে এ মাংস নিয়ে উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন মসজিদের রাস্তায় গেলে ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন মিলে তাকে আটকে মাংসের কার্টন জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেন।

শিক্ষক সুলতান মাহমুদ বলেছেন, দুস্থদের হক এভাবে মানুষ ছিনতাই করে নিয়ে যাবে, কখনো ভাবিনি। তবে, আমি কাউকে চিনতে পারিনি। এর বিচার আল্লাহ করবেন।

মাংস বিতরণকালে দায়িত্বে থাকা তাড়াশ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, দুম্বার মাংস বিতরণকালে কোনো প্রকার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। বিতরণের সময় উল্লাপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা স্যারসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

উল্লাপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সালেহ্ মোহাম্মদ হাসনাত বলেছেন, ছিনতাইয়ের বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি কেউ এ ধরনের কাজ করে থাকে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা/অদিত্য/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘লাল পরি’ হয়ে ঘরে ফিরল হারিয়ে যাওয়া শিশুটি
  • মাদ্রাসার বরাদ্দের দুম্বার মাংস ছিনতাইয়ের অভিযোগ