গত ৩০ নভেম্বর পূর্বাচল উপশহরে ভূমি জরিপ শুরু হয়েছে। কেতাবি কথায়, জরিপের মাধ্যমে প্রকৃত মালিককে প্রকৃত জমির রেকর্ড বুঝিয়ে দেওয়া হয়। জমির নকশার সর্বশেষ পরির্বতন জরিপের মাধ্যমে নতুন মৌজা ম্যাপ তৈরি হয়। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর জমির মালিককে জমির হাল নকশা বুঝিয়ে দিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত করে। এসব কেতাবি কথার বাইরে অকথা হচ্ছে, জমির মালিককে বিশেষ করে অনিবাসী মালিককে নানান ঝামেলা পোহাতে হয়।
পূর্বাচল উদীয়মান উপশহর। সিকি শতাব্দীর আগে থেকে এই উপশহর গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ঢাকা জেলার খিলক্ষেত, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মোট ১৭টি মৌজাজুড়ে এই উপশহর প্রকল্প বাস্তবায়নে ৬২২৭.
প্রস্তাবিত উপশহরটি ৩০টি সেক্টরে বিভক্ত। আবাসিক, বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিকসহ বিবিধ ধরন ও আকারের মোট প্লটের সংখ্যা ২৯,৭৭৬টি। এখনও সব প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের কাছে হস্তান্তর হয়নি। সামান্য সংখ্যক প্লট এখনও বরাদ্দ হয়নি; সংরক্ষিত আছে।
আমার এক বন্ধুর প্লট আছে পূর্বাচলে। ভূমি রাজস্ব দিতে যেতে হবে। বন্ধুকে সঙ্গ দিতে রূপগঞ্জ ইউনিয়ন ভূমি অফিসে আমিও গেলাম। ভূমি রাজস্ব দেওয়ার বিধান যদিও অনলাইনে, বন্ধুর অনলাইন নিবন্ধন না থাকায় ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যাওয়াই ছিল ন্যায়ত।
যাওয়ার পর শোনা গেল, যেহেতু জরিপ চলছে তাই এখন রাজস্ব নেওয়া বন্ধ। ভূমি রাজস্বের সঙ্গে জরিপের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়; রাজস্ব নেওয়ার যিনি মালিক তিনিই যদি না নেন, তবে আর জোর খাটে কী করে! ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে অগ্রসর হলাম পূর্বাচলের ইউসুফ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে জরিপ অফিসের সন্ধানে। জরিপ অফিসে গিয়ে দেখা গেল বন্ধুর সেক্টরের অনেক ক’টি রাস্তার নম্বর উল্লেখ করে জরিপের বিজ্ঞপ্তি টাঙানো থাকলেও তাঁর প্লটের রাস্তার নামগন্ধ নেই। কর্তব্যরত সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার বললেন ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখের পরে খবর নিতে। পরামর্শ দিলেন, রাজউক থেকে দখল বুঝে পাওয়া প্লট মালিকদের নিজ নিজ দখলনামা নিয়ে জরিপ অফিসে হাজির হয়ে নিজের প্লটের মালিকানা দাবি করতে হবে। যদি কোনো মালিক দাবিনামা দাখিল না করেন, তবে প্লটটি রাজউকের নামে রেকর্ড হয়ে যাবে।
সমস্যাটা এখানেই। প্রায় ২৬ হাজার আবাসিক প্লটের অর্ধেকের বেশির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়ে থাকলেও সে সংখ্যা কমপক্ষে ১৩ হাজার। এত সংখ্যক মানুষকে জমির কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াতে হবে জরিপ অফিসে! অনেকে হয়তো দেশেও নেই। ২৫ বছর আগে যারা জমির জন্য আবেদন করেছিলেন, তাদের অনেকে বৃদ্ধ। অনেকেই জীবিত নেই; সন্তানরা ছোট বা বিদেশে। সে সবই বিবেচনার অযোগ্য– সবাইকে হাজির হতে হবে জরিপের জন্য সরেজমিন!
মোট ১৭টি মৌজা নিয়ে পূর্বাচল উপশহরের কোনো কোনো প্লট পড়েছে একাধিক মৌজায়। কিন্তু জরিপ দল নির্দিষ্ট মৌজার বাইরে যাবে না। ফলে কাউকে কাউকে একাধিক মৌজার জরিপের সময় হাজির হতে হবে। কোনো কোনো প্লট শুধু একাধিক মৌজায় নয়; পড়েছে দুই উপজেলায়, মানে দুই জেলায়। ৩, ৫, ৭.৫ বা ১০ কাঠা প্লটের এক অংশ গাজীপুর তো অপর অংশ নারায়ণগঞ্জ জেলায় কিংবা ঢাকা জেলায় পড়তে পারে। এই প্লটগুলোয় যাদের বাড়ি হবে, তারা কোন জেলার বাসিন্দা হবেন? ভবিষ্যতে পরিচয় সংকটে পড়তে পারেন।
জরিপের বিরোধিতা করছি না। তবে জরিপটি শতাব্দীপ্রাচীন প্রক্রিয়ার বদলে যুগোপযোগী হতে পারে। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের কাছে রাজউক এক আবেদন করতে পারে– প্রকল্পের আওতাভুক্ত ১৭টি মৌজা বিলুপ্ত করে পূর্বাচল নামে স্বতন্ত্র মৌজা হোক। এ মৌজার ৩০টি সেক্টরের জন্য পৃথক ৩০টি শিট তৈরি হবে। বেশিও হতে পারে। ঢাকা শহরের জরিপের মতো ১২০ ইঞ্চি=১ মাইল হিসেবে মৌজা ম্যাপ হবে।
পূর্বাচল মৌজা একটি নতুন ও পৃথক প্রশাসনিক ইউনিট হওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জ জেলার অংশ হতে পারে। পূর্বাচল উপশহর সম্ভবত চারটি থানায় বিভক্ত হবে। এই বিভক্তিকরণও ভূমি জরিপের সময় হলে ভবিষ্যতে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হবে। আমার অভিমত, পূর্বাচল মৌজা ঢাকা জেলার অন্তর্ভুক্ত হোক।
জমির মালিকের নামে নতুন রেকর্ড করার জন্য জরিপ অধিদপ্তর ও রাজউক একসঙ্গে কাজ করতে পারে। প্রত্যেক বরাদ্দপ্রাপকের তথ্য রাজউকের কাছে আছে। রাজউক যথেষ্ট পরিশ্রম করে প্লট ম্যাপ করেছে। সেই ম্যাপ ও তথ্য জরিপ অধিদপ্তরের কাছে দিলে জরিপ অধিদপ্তর স্বল্প আয়েশে রেকর্ড প্রণয়ন করতে পারবে।
এখানেই রয়েছে অন্য সংকট। রাজউক এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক আস্থাহীনতা। দুই প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক আস্থাহীনতার কারণে রাষ্ট্রের মালিক জনসাধারণ ভোগান্তি পোহাতে পারে না। বর্তমান সরকার সহজেই অনেক বৈপ্লবিক কাজ করতে সক্ষম, যা স্বাভাবিক সময়ে সম্ভব নয়। ভূমি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করে পূর্বাচলে রাজউকের ম্যাপ অনুযায়ী জরিপ ম্যাপ করতে পারে। পারে রাজউকের তথ্য অনুযায়ী রেকর্ড সম্পন্ন করতে। নতুন প্রশাসনিক এলাকা গঠন করতে এবং সেই এলাকাকে ঢাকা জেলায় অন্তর্ভুক্ত করতে।
কাজটি করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর আয়োজিত জরিপের সময়ই সম্পূর্ণ আদর্শ সময়। অর্থাৎ এখনই সময়।
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: সাবেক
অতিরিক্ত সচিব
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জউক র র জন য ন করত
এছাড়াও পড়ুন:
কারখানার বর্জ্যে মরছে নদ
ডাইং কারখানার বর্জ্যে মরছে ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রকাশ্যে এ দূষণ ঘটলেও দেখার কেউ নেই। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ ভুক্তভোগীদের। পরিবেশ কর্মকর্তা চাইছেন সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ অভিযোগ।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ও নরসিংদী সদর উপজেলায় অন্তত ৬০টি ডাইং কারখানা ব্রহ্মপুত্র দূষণের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। নদের তীরে অবস্থিত এসব কারখানায় এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) থাকলেও তারা বর্জ্য পরিশোধন না করেই প্রতিদিন নদে ফেলছে। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এ নদের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষজন।
অভিযোগ রয়েছে, নদের তীরে অবস্থিত কারখানাগুলো ইটিপি রাখলেও তারা বর্জ্য পরিশোধন না করেই নদে ফেলছে। অনেক কারখানায় ইটিপি থাকলেও খরচ কমাতে বেশির ভাগ সময় তা বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া বেশকিছু কারখানার ইটিপি প্রয়োজনের তুলনায় ছোট হওয়ায় সঠিকভাবে বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হয় না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, নরসিংদী সদর উপজেলায় রয়েছে ছোট-বড় ৫০টি ডাইং কারখানা। আড়াইহাজারে স্পিনিং মিলসহ ডাইং কারখানা রয়েছে অন্তত ১০টি। নরসিংদীর ডাইং কারখানাগুলোর মধ্যে পাঁচদোনা এলাকার আবদুল্লাহ ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ, বাঘহাটা এলাকার ফাইভ অ্যান্ড ফাইভ ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, সাজেদা ডাইং, আনোয়ার ডাইং, শতরূপা ডাইং, রুকু ডাইং, মেসার্স একতা ডাইং, কুড়েরপাড় এলাকার ব্রাদার্স টেক্সটাইল, ইভা ডাইং, ভগীরথপুর এলাকার এম এমকে ডাইং, নীলা ডাইং, এইচ এম ডাইং, মা সখিনা টেক্সটাইল, মুক্তাদিন ডাইং, পাঁচদোনা এলাকার তানিয়া ডাইং, সান ফ্লাওয়ার টেক্সটাইল প্রভৃতি।
আড়াইহাজারের কয়েকটি কারখানা হলো– ভাই ভাই স্পিনিং মিলস, ছাবেদ আলী স্পিনিং মিল, রফিকুল ডাইং, দিপু ডাইং ও হাজী হাবিবুর ডাইং।
আড়াইহাজার পৌরসভার চামুরকান্দি এলাকার বাসিন্দা মিয়াজউদ্দিন মিয়া বলেন, দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নদটি। দেশীয় জাতের মাছের অভয়াশ্রম এ নদ থেকে মাছ হারিয়ে গেছে।
আড়াইহাজারের বালিয়াপাড়া এলাকার ইসমাইল হোসেন জানান, রফিকুল ডাইংয়ের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে পানির রং কালচে হয়ে গেছে। একই অবস্থা অন্য কারখানাগুলোর। বর্জ্য নদে ফেলার বিষয়ে স্থানীয়রা কথা বলতে গিয়ে উল্টো কারখানা কর্তৃপক্ষের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
রফিকুল ডাইংয়ের মালিক রফিকুল ইসলাম জানান, তাদের ইটিপি নেই। ডাইংয়ের পানি তারা নির্দিষ্ট পানির ট্যাংকে রাখেন, সরাসরি নদে ফেলেন না। ট্যাংকে জমানো পানি কোথায় ফেলেন জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
নরসিংদী সদর উপজেলার শিলমান্দী ইউনিয়নের গনেরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মাহবুব হাসান শুভর ভাষ্য, কুড়েরপাড় এলাকার ডাইং কারখানাগুলোর রং মেশানো বর্জ্য পরিশোধন না করে ব্রহ্মপুত্রে ফেলায় নদটি এখন মৃতপ্রায়। দূষণের কারণে দুর্গন্ধে এর পারে দাঁড়ানো যায় না। স্থানীয়রা অনেকবার প্রতিবাদ করেও প্রতিকার পাননি বলে জানান তিনি।
গত ১৫ এপ্রিল শিলমান্দী ইউনিয়নের কুড়েরপাড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ইভা ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেড নামে একটি কারখানা থেকে বর্জ্য এসে পড়ছে নদের পানিতে। ভিডিও করতে দেখে কারখানা কর্তৃপক্ষ বর্জ্য ফেলা বন্ধ করে দেয়।
ইভা ডাইংয়ের ইটিপি ইনচার্জ রেজাউল করিম জানান, বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তারা প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন। অনেক কারখানা সরাসরি নদে বর্জ্য ফেললেও তারা নদ দূষণ করেন না।
একই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফাতেমা ডাইংসহ ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো থেকেও নদে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে এসব কারখানার কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপসহকারী পরিচালক কামরুজ্জামান জানান, নদে বর্জ্য ফেলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক তারেক বাবু জানান, ব্রহ্মপুত্রে নদে সরাসরি বর্জ্য ফেলছে ডাইংসহ যেসব কারখানা সেসবের অধিকাংশই নরসিংদী জেলার অন্তর্গত। তাই নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে নদ দূষণমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
আড়াইহাজারের ইউএনও সাজ্জাত হোসেন বলেন, কখনও কখনও কিছু কারখানা বর্জ্য পরিশোধন না করেই নদে ছেড়ে দেয়। কোন কারখানা নদ দূষণ করছে, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশবাদী সংগঠন তা জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।