‘জাকাত’ একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ: পবিত্রতা, প্রবৃদ্ধি, পরিশুদ্ধ ও প্রশংসা। পারিভাষিক অর্থে, নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ কোনো ব্যক্তির মালিকানায় থাকলে নির্দিষ্ট সময় পর ওই সম্পদের একটি অংশ শরিয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত খাতে বিতরণ ও বণ্টন করাকে ‘জাকাত’ বলে। পবিত্র রমজান নিকটবর্তী হলে বাংলাদেশে একটি ভিন্ন আবহ তৈরি হয়। ইসলাম প্রতিপালনে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। মসজিদগুলোতে যেমন নামাজির সংখ্যা বাড়ে, তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন পরিবেশ তৈরি হয়। রমজানে অর্থনীতিতে জাকাতের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও জাকাতের লেনদেন বছরের যে কোনো সময়ে করা যায়, তবুও অঘোষিতভাবে রমজানে দাতা ও গ্রহীতা জাকাত অনুশীলন বেশি করে থাকেন। ইসলামের জাকাত ব্যবস্থায় দারিদ্র্য দূরীকরণের সর্বোত্তম ব্যবস্থা রয়েছে, যা ইতিহাসে একটি সুফলদায়ক নীতি বলে প্রমাণিত। বাংলাদেশের অধিবাসীদের ৯০ শতাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও এখানে জাকাত আদায় ও বিতরণ সঠিকভাবে হচ্ছে না। ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে জাকাত প্রদান করলেও দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের কোনো ভূমিকা রয়েছে বলে প্রতিভাত হচ্ছে না।
জাকাতের তাৎপর্য সবার কাছে তুলে ধরা এবং জাকাত তহবিল সংগ্রহ করে তা বঞ্চিত মানুষের প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিতরণ ব্যবস্থাপনার কাজ করছে সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট-সিজেডএম।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের জাকাত তহবিল দক্ষ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ব্যবহার করে উপযুক্ত ব্যক্তি ও পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের সার্বিক কল্যাণে কাজ করার জন্য সিজেডএমকে দায়িত্ব দিয়েছে। এ সংস্থা তাদের প্রদত্ত তহবিল ব্যবহার করে বিভিন্ন দরিদ্রবান্ধব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সিজেডএম ২০০৮ সাল থেকে বিগত ১৬ বছরে ১৭ লাখের অধিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদান করতে পেরেছে। জাকাত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সিজেডএম শরিয়াহ ও আধুনিক ব্যবস্থাপনার ধ্যান-ধারণাকে সমন্বিত করে নতুন কৌশল অনুসরণ করছে। জাকাত প্রাপকদের বাছাই করার জন্য ভিত্তিজরিপ পরিচালনা, গ্রুপভিত্তিক ঘূর্ণায়মান তহবিল গঠন, তত্ত্বাবধান ও মনিটরিং, কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান, যৌথ ব্যবসা, উদ্যোক্তা তৈরি, ঋণমুক্ত করা, মানব সম্পদের উন্নয়ন, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, জাকাত বণ্টনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, জাতীয় নীতির সঙ্গে সমন্বয়করণ ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সিজেডএম প্রতিবছর জাকাত ফেয়ারের আয়োজন করে। বিগত বছরগুলোতে বহু দর্শক-শ্রোতার অংশগ্রহণ এবং তাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা সিজেডএমকে এ আয়োজনে অনুপ্রাণিত করেছে। আগামী ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ শনি ও রোববার ঢাকার গুলশান-তেজগাঁও লিঙ্ক রোডে অবস্থিত আলোকি কনভেনশন সেন্টারে এ জাকাত ফেয়ার অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর বিগত পাঁচ দশকে এ দেশ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করলেও লাখ লাখ বঞ্চিত মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর দেশের জনগণের মধ্যে একটি বৈষম্যহীন, দারিদ্র্যমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন তৈরি হয়েছে, তা রূপায়ণে জাকাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সে জন্য জাকাত ফেয়ারের এবারে প্রতিপাদ্য: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাকাত। নতুন বাংলাদেশ সেই স্বপ্নের দেশ, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য নেই এবং প্রতিটি মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত। এ পরিবর্তনের অন্যতম চাবিকাঠি হতে পারে জাকাত। এখন দরকার দারিদ্র্য ও বৈষম্য নির্মূলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
বাংলাদেশে বর্তমানে এক লাখ কোটি টাকার জাকাত আদায়ের সুপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এই টাকা বাংলাদেশের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের প্রায় ১২.
গৃহহীনদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা যেত, যাতে প্রত্যেকের মাথার ওপর ছাদ থাকবে। মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা যাবে, যাতে চিকিৎসার অভাবে কেউ কষ্ট পাবে না।
ওয়েছ খান নূর সোহেল: সহকারী মহাব্যবস্থাপক, সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেডএম)
[email protected]
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক
নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।
ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’
সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।
প্রতিবাদ, বিক্ষোভসেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।
‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।
দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।
সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।
কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।