Samakal:
2025-11-02@19:06:45 GMT

মব: জেদের ভাত খায় না ফালায়

Published: 11th, February 2025 GMT

মব: জেদের ভাত খায় না ফালায়

অমর একুশে বইমেলায় প্রতিবছরই বই নিয়ে কোনো না কোনো ঝামেলা হয়। অন্তত গত ১০ বছর এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। সোমবারও একই চিত্র দেখা গেল। তসলিমা নাসরিনের বই রাখা নিয়ে ‘সব্যসাচী’ প্রকাশনীর স্টলে হট্টগোল হলো। ৫ আগস্টের পর মাজারসহ বিভিন্ন স্থানে যে ‘মব’ দেখা যাচ্ছিল, বইমেলাতে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল। 

সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যমতে, সোমবার সন্ধ্যায় ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয়ধারী এক দল লোক স্টলটিতে গিয়ে প্রকাশককে ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ প্রকাশক শতাব্দী ভবকে বইমেলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়। এ সময় তাঁর ওপর কিল-ঘুসি মারার ভিডিও দেখা যায়। পরে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষও ঘিরে রাখে উত্তেজিত ‘তৌহিদি জনতা’। তাদের দাবি, এই প্রকাশক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটাক্ষ করে ইসলামপন্থিদের ‘জঙ্গি’ বলে গালাগাল করেছেন এবং মেলায় এসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সাধারণ জনতার ওপর হামলা করেছেন।
সম্প্রতি এ ধরনের ‘মব’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। মবের পক্ষেই শক্তি বেশি মনে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ক্ষমতাধর অংশেরও কিছু লোক এতে শক্তি জোগাচ্ছে। শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীও মবের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন। ফলে মবের সঙ্গে মাঠের শক্তির পাশাপাশি তাত্ত্বিক শক্তিও যোগ হয়েছে। ফলে আমাদের মতো আমজনতার পক্ষে বোঝা কঠিন হয়ে গেছে, মব আসলে কী জিনিস? এটা কতটা ভালো, কতটা খারাপ?

সম্প্রতি ‘মব’ শব্দটি বাংলায় বেশি পরিচিত হয়ে উঠলেও এটি আদতে ইংরেজি শব্দ, যা এমন এক দল দাঙ্গাবাজ ও বিশৃঙ্খল মানুষকে বোঝায়, যাদের লক্ষ্য সহিংসতা কিংবা ঝামেলা করা। যারা মব করছে, তাদের পক্ষে বলা হচ্ছে– এটা জনগণের ‘ন্যায়সংগত ক্ষোভ’। এমন করার অধিকার তাদের আছে। এর বিরোধিতা যারা করে, তারা ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’। মবের বিরোধিতাকারীদের দমনের হুমকি-ধমকিও দেওয়া হচ্ছে। এর বিপরীতে মবের কঠোর বিরোধিতাও হচ্ছে। তারা বলছেন, মবের এসব হামলা, ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের অকার্যকারিতা প্রমাণ হচ্ছে। অভ্যন্তরীণভাবে রাষ্ট্র দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে। কারণ অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করতে আসবে না। আর বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থানও কম হবে। এমনকি মব সংস্কৃতির দেশের মানুষকে ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রেও উন্নত দেশগুলো দ্বিধাবোধ করবে।

এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন চলে আসে, মানুষ কি ‘ন্যায়সংগত ক্ষোভ’ প্রকাশ করতে পারবে না? জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যে নতুন দেশ গড়তে চেয়েছি; জনগণকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দিতে হবে। ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার থাকতে হবে। কিন্তু মবের মধ্য দিয়ে কি শুধুই ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে? ক্ষোভ প্রকাশের নামে হামলা, স্থাপনা ভাঙচুর, আগুন, এমনকি হত্যা– এসবও কি মেনে নিতে হবে?
ক্ষোভ প্রকাশ কার কাছে বা কোথায় করতে হয়? একটি গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষোভের কথা জানাতে হবে সরকার বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে। তারা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। আবার ১৮ কোটি মানুষের দেশে ক্ষোভ কি শুধু এক পক্ষের? ‘তৌহিদি জনতা’ ছাড়া কি কোনো ন্যায়ের পক্ষ নেই? নিশ্চয় আছে। তাদেরও ক্ষোভ আছে। এই তৌহিদি জনতার ওপর ক্ষুব্ধ অনেক মানুষই তো আছে। আবার নাস্তিকদের ওপর আস্তিকদের ক্ষোভ, আস্তিকদের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের ক্ষোভ কিংবা বিএনপির বিষয়ে জামায়াতের ক্ষোভ, বামপন্থিদের বিরুদ্ধে ডানপন্থিদের ক্ষোভ, কওমিদের বিষয়ে আলিয়ার ক্ষোভ, বোরকাহীনদের নিয়ে বোরকাধারীদের ক্ষোভ, নারীবাদীদের বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রের ক্ষোভ, সেটেলার বাঙালির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ক্ষোভ, সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষোভ– এ রকম হাজারো দ্বন্দ্ব-ক্ষোভের দেখা মিলবে। যে যখন সুযোগ পাবে, মব তৈরি করে ঝাঁপিয়ে পড়বে? তাহলে আর রাষ্ট্র কোথায়?

রাষ্ট্র তো বিবদমান এই পক্ষগুলোর মধ্যেই সমঝোতা বা বোঝাপড়া তৈরি করে দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্র তো এই রিকনসিলিয়েশনই করবে, মিটমাট করে দেবে; পুনর্মিলন ও সমন্বয় সাধন করবে। সে জন্য সব পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়। ছাড় না দিলে সমঝোতা হয় না। আর সমঝোতা যখন হয়, তখন কিছু নিয়ম-নীতিও নির্ধারণ করা হয়। সে সবই হয়ে দাঁড়ায় আইন ও সংবিধান। ফলে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন সরল এই বুঝটুকু মানতে চায় না, মব করে, তখন আসলে তারা নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাই তৈরি করে। সেসব কাজ আইন ও সংবিধানবিরোধী হয়ে যায়। চূড়ান্ত অর্থে তা দেশেরই বিরুদ্ধে যায়।
দেশ স্বাধীনের পর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নব্বইয়ে স্বৈরাচার হটিয়ে গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার পথে যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু আমরা কী দেখতে পেলাম? ’৯২ সালেই জোরেশোরে শুরু হলো নাস্তিকবিরোধী আন্দোলন, মব। ’৯৩ সালে দেশজুড়ে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এর মধ্য দিয়েই তৈরি হলো ধর্মীয় মৌলবাদবিরোধী বয়ান; এলো যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, গণআদালত। এলো জঙ্গি কার্ড। এসবেরই ধারাবাহিকতায় এক দশকের মধ্যেই সামনে চলে আসে আওয়ামী লীগের স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ।

ফলে এখন যখন আবার সেই পুরোনো খেলাগুলো হচ্ছে, তখন মাথায় রাখা দরকার– কে আসলে কার হয়ে খেলছে। এ দেশে নৈরাজ্য হলে, মবতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় কাদের লাভ? দেশের মধ্যে কোন রাজনীতি শক্তিশালী হয়? তা কি জনস্বার্থের সঙ্গে যায়?
তাই মাথা ঠান্ডা রেখে নির্মোহভাবে চিন্তা করতে হবে। সাময়িক উত্তেজনার বশে দেশ ও জনসাধারণের বড় ক্ষতি করে ফেলছি কিনা– তা ভাবতে হবে। জিদের বশে সব ভন্ডুল করে দেওয়াটা অন্যায়। জিদ মেটাতে ভাত না খেয়ে ফেলানো যাবে না।

রফিকুল রঞ্জু: অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক, সমকাল

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

জকসুতে এআই ব্যবহারে থাকবে শিথিলতা, তবে অপব্যবহার করা যাবে না: নির্বাচন কমিশন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহারে শিথিলতা থাকবে। তবে এর অপব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য জুলফিকার মাহমুদ।

রোববার উপাচার্যের সভাকক্ষে রাজনৈতিক ও সক্রিয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত জকসু ও হল সংসদ নির্বাচন-২০২৫-এর আচরণবিধিবিষয়ক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।

ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ফয়সাল মুরাদের এক দাবির জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। এর আগে ফয়সাল মুরাদ বলেন, ‘নির্বাচনী আচরণবিধির ৭–এর ঘ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করা যাবে না। আমরা যারা ছোট সংগঠন, আমাদের তহবিল সীমিত। আমরা নির্বাচনী প্রচারের জন্য এআই ব্যবহার করে দু-এক মিনিটের ভিডিও বানিয়ে প্রচার কার্যক্রম চালাতে চাই। আমাদের দাবি, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যেন শিথিল নীতি গ্রহণ করে।’

মুরাদ আরও বলেন, বিগত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কিছু ত্রুটি লক্ষ করা গেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনকে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত রাখার জন্য যতগুলো ভোটকক্ষ থাকবে, সব কটি সিসিটিভি ফুটেজের আওতায় রাখতে হবে। সবার জন্য সেই সিসিটিভি ফুটেজ উন্মুক্ত রাখতে হবে। ভোট গ্রহণকে স্বচ্ছ রাখার জন্য ভোটকক্ষের ভেতরে জাতীয় গণমাধ্যমকে সরাসরি সম্প্রচার করার অনুমতি দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জকসুর নির্বাচন কমিশনার জুলফিকার মাহমুদ বলেন, ‘এআই ব্যবহার করে বিভিন্নজনের চরিত্র হনন করা হয়, অপপ্রচার চালানো হয়। সেদিক থেকে চিন্তা করে এআই ব্যবহার নিষিদ্ধ রেখেছিলাম। তোমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এআই ব্যবহারে শিথিলতা থাকবে প্রচার–প্রসারে, তবে অপব্যবহার করা যাবে না। আর সরাসরি সম্প্রচারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আলোচনা করে।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা হাসানের সভাপতিত্বে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য রেজাউল করিম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ ও হল শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন ২০২৫–এর নির্বাচন কমিশনার ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ