মেলায় বই বিক্রি নিয়ে অসন্তুষ্টি
Published: 19th, February 2025 GMT
বইমেলায় লোকজন যতই আসুন না কেন, এবার বিক্রি নিয়ে প্রকাশকদের মন ভরছে না। গতকাল ১৮ দিন পেরিয়ে গেল, কিন্তু যে ধারায় বিক্রি হচ্ছে তাতে অবশিষ্ট দিনগুলোতেও যে খুব বড় পরিবর্তন হবে, এমন লক্ষণ দেখছেন না তাঁরা।
মেলার বিক্রি সম্পর্কে গতকাল মঙ্গলবার সাহিত্য প্রকাশের স্টলে ব্যবস্থাপক রথীন দাস বলেন, ‘আমি ১৯৭৩ সাল থেকে মেলা করছি। করোনার সময়টা বাদ দিলে বেচাকেনায় এমন নিম্নগামী অবস্থা আর দেখিনি।’ এবার তাঁদের প্রকাশনী থেকে রফিউর রাব্বির প্রবন্ধ বৃত্তের বাইরে এবং নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য, মফিদুল হক সম্পাদিত রশীদ করীম অমনিবাসসহ বেশ কিছু নতুন বই এসেছে।
অনুপম প্রকাশনীর প্রকাশক মিলন নাথও বললেন অসন্তুষ্টির কথা। বেচাকেনা তো কমই, তার ওপর প্রচুর হকার ঘুরছে মেলার মাঠে। সামনের ফুটপাতে পাইরেসি বই বিক্রি হচ্ছে। ভেতরে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্ল্যাকার্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন স্টল-প্যাভিলিয়নের সামনে। ইচ্ছামাফিক গড়ে তোলা হয়েছে বড় বড় বাণিজ্যিক স্থাপনা। এতে বইমেলা তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। এসব দেখভাল করার মতো মেলার কোনো অভিভাবক আছে বলে তাঁর মনে হচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী পেশাগত কাজে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে লম্বা সময় অবস্থান করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর বই আফ্রিকার দিনরাত্রি প্রকাশ করেছে প্রসিদ্ধ পাবলিশার্স। কথা হলো তাঁদের স্টলের ব্যবস্থাপক দ্বীপ মল্লিকের সঙ্গে। বিক্রি সম্পর্কে তাঁর এককথার উত্তর, ‘খুবই কম।’ গতকাল মেলায় লোকজনের উপস্থিতিও ছিল স্বল্প। বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানের স্টল-প্যাভিলিয়ন ছাড়া অধিকাংশ স্টলেই বেচাকেনা তেমন হয়নি। অনেক স্টলের সামনে লোকজনই দেখা যায়নি।
তথ্যকেন্দ্রের হিসাবে গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ৭৯টি। প্রথমা প্রকাশন থেকে এসেছে আনিসুল হকের কিশোর উপন্যাস নিশি ট্রেনের ভূত, কথাপ্রকাশ এনেছে সরদার ফজলুল করিমের দিনলিপি অতিক্রান্ত সময়, আত্মপ্রকাশ এনেছে আলোকচিত্রী শহীদুল আলম বাদলের আলোকচিত্রের অ্যালবাম মৌন মুখর বাদল দিন, বিশ্বসাহিত্য ভবন এনেছে হাসান হাফিজের কবিতা জয়গাথা জুলাই বিপ্লব, মিজান পাবলিশার্স এনেছে ফারুক নাওয়াজের কিশোর উপন্যাস আঙ্কল হার্বাটের পোষা ভূত, অ্যাডর্ন এনেছে হরিপদ দত্তের উপন্যাস চুয়াত্তরের অলৌকিক শিশু, তাম্রলিপি এনেছে অধ্যাপক ডা.
প্রথমা প্রকাশনের স্টলে গতকাল আগে প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে আকবর আলি খানের দারিদ্র্যের অর্থনীতি: অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ, আনিসুল হকের উপন্যাস কখনো আমার মাকে, আবুল মনসুর আহমদের গল্প আয়না, আলতাফ পারভেজের যোগেন মণ্ডলের বহুজনবাদ ও দেশভাগ, শাহীন আখতারের উপন্যাস অসুখী দিন, মো. তৌহিদ হোসেনের বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর বইগুলোর বিক্রি ভালো ছিল।
শত্রুভূমি থেকে সম্মুখসমরেমুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সামরিক বাহিনীর অনেক বাঙালি সদস্যের মতো ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারীও আটকে পড়েন পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু দৃঢ়সংকল্প করেন, যেভাবেই হোক শত্রুভূমি থেকে পালাবেন, যোগ দেবেন মুক্তিযুদ্ধে। নানা পরিকল্পনার পর এক ঝড়বৃষ্টির রাতে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে পাড়ি দেন কাশ্মীর সীমান্ত। এরপর সম্মুখযুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করে ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ‘বীর প্রতীক’ খেতাব। যুদ্ধের দিনগুলোর শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনি উঠে এসেছে বজলুল গনি পাটোয়ারীর (অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল) শত্রুভূমি থেকে সম্মুখসমরে নামের বইটিতে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পবিত্র কোরআনে ‘রুকু’ কীভাবে এল
আমরা কোরআন তিলাওয়াত করার সময় প্রতিটি সুরার শুরুতেই আয়াত সংখ্যার সঙ্গে ‘রুকু’ সংখ্যাও লেখা দেখি। পৃষ্ঠার মাঝেও রুকু লেখা থাকে। এই রুকু মানে কী? কী কাজ এই রুকুর?
এই প্রবন্ধে রুকুর ধারণা, কোরআন তিলাওয়াতের সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং কোরআনে রুকুর সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
রুকু কীরুকু আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘নমন’ বা ‘বাঁকানো’। নামাজে রুকু বলতে কোমর ঝুঁকিয়ে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অঙ্গভঙ্গিকে বোঝায়।
তবে কোরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে রুকু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকলনকে বোঝায়, যা তিলাওয়াতকে সংগঠিত ও সহজতর করে। এটি বিশেষ করে হাফেজদের (যাঁরা কোরআন মুখস্থ করেন) জন্য সুবিধাজনক।
ইমাম সারাখসি (মৃ. ৪৮৩ হি.) রুকুকে রাকাতের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বলেছেন, এক রাকাতে তিলাওয়াতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকেত হিসেবে রুকু ব্যবহৃত হতো।কোরআন তিলাওয়াতে রুকুর ভূমিকারুকু নির্ধারণের উদ্দেশ্য ছিল তিলাওয়াতের সময় আয়াতের বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং বিরতি নেওয়ার সুবিধা প্রদান। ইসলামের প্রাথমিক যুগে, বিশেষ করে হাফেজরা তিলাওয়াতের পর নির্দিষ্ট আয়াতে এসে রুকুতে যেতেন, যা এই প্রথার উৎপত্তির ইঙ্গিত দেয়।
ঐতিহাসিকভাবে রুকু নির্ধারণের প্রথা মা-ওয়ারাউন্নাহার (বুখারা, সমরখন্দ) অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এটি তারাবিহ নামাজের সময় কোরআন তিলাওয়াতকে সংগঠিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
ইমাম সারাখসি (মৃ. ৪৮৩ হি.) রুকুকে রাকাতের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বলেছেন, এক রাকাতে তিলাওয়াতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকেত হিসেবে রুকু ব্যবহৃত হতো। অন্য একটি মত অনুসারে, হাফেজরা নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াতের পর রুকুতে যাওয়ার কারণে এই নামকরণ হয়েছে। (আল-সারাখসি, আল-মাবসুত, বৈরুত: দার আল-মা’রিফা)
আরও পড়ুনধীরে ধীরে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণ৩০ মে ২০২৫কোরআনে রুকুর সংখ্যাকোরআনে রুকুর সংখ্যা বিভিন্ন অঞ্চলে ও ঐতিহ্য অনুসারে ভিন্নতা দেখায়। প্রধানত তিনটি ধারা প্রচলিত: ৫৫৮, ৫৪০ ও ৪৮০।
৫৫৮ রুকু: বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মুসহাফে সাধারণত ৫৫৮টি রুকু ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি সুরায় রুকুর সংখ্যা উল্লেখ থাকে এবং আরবি অক্ষর ‘আইন’ দিয়ে রুকু চিহ্নিত করা হয়। এই চিহ্নে তিনটি সংখ্যা থাকে:
১. ওপরের সংখ্যা: সুরার মধ্যে রুকুর ক্রম।
২. মাঝের সংখ্যা: রুকুর আয়াতসংখ্যা।
৩. নিচের সংখ্যা: পারার (জুজ) মধ্যে রুকুর ক্রম।
এই পদ্ধতি তিলাওয়াতকে সুসংগঠিত করে এবং হাফেজদের জন্য সুবিধাজনক। (সিদ্দিকি, এ, ২০১৭, কোরআনিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস অ্যান্ড দেয়ার ডিভিশনস, জার্নাল অব ইসলামিক স্টাডিজ, ২৮(২), (১৪৫-১৬৭)
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মুসহাফে সাধারণত ৫৫৮টি রুকু ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি সুরায় রুকুর সংখ্যা উল্লেখ থাকে এবং আরবি অক্ষর ‘আইন’ দিয়ে রুকু চিহ্নিত করা হয়।৫৪০ রুকু: বুখারায় প্রথম রুকু নির্ধারণের সময় এর সংখ্যা ছিল ৫৪০। বুখারার মাশায়েখরা রমজানে তারাবিহ নামাজে প্রতি রাকাতে ১০টি আয়াত তিলাওয়াতের প্রথা অনুসরণ করতেন। এভাবে ৩০ দিনে কোরআনের প্রায় ৬ হাজার আয়াত তিলাওয়াত হতো। তবে দশ আয়াতের ভিত্তিতে তিলাওয়াত করলে বিষয়বস্তুর মাঝখানে বিরতি পড়ত, তাই তারা বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রুকু নির্ধারণ করেন। (রহিম বখশ, আল-খাত্ত আল-উসমানি ফি রাসমিল কোরআন, লাহোর: মাকতাবা কুদ্দুসিয়া, ১৯৮২)
৪৮০ রুকু: সিন্ধুর হাশিম থাট্টুভি কোরআনের রুকুসংখ্যা ৪৮০ নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি সুরাভিত্তিক নয়, বরং পারাভিত্তিক রুকু নির্ধারণ করেন। প্রতি পারায় ১৬টি রুকু ধরে ৩০ পারায় মোট ৪৮০ রুকু হয়।
তিনি ‘রুকু’ শব্দের পরিবর্তে ‘মাকরা’ বা ‘মাকারি’ শব্দ প্রস্তাব করেন, যা ‘কিরআত’ (পাঠ্যাংশ) থেকে উদ্ভূত। (আজমি, এম এম, ২০০৩, দ্য হিস্ট্রি অব দ্য কোরআনিক টেক্সট: ফ্রম রেভল্যুশন টু কম্পাইলেশন, যুক্তরাজ্য: আল-কোরআন সোসাইটি)
আরও পড়ুনসহজে কোরআন বোঝার পাঁচটি কৌশল০৩ মে ২০২৫রুকুর প্রচলনহিজাজ, আন্দালুসিয়া, মিসর, আফ্রিকা ও সিরিয়ায় রুকুর প্রচলন তেমন ছিল না। রুকুর প্রচলন মূলত মা-ওয়ারাউন্নাহার (বুখারা, সমরখন্দ), ভারতবর্ষ ও তুরস্কে ব্যাপক ছিল। ওসমানি খেলাফতের পর তুরস্কে এটা বিলুপ্ত হয়ে, তবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এখনো রুকুর প্রচলন আছে।
বুখারার মাশায়েখরা রমজানে তারাবিহ নামাজে প্রতি রাকাতে ১০টি আয়াত তিলাওয়াতের প্রথা অনুসরণ করতেন। তবে এভাবে তিলাওয়াত করলে বিষয়বস্তুর মাঝখানে বিরতি পড়ত, তাই তারা বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রুকু নির্ধারণ করেন।ইমাম দানি (মৃ. ৪৪৪ হি.) তাঁর গ্রন্থ আল-বায়ান ফি আদ্দি আয়িল কোরআন-এ কোরআনের বিভিন্ন ভাগ নিয়ে আলোচনা করলেও রুকু নিয়ে বিস্তারিত বলেননি। তবে ইমাম সারাখসি এবং রহিম বখশ তাঁদের লেখায় রুকুর ঐতিহাসিক বিবরণ দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে সাহাবিরা ১০টি আয়াত করে মুখস্থ করতেন এবং এর ব্যাখ্যা বুঝে পরবর্তী আয়াত শিখতেন, যা রুকু নির্ধারণের প্রাথমিক ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। (আল-দানি, আল-বায়ান ফি আদ্দি আয়িল কুরআন, কায়রো: দার আল-মা’আরিফ)
সারকথা, রুকু কোরআন তিলাওয়াতকে সহজ ও সংগঠিত করে, বিশেষ করে হাফেজদের জন্য। এটি ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে প্রচলিত একটি পদ্ধতি, যা বুখারা, সমরখন্দ ও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। ৫৫৮, ৫৪০ ও ৪৮০ রুকুর ধারা বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হলেও বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ৫৫৮ রুকুই বেশি ব্যবহৃত হয়।
লেখক: খণ্ডকালীন শিক্ষক, আরবি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুনযে ঘটনায় কোরআনে পূর্ণ দুটি রুকু নাজিল হয়১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪