বুধবার যেইভাবে গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকরা দফায় দফায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালাইয়াছে, উহা অনাকাঙ্ক্ষিত ও উদ্বেগজনক। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাইতেছে, বেক্সিমকো গ্রুপের কয়েকটি কারখানা মাসখানেক পূর্বে বন্ধ হইবার কারণে শ্রমিকরা বর্তমানে কর্মহারা। একদিকে তাহাদের কর্মসংস্থানের জন্য কারখানা খুলিয়া দেওয়া জরুরি, অন্যদিকে বকেয়া পারিশ্রমিক পরিশোধও কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। আমরা দেখিয়াছি, ইহার পূর্বেও শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে দাবি আদায়ে রাস্তায় নামিয়াছেন; সপ্তাহখানেক পূর্বে কারখানা খুলিয়া দিবার জন্য মানববন্ধনও করিয়াছেন। আমরা মনে করি, শ্রমিকদের দাবি ন্যায্য এবং কেবল তাহাদের কর্মসংস্থানের জন্যই নহে, বরং দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনশক্তি চালু রাখিবার তাগিদ হইতেও কারখানা খুলিয়া দেওয়া জরুরি।
আমরা জানি, গত মধ্য ডিসেম্বরে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বেক্সিমকোর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির সভার সিদ্ধান্তের পর ১৬টি কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যাহা সত্য, প্রতিষ্ঠানগুলির মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে প্রভাব খাটাইবার অভিযোগ রহিয়াছে এবং তজ্জন্য মামলাও চলমান। কিন্তু কেবল সেই কারণে এই সকল কারখানা বন্ধ হইতে পারে না। বন্ধের কারণরূপে সরকার কারখানাগুলিতে কার্যাদেশ না থাকা ও ঋণখেলাপি হইবার যেই অজুহাত দিয়াছে, উহাও গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। সরকারের উচিত হইবে, যেই কোনো মূল্যে কারখানাগুলি সচল ও শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণে গুরুত্ব দেওয়া। শ্রম সচিবের বক্তব্যে আমরা আশ্বস্ত হইতে চাই, সরকার কারখানাগুলি বিক্রয় করিয়া নূতন মালিকানায় দ্রুত খুলিয়া দিবার ব্যবস্থা লইয়াছেন এবং এতদ্বিষয়ে উল্লেখযোগ্য বৈঠকও হইয়াছে। পাঁচ মাস ধরিয়া শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের মাধ্যমে সরকারের সদিচ্ছাও স্পষ্ট। আমরা মনে করি, এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর করা জরুরি।
বুধবার যেইভাবে চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় দফায় দফায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হইয়াছে, উহা নিরাপত্তারও প্রশ্ন বটে। লাঠিসোটা লইয়া মহাসড়কের শতাধিক যানবাহনে নির্বিচার ভাঙচুর চালানো ও অগ্নিসংযোগ, খবর সংগ্রহ করিতে গিয়া সংবাদকর্মীর ওপর হামলা গ্রহণযোগ্য নহে। তথাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হইয়াছে কেন?
কয়েক মাস পূর্বে যখন শিল্প এলাকায় এই ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়, তখন শ্রমিক-কর্মচারী, তৎসহিত কারখানার নিরাপত্তা চাহিয়াছিলেন সাভারের আশুলিয়ার পোশাকশিল্প মালিকরা। অন্যায় দাবি ও গুজব ছড়াইয়া অস্থিরতা তৈরি করা হইতেছে কিনা, উহা দেখিবার তাগিদ দিয়াছিলেন তাহারা।
এমনিতেই জ্বালানি সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ ও ব্যাংক খাতে অস্থিতিশীলতায় এক ধরনের সংকটে রহিয়াছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। ইহার মধ্যে নূতন করিয়া শ্রমিক অসন্তোষ সমগ্র পোশাক খাতের জন্যই অশনিসংকেত। বলাবাহুল্য, কারখানা বন্ধ হইলে কর্মহীন হইবার ঝুঁকিতে থাকে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা। উহাদের কর্মসংস্থানের জন্য তো বটেই, দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসাবে উৎপাদন অব্যাহত রাখিবার জন্যও কারখানা খোলা রাখা জরুরি। আমরা প্রত্যাশা করি, বন্ধ থাকা কারাখানাগুলি যত দ্রুত সম্ভব খুলিয়া দিতে সরকার তৎপর ও আন্তরিক হইবে। যেইভাবে ইহার সমাধানে শ্রমিক ও শিল্পের স্বার্থ রক্ষা হইবে, সেইভাবে উহা করিতে হইবে। একই সঙ্গে শ্রমিকরা শিল্প এলাকার পরিবেশ ও নিরাপত্তা রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করিবে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহনীর সতর্কতারও বিকল্প নাই।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন: জামায়াতে ইসলামী
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাভাবিক বললেও, দুইজনের যৌথ বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জামায়াতে ইসলামী।
শনিবার জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের বৈঠকের পর বিবৃতিতে দলটি বলেছে, ‘যৌথ বিবৃতি প্রদান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় বলে আমরা মনে করি। এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে।’
দলের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ‘১৩ জুন লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাকে জামায়াত খুবই স্বাভাবিক মনে করে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে এবং যৌথভাবে বৈঠক করেছেন।’
লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে জামায়াত বলেছে, ‘গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন প্রধান উপদেষ্টা। তার এই ঘোষণার পর লন্ডন সফরে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিদেশে যৌথ প্রেস ব্রিফিং এবং বৈঠকের বিষয় সম্পর্কে যৌথ বিবৃতি প্রদান করা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় বলে জামায়াত মনে করে। এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করে।’
লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। জামায়াত এ প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা মনে করি দেশে ফিরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার অভিমত প্রকাশ করাই সমীচীন ছিল।’
জামায়াত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিরোধী নয় বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘গত ১৬ এপ্রিল জামায়াত আমির দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরে জানিয়েছিলেন ২০২৬ সালের রসজানের পূর্বে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হতে পারে।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘জামায়াত মনে করে সরকার প্রধান হিসেবে কোনো একটি দলের সঙ্গে যৌথ প্রেস ব্রিফিং নৈতিকভাবে কিছুতেই যথার্থ নয়। প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দেওয়ায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান, সেখানে শুধু একটি দলের সঙ্গে আলাপে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। জামায়াত আশা করে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার নিরপেক্ষ থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করবে। সরকারের নিরপেক্ষতা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে তা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা জাতির সামনে স্পষ্ট করার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।’
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের দিন জামায়াত আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা সমকালকে বলেছিলেন, ‘জামায়াতই প্রথম বলেছে, রমজানের আগে নির্বাচন হওয়া উচিত। তাই নির্বাচনের যে নতুন সময়সীমা বলা হচ্ছে, এ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সরকার যেভাবে শুধু বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে সময়সীমা নির্ধারণ করেছে, তা অগ্রহণযোগ্য।’
জামায়াত নেতারা শুক্রবার রাতেই সমকালকে বলেছিলেন, যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে– সরকার এবং বিএনপি সমশক্তি। এর পর আর সরকারের নিরপেক্ষতা থাকে না। এ বক্তব্য ড. ইউনূসকে জানাবে জামায়াত।