রাজধানীর উত্তরায় দুই নারী-পুরুষকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর ঘটনায় আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলো– সজীব ও মেহেদী হাসান সাইফ। মঙ্গলবার রাত ও বুধবার ভোরে গাজীপুরে এ অভিযান চালানো হয়। এ নিয়ে ওই হামলায় জড়িত পাঁচজনকেই গ্রেপ্তার করা হলো। অভিযানে কোপানোয় ব্যবহৃত দুটি রামদা উদ্ধার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে বুধবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার রওনক জাহান বলেন, উত্তরা পশ্চিম থানার একটি দল মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় আব্দুল্লাহপুর পশ্চিম পাড়া থেকে আলফাজ মিয়া ওরফে শিশিরকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার সময় তার পরনে থাকা হালকা জলপাই রংয়ের ফুলহাতা শার্ট জব্দ করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী থেকে সজিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তার তথ্য অনুযায়ী মেহেদী হাসান সাঈফকে গাজীপুরের টঙ্গীর মাজার বস্তি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে একটি মোটরসাইকেল ও ঘটনার সময় তার পরনে থাকা শার্ট জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার আলফাজ ও সাইফ দুই নারী–পুরুষকে কুপিয়েছিলেন। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে সকাল ১০টার দিকে তুরাগ নদীর পাড় থেকে ঘটনায় ব্যবহৃত দুটি রামদা উদ্ধার করা হয়।

এর আগে সোমবার রাতে মোবারক হোসেন ও রবি রায় নামে দুজনকে ঘটনাস্থলেই আটক করে জনতা। পরে তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা হয়। মঙ্গলবার তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। গতকাল বাকি তিনজনকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

এজাহারের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সোমবার রাত আনুমানিক ৯টার দিকে উত্তরার আমির কমপ্লেক্স থেকে কেনাকাটা সেরে বাসায় ফিরছিলেন মেহেবুল হাসান ও নাসরীন আক্তার ইপ্তি। পথে উত্তরা–৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাসার সামনে পৌঁছলে ঘটনার সূত্রপাত হয়। তখন তিনজন দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে বিকট শব্দ করে এলোমেলোভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেল সামনের রিকশাকে ধাক্কা দেয়। রিকশায় মা–বাবার সঙ্গে ছিল চার বছরের এক শিশু। আরোহীদের সঙ্গে মোটরসাইকেল চালকের বাকবিতন্ডা হয়। পেছনে থাকা মেহেবুল ও ইপ্তি মোটরসাইকেল চালককে ‘ঝামেলা’ করতে নিষেধ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসীরা তাদের মারধর শুরু করে। তারা বলতে থাকে, ‘আমাদের চিনিস? আমরা কে?’ একপর্যায়ে ভুক্তভোগী দুজন আশপাশের লোকজনের সহযোগিতায় আক্রমণকারীকে ধরে ফেলেন। তখন তিনি কল করে আরও কয়েক সহযোগীকে ডেকে নিয়ে আসেন। আনুমানিক ১০ মিনিট পর ৪–৫ জন রামদাসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নারী–পুরুষকে কোপাতে শুরু করে। মোবাইল ফোনে ধারণ করা এই ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। 

এদিকে শম্পা বেগম নামে এক নারী গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, ‘ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মেহেবুল হাসান ও নাসরীন আক্তার ইপ্তি স্বামী–স্ত্রী নন। তিনিই (শম্পা) মেহেবুলের প্রকৃত স্ত্রী। ২০১৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। তাদের ৫ ও ৪ বছর বয়সী দুটি সন্তানও রয়েছে। ইপ্তির সঙ্গে মেহেবুলের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক রয়েছে।’ তবে তাদের বিয়ে হয়েছে কিনা সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। 

এ ব্যাপারে মেহেবুল ও ইপ্তির বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। অবশ্য পুলিশ সংবাদ সম্মেলনে তাদের দম্পতি হিসেবেই উল্লেখ করেছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর

এছাড়াও পড়ুন:

অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক

নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।

ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’

সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।

প্রতিবাদ, বিক্ষোভ

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।

‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।

পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।

দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।

সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।

সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।

কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ