সব নাগরিক ও সম্পদ বীমার আওতায় আনতে চায় সরকার
Published: 1st, February 2025 GMT
দেশের সব নাগরিক ও সম্পদকে বীমার আওতায় আনতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি প্রস্তাবনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এ বিষয়ে সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। সভায় প্রাথমিক পর্যায়ে সব গার্মেন্ট-কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিক, মেট্রোরেল, ট্রেনসহ সব ধরনের যানবাহন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, শপিংমলসহ ছয় খাতকে বীমার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়। সভার কার্যপত্র সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা সমকালকে বলেন, আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আইডিআরএকে বলা হয়েছে। তাদের প্রস্তাব পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আইডিআরএর প্রতিনিধি সভায় বলেন, দেশের সব নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে স্বাস্থ্যবীমা সুবিধার বিকল্প নেই। বীমার আওতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও বীমায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে যেসব সম্পদ বীমার আওতাবহির্ভূত সেগুলোকে আবশ্যিকভাবে বীমার আওতায় আনা যেতে পারে। এমনকি সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের বিষয়েও বীমার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সভায় অংশ নিয়ে দেশের সব সম্পদ বীমার আওতায় আনার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রতিনিধি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বলেন, দেশের প্রান্তিক খামারিদের গবাদি পশুবীমা ও পোলট্রি বীমার আওতায় আনতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য জনমনে বীমা সম্পর্কে ব্যাপক আস্থা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। এরই অংশ হিসেবে বীমার প্রিমিয়াম সরকারকে পরিশোধ করতে হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বলেন, সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্থাৎ আবাসিক-অনাবাসিক ভবন ফায়ার ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। রাজউকের প্রতিনিধি বলেন, তাদের নথিগুলোকে বীমার আওতায় আনা যেতে পারে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি ভবন বীমার আওতায় আনার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যে কোনো ভবন তৈরির ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ চলাকালীন সময়ের জন্য বীমা করে থাকে। কিন্তু পরে তা আর কার্যকর থাকে না।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রতিনিধি বলেন, উন্নত দেশের মতো সব নাগরিক ও সম্পদের বীমা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সব সম্পদ বীমার আওতায় আনা হলে বীমা খাতের ব্যাপক অগ্রগতি হবে। তিনি সম্প্রতি বন্ধ হওয়া মোটর ইন্স্যুরেন্স চালু করার জন্য মত দেন। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি বলেন, মেট্রোরেল ও ট্রেন বীমা নিশ্চিত করা যেতে পারে। এ ছাড়া গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে গার্মেন্টকর্মীদের বীমার আওতায় আনা যেতে পারে। সভায় উপস্থিত অন্যরাও বীমার আওতা বাড়ানোর উদ্যোগে একমত পোষণ করেন।
সভায় প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়, মেট্রোরেল, ট্রেনসহ সব ধরনের যানবাহন বীমার আওতায় আনা হবে। ফায়ার ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনা হবে দেশের সব বৃহৎ শপিংমল। গবাদিপশু বীমা ও পোলট্রি শিল্পের বীমা চালু হবে। গার্মেন্ট-কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা আসবেন গ্রুপ বীমার আওতায়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক আসবেন স্বাস্থ্যবীমার আওতায় এবং মোটর বীমা পলিসি চালু হবে। এসব বীমা চালু করতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয়। একই সঙ্গে অর্থ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে প্রিমিয়াম প্রদান পদ্ধতি নির্ধারণ করার পাশাপাশি কে কত ভাগ দেবে তা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।