ভিটে ছেড়ে শত মাইল দূরে ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়েছেন রাজ্জাক-জোহরা
Published: 15th, February 2025 GMT
গামলার মধ্যে ট্যাংরা, বাইল্যা, পুঁটি, কই, শোল, টাকি, চিংড়ি, ডগরিসহ নানা প্রজাতির মাছ। মাছগুলোর গায়ে লেগে আছে কাদাপানি। কিছু মাছ একেবারে জ্যান্ত—তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। কিছু মাছের নড়নচড়ন হয়তো মাত্রই থেমেছে। সদ্য ধরা মাছের গামলা রেখে হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে জাল পরিষ্কার করছেন রাজ্জাক-জোহরা দম্পতি। মাছের কিছুটা বিক্রি করবেন, বাকিটা রাখবেন নিজেদের খাওয়ার জন্য।
রাজ্জাক-জোহরা বেড়িজাল দিয়ে যে জায়গায় মাছ ধরছিলেন, সেটা একসময়ের খরস্রোতা ‘মরা পশুর নদ’। নাম শুনেই নদের এখনকার অবস্থা বোঝা যাচ্ছে। খুলনার বটিয়াঘাটা ও বাগেরহাটের রামপাল-ফকিরহাটের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এই নদে এখনো ক্ষীণ স্রোত আছে।
জাল ধুয়ে পরিষ্কারের পর মাছের গামলা নিয়ে পাড়ে উঠলেন রাজ্জাক-জোহরা। রাস্তায় উঠেই জোহরা মাছের গামলা নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন। জালে কোথাও ময়লা থেকে গেছে কি না, তা দেখছিলেন রাজ্জাক। ১২ ফ্রেব্রুয়ারি সেখানেই কথা হলো রাজ্জাকের সঙ্গে।
রাজ্জাকরা এখন থাকছেন বটিয়াঘাটার আমিরপুর গ্রামে। একসময়ের মূল পেশা মাছ শিকার হলেও এখন বছরের বেশির ভাগ সময়ই দিনমজুরি করতে হয়। রাজ্জাকের আদি নিবাস যেখানে, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ বেড়ে ওঠেন জাল, নৌকা আর মাছ সঙ্গী করে।
রাজ্জাকদের আদি বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সাগর ও সুন্দরবনঘেঁষা জনপদ গাবুরা ইউনিয়নের পাশ্বেমারী গ্রামে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জনপদগুলোর অন্যতম দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। রাজ্জাক গাজী একজন জলবায়ু উদ্বাস্তু। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা তাঁকে ভিটে ছাড়তে বাধ্য করেছে। নিজের জন্মভিটা থেকে সবচেয়ে কম পথে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরের আমিরপুরে এসে ঠাঁই নিতে হয়েছে তাঁর পরিবারকে।
আবদুর রাজ্জাক গাজী বলছিলেন, ‘ওই যে আইলা হুয়োলো। বাড়ির তে রশিখানিক দূরি নাপিতখালী বাঁধ ভাঙে গেল। কপোতাক্ষের স্রোতে জিনিসপত্তর, গরু সব ভাইসে যাতি লাগল। মুহূর্তের মধ্যি ঘরের ওপরে পানি উঠে গেল। ওই সময় বাচাকাছা নে, ভাইসেপুড়ে বারইলাম, এরপর নৌকায় পাঁচ-ছয় দিন। এর কয় দিন পর ভিটেকাটা সব ফেলিয়ে থুয়ে খুলনা চুলে আইলাম।’
খুলনা শহরে এসে নগরের শ্রমিক–অধ্যুষিত এলাকা লবণচরা বান্দাবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া করেন আবদুর রাজ্জাক। এরপর চিরচেনা পেশা বদলে হয়ে ওঠেন রিকশাভ্যানের চালক। তারপর জ্বালানি কাঠের গোলায় কাজ নেন। পরে আবার কাজ নেন সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। এভাবেই কেটে যায় ছয় থেকে সাত বছর। তবে অনিশ্চয়তা আর একের একের পর এক পেশা বদলের ধকলে শহরে থাকার ছেদ টানতে হয় রাজ্জাককে। এর মধ্যে অবশ্য রাজ্জাকের মতো তাঁর ভাইসহ অনেকেই টিকেতে না পেরে গাবুরা ছেড়ে শহরে এসে পড়েন কাজের খোঁজে। এলাকার কয়েকজন মিলে চেষ্টা করতে থাকেন নতুন কোনো জায়গায় নতুন করে বসতি গড়ার।
আবদুর রাজ্জাক বলতে থাকেন, বাসা ভাড়া দিয়ে আর পারতেন না। একা খেটে আর সংসার চালাতে পারতেন না। আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর বাঁধার জন্য সরকার ২০ হাজার করে টাকা দিয়েছিল, ওই টাকা দিয়ে তাঁরা দুই ভাই আমিরপুরের চরে কাঠা পাঁচেক জায়গা নেন। তাঁদের মতো অনেকেই এখন এখানে থাকছেন। প্রায় সবাই টিনের ঘর করেছেন।
রাজ্জাক গাজীরা পাঁচ ভাই। রাজ্জাক গাজী, কালাম গাজী ও ইসরাফিল গাজী এখন আমিরপুরে থাকছেন। এক ভাই জলিল গাজী চলে গেছেন যশোরের বেনাপোল। অন্য ভাই খলিল গাজী শুধু টিকে আছেন গাবুরার পৈতৃক ভিটায়।
রাজ্জাকের হিসাবে খুলনার কয়রা, দক্ষিণ বেদকাশী, শ্যামনগরের গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ এলাকা থেকে দুই শতাধিক জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার এসে এখন আমিরপুর এবং পাশের এলাকায় বসবাস করছে। তাঁর ভাষ্য, গাবুরায় আগে গায়ে গায়ে বসতি ছিল। এখন বসতি হালকা হয়েছে। এখন যাঁরা গাবুরাতে আছেন, তাঁরাও খুলনা শহরে এসে কাজ করছেন। তাঁরা একসঙ্গেই কাজ করেন।
খুলনা শহরের বাসা ছাড়লেও আবদুর রাজ্জাককে কাজের খোঁজে এখনো প্রতিনিয়ত খুলনা শহরেই যেতে হয়। শহরে গিয়ে করেন দিনমজুরের কাজ। আমিরপুর এলাকাতেও মাঝেমধ্যে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। যেদিন কাজে যান না, সেদিন নদী–খালে মাছ ধরেন। আর বর্ষাকালে মাছ ধরাটাই প্রধান পেশা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আবদ র র জ জ ক
এছাড়াও পড়ুন:
ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন
কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ।
এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।
একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।
দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।
পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।
ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।
এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।
বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।
এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”
যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।
বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”
তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।
প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।
এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।
ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”
শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
ঢাকা/এস