সরকারের এক সিদ্ধান্তে বদলাবে কোটি জেলের জীবন
Published: 25th, January 2025 GMT
সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, হবিগঞ্জের লাখাইয়ে জলমহালের দখল নিয়ে স্থানীয় বিএনপির দুই নেতার লোকজনের মধ্যে রাতের আঁধারে টর্চ জ্বালিয়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে নারী-শিশুসহ অর্ধশতাধিক আহত (সমকাল, ৯ জানুয়ারি ২০২৪)। আপাতদৃষ্টিতে খবরটিকে ‘চাঞ্চল্যকর’ মনে হতে পারে; কিন্তু জলমহাল নিয়ে সংঘর্ষ, খুনোখুনিও বিরল নয়।
কাগজে-কলমে যদিও ‘প্রকৃত’ জেলেদের জলমহাল ইজারা দেওয়ার কথা রয়েছে; এ জন্য যদিও ‘মৎস্যজীবী সমিতি’ গঠন এবং নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়েছে; বাস্তবে জলমহালের নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কাছেই থাকে। প্রকৃত জেলেরা সেখানে বড়জোর ‘শ্রমিক’ মাত্র। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই মৎস্যজীবী সমিতির নামে ইজারার টাকা পরিশোধ করেন। পরে ওই সব মৎস্যজীবীকে ব্যবহার করে মাছ ধরে বা চাষ করে থাকেন।
এ ধরনের ‘অনিয়ম’ রোধে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সব আবেদনপত্র অনলাইনে গৃহীত হবে। অথচ এটি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, যদি ‘প্রকৃত মৎস্যজীবীরা’ অনলাইনে আবেদনই করতে পারবেন, তাহলে অফলাইনেও আবেদন করতে অসুবিধা কী? জলমহাল ইজারার বিষয়টি কি এক-দুই দিনের বিষয় যে, ‘চুপিসারে’ অনলাইনে আবেদন করলেই সব কাজ শেষ? যে প্রভাবশালীরা ভয়ভীতি দেখিয়ে ইজারায় কারসাজি করেন, অনলাইন আবেদনে ইজারা পেয়ে অফলাইনে তাদের এড়িয়ে মৎস্যজীবীরা জলমহালে নামতে পারবেন? বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় এটি বিশ্বাসযোগ্য?
ইজারার নামে আসলে কী ঘটে, সেটি ফুটে উঠেছিল বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে– ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় হাওরের বিল-জলমহাল ইজারা নিয়েছে। এখন এসব ইজারা বাতিল করতে হবে। আওয়ামী লীগ যে টাকা দিয়ে ইজারা নিয়েছে, সে টাকা আমরা দিয়ে দেব, প্রয়োজনে আরও ১০ পার্সেন্ট বেশি দেব। তবুও এলাকার সাধারণ মানুষকে জলমহালের মাছ ধরার অধিকার দিতে হবে। আওয়ামী লীগের লোকজন পাটিবাঁধ দিয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ মারে আর গরিব জেলে ও সাধারণ মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে’ (মানবজমিন, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
ফজলুর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েও যোগ করা যেতে পারে যে, শুধু আওয়ামী লীগ নয়; যখন যে দল ক্ষমতায়, তখন তারাই এসব জলমহাল নিয়ন্ত্রণ করেছে। সাধারণ জেলেরা, তাঁরই ভাষায়, শুধু ‘চেয়ে চেয়ে দেখেছে’। যেমন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর এখন বেশির ভাগ জলমহাল বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীর দখলে চলে গেছে। কোথাও কোথাও এ নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষ বা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিরোধও দেখা দিচ্ছে।
প্রশ্নটা কেবল জলমহালগুলো ‘প্রকৃত’ জেলের ইজারাপ্রাপ্তি নিয়ে নয়; কোন জলাভূমিকে ‘জলমহাল’ ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হচ্ছে, সেটিও। দেখা যাচ্ছে, জেলা প্রশাসন কাঁচা পয়সার লোভে বা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপে প্রবহমান নদীকেও জলমহাল ঘোষণা করে ইজারা দিয়ে থাকে। জলমহাল ব্যবস্থার উপদ্রবে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ যে ঐতিহ্য মেনে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে নিজের হাতে মাছ ধরে খাবে, সেই সুযোগও প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে।
অথচ জলমহাল নীতিমালা ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুযায়ী, দেশে দুই ধরনের জলমহাল রয়েছে; বদ্ধ বা অবক্ষয়িত ও উন্মুক্ত জলমহাল। এর মধ্যে খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুর, বিল, ঝিল, বাঁওড় বদ্ধ জলমহাল এবং নদী ও খাল উন্মুক্ত জলমহাল হিসেবে চিহ্নিত। দেশের ‘প্রকৃত’ জেলেদের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করতে সেই ১৯৯৫ সালেই নদী, খাল ও উন্মুক্ত শ্রেণির সব জলমহালের ইজারা প্রদান প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছিল। এখনও এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে যে, প্রবহমান নদী বা খালকে বদ্ধ বা অবক্ষয়িত জলমহাল ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হয়।
যেমন, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে প্রবাহিত চকিরপশার নদীকে ‘বিল’ ঘোষণা করে বছরের পর বছর ইজারার নামে দখলদারিত্ব দেওয়া হয়েছে। যারা এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গেছেন, উল্টো প্রভাবশালী দখলদারদের হুমকি-ধমকি, এমনকি শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। জেলা প্রশাসন হয় গোপনে মদদ দিয়েছে, না হয় প্রকাশ্যে ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থান নিয়েছে।
কথিত জলমহাল ইজারা নিয়ে সরকারিভাবেই কী তুঘলকি কাণ্ডকারখানা চলতে পারে, এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ অবশ্য পাবনা জেলা প্রশাসনের। গত বছর জানুয়ারি মাসে পাবনা জেলা প্রশাসনের জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি ৯টি উপজেলার যে ৬৩টি জলমহাল তিন বছরের ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়, সেগুলোর ৩১টিই প্রবহমান নদীর অংশ। যে ১০টি নদীর অংশবিশেষ ‘জলমহাল’ ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হয়, এর মধ্যে প্রমত্ত পদ্মা ছাড়াও ইছামতী, আত্রাই, চন্দ্রাবতী, বড়াল, চিকনাই, গুমানি, গোহালা, কাগেশ্বরী ও রুকনাই নদী রয়েছে।
ব্যক্তিগত আক্ষেপের বিষয়, বড়াল নদী রক্ষায় ওই অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যে আন্দোলন করে আসছে, তার সঙ্গে আমারও সামান্য সম্পৃক্ততা রয়েছে। ২০১০ সালে নদীটি নিয়ে ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’ এবং ‘রিভারাইন পিপল’ যৌথভাবে যে গবেষণা করেছিল, সেখানে প্রাঞ্জল ভাষায় বলা হয়েছিল যে, প্রবহমান বড়াল নদীকে জলমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়ার মতো বেআইনি কাজ করা যাবে না।
আমার না হয় সামান্য আক্ষেপ, বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমানের আরও কেমন অনুভূতি হওয়ার কথা? বলতে গেলে পুরোটা জীবন তিনি ব্যয় করেছেন বড়াল রক্ষার আন্দোলনে। এর আগেও মিজান ভাই আন্দোলন করে বড়ালের ইজারা বাতিল করেছেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন যেন নাছোড়বান্দা! কারণ জলমহাল ঘোষণা করে ইজারা দিতে পারলেই ঘোষিত রাজস্ব যেমন তেমন, অঘোষিত পথে লাভেই লাভ!
ওই ১০ নদীর তালিকায় ইছামতী ইজারা দেওয়ার বিষয়য়টি আরও মহাকাব্যিক। ২০২৩ সালের অক্টোবরেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি তথা একনেক ‘পাবনা জেলার ইছামতী নদী পুনরুজ্জীবিতকরণ’ প্রকল্পে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কাজও শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে জেলা প্রশাসন নদীটির এক অংশ ইজারার জন্য ওয়েবসাইটে তোলে!
প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি, সবচেয়ে সহজ ও সংগত সমাধান হচ্ছে, জলমহাল ইজারাপ্রথা বাতিল। জলমহাল ইজারা দিয়ে সরকার যে হস্তী-অশ্ব তুল্য রাজস্ব পায়, এমন নয়। যেমন ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ১৩৪টি জলমহাল ইজারা দিয়ে পাওয়া গেছে মাত্র ১১৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার টাকা। অথচ ওই অর্থবছরে জাতীয় বাজেট ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
অপরদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মৎস্যজীবীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৬৪ হাজার ১৫৪ জন; বলা বাহুল্য, সাধারণত খানাপ্রতি একজন ধরে। যে কারণে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে ১ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল।
এটি স্পষ্ট, জাতীয় বাজেটের তুলনায় জলমহাল থেকে পাওয়া রাজস্ব সরকারের কাছে নস্যিও নয়! এই কমবেশি ১০০ কোটি টাকা রাজস্বের জন্য ৭ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটের দেশে ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা জিম্মি করার কী অর্থ থাকতে পারে? দুর্নীতিবাজ আমলা, টাউট রাজনীতিক, বাটপার সমাজপতিদের রমরমা অবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া? অথচ, জলমহাল প্রথা বাতিলের একটি সিদ্ধান্তে কোটি জেলের জীবন বদলে যেতে পারে।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবস থ বড় ল র র জন য মৎস য ব এনপ সরক র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি ও জামায়াতের কাছে কেন আরপিওর ২১ ধারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল
নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে গত ছয় দিনে দল দুটির পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন আরপিওর ২১ ধারার সংশোধনীর পরিবর্তন। জামায়াত মনে করে, সরকার বিএনপির চাপে নতি স্বীকার করে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত খসড়া সংশোধনী বাতিল করেছে। আর বিএনপি মনে করে, জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ায় ২১ ধারার পরিবর্তন করে; যা গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদিত হয়। আরপিওর ২১ ধারা সংশোধনীর ওই পরিবর্তন বহাল থাকলে কোনো দল জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে বাধ্য ছিল। ৩০ অক্টোবর সেটি আবার পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়। তাতে জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এতে জামায়াত বেশ ক্ষুব্ধ হয়।
যদিও সরকারের দিক থেকে এই নতুন সিদ্ধান্তের তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে সরকার-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটি শুধু বিএনপির দাবির কারণে নয়, ছোট বিভিন্ন দলেরও দাবি ছিল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নিশ্চিত করেছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই। আমরা সরকারের কথায় বিশ্বাস করি। সুতরাং এখন থেকে আমাদের সব কার্যক্রম নির্বাচনকেন্দ্রিক। এখন সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কীভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, সেটি তাদের বিষয়। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারকে যতটুকু সহযোগিতা দেওয়া দরকার, সেটা বিএনপি করবে।’
বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে...একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপিএ দিকে আজ সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা হবে। তবে অন্য দিন রাতে সভা হলেও আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় সভা বসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আজকের সভায় আলোচ্যসূচিতে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করার বিষয় থাকবে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন–সংক্রান্ত বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে।
হঠাৎ কেন সামনে এল আরপিওর সংশোধনী
আরপিওর ২১ ধারার সংশোধন বিএনপি ও জামায়াতের কাছে হঠাৎ করে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়। এর পরেই সরকার আরপিওর ২১ ধারার পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, নতুন সিদ্ধান্তে বিএনপি উপকৃত হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিএনপি। অন্য দিকে এতে লাভবান হয় জামায়াতসহ তার মিত্র দলগুলো। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে ‘ভরসা’ হিসেবে দেখেন।
...যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছে না। সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নায়েবে আমির, জামায়াতএখন জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হলে ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে খুব আগ্রহী হবে না। এর কারণ দুটি। প্রথমত, বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলের কেউ বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে ভোটে জেতা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহীকে সরাতে বিএনপির নেতৃত্ব কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে প্রশ্নও আছে।
এ ছাড়া এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যে আটটি দল আছে, তারা আরপিওর ওই ধারা পরিবর্তনের পক্ষে। অর্থাৎ দলগুলো জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে—এর পক্ষে। এর জন্য দলগুলো যৌথ কর্মসূচিও করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জামায়াত যে নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা করতে চাইছে, সে দলগুলো পরস্পর আস্থাশীল। তাদের কাছে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বা ‘হাতপাখা’ বা ‘রিকশা’ প্রতীক কোনো বিষয় নয়। সমঝোতা হলে সবাই ওই প্রতীকের পক্ষে এক হয়ে কাজ করবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা নেই। অন্যদিকে বিএনপির জোটের ক্ষেত্রে ভাবনা হচ্ছে, ধানের শীর্ষ প্রতীক না দিলে ভোটের আগেই আসন হারানোর আশঙ্কা থাকবে।
গতকাল সকালে এক বিবৃতিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, একটি দলের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে সরকার আরপিওর সর্বশেষ সংশোধনী বাতিল করেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাতিল করা হলে সেটি ন্যক্কারজনক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে।
আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়।ঐকমত্য কমিশন সুপারিশের পর থেকেই উত্তাপ
২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে—সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এই সময়ের মধ্যে সংবিধান সংশোধন না করলে আপনা–আপনি সেটা সংবিধানে যুক্ত হবে। এ ছাড়া গণভোট কবে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন নাকি তার আগে—সেটা ঠিক করবে সরকার।
চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহবিএনপি প্রথমত ক্ষুব্ধ হয় বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে ভিন্নমত বাদ দেওয়ায়। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন, ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া, সেটা না হলে আপনা-আপনি সংবিধানে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে দলটির আপত্তি আছে। দলটি গণভোট আগে নয়, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে চায়। জামায়াতের অবস্থান এর পুরো বিপরীত।
এসব নিয়ে পরস্পরকে লক্ষ্য করে দল দুটির রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।
গতকাল দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা দেখছি যে বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে, ততই বাংলাদেশে একটা অ্যানার্কিক সিচুয়েশন, একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে।’
জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।এর আগের দিন শনিবার বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে যতটা বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেটা আপনারা করেছেন।’
পাল্টা বক্তব্য এসেছে জামায়াতের দিক থেকেও। দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গতকাল বিকেলে ঢাকায় এক সেমিনারে বলেছেন, ‘বিএনপি ভেতরে-ভেতরে আবার ফ্যাসিস্ট হওয়ার একটা খায়েশ আছে মনে হচ্ছে। যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছেন না।’
অবশ্য সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি যতই উসকানি দিক, জামায়াত বিএনপির সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চায় না। মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক আছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দূর করে স্পষ্ট করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। সুতরাং আসুন আমরা সব ভুলে আলোচনায় বসি।’
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এই মুখোমুখি অবস্থা চলতে থাকলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, একটা চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।