শ্রীপুরে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য
Published: 18th, January 2025 GMT
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। উপজেলায় কিশোর অপরাধীদের কর্মকাণ্ডে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, উপজেলায় গত ১৫ দিনে বেশ কিছু কিশোর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদক সেবন করে রাস্তায় উল্লাস করা, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, ওষুধ ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করা, পোশাক শ্রমিককে ডেকে নিয়ে নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য নারীকে ডেকে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ, চিকিৎসককে তুলে নিয়ে নির্যাতনের পর মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। এ সব ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
শ্রীপুরে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে, পৌর শহরের মসজিদ মোড়, ফখরুদ্দিন মোড়, মাওনা চৌরাস্তা উড়াল সেতুর নিচে, শ্রীপুর রেঞ্জ অফিসসংলগ্ন, ওদ্দা দিঘি, তেলিহাটি ইউনিয়নের সফিক মোড়, বরমী ইউনিয়নের বরামা ব্রিজ, পাইটালবাড়ী, কাওরাইদ ইউনিয়নের নান্দিয়া সাঙ্গুন, গলদাপাড়া গ্রামসহ বেশ কিছু পয়েন্ট।
আরো পড়ুন:
টেকনাফে অপহরণের ৪৮ ঘণ্টা পর উদ্ধার ১৮ বনকর্মী
হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ, অনুসন্ধানে দুদক
স্থানীয়রা জানান, শ্রীপুরে মাদকের ভয়াবহতার কারণে কিশোরদের অপরাধের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। ভুক্তভোগীরা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কম থাকায় শ্রীপুরে দিনের পর দিন কিশোরদের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে।
শ্রীপুর পৌরসভার মসজিদ মোড়ে মা মনি নামে ফার্মেসি পরিচালনা করেন হাসিবুল ইসলাম বাদশা। মাঝে-মধ্যে রুবেল নামে স্থানীয় এক কিশোর গ্যাং নেতা বাদশার কাছে পোলাপানের খরচের কথা বলে টাকা দাবি করতেন। কয়েক দফা টাকাও নিয়েছেন। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয়দের জানিয়ে প্রতিকার পাননি বাদশা। সর্বশেষ চলতি ৩ জানুয়ারি কিশোর গ্যাং নেতা রুবেলের নেতৃত্বে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ইট দিয়ে আঘাত করে বাদশাকে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
এ কিশোর গ্যাং নেতা রুবেল ২০২২ সালের ১৮ মার্চ একই এলাকায় সিহাব নামে এক ছাত্রলীগ নেতাকে গুলি করে। ভাগ্যক্রমে সিহাব বেঁচে যান। এছাড়া প্রায় প্রতিরাতে মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে এই রুবেল ও তার গ্যাংয়ের সদস্যরা। ফার্মেসি ব্যবসায়ীকে হত্যার পরও কয়েক দফা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
গত ৮ জানুয়ারি পোশাক কারখানার এক শ্রমিককে মুক্তিপণের জন্য দুই দিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এ সময় মুক্তিপণ আদায়ের জন্য ওই পোশাক শ্রমিকের দুরসম্পর্কের বোনকে কৌশলে ডেকে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। ভুক্তভোগী দুজন জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দফায় দফায় মাদক সেবন করে তাদের উপর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত খুন, ধর্ষণ, অপহরণসহ এসব অপরাধের নেতৃত্বে রয়েছেন শ্রীপুর পৌর এলাকার ফখরুদ্দিন মোড়ের সাগর। তিনি স্থানীয়ভাবে ‘সাগর বাহিনী’ নামে কিশোর গ্যাং গ্রুপ গড়ে তুলেছেন। এ গ্রুপের টার্গেট পোশাক শ্রমিক। পোশাক কারখানায় শ্রমিকেরা বেতন পেলে এ বাহিনীর সদস্যদের উৎপাত বেড়ে যায়। পুলিশ বলছে, সাগর একাধিক মামলার আসামি। বেশ কিছু দিন জেলে থাকলেও কয়েক দিন আগে ছাড়া পেয়েছে সাগর।
গত ১১ জানুয়ারি মাওনা চৌরাস্তা এলাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মো.
চিকিৎসকের চাচাত ভাই সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন মিল্টন বলেন, ‘‘অপহরণের পরপরই আমরা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে উদ্ধারে সহযোগিতা চেয়েছি। সব তথ্য আমরা তাদের সরবরাহ করেছি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এত সব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ভাইকে উদ্ধার করতে পারেনি।’’
শ্রীপুর নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম জানান, মাদকে আসক্ত হয়ে দিন দিন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকাসক্ত একজন কিশোর কিংবা যুবক অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। অপহরণ, নারীদের উত্ত্যক্ত; এমনকি খুন করতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না।
তিনি আরো বলেন, পুলিশ যদি তাদের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করে, তাহলে এ ধরনের অপরাধ নির্মূল সম্ভব। একটি অপরাধ, অপহরণ, ধর্ষণ অথবা খুন সংঘটিত হলে একজন ভুক্তভোগী প্রথমে পুলিশকে জানায়। তারা ঘটনাস্থলে আসার আগেই যোগাযোগ করে অপরাধীর সঙ্গে। এ জন্য পুলিশের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ।
শ্রীপুর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন মণ্ডল বলেন, পুলিশ কিশোর গ্যাং নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া মাদকের বিরুদ্ধেও পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক দিনে চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনার পরপরই বেশ কয়েকজন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, এর সঠিক তথ্য-প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সজীব আহমেদ বলেন, গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিশোর গ্যাং নির্মূল ও মাদক নিয়ন্ত্রণে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে। তবে এটাই যথেষ্ট নয়। এগুলো নির্মূলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি করা দরকার।
ঢাকা/বকুল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অপর ধ ব হ ন র সদস য র অপর ধ র জন য উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের ৪৫% রাজনৈতিক
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত ভুল তথ্য ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এ সময়ে যাচাই করা ভুল তথ্যের ৪৫ শতাংশই ছিল রাজনৈতিক। গতকাল বুধবার তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত ভুল তথ্য ছিল ১ শতাংশ। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা বেড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সংখ্যার হিসাবে গত প্রান্তিকে এ ধরনের ভুল তথ্য ছিল মাত্র ১১টি। সেটি এ বছরের প্রথম তিন মাসে সাত গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭টিতে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পেয়েছে ডিসমিসল্যাব।
সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠানগুলো ১ হাজার ২৩৬টি তথ্য যাচাইয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র ভুল তথ্য পাওয়া গেছে ৮৬৭টি, যা আগের প্রান্তিকে রেকর্ড করা ৮১৬টির তুলনায় কিছুটা বেশি। ভুল তথ্যের প্রায় অর্ধেকই (৪৫ শতাংশ) রাজনীতি সম্পর্কিত ছিল। এর পর ছিল ধর্ম-সংক্রান্ত ভুল তথ্য (১৩ শতাংশ), যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় সামান্য কম।
অপরাধ-সম্পর্কিত ভুল তথ্য বেড়েছে
বছরের প্রথম তিন মাসে প্রচারিত খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও ডাকাতি-সংক্রান্ত খবর ছিল ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা ছিল ভারতের, যা বাংলাদেশের বলে ভুলভাবে প্রচার করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে একটি ইউটিউব চ্যানেলে হোটেল থেকে লাফিয়ে পড়া এক ভিডিও প্রচার করে বাংলাদেশের বলে দাবি করা হয়, কিন্তু সেটি ছিল মূলত ইন্দোনেশিয়ার।
রাজনৈতিক ভুল তথ্য
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যাচাই করা ভুল তথ্যের ৪৫ শতাংশই রাজনৈতিক। আগের বছরও রাজনীতি-সংক্রান্ত ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ (৩৪.৮ শতাংশ) ও অন্তর্বর্তী সরকারকে (২১.৮ শতাংশ) নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। তবে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে প্রচারিত ভুল তথ্যগুলোর অধিকাংশই (৬৮ শতাংশ) ছিল ইতিবাচক। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াত-শিবির ও সমন্বয়কদের নিয়ে ছড়ানো অধিকাংশ ভুল তথ্য ছিল নেতিবাচক।
ধর্ম-সংক্রান্ত ভুল তথ্য
ধর্ম-সম্পর্কিত ভুল তথ্যের সংখ্যা সর্বশেষ প্রান্তিকে কিছুটা কমেছে। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে ধর্ম-সংক্রান্ত ভুল তথ্যের পরিমাণ ছিল মোট যাচাইকৃত ভুল তথ্যের ১৮ শতাংশ, যা চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। তবে এর ধরন ছিল একই রকমের। যেমন, পুরোনো বা সম্পাদিত ছবি-ভিডিও সাম্প্রতিক বলে প্রচার করা।
বেড়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্য
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্যের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে। ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ২৭টি ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন। সেখানে এ বছরের প্রথম তিন মাসে এই সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪টিতে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব ভুল তথ্যের ২৪ শতাংশ ছিল রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট।