সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, হবিগঞ্জের লাখাইয়ে জলমহালের দখল নিয়ে স্থানীয় বিএনপির দুই নেতার লোকজনের মধ্যে রাতের আঁধারে টর্চ জ্বালিয়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে নারী-শিশুসহ অর্ধশতাধিক আহত (সমকাল, ৯ জানুয়ারি ২০২৪)। আপাতদৃষ্টিতে খবরটিকে ‘চাঞ্চল্যকর’ মনে হতে পারে; কিন্তু জলমহাল নিয়ে সংঘর্ষ, খুনোখুনিও বিরল নয়। 

কাগজে-কলমে যদিও ‘প্রকৃত’ জেলেদের জলমহাল ইজারা দেওয়ার কথা রয়েছে; এ জন্য যদিও ‘মৎস্যজীবী সমিতি’ গঠন এবং নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়েছে; বাস্তবে জলমহালের নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কাছেই থাকে। প্রকৃত জেলেরা সেখানে বড়জোর ‘শ্রমিক’ মাত্র। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই মৎস্যজীবী সমিতির নামে ইজারার টাকা পরিশোধ করেন। পরে ওই সব মৎস্যজীবীকে ব্যবহার করে মাছ ধরে বা চাষ করে থাকেন। 

এ ধরনের ‘অনিয়ম’ রোধে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সব আবেদনপত্র অনলাইনে গৃহীত হবে। অথচ এটি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, যদি ‘প্রকৃত মৎস্যজীবীরা’ অনলাইনে আবেদনই করতে পারবেন, তাহলে অফলাইনেও আবেদন করতে অসুবিধা কী? জলমহাল ইজারার বিষয়টি কি এক-দুই দিনের বিষয় যে, ‘চুপিসারে’ অনলাইনে আবেদন করলেই সব কাজ শেষ? যে প্রভাবশালীরা ভয়ভীতি দেখিয়ে ইজারায় কারসাজি করেন, অনলাইন আবেদনে ইজারা পেয়ে অফলাইনে তাদের এড়িয়ে মৎস্যজীবীরা জলমহালে নামতে পারবেন? বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় এটি বিশ্বাসযোগ্য?

ইজারার নামে আসলে কী ঘটে, সেটি ফুটে উঠেছিল বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে– ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় হাওরের বিল-জলমহাল ইজারা নিয়েছে। এখন এসব ইজারা বাতিল করতে হবে। আওয়ামী লীগ যে টাকা দিয়ে ইজারা নিয়েছে, সে টাকা আমরা দিয়ে দেব, প্রয়োজনে আরও ১০ পার্সেন্ট বেশি দেব। তবুও এলাকার সাধারণ মানুষকে জলমহালের মাছ ধরার অধিকার দিতে হবে। আওয়ামী লীগের লোকজন পাটিবাঁধ দিয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ মারে আর গরিব জেলে ও সাধারণ মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে’ (মানবজমিন, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।

ফজলুর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েও যোগ করা যেতে পারে যে, শুধু আওয়ামী লীগ নয়; যখন যে দল ক্ষমতায়, তখন তারাই এসব জলমহাল নিয়ন্ত্রণ করেছে। সাধারণ জেলেরা, তাঁরই ভাষায়, শুধু ‘চেয়ে চেয়ে দেখেছে’। যেমন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর এখন বেশির ভাগ জলমহাল বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীর দখলে চলে গেছে। কোথাও কোথাও এ নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষ বা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিরোধও দেখা দিচ্ছে।

প্রশ্নটা কেবল জলমহালগুলো ‘প্রকৃত’ জেলের ইজারাপ্রাপ্তি নিয়ে নয়; কোন জলাভূমিকে ‘জলমহাল’ ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হচ্ছে, সেটিও। দেখা যাচ্ছে, জেলা প্রশাসন কাঁচা পয়সার লোভে বা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপে প্রবহমান নদীকেও জলমহাল ঘোষণা করে ইজারা দিয়ে থাকে। জলমহাল ব্যবস্থার উপদ্রবে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ যে ঐতিহ্য মেনে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে নিজের হাতে মাছ ধরে খাবে, সেই সুযোগও প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। 

অথচ জলমহাল নীতিমালা ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুযায়ী, দেশে দুই ধরনের জলমহাল রয়েছে; বদ্ধ বা অবক্ষয়িত ও উন্মুক্ত জলমহাল। এর মধ্যে খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুর, বিল, ঝিল, বাঁওড় বদ্ধ জলমহাল এবং নদী ও খাল উন্মুক্ত জলমহাল হিসেবে চিহ্নিত। দেশের ‘প্রকৃত’ জেলেদের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করতে সেই ১৯৯৫ সালেই নদী, খাল ও উন্মুক্ত শ্রেণির সব জলমহালের ইজারা প্রদান প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছিল। এখনও এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে যে, প্রবহমান নদী বা খালকে বদ্ধ বা অবক্ষয়িত জলমহাল ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হয়। 

যেমন, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে প্রবাহিত চকিরপশার নদীকে ‘বিল’ ঘোষণা করে বছরের পর বছর ইজারার নামে দখলদারিত্ব দেওয়া হয়েছে। যারা এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গেছেন, উল্টো প্রভাবশালী দখলদারদের হুমকি-ধমকি, এমনকি শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। জেলা প্রশাসন হয় গোপনে মদদ দিয়েছে, না হয় প্রকাশ্যে ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থান নিয়েছে।  
কথিত জলমহাল ইজারা নিয়ে সরকারিভাবেই কী তুঘলকি কাণ্ডকারখানা চলতে পারে, এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ অবশ্য পাবনা জেলা প্রশাসনের। গত বছর জানুয়ারি মাসে পাবনা জেলা প্রশাসনের জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি ৯টি উপজেলার যে ৬৩টি জলমহাল তিন বছরের ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়, সেগুলোর ৩১টিই প্রবহমান নদীর অংশ। যে ১০টি নদীর অংশবিশেষ ‘জলমহাল’ ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হয়, এর মধ্যে প্রমত্ত পদ্মা ছাড়াও ইছামতী, আত্রাই, চন্দ্রাবতী, বড়াল, চিকনাই, গুমানি, গোহালা, কাগেশ্বরী ও রুকনাই নদী রয়েছে।

ব্যক্তিগত আক্ষেপের বিষয়, বড়াল নদী রক্ষায় ওই অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যে আন্দোলন করে আসছে, তার সঙ্গে আমারও সামান্য সম্পৃক্ততা রয়েছে। ২০১০ সালে নদীটি নিয়ে ‘বড়াল রক্ষা আন্দোলন’ এবং ‘রিভারাইন পিপল’ যৌথভাবে যে গবেষণা করেছিল, সেখানে প্রাঞ্জল ভাষায় বলা হয়েছিল যে, প্রবহমান বড়াল নদীকে জলমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়ার মতো বেআইনি কাজ করা যাবে না।
আমার না হয় সামান্য আক্ষেপ, বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমানের আরও কেমন অনুভূতি হওয়ার কথা? বলতে গেলে পুরোটা জীবন তিনি ব্যয় করেছেন বড়াল রক্ষার আন্দোলনে। এর আগেও মিজান ভাই আন্দোলন করে বড়ালের ইজারা বাতিল করেছেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন যেন নাছোড়বান্দা! কারণ জলমহাল ঘোষণা করে ইজারা দিতে পারলেই ঘোষিত রাজস্ব যেমন তেমন, অঘোষিত পথে লাভেই লাভ!

ওই ১০ নদীর তালিকায় ইছামতী ইজারা দেওয়ার বিষয়য়টি আরও মহাকাব্যিক। ২০২৩ সালের অক্টোবরেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি তথা একনেক ‘পাবনা জেলার ইছামতী নদী পুনরুজ্জীবিতকরণ’ প্রকল্পে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কাজও শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে জেলা প্রশাসন নদীটির এক অংশ ইজারার জন্য ওয়েবসাইটে তোলে!
প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি, সবচেয়ে সহজ ও সংগত সমাধান হচ্ছে, জলমহাল ইজারাপ্রথা বাতিল। জলমহাল ইজারা দিয়ে সরকার যে হস্তী-অশ্ব তুল্য রাজস্ব পায়, এমন নয়। যেমন ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ১৩৪টি জলমহাল ইজারা দিয়ে পাওয়া গেছে মাত্র ১১৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার টাকা। অথচ ওই অর্থবছরে জাতীয় বাজেট ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। 

অপরদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মৎস্যজীবীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৬৪ হাজার ১৫৪ জন; বলা বাহুল্য, সাধারণত খানাপ্রতি একজন ধরে। যে কারণে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে ১ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল।
এটি স্পষ্ট, জাতীয় বাজেটের তুলনায় জলমহাল থেকে পাওয়া রাজস্ব সরকারের কাছে নস্যিও নয়! এই কমবেশি ১০০ কোটি টাকা রাজস্বের জন্য ৭ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটের দেশে ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা জিম্মি করার কী অর্থ থাকতে পারে? দুর্নীতিবাজ আমলা, টাউট রাজনীতিক, বাটপার সমাজপতিদের রমরমা অবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া? অথচ, জলমহাল প্রথা বাতিলের একটি সিদ্ধান্তে কোটি জেলের জীবন বদলে যেতে পারে।

শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.

com
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবস থ বড় ল র র জন য মৎস য ব এনপ সরক র আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ