অমর একুশে বইমেলায় প্রতিবছরই বই নিয়ে কোনো না কোনো ঝামেলা হয়। অন্তত গত ১০ বছর এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। সোমবারও একই চিত্র দেখা গেল। তসলিমা নাসরিনের বই রাখা নিয়ে ‘সব্যসাচী’ প্রকাশনীর স্টলে হট্টগোল হলো। ৫ আগস্টের পর মাজারসহ বিভিন্ন স্থানে যে ‘মব’ দেখা যাচ্ছিল, বইমেলাতে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল।
সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যমতে, সোমবার সন্ধ্যায় ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয়ধারী এক দল লোক স্টলটিতে গিয়ে প্রকাশককে ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ প্রকাশক শতাব্দী ভবকে বইমেলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়। এ সময় তাঁর ওপর কিল-ঘুসি মারার ভিডিও দেখা যায়। পরে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষও ঘিরে রাখে উত্তেজিত ‘তৌহিদি জনতা’। তাদের দাবি, এই প্রকাশক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটাক্ষ করে ইসলামপন্থিদের ‘জঙ্গি’ বলে গালাগাল করেছেন এবং মেলায় এসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সাধারণ জনতার ওপর হামলা করেছেন।
সম্প্রতি এ ধরনের ‘মব’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। মবের পক্ষেই শক্তি বেশি মনে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ক্ষমতাধর অংশেরও কিছু লোক এতে শক্তি জোগাচ্ছে। শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীও মবের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন। ফলে মবের সঙ্গে মাঠের শক্তির পাশাপাশি তাত্ত্বিক শক্তিও যোগ হয়েছে। ফলে আমাদের মতো আমজনতার পক্ষে বোঝা কঠিন হয়ে গেছে, মব আসলে কী জিনিস? এটা কতটা ভালো, কতটা খারাপ?
সম্প্রতি ‘মব’ শব্দটি বাংলায় বেশি পরিচিত হয়ে উঠলেও এটি আদতে ইংরেজি শব্দ, যা এমন এক দল দাঙ্গাবাজ ও বিশৃঙ্খল মানুষকে বোঝায়, যাদের লক্ষ্য সহিংসতা কিংবা ঝামেলা করা। যারা মব করছে, তাদের পক্ষে বলা হচ্ছে– এটা জনগণের ‘ন্যায়সংগত ক্ষোভ’। এমন করার অধিকার তাদের আছে। এর বিরোধিতা যারা করে, তারা ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’। মবের বিরোধিতাকারীদের দমনের হুমকি-ধমকিও দেওয়া হচ্ছে। এর বিপরীতে মবের কঠোর বিরোধিতাও হচ্ছে। তারা বলছেন, মবের এসব হামলা, ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের অকার্যকারিতা প্রমাণ হচ্ছে। অভ্যন্তরীণভাবে রাষ্ট্র দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে। কারণ অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করতে আসবে না। আর বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থানও কম হবে। এমনকি মব সংস্কৃতির দেশের মানুষকে ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রেও উন্নত দেশগুলো দ্বিধাবোধ করবে।
এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন চলে আসে, মানুষ কি ‘ন্যায়সংগত ক্ষোভ’ প্রকাশ করতে পারবে না? জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যে নতুন দেশ গড়তে চেয়েছি; জনগণকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দিতে হবে। ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার থাকতে হবে। কিন্তু মবের মধ্য দিয়ে কি শুধুই ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে? ক্ষোভ প্রকাশের নামে হামলা, স্থাপনা ভাঙচুর, আগুন, এমনকি হত্যা– এসবও কি মেনে নিতে হবে?
ক্ষোভ প্রকাশ কার কাছে বা কোথায় করতে হয়? একটি গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষোভের কথা জানাতে হবে সরকার বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে। তারা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। আবার ১৮ কোটি মানুষের দেশে ক্ষোভ কি শুধু এক পক্ষের? ‘তৌহিদি জনতা’ ছাড়া কি কোনো ন্যায়ের পক্ষ নেই? নিশ্চয় আছে। তাদেরও ক্ষোভ আছে। এই তৌহিদি জনতার ওপর ক্ষুব্ধ অনেক মানুষই তো আছে। আবার নাস্তিকদের ওপর আস্তিকদের ক্ষোভ, আস্তিকদের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের ক্ষোভ কিংবা বিএনপির বিষয়ে জামায়াতের ক্ষোভ, বামপন্থিদের বিরুদ্ধে ডানপন্থিদের ক্ষোভ, কওমিদের বিষয়ে আলিয়ার ক্ষোভ, বোরকাহীনদের নিয়ে বোরকাধারীদের ক্ষোভ, নারীবাদীদের বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রের ক্ষোভ, সেটেলার বাঙালির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ক্ষোভ, সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষোভ– এ রকম হাজারো দ্বন্দ্ব-ক্ষোভের দেখা মিলবে। যে যখন সুযোগ পাবে, মব তৈরি করে ঝাঁপিয়ে পড়বে? তাহলে আর রাষ্ট্র কোথায়?
রাষ্ট্র তো বিবদমান এই পক্ষগুলোর মধ্যেই সমঝোতা বা বোঝাপড়া তৈরি করে দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্র তো এই রিকনসিলিয়েশনই করবে, মিটমাট করে দেবে; পুনর্মিলন ও সমন্বয় সাধন করবে। সে জন্য সব পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়। ছাড় না দিলে সমঝোতা হয় না। আর সমঝোতা যখন হয়, তখন কিছু নিয়ম-নীতিও নির্ধারণ করা হয়। সে সবই হয়ে দাঁড়ায় আইন ও সংবিধান। ফলে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন সরল এই বুঝটুকু মানতে চায় না, মব করে, তখন আসলে তারা নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাই তৈরি করে। সেসব কাজ আইন ও সংবিধানবিরোধী হয়ে যায়। চূড়ান্ত অর্থে তা দেশেরই বিরুদ্ধে যায়।
দেশ স্বাধীনের পর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নব্বইয়ে স্বৈরাচার হটিয়ে গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার পথে যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু আমরা কী দেখতে পেলাম? ’৯২ সালেই জোরেশোরে শুরু হলো নাস্তিকবিরোধী আন্দোলন, মব। ’৯৩ সালে দেশজুড়ে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এর মধ্য দিয়েই তৈরি হলো ধর্মীয় মৌলবাদবিরোধী বয়ান; এলো যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, গণআদালত। এলো জঙ্গি কার্ড। এসবেরই ধারাবাহিকতায় এক দশকের মধ্যেই সামনে চলে আসে আওয়ামী লীগের স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ।
ফলে এখন যখন আবার সেই পুরোনো খেলাগুলো হচ্ছে, তখন মাথায় রাখা দরকার– কে আসলে কার হয়ে খেলছে। এ দেশে নৈরাজ্য হলে, মবতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় কাদের লাভ? দেশের মধ্যে কোন রাজনীতি শক্তিশালী হয়? তা কি জনস্বার্থের সঙ্গে যায়?
তাই মাথা ঠান্ডা রেখে নির্মোহভাবে চিন্তা করতে হবে। সাময়িক উত্তেজনার বশে দেশ ও জনসাধারণের বড় ক্ষতি করে ফেলছি কিনা– তা ভাবতে হবে। জিদের বশে সব ভন্ডুল করে দেওয়াটা অন্যায়। জিদ মেটাতে ভাত না খেয়ে ফেলানো যাবে না।
রফিকুল রঞ্জু: অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক, সমকাল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
৪৪তম বিসিএসের ৪০০ রিপিট ক্যাডার বাদ দিচ্ছে সরকার, নতুন সিদ্ধান্ত আসছে
৪৪তম বিসিএসে পুনরাবৃত্তি হওয়া ৪০০ ক্যাডারকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তারা ৪৩তম বিসিএসে বা আগের বিসিএসে যে ক্যাডারে আছেন ৪৪তম বিসিএসেও একই ক্যাডার পেয়েছিলেন। এই ৪০০ ক্যাডারকে নিয়ে সিদ্ধান্ত দ্রুতই হবে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা।
প্রথম আলোকে ওই কর্মকর্তা আজ বৃহস্পতিবার বলেন, ৪০০ ক্যাডারকে নিয়ে পিএসসির কিছু সুপারিশ আমরা পেয়েছি। এগুলো বাদ দিতে সরকার কাজ করছে। বাদ দিলে কি করা হবে তা নিয়েও কাজ করছে সরকার। এখন পিএসসিকে এ বিষয় নিয়ে একটি মতামত দিতে বলা হয়েছে। পেলেই তা পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে প্রজ্জাপন দেওয়া হবে। এটি যাতে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় সেজন্য আমরা কাজ করছি।
আরও পড়ুন৪৯তম বিসিএস: অনলাইন আবেদন ও ফি জমাদানে পিএসসির নতুন নির্দেশনা৩০ জুলাই ২০২৫৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল ৩০ জুন প্রকাশিত হয়। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৬৯০ জনকে নিয়োগের জন্য সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সাময়িকভাবে মনোনীত করেছে।
প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১ হাজার ৬৯০ জনের মধ্যে প্রায় ৪০০ জন প্রার্থী একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন (রিপিট ক্যাডার)। এই ৪০০ জনের তালিকা পেয়েছে পিএসসি। এই রিপিট ক্যাডার বন্ধে বিধি সংশোধন করা হচ্ছে। এ–সংক্রান্ত চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পিএসসি।
পিএসসি জনপ্রশাসনের চিঠিতে বলছে, এই রিপিট ক্যাডারের ফলে নতুন ও অপেক্ষমাণ মেধাবীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটি প্রশাসনিক কাঠামো ও জনসম্পদের সদ্ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করছে। এখন এটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া বন্ধ করার জন্য বিদ্যমান বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা ২০১৪–এর বিধি-১৭ এর শেষে নিম্নোক্ত শর্ত যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে পিএসসি।
আরও পড়ুনসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের ৩৪০০০ শূন্য পদ পূরণে উদ্যোগ২৯ জুলাই ২০২৫শর্তে কী আছে—পিএসসির চিঠিতে শর্ত হিসেবে বলা আছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে এই বিধির আওতাধীন সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিবার প্রাক্কালে, কিংবা কোনো বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রস্তুতকালে, সংশ্লিষ্ট প্রার্থী কর্তৃক প্রদত্ত লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে কিংবা কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যদি কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয় যে এই বিধির আওতাধীন মনোনয়নযোগ্য কিংবা মনোনীত কোনো প্রার্থী একই ক্যাডার পদ, সমপদ কিংবা প্রার্থীর আগ্রহ নেই এমন কোনো সার্ভিস বা ক্যাডার পদে পুনরায় মনোনীত হইবার কারণে মনোনীত সার্ভিসে বা ক্যাডার পদে যোগদান করিতে অনিচ্ছুক, এইরূপ ক্ষেত্রে কমিশন অনাগ্রহ প্রকাশকারী প্রার্থীকে এই বিধির আওতাধীন সরকারের নিকট সুপারিশ করা হইতে বিরত থাকিতে পারিবে; আরও শর্ত থাকে যে প্রথম শর্তাংশে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী কোনো প্রার্থীকে সুপারিশ করা হইতে বিরত থাকিবার কারণে উদ্ধৃত শূন্য পদে নিয়োগের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রেরণ করিবার জন্য উত্তীর্ণ প্রার্থিগণের মধ্য হইতে মেধাক্রম অনুযায়ী প্রার্থী নির্বাচনপূর্বক কমিশন সম্পূরক ফলাফল প্রকাশ এবং সার্ভিসে বা ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিতে পারিবে;আরও অধিকতর শর্ত থাকে যে দ্বিতীয় শর্তাংশে উল্লিখিত সম্পূরক ফলাফল দ্বারা বা উহার পরিণতিতে প্রথম ঘোষিত ফলাফলে সার্ভিস বা ক্যাডার পদের জন্য মনোনীত কোনো প্রার্থীর প্রতিকূলে কোনো পরিবর্তন ঘটানো কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাইবে না।’
আরও পড়ুনবস্ত্র অধিদপ্তরে বড় নিয়োগ, চাকরির সুযোগ ১৯০ জনের২৯ জুলাই ২০২৫